মূল্যবান মনুষ্য জীবন ও বসুমাতা ঋতুমতী : স্বামী আত্মভোলানন্দ (পরিব্রাজক)।

আমাদের মূল্যবান সুন্দর মনুষ্য জীবনে ভারতভূমি ধর্মীয় উৎসব-মুখর পুণ্যভূমি পবিত্রভূমি। সৌন্দর্যময় আমাদের এই ভারতবর্ষের সুন্দর প্রকৃতি সকল ধর্মীয় ও নৈসর্গিক উপাদানে সমৃদ্ধ। এই মনোরম, অনুপম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও উৎসব অনন্তকাল ধরে আমাদের চিত্তে শিক্ষা ও আনন্দের অমৃতধারা জাগিয়ে তুলছে। আমাদের শিক্ষা ক্ষেত্রে ভারতমাতা ও প্রকৃতির অবদান অপরিসীম। আমাদের ভারতমাতা স্বমহিমায় উজ্জ্বল।
আমাদের ভারতবর্ষে সনাতন হিন্দু ধর্মের এক গুরুত্বপূর্ণ বাৎসরিক উৎসব অম্বুবাচী। লোকবিশ্বাস মতে আষাঢ় মাসের ৭ তারিখে মৃগশিরা নক্ষত্রের তিনটি পদ শেষ হলে পৃথিবী বা ধরিত্রী মা ঋতুময়ী হয়। এই সময়টিতে অম্বুবাচী পালন করা হয়। অর্থাৎ, সূর্য আষাঢ় মাসে যে দিন যে সময়ে মিথুন রাশিতে আদ্রা নক্ষত্রের প্রথম পাদে গমন করে সেই সময়কাল থেকে মাতৃস্বরূপা পৃথিবী এবং আদ্যাশক্তি মহামায়া ঋতুমতী হয় বা অম্বুবাচির কাল শুরু হয়। পূর্ণ বয়স্কা ঋতুমতী নারীরাই কেবল সন্তান ধারণে সক্ষম হোন। তাই অম্বুবাচীর পর ধরিত্রীও শস্য শ্যামলা হয়ে ওঠেন।

অম্বুবাচী কথাটি এসেছে সংস্কৃত শব্দ ‘অম্ব’ ও ‘বাচি’ থেকে। ‘অম্ব’ শব্দের অর্থ হলো জল এবং ‘বাচি’ শব্দের অর্থ হলো বৃদ্ধি। অতএব গ্রীষ্মের প্রখর দাবদাহের পর যখন বর্ষার আগমনে ধরিত্রী সিক্ত হয় এবং নবরূপে বীজধারণের যোগ্য হয়ে ওঠে সেই সময়কেই বলা হয় অম্বুবাচী। আমাদের মা ঠাকুমারা, ঠাকুরদারা বলেন, কি বা বার কিই বা তিথি, সাতই আষাঢ় ‘অম্বুবাচী’ ঠাকুমা দিদিমারা বলতেন যে দশহরা ও অম্বুবাচী ও রথ এই তিনে বৃষ্টি হবেই৷ সত্যিই তাই, তবে কালের বিবর্তনে ও আমাদের পাপাচারে প্রকৃতি আজ বিমুখ৷ তথাপি যারা আমরা ধর্মমতী তারা অম্বুবাচী পালন করি৷ কি অদ্ভুত এক প্রচলিত প্রথা৷ এই গ্রীষ্মের দাবদাহে জনপদ অতিষ্ঠ হয়ে উঠত৷ রেহাই পেতে নানারকম ধর্মীয় আচরণ পালন করা হত৷ অতিখরা ও প্রচন্ড গরম থেকে বাঁচতে ভূদেবীর নিকট বা বসুমাতার নিকট প্রার্থনা করা হত৷ ঠিক নিয়ম মেনে এই আষাঢ়ের ৭-ই হত সেই শুভক্ষণের সূচনা৷ বর্ষা কালের প্রথম বর্ষার আগমন ঘটত, সিক্ত হত ধরাতল৷ হিন্দু সনাতন ধর্মের এটাই প্রচলিত মত যে বসুমাতা বা ভূদেবী হন রজস্বলা ঋতুমতী৷ একজন নারীও যেমন ঋতুমতীর পরই নবজীবন ধারণে উদ্যত হন ঠিক তেমনই বসুমাতার রজস্রাবের পর প্রকৃতি নতুন করে প্রাণ পাই, মৃতপ্রায় গাছসকল নতুনভাবে সজীব হয়৷

আমাদের শাস্ত্রে যে ৫১টি শক্তিপীঠের উল্লেখ রয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম হল কামাখ্যা মন্দির। সতীপিঠের অন্যতম অসমের গুয়াহাটিতে অবস্থিত কামাক্ষ্যা মন্দির। দেবী রজঃস্বলা হওয়ায় তিন দিন মন্দিরের কপাট বন্ধ থাকে এই মন্দিরে সতীর গর্ভ এবং যোনি পড়েছিল। তন্ত্র সাধনার অন্যতম পীঠ এই মন্দির। প্রতি বছর অম্বুবাচীর তিন দিন কামাক্ষ্যা মন্দিরে বিশেষ উৎসব এবং মহা মেলার আয়োজন হয়। কামাখ্যা মন্দিরে এই উৎসবটি ২২ থেকে ২৬ জুন পর্যন্ত চলবে। এই সময় মন্দিরটি বন্ধ থাকে এবং ২৬ জুন মন্দিরটি পুনরায় খুলে দেওয়া হয়। এই সময়টি দেবী কামাখ্যার বার্ষিক ঋতুস্রাবকে চিহ্নিত করে এবং লক্ষ লক্ষ ভক্ত এই উৎসবে অংশ নিতে আসেন। দেশ- বিদেশ থেকে ভক্তেরা ভিড় জমান মন্দিরে। শাস্ত্রে কথিত আছে, “যথা পিন্ডে তথা ব্রহ্মাণ্ডে”। অর্থাৎ ব্রহ্মাণ্ডে যা ঘটে তার সব আমাদের শরীরেও ঘটে। যেমন দেবী মহামায়া নিজের মধ্যেই সৃষ্টি স্থিতি ও লয়ের খেলায় মেতে থাকেন একজন নারীও নিজের শরীরে সৃষ্টি, স্থিতি ও লয়ের খেলা খেলতে থাকেন।

অম্বুবাচী ও নারীর ঋতুমতী হওয়ার একটি পৌরাণিক আখ্যান আছে। দেবরাজ ইন্দ্র বৃত্রাসুরকে হত্যা করার ফলে ব্রহ্মহত্যার পাপী হন। এই পাপ স্খলন করার উপায় তিনি অন্বেষণ করতে থাকেন৷ ভগবান শ্রীবিষ্ণুর আদেশে ইন্দ্র নতজানু হয়ে পৃথিবী, বৃক্ষ, নদী ও সকল নারীদের দ্বারস্থ হন। তার পাপের এক চতুর্থাংশ করে ভাগ গ্রহণ করতে অনুরোধ করেন এই চার মাতাকে। সকলে দেবরাজ ইন্দ্রের আকুতি মঞ্জুর করেন তার পাপ সকলে ধারণ করেন৷ কিন্তু ইন্দ্রের সেই পাপস্খালন হেতু সমগ্র নারী জাতি তাই মাসিক রজস্বলা হন। এই রজঃরক্ত এতটাই পবিত্র যে ব্রহ্মহত্যার মতন গর্হিত পাপও ধৌত হয়ে যায়। ইন্দ্রের প্রার্থনায় সকল নারী জাতির মধ্যে স্বয়ং মহামায়া বিরাজ করেন। তাই, আমাদের ভারতবর্ষে সনাতন হিন্দু ধর্মে প্রত্যেক স্ত্রীলোক মাতা দূর্গার আরেক রূপ হয়। হিন্দু শাস্ত্রে ও বেদে পৃথিবীকে মা বলা হয়ে থাকে। পৌরাণিক যুগেও পৃথিবীকে ধরিত্রী মাতা বলে সম্বোধন করা হয়েছে।

বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষায় অম্বুবাচী, অমাবতী বলেও পরিচিত। ভারতের একাধিক স্থানে অম্বুবাচী উৎসব, রজঃউৎসব নামেও পালিত হয়। এই উৎসবের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে শাস্ত্রের নানা কাহিনি। প্রচলিত বিশ্বাস ঋতুকালে মেয়েরা অশুচি থাকেন। একই ভাবে মনে করা হয় পৃথিবীও সময়কালে অশুচি থাকেন। অম্বুবাচীর সঙ্গে জড়িয়ে আছে বহু আচার অনুষ্ঠান। এই তিনদিন সন্ন্যাসী এবং বিধবারা বিশেষ ভাবে পালন করেন। কোনও শুভ কাজও এই কয়েকদিন নিষিদ্ধ থাকে। শুধু তাই নয়, অম্বুবাচী চলাকালীন কৃষিকাজ বন্ধ রাখা হয়। তিনদিন পর অম্বুবাচী ফের কোনও মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান ও চাষাবাদ শুরু হয়। অম্বুবাচী চলাকালীন বিভিন্ন মন্দির ও বাড়ির ঠাকুর ঘরের মাতৃ শক্তির প্রতিমা বা ছবি কাপড় দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। সারাবছর জগতজননী মা আমাদেরকে আগলে রাখেন, সব রকম দেখাশোনা করেন। তাই এই তিনটে দিন আমাদেরও উচিত মায়ের একটু খেয়াল রাখা, একটু যত্ন নেওয়া। মা সকলের সর্বাঙ্গীণ মঙ্গল করুন এই কামনা করি।

প্রকৃতপক্ষে সৃষ্টির নিমিত্তে দেবী এই সময় যোগনিদ্রায় মগ্ন থাকেন, সেই কারণে এই সময় দেবীকে স্পর্শ করা উচিত নয়। উপরন্তু যথাসম্ভব একান্ত পরিবেশে নির্জন বাসের ব্যবস্থা করা উচিত। কোনভাবেই আমাদের কোন আচরণে মায়ের বিরক্তির উদ্রেক যেন না হয় সেদিকে সর্বদাই খেয়াল রাখতে হবে। সংকল্প বিহীন নিত্য পূজাপাঠ ও আচার অনুষ্ঠান যথাসম্ভব অনাড়ম্বর ভাবে পালন করা উচিত। কিন্তু এই সময় বেশী করে জপ-ধ্যান ইত্যাদি করা উচিত। এই কালে জপ করলে বহুগুণ ফল লাভ হয়। উচ্চৈঃস্বরে মন্ত্রপাঠ, ভজন এবং ঘন্টা-কাসর, ঢাক-ঢোল ইত্যাদি বাজানো এই সময় বর্জনীয়। ভূমি কর্ষণ বা ভূমিতে কোনরকম আঘাত করা এবং ক্ষৌরকর্ম ইত্যাদি এই তিন দিন নিষিদ্ধ। সকল সাধক ও ভক্তগণের এই সময় সংযত জীবনযাপন করা একান্ত কর্তব্য।
*পঞ্জিকা অনুসারে ২০২৫-র চলতি বছরে অম্বুবাচী প্রবৃত্তিঃ অর্থাৎ শুরু হবে ২২ জুন, ৭-ই আষাঢ় রবিবার দিবা ঘ ০২/৫৭ এবং ২৫ জুন, ১০ আষাঢ় বুধবার রাত ০৩/২১ গতে এর নিবৃত্তিঃ অর্থাৎ সমাপ্তি হবে ।*
ওঁ গুরু কৃপা হি কেবলম্ ….!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *