লক্ষ্য যখন লক্ষ্মীদেবীর কৃপালাভ : রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক।

0
993

  "এস মা কমলা লক্ষ্মী ত্রিলোক জননী।
    কৃপাময়ী করো কৃপা মাতা নারায়ণী।।"
         আজ শ্রীশ্রী লক্ষ্মীদেবীর আরাধনার বিশেষ তিথি  'কোজাগরী পূর্ণিমা'র শুভলগ্ন সমাগত হয়েছে। শ্রী,সম্পদ আর সৌন্দর্যের অধিষ্ঠাত্রী দেবী লক্ষ্মীর কৃপা লাভ করতে আমরা নিজেদের অন্তরের সবটুকু ভক্তিশ্রদ্ধার নৈবেদ্য নিবেদন করে দেই লক্ষ্মীদেবীর শ্রীচরণে ।সারা বছরের সব থেকে অপেক্ষার আর আনন্দে কাটানো কয়েকটি দিনের শেষে দেবী দূর্গার প্রতিমা নিরঞ্জনের পর পরই বাঙালির হৃদয়ে আকস্মিক যে একটা বেদনার বা শূণ্যতার বাতাবরণ তৈরী হয় ,তার পঞ্চম দিনের দিন শ্রীলক্ষ্মীর পূজা যেন সেই বেদনার উপশম ঘটিয়ে প্রতি ঘরে ঘরে আনয়ণ করে এক স্নিগ্ধতার , শান্তির আর স্থির আনন্দের আবহ। সিংহবাহিনী উমার আসার আনন্দে যে উচ্ছ্বলতা আমরা এই কদিন বাইরে প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে করেছি , সেই উচ্ছ্বলতা এবার এই কোজাগরী তিথিতে যেন প্রত্যেকের গৃহকন্দরে ঘনীভূত হয়। প্রতিটি গৃহস্থ বাড়ি আপন আপন সামর্থ্য অনুযায়ী পূজার ব্যবস্থা করেন নিয়ম নিষ্ঠাসহ। মঙ্গলঘট, আলপনা, ধানের ছড়া, শোলার কদমফুলে সুসজ্জিত হয়ে এই তিথিতে  শ্রীময়ী হয়ে ওঠে প্রতিটি সংসার‌। 
       যা কিছু সুন্দর তা 'শ্রী' শব্দে প্রতিপন্ন হয়। তাইতো  দেবী লক্ষ্মীর নাম শ্রী। তিনি যে সৌন্দর্যের ,শোভার মূর্তিমন্ত রূপ।গোলকে কমলানাম্নী  তিনি, তিনিই মাধবগেহিনী, বিষ্ণুবক্ষবিলাসিনী, শ্রীকৃষ্ণপ্রিয়া রুক্মিণী। স্বর্গলক্ষ্মী রূপে তিনি স্বর্গের অধিষ্ঠাত্রী দেবী , আবার গৃহলক্ষ্মী নামে তিনি ভূতলে প্রতিগৃহেই বিরাজ করেন। বনলক্ষ্মী রূপে তিনি বনে বিরাজ করেন।তিনিই রাজলক্ষ্মী রাজপুরে, বেদের জননী,বিরাজ ঈশ্বরী , পদ্মাবতী, কুন্দদন্তী, মালতী।সম্পদরূপিনী ,জ্ঞানদাত্রী , ঐশ্বর্যদায়িনী দেবী লক্ষ্মীই হলেন সতী-সাধ্বী রমনীদের পরম উপমা।
            কথায় আছে ' সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে'---- আর তাই, প্রতিটি রমণীর মানবিক মুখটি ঠিক কেমন হওয়া উচিৎ , কেমন করে নিজের সংসারের কাছে কর্তব্যপরায়ণ ও দায়বদ্ধ থাকা উচিৎ , অন্যান্য সদস্যদের প্রতি আচরণ কেমন হওয়া বাঞ্ছনীয় --এ সকল শিক্ষা আরও একবার মনে পড়ে যায় প্রতিটি নারীর মনে এই লক্ষ্মীদেবীর পূজার আচার আচরণের বিধি পালন ও পাঁচালী পাঠ  করতে গিয়ে। করুণা ভরা, মমতাভরা দৃষ্টিতে দেবী সংসারকে লক্ষ্য করেন তাই তো 'লক্ষ্মী'। একারণে শ্রীলক্ষ্মীর পূজায় , তাঁর ধ্যানে , তাঁর প্রণামে প্রতিটি নারীমনও  দেবী লক্ষ্মীর ভাবে ভাবিত হয়ে মমতাভরা স্বভাবসম্পন্না হয়ে ওঠে। 
                 লক্ষ্মীর স্ত্রোত্রে বলা হয়েছে -

“লক্ষ্মীঃ শ্রীঃ কমলা বিদ্যা মাতা বিষ্ণুপ্রিয়া সতী ।
পদ্মালয়া পদ্মহস্তা পদ্মাক্ষী পদ্মসুন্দরী ।।
ভূতানামীশ্বরী নিত্যা মতা সত্যাগতা শুভা ।
বিষ্ণুপত্নী মহাদেবী ক্ষীরোদতনয়া ক্ষমা ।।
অনন্তলোকলাভা চ ভূলীলা চ সুখপ্রদা ।
রুক্মিণী চ তথা সীতা মা বৈ বেদবতী শুভা ।।
এতানি পুন্যনামানি প্রাতরুথায় যঃ পঠেৎ ।
মহাশ্রিয়নবাপ্নোতি ধনধান্যকল্মষম্ ।।”
——–শ্রী,কমলা, বিদ্যা,মাতা ,বিষ্ণুপ্রিয়া,সতী , পদ্মালয়া, পদ্মহস্তা ,পদ্মাক্ষী ,পদ্মসুন্দরী , ভূতগণের ঈশ্বরী , নিত্যা , সত্যাগতা , শুভা , বিষ্ণুপত্নী , ক্ষীরোদ-তনয়া , ক্ষমা স্বরূপা , অনন্তলোকলাভা , ভূলীলা , সুখপ্রদা , রুক্মিণী , সীতা , বেদবতী – দেবীর এ সকল নাম । প্রভাতে যারা দেবীর এই পুণ্য নামাবলী পাঠ করেন তারা বিপুল ঐশ্বর্য পেয়ে ধনী হয়ে থাকে।
কোজাগরী শব্দটির অর্থ কে জাগে? ‘কো জাগর্তি গভীর হস্মিন্ নক্তম্।’—কে জেগে আছ?— এই বলে দেবী লক্ষ্মী এ তিথির রাত্রে ডেকে ডেকে জিজ্ঞাসা করেন সকলকে। সেকারণে কোজাগরী পূর্ণিমায় রাত্রি জাগরণ করে দেবীকে আহ্বান করার বিধান। আবার ধানের অধিষ্ঠাত্রী দেবী তিনি। ‘লক্ষ্মীত্বং ধান্যরূপাসি প্রাণীনাং প্রাণদায়িনীম্’– তাই প্রাণদায়িণী দেবীর পূজায় তাঁকে প্রসন্ন করতে আসনে রাখা হয় ধান আর শস্য পূর্ণ ছোট ঘট বা ঝুড়ি। তাইতো পূজার অর্ঘ্যে থাকে চিঁড়ে, খই, মুড়কি, মুরি ,বিভিন্ন ধরণের নাড়ু ও মোয়া ।
শ্রীলক্ষ্মীদেবীর পূজা হয় প্রতিমায় ও চিত্র আঁকা পটে বা সরায় ।বিবিধ অলঙ্কারে সজ্জিতা শান্ত, স্নিগ্ধ, অপরূপা দেবী প্রতিমার বাম হস্তে ধানের শীষের ছড়া ও ঝাঁপি আর ডান হস্ত দ্বারা তিনি আশীর্বাদ প্রদায়িনী, বরাভয়দায়িনী। আর সরা পূজায় চাররকম প্রকারভেদ লক্ষ্য করা যায়– ঢাকাই সরা,ফরিদপুরী সরা, সুরেশ্বরী সরা ও শান্তিপুরী সরা। কোন সরাতে লক্ষ্মী জয়া-বিজয়া সহ, কোনটিতে রাধাকৃষ্ণ ও লক্ষ্মী,আবার কোনটিতে সপরিবার দেবী দূর্গার সঙ্গে লক্ষ্মী। সাতটি কলার ডোঙায় অথবা কলা গাছের গা দিয়ে তৈরী নৌকায় নানাবিধ শস্য, স্বর্ণ-রৌপ্যের অলঙ্কার, কাচা টাকা ভরে দেবীর আসনের পাশে সজ্জিত করে দেওয়া হয় যা সম্পদ ও সমৃদ্ধির সূচক । সাথে দেওয়া হয় কলা পাতার মাঝ, ধান ঝাড়ার কুলো, বউ নারকেল , কাঁঠালি কলার ফানা, পান-সুপুরি, শোলার কদম , ধানের ছড়া আর পদ্ম। শুকনো চিঁড়ের সাথে নারকেলের জল হল দেবীর প্রধান নৈবেদ্য। দেবীর পূজার ঘটের তলায় রাখা হয় গঙ্গামাটি, ধান আর দূর্বা। চারিদিকে চালের গুঁড়ার আলপনা দেওয়া হয়। সে আলপনায় দেবীর চরণচিহ্ন , ধানের শীষ, পদ্ম অবশ্যই আঁকতে হয় দেবীর প্রসন্নতা বিধানের জন্য । গৃহের প্রতিটি দ্বারের ধারে এক কোনে তেল-সিঁদুর আর দূর্বা দিতে হয়, আলপনা আঁকতে হয়।দেবীর কৃপাপূর্ণ পাদস্পর্শ যাতে গৃহস্থের প্রতিটি ঘরের ভিতর পড়ে একারণে তাঁকে আবাহন জানানোর রূপক এই রীতি।
শ্রীলক্ষ্মীদেবীর বাহন শ্বেত পেঁচক বা সাদা পেঁচাটিও এক শিক্ষার দ্যোতক। পেঁচা যমের অর্থাৎ মৃত্যুর দূত। সে যেন সাবধান বাণী শোনায় যাতে খারাপ পথে ধন আহরণের সকল প্রলোভনের ক্ষেত্রে আমরা যেন অন্ধ হয়ে থাকি। যেন অসৎ পথে ধন উপার্জন না করা হয়, তাহলে মৃত্যুপথে পতিত হতে হবে।
তাই , আমাদের প্রত্যেকের লক্ষ্য হওয়া উচিৎ সাধু উপায়ে সৎ পথে থেকে সম্পদের দেবী লক্ষ্মীর কৃপা লাভ করার চেষ্টা করা। সম্পদ তো শুধু অর্থ হয় না, পারমার্থিক সম্পদ , চরিত্র সম্পদও যে মহাবল , যা অর্জন করতে হয় , রপ্ত করতে হয়।

কলমে : রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here