পদ্মজা নাইডু হিমালয়ান জুলজিক্যাল পার্ক – প্রকৃতি, পাহাড় ও বন্যপ্রাণীর এক মেলবন্ধন।

হিমালয়ের কোলে অবস্থিত দার্জিলিং-এর বুকের মধ্যে যেন এক স্বপ্নময় স্থান — পদ্মজা নাইডু হিমালয়ান জুলজিক্যাল পার্ক। এটি ভারতের অন্যতম উঁচুতে অবস্থিত একটি চিড়িয়াখানা, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৭,০০০ ফুট ওপরে। এই পার্ক শুধু প্রাণীদের প্রদর্শনের স্থান নয়, এটি হিমালয়ের বিরল প্রজাতির প্রাণীদের সংরক্ষণের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। প্রকৃতি, পাহাড়, সবুজের গালিচা আর নীরব সৌন্দর্যের সঙ্গে বন্যপ্রাণীর মিলনে তৈরি এই স্থানটি সত্যিই অনন্য।


প্রবেশ ও প্রথম দর্শন

দার্জিলিং শহর থেকে প্রায় ৩ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই পার্কে পৌঁছানোর পথটিও এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তায় গাড়ি চলতে চলতে যখন পার্কের প্রবেশদ্বারে পৌঁছানো যায়, তখন ঠান্ডা হাওয়া মুখে এসে লাগে আর দূরে দেখা যায় হিমালয়ের ধূসর আভা। পার্কে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে যে নিরবতা ও শীতল পরিবেশ মেলে, তা যেন অন্য এক জগতে নিয়ে যায়।


বন্যপ্রাণীর আশ্চর্য ভুবন

এই জুলজিক্যাল পার্কটি ১৯৫৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, দার্জিলিং-এর প্রাক্তন গভর্নর পদ্মজা নাইডু-র নামাঙ্কিত করে। এখানে পাহাড়ি পরিবেশে টিকে থাকা নানা বিরল প্রজাতির প্রাণী দেখা যায়, যেমন —

  • স্নো লেপার্ড (Snow Leopard) – ধূসর পশমে ঢাকা রাজসিক এই বিড়ালজাত প্রাণীটিকে এখানে বেশ কয়েকটি প্রজাতিতে দেখা যায়।
  • রেড পাণ্ডা (Red Panda) – হিমালয়ের প্রতীক এই মিষ্টি প্রাণীটি এখানে পর্যাপ্ত যত্নে সংরক্ষিত।
  • হিমালয়ান ব্ল্যাক বেয়ার, তিব্বতি নেকড়ে, সেরাও, হিমালয়ান মনাল (Nepal’s national bird) – সবই এই পার্কের গর্ব।

এখানে প্রাণীদের খাঁচায় বন্দি করে নয়, বরং প্রাকৃতিক পরিবেশে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে যাতে তারা নিজেদের স্বাভাবিক আবাসের অনুভূতি পায়।


প্রকৃতি ও পরিবেশ সংরক্ষণ

এই পার্ক শুধুমাত্র দর্শনীয় স্থান নয়; এটি একটি বন্যপ্রাণী প্রজনন ও সংরক্ষণ কেন্দ্রও বটে। বিশেষ করে স্নো লেপার্ড ও রেড পাণ্ডা প্রজননে এটি ভারতের মধ্যে অন্যতম সফল প্রতিষ্ঠান। হিমালয়ের বাস্তুতন্ত্র রক্ষা এবং বিপন্ন প্রাণীদের পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে এই পার্কের ভূমিকা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত।


পর্যটকদের আকর্ষণ

পদ্মজা নাইডু পার্ক শুধু প্রাণীদের জন্য নয়, প্রকৃতি ও আলোকচিত্রপ্রেমীদেরও এক স্বপ্নরাজ্য। পাহাড়ি ঢালে সাজানো পথ, অর্কিড ও রডোডেনড্রনের ফুল, আর কুয়াশায় ঢাকা পাহাড়ের দৃশ্য যেন এক অপরূপ পটভূমি তৈরি করে। পাশেই রয়েছে বিখ্যাত হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউট (HMI) — যেখানে এভারেস্ট বিজেতা তেনজিং নোরগের স্মৃতি সংরক্ষিত।


অল্প বিশ্রাম ও স্মৃতিচারণ

ঘুরে ক্লান্ত হলে কাছের চায়ের দোকানে এক কাপ দার্জিলিং চা হাতে নিয়ে পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে বসে থাকা যায়। পাখির ডাক, দূরের মেঘ, আর শীতল হাওয়ায় চা চুমুক — এ এক অন্যরকম শান্তি। মনে হয়, সময় যেন থেমে গেছে।


শেষ কথা

পদ্মজা নাইডু হিমালয়ান জুলজিক্যাল পার্ক শুধুমাত্র একটি চিড়িয়াখানা নয়, এটি প্রকৃতি, বন্যপ্রাণী ও মানুষের সহাবস্থানের এক অনন্য উদাহরণ। দার্জিলিং ভ্রমণ অসম্পূর্ণ থেকে যায় যদি এই পার্কে না আসা হয়।
যে কেউ একবার এ স্থানে এলে বুঝবেন— প্রকৃতির কোলে বন্যপ্রাণীর সুরক্ষা মানেই মানব সভ্যতার অস্তিত্ব রক্ষার এক গভীর প্রতিশ্রুতি।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *