বাংলার মানুষ বললেই প্রথম যে সমুদ্র সৈকতের নাম মনে আসে, তা হল — দীঘা। পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব মেদিনীপুর জেলার এই সমুদ্রতট শুধুমাত্র বাংলার নয়, ভারতের অন্যতম জনপ্রিয় সৈকত শহর। এখানকার শান্ত অথচ প্রাণবন্ত পরিবেশ, নীল জলরাশি, বালুকাবেলায় ঢেউয়ের গর্জন, আর ঝাউবনের ছায়াঘেরা পথ—সব মিলিয়ে দীঘা যেন এক চিরকালীন আকর্ষণ।
️ ভৌগোলিক পরিচিতি
দীঘা অবস্থিত পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব প্রান্তে, ওড়িশা সীমান্তের কাছাকাছি। কলকাতা থেকে প্রায় ১৮৭ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই সমুদ্রতট বঙ্গোপসাগরের তীরে অবস্থিত। ট্রেন, বাস কিংবা নিজস্ব গাড়িতে করে সহজেই পৌঁছানো যায়। দীঘা মূলত তিনটি ভাগে বিভক্ত — ওল্ড দীঘা, নিউ দীঘা এবং উদয়পুর সৈকত।
সমুদ্রের সকাল ও সন্ধ্যা – রঙের মায়াজাল
দীঘার সবচেয়ে বড় আকর্ষণ সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত।
ভোরের আলো ফুটতেই যখন ঢেউয়ের ওপর সূর্যের প্রথম কিরণ পড়ে, তখন পুরো সমুদ্র যেন সোনালী আভায় ঝলমল করে ওঠে।
আবার সন্ধ্যায় যখন সূর্য পশ্চিমে অস্ত যায়, তখন আকাশের রঙ বদলে যায়—কমলা, লাল, বেগুনি—সব রঙ একসঙ্গে নেচে ওঠে সমুদ্রের জলে। সেই দৃশ্য যেন এক জীবন্ত চিত্রপট।
দেখার মতো জায়গা
দীঘা ভ্রমণে শুধু সমুদ্রস্নান নয়, আশেপাশে দেখার মতো অনেক সুন্দর স্থান রয়েছে—
- নিউ দীঘা সৈকত: আধুনিক ও পরিষ্কার, পরিবার ও বন্ধুবান্ধবদের জন্য আদর্শ স্থান।
- ওল্ড দীঘা সৈকত: পুরোনো সময়ের নস্টালজিয়া জড়িয়ে থাকা সৈকত; ঢেউয়ের গর্জন এখানে অনেক বেশি প্রবল।
- উদয়পুর সৈকত: শান্ত, নির্জন ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর। এখান থেকে ওড়িশার তট দেখা যায়।
- মেরিন অ্যাকুয়ারিয়াম: ভারতের অন্যতম বৃহৎ সামুদ্রিক জীববিজ্ঞান কেন্দ্র। এখানে নানা প্রজাতির মাছ, কচ্ছপ, স্টারফিশ, সি অ্যানেমোন দেখা যায়।
- আমরাবতী পার্ক: সুন্দর লেক ও প্যাডেল বোটিংয়ের ব্যবস্থা রয়েছে।
- চাঁদেশ্বর মন্দির: স্থানীয় ধর্মীয় আবেগের কেন্দ্রবিন্দু, সমুদ্র থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে।
- শঙ্করপুর ও তাজপুর সৈকত: দীঘা থেকে কিছু দূরে অবস্থিত, প্রকৃতিপ্রেমী ও নিরিবিলি সময় কাটাতে ইচ্ছুকদের জন্য স্বর্গতুল্য।
স্থানীয় জীবন ও সংস্কৃতি
দীঘার মানুষের জীবিকা প্রধানত মৎস্যধরন ও পর্যটনের ওপর নির্ভরশীল। সকালে সমুদ্রতীরে গেলে দেখা যায় জেলেদের জাল টানার দৃশ্য—সেই জালভর্তি তাজা মাছ, চিংড়ি, কাঁকড়া, ইলিশ—সবকিছুই যেন জীবন্ত জীবনের রঙ ছড়িয়ে দেয়।
স্থানীয় বাজারে ঝিনুক, শাঁখ, সি-শেল, কাঠের তৈরি শৌখিন দ্রব্য, ও নানা ধরনের সামুদ্রিক গহনা বিক্রি হয়, যা পর্যটকদের আকর্ষণ করে।
খাদ্যের আকর্ষণ
দীঘায় গেলে অবশ্যই চেখে দেখতে হবে এখানকার তাজা সি-ফুড। মাছ, চিংড়ি, কাঁকড়া, লবস্টার—সবই পাওয়া যায় সাশ্রয়ী মূল্যে।
“দীঘার ফ্রাই ফিশ” বা “প্রন ফ্রাই” গরম গরম পরিবেশিত হলে তার স্বাদ সত্যিই অবিস্মরণীয়।
থাকার ব্যবস্থা
দীঘায় নানা রকম হোটেল, রিসোর্ট ও অতিথিশালা রয়েছে — সাধারণ বাজেট থেকে শুরু করে বিলাসবহুল রিসোর্ট পর্যন্ত। নিউ দীঘাতে আধুনিক হোটেলগুলির পাশাপাশি ওল্ড দীঘাতে এখনো পুরোনো বাংলোর ছোঁয়া পাওয়া যায়। সমুদ্রের সামনে বসে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে ঢেউয়ের শব্দ শোনা এক অনন্য অনুভূতি।
কীভাবে পৌঁছাবেন
- রেলপথে: হাওড়া থেকে দীঘা পর্যন্ত নিয়মিত ট্রেন চালু আছে, যেমন তামরলিপ্ত এক্সপ্রেস, পাহাড়পুর এক্সপ্রেস ইত্যাদি।
- সড়কপথে: কলকাতা থেকে NH16 হয়ে দীঘা পৌঁছাতে প্রায় ৫ ঘণ্টা সময় লাগে।
- নিকটবর্তী শহর: কাঁথি (Contai) প্রায় ৩০ কিমি দূরে।
উপসংহার
দীঘা এমন এক জায়গা, যেখানে প্রকৃতি, আনন্দ ও বিশ্রাম একসঙ্গে মিশে যায়। এখানে ঢেউয়ের শব্দে মন শান্ত হয়, সূর্যাস্তের আলোয় মন কাব্যিক হয়ে ওঠে, আর হালকা লবণাক্ত বাতাসে যেন জীবনের ক্লান্তি ধুয়ে যায়।
দীঘা শুধুমাত্র একটি পর্যটনকেন্দ্র নয়—এটি বাংলার মানুষের হৃদয়ে এক অনন্ত ভালোবাসার প্রতীক। 













Leave a Reply