
কলকাতা শহর শুধুমাত্র সাহিত্য, সংস্কৃতি ও শিল্পকলার শহর নয়, বরং এটি ভারতের ইতিহাসের এক জীবন্ত ভাণ্ডার। এই শহরের প্রাণকেন্দ্রে দাঁড়িয়ে আছে এক অনন্য প্রতিষ্ঠান — ইন্ডিয়ান মিউজিয়াম, যা শুধু ভারতের নয়, সমগ্র এশিয়ার প্রাচীনতম ও বৃহত্তম জাদুঘর। ইতিহাস, প্রত্নতত্ত্ব, শিল্প, প্রকৃতি ও বিজ্ঞানের নিদর্শনে পরিপূর্ণ এই মিউজিয়াম যেন অতীত ও বর্তমানের এক সেতুবন্ধন।
️ ইতিহাসের সূত্রপাত
ইন্ডিয়ান মিউজিয়ামের সূচনা হয় ১৮১৪ সালে। প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ড. নাথানিয়েল ওয়ালিচ (Dr. Nathaniel Wallich), যিনি ছিলেন একজন ডেনিশ উদ্ভিদবিদ। তাঁর প্রচেষ্টায় এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গল-এর অধীনে এই জাদুঘর গড়ে ওঠে।
তখন এর উদ্দেশ্য ছিল ভারতীয় প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সংরক্ষণ ও গবেষণা করা। প্রথমদিকে এটি চৌরঙ্গির নিকটে স্থাপিত হলেও পরে বর্তমান ভবনে স্থানান্তরিত হয়। ১৮৭৫ সালে লর্ড নর্থব্রুক-এর সময়ে এই বিশাল ভবনের উদ্বোধন হয়।
️ স্থাপত্যের সৌন্দর্য
ইন্ডিয়ান মিউজিয়ামের স্থাপত্য এক ক্লাসিকাল ইউরোপীয় ধাঁচের। ইতালীয় রেনেসাঁ শৈলীতে নির্মিত এই বিশাল ভবনটির ছাদ উঁচু, বড় বড় সাদা স্তম্ভ ও দীর্ঘ বারান্দা রয়েছে, যা এক রাজকীয় মর্যাদার প্রতীক।
ভিতরে প্রবেশ করলেই দেখা যায় ছয়টি বিভাগে সাজানো বিশাল প্রদর্শনী কক্ষ—
- প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ,
- শিল্প বিভাগ,
- জীববিজ্ঞান বিভাগ,
- ভূতত্ত্ব বিভাগ,
- অর্থনৈতিক জীববিজ্ঞান বিভাগ,
- মানববিদ্যা বিভাগ।
এই ছয়টি বিভাগে প্রায় এক লক্ষেরও বেশি নিদর্শন সংরক্ষিত আছে, যা ভারতের সভ্যতার হাজার বছরের ইতিহাস বর্ণনা করে।
প্রত্নতত্ত্ব ও ঐতিহাসিক নিদর্শন
ইন্ডিয়ান মিউজিয়ামের অন্যতম আকর্ষণ প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগ। এখানে রয়েছে মৌর্য, গুপ্ত, পাল ও সেন যুগের অসংখ্য মূর্তি, স্তম্ভ ও ভাস্কর্য।
বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো ভগবান বুদ্ধের অবশেষধারী “বুদ্ধের অস্থি” (Buddha’s Relic Casket) — যা সারনাথ থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল।
তাছাড়া রয়েছে অশোক স্তম্ভের খণ্ডাংশ, টেরাকোটা মূর্তি, সোনার ও রুপোর মুদ্রা, রাজকীয় মুদ্রাঙ্কিত সিল, যা প্রাচীন ভারতের প্রশাসন ও বাণিজ্যের ইতিহাস তুলে ধরে।
শিল্প ও সংস্কৃতির ভাণ্ডার
