বাংলা সিনেমার প্রথম ‘আধুনিক নায়ক’ — শমিত ভঞ্জ।

(জন্ম : জানুয়ারি ১৯৪৪ | মৃত্যু : ২৪ জুলাই ২০০৩)
বাংলা সিনেমা জগতে আধুনিকতার সঞ্চারকারী এক অনন্য নাম হলেন শমিত ভঞ্জ। তাঁর অভিনয়-দক্ষতা, ব্যক্তিত্ব এবং পর্দায় উপস্থিতি তাঁকে এনে দিয়েছিল এক বিশেষ পরিচিতি। তিনি ছিলেন এমন এক অভিনেতা যিনি উত্তম-সৌমিত্র যুগে দাঁড়িয়েও নিজের আলাদা জায়গা তৈরি করতে পেরেছিলেন—এমনটা কজনই বা পেরেছেন?

জন্ম ও পারিবারিক পরিপ্রেক্ষিত

শমিত ভঞ্জ জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪৪ সালের জানুয়ারি মাসে, পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব মেদিনীপুর জেলার তমলুক শহরে। তাঁর পিতা প্রীতিময় ভঞ্জ এবং মা শীলা ভঞ্জ। পরিবারে তিনি ছিলেন তৃতীয় পুত্র; তাঁর দুই দাদা এবং এক ছোট বোন ছিলেন।

ছেলেবেলা : দুরন্ত ও আত্মবিশ্বাসী

ছোট থেকেই ছিলেন রীতিমতো দস্যিপনায় ভরপুর। একবার তাঁর ছোট বোন কৃষ্ণাকে একজন সহপাঠী চড় মারলে, সাত বছরের শমিত রেগে গিয়ে সেই সহপাঠীকে বালিতে পুঁতে দিয়েছিলেন। শিক্ষকরা এসে তাঁকে উদ্ধার করেন। আবার খেলার মাঠে পড়ে গিয়ে মাথা ফেটে গেলেও, মাটির মুঠো ঘষে উঠে দাঁড়িয়ে খেলায় ফেরেন—এমনটাই ছিল তাঁর সাহসী, অবিচল মানসিকতা।

অভিনয়ে আসার সংগ্রাম : একাগ্রতা ও জেদের প্রতিচ্ছবি

শমিতের স্বভাব ছিল ডানপিটে, তৎকালীন অর্থে একটু ‘দাদাগিরি টাইপের’। অভিনয়কে পেশা হিসেবে বেছে নিতে চাওয়ায় বাবার সঙ্গে ঝগড়া করে বাড়ি ছাড়েন। জীবনের এই যাত্রাপথে তিনি এমনকি নিজের বেকারত্বকে পাত্তা না দিয়ে, কলেজ পড়ুয়া প্রেমিকাকে বিয়ে করেন শুধুমাত্র নিজের সিদ্ধান্তে অটল থেকে।
অভিনয়ের প্রতি তাঁর আকর্ষণ এতটাই প্রবল ছিল যে, একদিন সরাসরি বিশিষ্ট চলচ্চিত্র নির্মাতা তপন সিংহ-এর ঘরে ঢুকে তাঁকে সোজাসুজি বলেন—

“অভিনয় করতে চাই!”

তপনবাবুও তাঁর এই আত্মবিশ্বাসে মুগ্ধ হয়ে সুযোগ দেন “আপনজন” ছবিতে। সেখান থেকেই শুরু নতুন অধ্যায়।

কর্মজীবন : প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাঝেই প্রতিষ্ঠা

শমিত ভঞ্জ বাংলা চলচ্চিত্র জগতে প্রবেশ করেন এমন এক সময়ে, যখন উত্তমকুমার ছিলেন বাংলা সিনেমার অপরাজেয় নায়ক এবং সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ও তখন নিজের অসাধারণ অভিনয় দিয়ে দর্শকদের মন জয় করছেন। এই দুই কিংবদন্তির মধ্যেও শমিত ভঞ্জ নিজের অভিনয়-দক্ষতায় গড়ে তোলেন একটি স্বতন্ত্র পরিচয়।
তিনি কাজ করেছেন বাংলা চলচ্চিত্র জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ পরিচালকদের সঙ্গে—যেমন সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, তপন সিংহ, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, গৌতম ঘোষ, তরুণ মজুমদার প্রমুখ। তাঁদের অনেক ছবিতে শমিতের অভিনয় আজও বাঙালির হৃদয়ে গেঁথে আছে।

উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রসমূহ

শমিত ভঞ্জ তাঁর কর্মজীবনে বহু মনে রাখার মতো সিনেমায় অভিনয় করেছেন। তার মধ্যে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ছবি হল:

আপনজন (১৯৬৮) – তপন সিংহ

অরণ্যের দিনরাত্রি (১৯৭০) – সত্যজিৎ রায়

ফুলেশ্বরী, দাদার কীর্তি, গণদেবতা – তরুণ মজুমদার

ফেরা – বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত

গুড্ডি (১৯৭১, হিন্দি) – হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায়

অন্যান্য ছবি: হাটে বাজারে (১৯৬৭), বনজ্যোৎস্না (১৯৬৯), আজকের নায়ক (১৯৭২), অসতী (১৯৭৪), মৃগয়া (১৯৭৬), কবিতা (১৯৭৭), শহর থেকে দূরে (১৯৮১), আবার অরণ্যে (২০০৩) প্রভৃতি।

শুধু বাংলা নয়, হিন্দি চলচ্চিত্রেও তিনি নিজের প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায় পরিচালিত বিখ্যাত ছবি “গুড্ডি”-তে তিনি নায়কের চরিত্রে অভিনয় করেন, যা প্রশংসিত হয় সর্বমহলে।

প্রয়াণ ও শেষ ছবি

জীবনের শেষ অধ্যায়ে তিনি ক্যানসারে আক্রান্ত হন। তবে সেই শারীরিক যন্ত্রণাও তাঁকে অভিনয় থেকে সরিয়ে রাখতে পারেনি। জীবনের শেষ ছবি “আবার অরণ্যে”-তে তিনি অসুস্থ অবস্থায় অভিনয় করেন, সেই ছবির কাজ শেষ করেন নিজের জীবনবলের জোরেই। শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ২০০৩ সালের ২৪ জুলাই।

উপসংহার : এক অসম্পূর্ণ অথচ দীপ্তিময় অধ্যায়

শমিত ভঞ্জ বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এক ‘আন্ডাররেটেড জেম’—একজন এমন অভিনেতা, যিনি উত্তম-সৌমিত্র যুগে নিজের আলাদা জায়গা করে নিয়েছিলেন। হয়তো তাঁর সময় তাঁকে পুরোপুরি চিনতে পারেনি, কিন্তু আজ তিনি বাংলা সিনেমার ‘আধুনিক নায়ক’ হিসেবে চিরকাল বেঁচে থাকবেন বাংলা চলচ্চিত্রপ্রেমী হৃদয়ে।

তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া ও বিভিন্ন ওয়েবপেজ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *