
ইংল্যান্ডের উইল্টশায়ার অঞ্চলের বিস্তীর্ণ সবুজ প্রান্তরে দাঁড়িয়ে থাকা স্টোনহেঞ্জ যেন মানবসভ্যতার এক অমর বিস্ময়। হাজার হাজার বছর আগে নির্মিত পাথরের বৃত্তটি আজও ইতিহাসবিদ, প্রত্নতাত্ত্বিক ও পর্যটকদের কাছে রহস্যের উৎস। কেন তৈরি হয়েছিল এই পাথরের বৃত্ত? কারা তৈরি করেছিল? এ প্রশ্নের উত্তর আজও পুরোপুরি স্পষ্ট নয়, আর এই রহস্যই স্টোনহেঞ্জকে করেছে আরও আকর্ষণীয়।
প্রথম দেখাতেই মুগ্ধতা
স্টোনহেঞ্জের দিকে এগোতে এগোতে যখন বিস্তীর্ণ ঘাসের মাঠের মাঝে হঠাৎ করে বিশালাকার পাথরের স্তম্ভগুলো চোখে পড়ে, তখন মনে হয় যেন হাজার বছরের পুরোনো কোনো সভ্যতার দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছেছি।
আকাশের কোল ঘেঁষে দাঁড়ানো সেই খণ্ডপাথরগুলোতে বয়সের ছাপ স্পষ্ট, তবে তাদের দৃঢ় অবস্থান আজও মানুষের কল্পনাকে চ্যালেঞ্জ করে।
ইতিহাসের পাতায় স্টোনহেঞ্জ
গবেষকদের মতে স্টোনহেঞ্জের নির্মাণ শুরু হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ সালেরও আগে, এবং পরবর্তী ১৫০০ বছর ধরে বিভিন্ন ধাপে গড়ে উঠেছে এর বর্তমান রূপ।
বিশেষ যে দিকগুলো উল্লেখযোগ্য—
- পাথরগুলোর ওজন ৪ টন থেকে ৩০ টন পর্যন্ত
- কিছু ব্লুস্টোন আনা হয়েছিল ২৫০ কিমি দূর ওয়েলসের প্রিসেলি পর্বত থেকে
- পাথরগুলোর বৃত্তাকার বিন্যাস জ্যোতির্বিজ্ঞানের সঙ্গে যুক্ত—সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের অবস্থান অনুযায়ী কাঠামো সাজানো
এই কারণে অনেকেই মনে করেন এটি ছিল সৌর উপাসনার কেন্দ্র, কেউ বলেন প্রাচীন সমাধিক্ষেত্র, আবার অনেকে দাবি করেন এটি ছিল পূর্বপুরুষদের স্মৃতিস্তম্ভ।
স্টোনহেঞ্জ ভিজিটর সেন্টার
স্টোনহেঞ্জ ভ্রমণের শুরু হয় এর Visitor Centre থেকে, যেখানে আছে—
- হাজার বছরের নিদর্শন
- প্রাক-যুগের মানুষের জীবনের পুনর্নির্মাণ
- অডিও-ভিজ্যুয়াল প্রদর্শনী
- পাথর টানার প্রাচীন পদ্ধতির মডেল
এই অংশটি ঘুরে দেখলে স্টোনহেঞ্জের ইতিহাস যেন চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে ওঠে।
স্টোন সার্কেলের কাছে পৌঁছানো
Visitor Centre থেকে শাটল বাসে বা হেঁটেও পৌঁছানো যায় স্টোন সার্কেলের কাছে।
মাঠের মধ্যপথে হাওয়ার সঙ্গে যখন পাথরের ছায়া ভেসে আসে, তখন পরিবেশে এক ধরনের মায়াবী নীরবতা তৈরি হয়।
স্টোনগুলো ঘিরে যে হাঁটার পথ আছে, সেখান থেকে প্রতিটি কোণ থেকেই অসাধারণ দৃশ্য দেখা যায়—
- সূর্যাস্তের সময় এটি সবচেয়ে জাদুকরী দেখায়
- নীল আকাশের নীচে পাথরের ছায়া যেন ইতিহাসের মূর্ত প্রতীক
- দূর থেকে ছবির মতো দাঁড়িয়ে থাকা সার্কেল আপনার মনে এক অদ্ভুত বিস্ময় জাগায়
Summer Solstice – আলোর উৎসব
স্টোনহেঞ্জের সবচেয়ে বিখ্যাত উৎসব হল গ্রীষ্মের দীর্ঘতম দিন, অর্থাৎ ২১ জুনের Summer Solstice।
এই দিনে সূর্যোদয় স্টোনহেঞ্জের Heel Stone-এর ঠিক ওপরে দেখা যায়—এ দৃশ্য দেখার জন্য হাজার হাজার মানুষ এখানে ভিড় করেন।
ঢাক-ঢোল, নৃত্য, জাদুকরী আচার এবং এক আনন্দমেলায় রূপ নেয় প্রান্তরটি।
প্রকৃতির শান্তি
স্টোনহেঞ্জের চারপাশের মাঠগুলো অদ্ভুত শান্ত। দূরে দেখা যায়—
- গোল পাহাড়
- ঘাসের ঢেউ
- ভেড়ার পাল
- উড়ন্ত পাখি
এই নীরব প্রকৃতি যেন স্টোনহেঞ্জের রহস্যকে আরও গভীর করে তোলে।
যেভাবে পৌঁছাবেন
স্টোনহেঞ্জ লন্ডন থেকে প্রায় ১৪০ কিমি দূরে।
সেই কারণে—
- ট্রেনে স্যালিসবারি পর্যন্ত গিয়ে সেখান থেকে বাস
- লন্ডন থেকে ডে ট্যুর
- অথবা নিজস্ব গাড়িতে সুন্দর গ্রাম্য রাস্তায় ড্রাইভ
সব পথেই ভ্রমণ উপভোগ্য।
শেষ কথা
স্টোনহেঞ্জ কেবল একটি স্থাপনা নয়—এটি ইতিহাস, বিজ্ঞান, রহস্য ও প্রকৃতির অপূর্ব মিশ্রণ।
এখানে দাঁড়ালে মনে হয় যেন সময় থমকে গেছে, আর সেই থমকে থাকা মুহূর্ত আপনাকে নিয়ে যায় হাজার বছরের অতীতে।
যাঁরা পৃথিবীর বিস্ময় দেখতে ভালোবাসেন, স্টোনহেঞ্জ তাদের জন্য অবশ্যই জীবনে একবার দেখা উচিত একটি স্থান।












Leave a Reply