শিল্পপ্রেমীদের জন্য ইন্ডিয়ান মিউজিয়াম এক স্বর্গতুল্য। এখানে রয়েছে রাজপুত, মুঘল ও পাহাড়ি মিনিয়েচার পেইন্টিং, এছাড়াও চীনা, তিব্বতি ও বার্মিজ শিল্পকর্ম।
প্রাচীন ব্রোঞ্জের মূর্তি, কাঠখোদাই করা দেবমূর্তি, হাতির দাঁতের গহনা—সব মিলিয়ে এটি ভারতীয় কারুশিল্পের এক বিশাল ভাণ্ডার।
গ্যালারির এক কোণে রয়েছে ইজিপ্টের মমি, যা মিউজিয়ামের সবচেয়ে জনপ্রিয় নিদর্শনগুলোর একটি। হাজার বছরের পুরোনো এই মমির সামনে দাঁড়িয়ে মনে হয়, ইতিহাস যেন নিঃশব্দে কথা বলছে।
প্রাকৃতিক ইতিহাস ও জীববিজ্ঞান বিভাগ
এই বিভাগের প্রধান আকর্ষণ হলো ডাইনোসরের জীবাশ্ম, বিভিন্ন প্রজাতির পাখি, পশু ও সরীসৃপের সংরক্ষিত নমুনা।
এখানে রয়েছে বিরল প্রজাতির পাখির ডিম, প্রজাপতির ডানা, পশুর কঙ্কাল এবং জীবাশ্ম, যা বিজ্ঞানপ্রেমী ও শিক্ষার্থীদের কাছে অমূল্য সম্পদ।
একটি বিশাল নীল তিমির কঙ্কাল ছাদের সঙ্গে ঝুলছে—যা দর্শকদের বিস্মিত করে।
অর্থনৈতিক জীববিজ্ঞান ও ভূতত্ত্ব বিভাগ
এই বিভাগে প্রদর্শিত আছে বিভিন্ন ধরনের খনিজ পদার্থ, পাথর, ধাতু ও রত্ন। ভারতের প্রাকৃতিক সম্পদের বৈচিত্র্য সম্পর্কে এখানে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়।
অন্যদিকে, ভূতত্ত্ব বিভাগে রয়েছে প্রাচীন আগ্নেয়গিরি শিলা, জীবাশ্ম কাঠ ও উল্কাপিণ্ডের সংগ্রহ।
ভ্রমণ নির্দেশিকা
- অবস্থান: জওহরলাল নেহরু রোড, পার্ক স্ট্রিট মোড়, কলকাতা।
- কাছাকাছি স্থান: এসপ্লানেড, পার্ক স্ট্রিট, ময়দান, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল।
- যেভাবে পৌঁছাবেন: মেট্রো রেলে এসপ্লানেড বা পার্ক স্ট্রিট স্টেশন নেমে হাঁটা পথে পৌঁছানো যায়। বাস, ট্যাক্সি, ট্রাম সবই সহজলভ্য।
- দর্শন সময়: সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা (সোমবার বন্ধ)।
- প্রবেশমূল্য: প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য ₹৫০, ছাত্রদের জন্য ₹২০।
শেষকথা
ইন্ডিয়ান মিউজিয়াম শুধু একটি ভবন নয়—এটি ভারতের সভ্যতার সজীব ইতিহাসের ঘর। এখানে প্রতিটি নিদর্শন যেন একেকটি পৃষ্ঠা, যা বলে যাচ্ছে আমাদের অতীতের গল্প—কেমন ছিল আমাদের রাজ্য, শিল্প, বিজ্ঞান, ধর্ম ও সমাজব্যবস্থা।
আজও যখন কেউ এই জাদুঘরে প্রবেশ করে, তখন মনে হয়, সময়ের পর্দা সরিয়ে এক অদ্ভুত ঐতিহাসিক ভুবনে প্রবেশ করা গেছে।
ইন্ডিয়ান মিউজিয়াম তাই শুধু পর্যটকদের নয়, প্রতিটি ভারতবাসীর জন্য গর্বের স্থান—যেখানে ইতিহাস স্পর্শ করা যায়, দেখা যায়, আর অনুভব করা যায় অন্তর দিয়ে।












Leave a Reply