
কলকাতা শহর শুধু তার প্রাণচঞ্চলতা বা ঐতিহ্যের জন্যই নয়, বরং তার স্থাপত্যের বহুমাত্রিক বৈচিত্র্যের জন্যও বিশ্বজোড়া খ্যাত। হিন্দু মন্দির, মুসলিম মসজিদ, শিখ গুরুদ্বারা, জৈন মন্দিরের পাশাপাশি শহরের বুকে রয়েছে এক মনোমুগ্ধকর ইউরোপীয় স্থাপত্য— সেন্ট পলস ক্যাথেড্রাল, যা কলকাতার এক অনন্য ঐতিহ্যবাহী নিদর্শন। এটি শুধু খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের প্রার্থনালয় নয়, বরং শিল্প, ইতিহাস ও আধ্যাত্মিকতার এক জীবন্ত প্রতীক।
ইতিহাসের পথে সেন্ট পলস ক্যাথেড্রাল
সেন্ট পলস ক্যাথেড্রালের ইতিহাস ১৯শ শতকের প্রথম দিক থেকে শুরু। কলকাতার প্রথম বিশপ ড্যানিয়েল উইলসন (Bishop Daniel Wilson) শহরে একটি বৃহৎ গির্জা নির্মাণের পরিকল্পনা নেন, যা ক্রমবর্ধমান ইউরোপীয় জনগোষ্ঠীর উপাসনার স্থান হিসেবে ব্যবহৃত হবে। তার উদ্যোগেই ১৮৩৯ সালে মন্দিরের নির্মাণকাজ শুরু হয় এবং প্রায় আট বছর পর, ১৮৪৭ সালে, গির্জাটি জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হয়।
স্থাপত্যটি নকশা করেছিলেন বিখ্যাত স্থপতি মেজর উইলিয়াম এনফিল্ড (Major William Nairn Forbes), যিনি ইংল্যান্ডের Gothic Revival স্থাপত্যশৈলীকে ভারতীয় জলবায়ুর সঙ্গে মিলিয়ে তৈরি করেন।
️ স্থাপত্যের সৌন্দর্য
সেন্ট পলস ক্যাথেড্রাল-এর স্থাপত্য দর্শককে মুগ্ধ করে। ইউরোপীয় গথিক স্টাইলের উঁচু গম্বুজ, ভিক্টোরিয়ান আর্টের সূক্ষ্ম খোদাই, ও রঙিন কাচের স্টেইনড গ্লাস জানালা যেন এক জাদুকরী আলোর খেলা তৈরি করে।
প্রধান প্রবেশদ্বার দিয়ে ঢুকতেই চোখে পড়ে দীর্ঘ নাভ (nave), যা গির্জার মূল প্রার্থনা কক্ষ। ছাদের উচ্চতা, স্তম্ভের সারি, আর কাঠের পিউ বেঞ্চগুলোর সারি—সব মিলিয়ে গির্জার ভেতরটা এক শান্ত, পবিত্র আবহ তৈরি করে।
গির্জার এক প্রান্তে রয়েছে বিশাল আলতারে ক্রুশবিদ্ধ যীশু খ্রিষ্টের প্রতিমা, যার সামনে প্রার্থনায় বসলে মনে হয়, সমস্ত কোলাহল থেকে মুক্তি মিলছে।
চারপাশের পরিবেশ
গির্জার চতুর্দিকে রয়েছে সুন্দরভাবে সাজানো উদ্যান ও গাছপালা, যা গির্জাটিকে শহরের কোলাহলের মধ্যে এক শান্তির দ্বীপে পরিণত করেছে। বাইরের বাগানে ফুলে ফুলে ভরে ওঠে বসন্তকাল, আর পাখির কূজনে সকালের প্রার্থনা যেন আরও মধুর হয়ে ওঠে।
সামনে দিয়ে চলে গেছে রানি রাসমণি অ্যাভিনিউ, আর পাশেই বিখ্যাত ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, যা মিলিতভাবে এক রাজকীয় ঔপনিবেশিক আবহ তৈরি করে। সন্ধ্যাবেলা গির্জার আলোকসজ্জা এক অনন্য দৃশ্য—সাদা গম্বুজে পড়া আলো যেন আকাশের তারার মতো ঝলমল করে।
ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব
সেন্ট পলস ক্যাথেড্রাল শুধু খ্রিস্টানদের প্রার্থনালয় নয়, বরং বহু সংস্কৃতির মিলনস্থল। এখানে ক্রিসমাস, ইস্টার ও নিউ ইয়ার ইভের সময় হাজার হাজার মানুষ আসেন, ধর্ম নির্বিশেষে। সেই সময় গির্জার ভেতর সঙ্গীত, প্রার্থনা ও আলোয় ভরে ওঠে এক স্বপ্নময় পরিবেশ।
প্রতি বছরই এখানে ক্যারল গান, কোরাস সঙ্গীত, অর্গান বাজনা ও কনসার্ট অনুষ্ঠিত হয়, যা কলকাতার সাংস্কৃতিক ক্যালেন্ডারের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ।
♂️ ভ্রমণ নির্দেশিকা
- অবস্থান: ক্যাথেড্রাল রোড, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের পাশে, কলকাতা।
- যেভাবে পৌঁছাবেন: মেট্রোতে ময়দান স্টেশন অথবা বাসে এসপ্লানেড হয়ে পৌঁছানো যায়। ট্যাক্সি বা অটো রিকশাও সহজলভ্য।
- দর্শন সময়: সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত; রবিবার সকালে বিশেষ প্রার্থনা সভা হয়।
- প্রবেশ ফি: বিনামূল্যে।
শেষকথা
সেন্ট পলস ক্যাথেড্রাল শুধু একটি ধর্মীয় স্থাপনা নয়, এটি এক ইতিহাস—কলকাতার ঔপনিবেশিক ঐতিহ্য, শিল্প ও মানবিকতার প্রতীক। এখানে প্রবেশ করলে মনে হয়, সময় যেন থমকে গেছে। চারপাশের নিস্তব্ধতা, পাখির গান, আর রঙিন আলো-ছায়ার খেলা মিলিয়ে এটি এমন এক স্থান, যেখানে আত্মা শান্তি খুঁজে পায়।
কলকাতার ভ্রমণ কখনোই সম্পূর্ণ হয় না যদি সেন্ট পলস ক্যাথেড্রালের নীরব প্রার্থনার মুহূর্ত একবার চোখে না দেখা হয়।











Leave a Reply