
গঙ্গার দুই তীরকে এক অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে যুক্ত করেছে দুটি অমর সৃষ্টি — হাওড়া ব্রিজ ও বিদ্যাসাগর সেতু। এই দুই সেতু কেবলমাত্র লোহার ও কংক্রিটের কাঠামো নয়, বরং তারা কলকাতার ইতিহাস, প্রযুক্তি, স্থাপত্য ও সংস্কৃতির জীবন্ত প্রতীক। একদিকে হাওড়া ব্রিজ কলকাতার ঐতিহ্যের প্রতিচ্ছবি, অন্যদিকে বিদ্যাসাগর সেতু আধুনিকতার প্রতীক। একে দেখা মানে শহর কলকাতার আত্মাকে স্পর্শ করা।
️ হাওড়া ব্রিজ – ইতিহাসের গর্ব
গঙ্গার উপর স্থাপিত এই বিশাল লোহার সেতুটি ১৯৪৩ সালে উদ্বোধন করা হয়। এর আসল নাম রবীন্দ্র সেতু, তবে আজও সারা পৃথিবী একে হাওড়া ব্রিজ নামেই চেনে। ব্রিটিশ শাসনামলে গঙ্গার দুই তীর—কলকাতা ও হাওড়া—এর মধ্যে যোগাযোগের জন্য এই সেতু নির্মাণের প্রয়োজন অনুভূত হয়।
এই সেতুটি একটি ক্যান্টিলিভার ব্রিজ — অর্থাৎ এটি কোনো স্তম্ভ বা পিলার ছাড়াই গঙ্গার দুই পাড়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। লোহার বিশাল কাঠামোটি তৈরি হয়েছিল প্রায় ২৬,৫০০ টন ইস্পাত দিয়ে, যার বেশিরভাগই উৎপাদিত হয়েছিল ভারতের টাটানগরে।
১৯৪৩ সালে জনসাধারণের জন্য এটি খুলে দেওয়া হলে, এটি ছিল বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম ক্যান্টিলিভার সেতু।
কলকাতার প্রাণরেখা
প্রতিদিন প্রায় এক লক্ষাধিক যানবাহন এবং প্রায় পাঁচ লক্ষ পথচারী এই সেতু পার হন। ভোরবেলা থেকে রাত পর্যন্ত হাওড়া ব্রিজ যেন জীবন্ত এক নদীর মতো, যেখানে মানুষ, গাড়ি, বাস, ট্রাম সব মিশে যায় শহরের ছন্দে।
রাতে যখন সেতুটি আলোকিত হয়, তখন গঙ্গার জলে সেই আলোয় প্রতিবিম্ব তৈরি করে এক মনোমুগ্ধকর দৃশ্য। দাঁড়িয়ে যদি কেউ গঙ্গার হাওয়া মুখে মাখে, আর দেখে শহরের আলোছায়া—তবে বোঝা যায়, এই সেতু কেবল ইস্পাতের নয়, এটি কলকাতার প্রাণ।
বিদ্যাসাগর সেতু – আধুনিক কলকাতার গর্ব
হাওড়া ব্রিজের প্রায় চার দশক পরে, ১৯৯২ সালে উদ্বোধন করা হয় বিদ্যাসাগর সেতু—যা ভারতের প্রথম কেবল-স্টেড ব্রিজ এবং বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম। এটি নির্মাণে ব্যবহৃত হয়েছিল আধুনিক প্রযুক্তি, যা সেই সময়ে এক অসাধারণ প্রকৌশল কীর্তি বলে বিবেচিত হয়।
এই সেতুটি নামাঙ্কিত হয়েছে মানবতাবাদী মহাপুরুষ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর-এর নামে, যা জ্ঞানের ও অগ্রগতির প্রতীক।
বিদ্যাসাগর সেতু ৮২৩ মিটার দীর্ঘ ও ৩৫ মিটার প্রশস্ত। এর উচ্চতা প্রায় ১২৭ মিটার, যা থেকে কলকাতার শহরদৃশ্য ও গঙ্গার সৌন্দর্য উপভোগ করা যায় অপার আনন্দে।
দুই সেতুর ভ্রমণ অভিজ্ঞতা
ভ্রমণপ্রেমীদের কাছে এই দুটি সেতু যেন কলকাতার দুটি রত্ন।
- সকালে হাওড়া ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে সূর্যোদয়ের প্রথম আলোয় গঙ্গার ঝিলমিল জলরাশি দেখা এক অপূর্ব অভিজ্ঞতা।
- অপরদিকে, সন্ধ্যায় বিদ্যাসাগর সেতু থেকে সূর্যাস্তের দৃশ্য, শহরের আলো আর গঙ্গার ওপর প্রতিফলিত রঙিন আকাশ—এক কথায় জাদুকরী।
নৌকা ভ্রমণে গঙ্গার বুক থেকে যখন দেখা যায় দুটি সেতু পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে—একটি অতীতের গর্ব, অন্যটি বর্তমানের অগ্রগতি—তখন মনে হয় যেন সময়ের দুটি যুগ পাশাপাশি হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে।
ছবিপ্রেমীদের স্বর্গ
ফটোগ্রাফি বা সিনেমার দৃশ্যায়নে এই দুই সেতু বহুবার অমর হয়ে আছে।
- হাওড়া ব্রিজের নিচে সূর্যাস্তের আলো
- বিদ্যাসাগর সেতুর ওপর রাতের আলোকসজ্জা
 — উভয় দৃশ্যই কলকাতার পরিচয় বহন করে সারা পৃথিবীতে।
কীভাবে পৌঁছাবেন
- হাওড়া ব্রিজ: হাওড়া স্টেশন থেকে হাঁটাপথেই পৌঁছানো যায়। কলকাতার যেকোনো প্রান্ত থেকে বাস, ট্যাক্সি বা ট্রামে আসা যায় সহজেই।
- বিদ্যাসাগর সেতু: এটি ময়দান, আলিপুর বা হেস্টিংস থেকে সহজে পৌঁছানো যায়। দক্ষিণ কলকাতা বা হাওড়া উভয় দিক থেকেই এর সংযোগ চমৎকার।
শেষকথা
হাওড়া ব্রিজ ও বিদ্যাসাগর সেতু শুধু গঙ্গার দুই তীরকে যুক্ত করে না, তারা যুক্ত করেছে কলকাতার ইতিহাস ও আধুনিকতাকে।
একদিকে অতীতের স্থায়িত্ব, অন্যদিকে ভবিষ্যতের অগ্রগতি—এই দুই মিলে গড়ে উঠেছে কলকাতার আত্মা।
গঙ্গার হাওয়ায় দাঁড়িয়ে যখন এই দুটি সেতুর দিকে তাকানো যায়, তখন মনে হয়—
“একটি বলছে, আমি তোমার ইতিহাস;
অন্যটি বলছে, আমি তোমার আগামীকাল।”












Leave a Reply