মেঘালয়ের উমিয়াম লেক – পাহাড়ের কোলে নীল জলের স্বর্গ।

মেঘালয়ের প্রকৃতি যেন এক চিত্রশিল্পীর ক্যানভাসে আঁকা রঙিন স্বপ্ন। শিলংয়ের কাছেই অবস্থিত উমিয়াম লেক (Umiam Lake) সেই স্বপ্নেরই এক বাস্তব রূপ — এক গভীর নীল হ্রদ, পাহাড়ে মোড়া সবুজ বন, আর আকাশে ভাসমান সাদা মেঘের মেলা। “বারাপানি” নামেও পরিচিত এই হ্রদটি শুধু একটি পর্যটন কেন্দ্র নয়, এটি মেঘালয়ের হৃদস্পন্দন, প্রকৃতি ও প্রশান্তির এক মায়াবী মিলনক্ষেত্র।


উমিয়াম লেকের ইতিহাস

উমিয়াম লেকের জন্ম কৃত্রিম হলেও, তার সৌন্দর্য সম্পূর্ণ প্রাকৃতিকের মতোই অপরূপ। ১৯৬০ সালে উমিয়াম নদীর ওপর বাঁধ নির্মাণ করে একটি জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য এই হ্রদ তৈরি করা হয়। মূল উদ্দেশ্য ছিল বিদ্যুৎ উৎপাদন, কিন্তু এর ফলে যে মনোমুগ্ধকর হ্রদের সৃষ্টি হয়, তা আজ বিশ্বের অন্যতম সুন্দর জলাধার হিসেবে পরিচিত।

এই লেকের দৈর্ঘ্য প্রায় ১০ বর্গকিলোমিটার, এবং শিলং শহর থেকে মাত্র ১৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। স্থানীয় খাসি ভাষায় “উমিয়াম” শব্দের অর্থ “জলের অশ্রু” — আর সত্যিই, এই হ্রদের শান্ত নীল জলে যেন প্রকৃতির আবেগ মিশে আছে।


শিলং থেকে উমিয়ামের পথে

শিলং থেকে উমিয়াম লেক যাওয়ার পথটি নিজেই এক রোমাঞ্চকর ভ্রমণ। পাহাড়ি রাস্তা ধরে গাড়ি যখন এগিয়ে চলে, চোখের সামনে খুলে যায় একের পর এক মেঘের রাজ্য। উমিয়াম লেকের কাছে পৌঁছেই যে দৃশ্যটি প্রথম চোখে পড়ে — তা যেন এক বিশাল নীল সমুদ্র পাহাড়ের কোলে নিদ্রিত।

হ্রদের চারপাশে ঘন পাইন বন, ঢেউ খেলানো তৃণভূমি আর শীতল হাওয়া মনকে মুহূর্তে প্রশান্ত করে দেয়।


‍♀️ লেকের জলে জলযাত্রা

উমিয়াম লেকে সবচেয়ে জনপ্রিয় কার্যকলাপ হলো বোটিং। এখানে মোটরবোট, প্যাডেলবোট, স্পিডবোট থেকে শুরু করে ক্রুজ পর্যন্ত বিভিন্ন ধরনের নৌকা ভাড়া পাওয়া যায়। লেকের জলে ভেসে পাহাড়ের প্রতিফলন দেখা, হালকা বাতাসে চুল উড়িয়ে নৌকা চালানো—এই অভিজ্ঞতা সত্যিই স্বপ্নময়।

সূর্যাস্তের সময় লেকের রূপ একেবারে অন্যরকম হয়ে ওঠে। আকাশের কমলা, লাল, বেগুনি রঙের ছোঁয়া জলে প্রতিফলিত হয়ে সৃষ্টি করে এক অপার্থিব দৃশ্য। অনেক পর্যটক এখানে এসে সন্ধ্যার আকাশের সঙ্গে নীরব জলধ্বনির সুরে হারিয়ে যান।


প্রকৃতি ও পাখির রাজ্য

উমিয়াম লেকের চারপাশে প্রচুর পরিযায়ী পাখি আসে, বিশেষ করে শীতকালে। যারা পাখিপ্রেমী বা ফটোগ্রাফার, তাদের জন্য এটি এক আদর্শ জায়গা। পাইন গাছের ফাঁক দিয়ে উড়ে যাওয়া সাদা বক, নীল জলকাদম্বিনী আর রঙিন প্রজাপতিদের উড়ান – সব মিলিয়ে এক অপূর্ব চিত্রকল্প।

লেকের তীরে অনেক জায়গায় পিকনিকের ব্যবস্থা রয়েছে। সকালে পাহাড়ি চা হাতে বসে লেকের দিকে তাকিয়ে থাকা যেন আত্মার এক শান্তি দেয়।


️ থাকার ব্যবস্থা ও ভ্রমণ অভিজ্ঞতা

উমিয়াম লেকের আশেপাশে বেশ কিছু সুন্দর রিসোর্ট ও হোটেল আছে। এর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় হলো “Umiam Lake Boathouse”“Meghalaya Tourism’s Orchid Lake Resort”। এখান থেকে লেকের দৃশ্য দেখা যায় একেবারে সামনে থেকে — সকালে সূর্যের আলোয় ঝলমলে জলের রঙ আর রাতে চাঁদের আলোয় ঝিকিমিকি প্রতিফলন।

প্রকৃতিপ্রেমী বা নবদম্পতিদের জন্য এটি এক আদর্শ গন্তব্য।


ভ্রমণের সেরা সময়

উমিয়াম লেক ভ্রমণের সেরা সময় অক্টোবর থেকে মার্চ। শিলংয়ের মতো এখানেও শীতকালে আবহাওয়া মনোরম থাকে এবং আকাশ পরিষ্কার থাকে বলে লেকের সৌন্দর্য আরও বেশি উপভোগ করা যায়। বর্ষার সময় যদিও বৃষ্টি বেশি হয়, তবে তখন লেকের চারপাশের সবুজ আরও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।


কিছু প্রয়োজনীয় টিপস

  • সকাল সকাল গেলে লেকের শান্ত সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়।
  • ক্যামেরা সঙ্গে রাখুন — প্রতিটি দৃশ্যই ছবির মতো।
  • লেকের কাছে একটি সুন্দর অর্কিড পার্ক রয়েছে, সেখানে ঘুরে আসা যায়।
  • প্রকৃতিকে অপরিষ্কার করবেন না — এখানে প্লাস্টিক ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।

উপসংহার

উমিয়াম লেক মেঘালয়ের রত্নসম এক স্থান, যেখানে নীরবতারও একটি সুর আছে। পাহাড়, আকাশ আর জলের এমন মেলবন্ধন খুব কমই দেখা যায়। এখানে এসে মনে হয়, সময় থমকে গেছে, কেবল বাতাসের ফিসফিসানি আর জলের ঢেউয়ের আওয়াজ শোনা যায়।

যারা শহরের কোলাহল থেকে পালিয়ে কিছুটা শান্তি খুঁজতে চান, তাদের জন্য উমিয়াম লেক এক পরম আশ্রয়। এটি শুধু একটি হ্রদ নয়, এটি প্রকৃতির বুকে লেখা এক নীল কবিতা।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *