
ভারতের পশ্চিম উপকূলে, আরব সাগরের বুকে ছোট্ট এক দ্বীপ— দিউ (Diu)। গুজরাটের সোরাষ্ট্র উপকূল থেকে সামান্য দূরে অবস্থিত এই দ্বীপটি একদিকে সমুদ্রের নীলাভ জলে ঘেরা, অন্যদিকে ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ইউরোপীয় স্থাপত্যে সমৃদ্ধ। দিউ এমন এক স্থান যেখানে প্রকৃতি, স্থাপত্য ও প্রশান্তি মিলেমিশে এক অনুপম ভ্রমণ গন্তব্য গড়ে তুলেছে।
️ দিউয়ের ভূগোল ও ইতিহাস
দিউ আসলে একটি ছোট দ্বীপ, যার আয়তন মাত্র ৪০ বর্গকিলোমিটার। তবে এই ছোট্ট জায়গাটিই বহু শতকের ইতিহাসের সাক্ষী। প্রাচীনকালে এটি গুজরাটের সৌরাষ্ট্র অঞ্চলের অংশ ছিল। পরে ১৬শ শতকে পর্তুগিজরা এখানে দুর্গ নির্মাণ করে এবং ১৯৬১ সাল পর্যন্ত এটি পর্তুগিজ শাসনের অধীনে ছিল।
১৯৬১ সালে ভারত সরকার ‘অপারেশন বিজয়’-এর মাধ্যমে দিউ-দমন-গোয়া দখল করে এবং এরপর থেকেই এটি ভারতের অংশ। আজও দিউয়ের রাস্তাঘাট, দুর্গ, ও চার্চগুলিতে সেই পর্তুগিজ ঐতিহ্যের ছাপ স্পষ্ট দেখা যায়।
দিউ ফোর্ট – অতীতের দুর্গ ও ইতিহাসের প্রতিধ্বনি
দিউ ভ্রমণের প্রথম গন্তব্য হওয়া উচিত দিউ ফোর্ট। ১৫৩৫ সালে পর্তুগিজরা এই বিশাল দুর্গ নির্মাণ করে। সমুদ্রের ধারে দাঁড়িয়ে থাকা এই দুর্গ একসময় ছিল নৌবাহিনীর ঘাঁটি। দুর্গের উপরে উঠে গেলে চোখে পড়বে আরব সাগরের অনন্ত জলরাশি, নিচে ঢেউ ভাঙার শব্দ আর বাতাসে এক অপার শান্তি।
এখানকার কামান, পাথরের প্রাচীর এবং পুরনো বাতিঘর আজও সেই ঐতিহাসিক যুগের সাক্ষী হয়ে আছে।
⛪ সেন্ট পল’স চার্চ – ইউরোপীয় স্থাপত্যের সৌন্দর্য
দিউয়ের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ সেন্ট পল’স চার্চ, যা ১৬০১ সালে পর্তুগিজদের দ্বারা নির্মিত। গথিক শৈলীর এই চার্চটি তার সূক্ষ্ম কাঠের খোদাই, বিশাল স্তম্ভ, এবং সুন্দর অলংকরণের জন্য বিখ্যাত। সাদা রঙের এই চার্চে একবার প্রবেশ করলে মনে হবে যেন ইউরোপের কোনো ছোট শহরে চলে এসেছেন।
নাগোয়া বিচ – শান্তির সাগরতট
নাগোয়া বিচ (Nagoa Beach) দিউয়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় সমুদ্রসৈকত। এখানে সমুদ্র শান্ত, ঢেউ মৃদু, আর চারিদিকে নারকেল গাছের ছায়া। এই সৈকতে ভ্রমণকারীরা স্নান, জেট স্কি, প্যারাসেইলিং বা বোট রাইড উপভোগ করতে পারেন।
যারা প্রকৃতির মাঝে প্রশান্তি খোঁজেন, তাদের জন্য নাগোয়া বিচ এক আদর্শ স্থান। সূর্যাস্তের সময় এখানে বসে সমুদ্রের রঙ বদলানোর দৃশ্য এক অনন্য অভিজ্ঞতা।
গোমতিমাতা বিচ – প্রকৃতির নির্জনতা
দিউয়ের পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত গোমতিমাতা বিচ, যেখানে জনসমাগম কম এবং প্রকৃতি আরও বেশি অবিকