
কলকাতার বুকে যে কয়েকটি স্থান ইতিহাস, সংস্কৃতি ও আধ্যাত্মিকতার গভীর ছোঁয়া বহন করে, তার মধ্যে দাকেশ্বরী কালী মন্দির, যা সাধারণত কালিঘাট মন্দির নামে অধিক পরিচিত, নিঃসন্দেহে অন্যতম। এই প্রাচীন তীর্থস্থানটি শুধু কলকাতাবাসীর নয়, সমগ্র ভারতের হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে অতি পবিত্র ও শ্রদ্ধার স্থান। কালীমায়ের এই পীঠস্থানে এসে মন অজান্তেই নত হয়ে যায় ভক্তির আবেশে।
️ ঐতিহাসিক পটভূমি
কালিঘাটের কালীমন্দিরকে ভারতবর্ষের ৫১টি শক্তিপীঠের একটি বলে মনে করা হয়। পুরাণ অনুসারে, দেবী সতীর শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে পতিত হয়েছিল, আর সেই স্থানগুলিই আজ শক্তিপীঠ নামে পরিচিত। কিংবদন্তি অনুযায়ী, সতীর ডান পায়ের আঙুলটি এই স্থানে পতিত হয়েছিল, তাই কালিঘাট এক শক্তিশালী পীঠক্ষেত্র হিসেবে খ্যাত।
প্রাচীনকালে এই অঞ্চল ছিল ঘন জঙ্গল ও নদীনির্ভর এক গ্রামাঞ্চল। “কালিঘাট” নামটি এসেছে “কালীর ঘাট” থেকে — অর্থাৎ, আদিগঙ্গার তীরে দেবী কালীর পূজাস্থান। ধারণা করা হয়, প্রায় ৩৫০ বছর আগে এখানে দেবীর প্রতিমা আবিষ্কার করেন এক সন্ন্যাসী। পরবর্তীতে সবর্ণ চৌধুরী পরিবার মন্দিরটি স্থাপন ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নেন। বর্তমান মন্দিরের স্থাপত্য ১৮০৯ সালে নির্মিত হয়, যা আজও ঐতিহ্যের প্রতীক।
মন্দিরের স্থাপত্য ও পরিবেশ
কালিঘাট মন্দিরটি বাংলা মন্দির স্থাপত্যের এক উৎকৃষ্ট নিদর্শন। মন্দিরের গর্ভগৃহে রয়েছে দেবী কালীমায়ের কৃষ্ণবর্ণ মূর্তি, যার জিভ রক্তরঙা এবং চোখ দুটি উজ্জ্বল সোনালি। দেবীর পায়ের নীচে শয়ান অবস্থায় রয়েছেন ভগবান শিব, যা তন্ত্র দর্শনের গভীর প্রতীক।
মন্দিরের চারপাশে রয়েছে প্রাচীন স্নানঘাট, যেখানে ভক্তরা গঙ্গাজল স্পর্শ করে নিজেদের পবিত্র মনে করেন। আশেপাশে রয়েছে রাধাকান্ত মন্দির, যা বৈষ্ণব ও শাক্ত মিলনের এক অপূর্ব উদাহরণ।
ভক্তির পরিবেশ
কালিঘাটে ভোর থেকে শুরু হয় পূজা, ধূপ, আরতি ও ঘণ্টাধ্বনি। ভক্তরা সারিবদ্ধভাবে মা কালীর দর্শনের জন্য অপেক্ষা করেন। মন্দিরের পুরোহিতরা প্রাচীন রীতিতে ‘ভোগ’ ও ‘আরতি’ সম্পন্ন করেন। বিশেষ করে অমাবস্যা, নবরাত্রি, এবং কালীপূজার দিন এখানে ভক্তদের ঢল নামে। সেদিন কলকাতা যেন পরিণত হয় এক মহাতীর্থে — ধূপ, প্রদীপ ও শঙ্খধ্বনিতে মুখরিত গোটা এলাকা।
কালিঘাটের চারপাশের জীবন
মন্দিরের চারপাশে রয়েছে ভক্তি ও বাণিজ্যের এক মিশ্র জগৎ — ফুল, মালা, ধূপ, প্রসাদের দোকান, ভবিষ্যৎবক্তা, ভজনগায়ক—সব মিলিয়ে এক প্রাণবন্ত পরিবেশ। রাস্তার মোড়ে মোড়ে পাওয়া যায় কলকাতার ঐতিহ্যবাহী খাবার—কচুরি, ছোলার ডাল, মিষ্টি ও ঠান্ডা পানীয়।
ভক্তদের পাশে মাঝে মাঝে দেখা মেলে সন্ন্যাসী ও সাধুদের, যারা ধ্যানমগ্ন অবস্থায় কালীমায়ের নাম জপ করছেন। এখানে প্রতিটি পাথর, প্রতিটি ধ্বনি যেন দেবীর উপস্থিতি ঘোষণা করে।
ভ্রমণ নির্দেশিকা
অবস্থান: দক্ষিণ কলকাতা, আদিগঙ্গার তীরে।
যেভাবে পৌঁছাবেন: মেট্রোতে কালিঘাট স্টেশন অথবা যতীন্দ্রনাথ মুখার্জি রোড পর্যন্ত পৌঁছানো যায়। বাস, অটো, ট্যাক্সি — সব পরিবহনই সহজলভ্য।
সেরা সময়: কালীপূজা, অমাবস্যা ও শনিবার সকালে মায়ের পূজা বিশেষভাবে উপভোগ্য।
✨ শেষকথা
দাকেশ্বরী কালী মন্দিরে ভ্রমণ মানে শুধু এক ঐতিহাসিক স্থানে যাওয়া নয় — এটি এক আত্মিক যাত্রা, যেখানে ভক্তি ও বিশ্বাস মিলেমিশে যায় আধ্যাত্মিকতার অনন্ত স্রোতে। কালিঘাটে গিয়ে মনে হয়, দেবী মা এখনও এই নগরীর হৃদয়ে জাগ্রত আছেন—যিনি রক্ষা করেন, স্নেহ দেন, আর সব অন্ধকারের মধ্যে আলো ছড়ান।












Leave a Reply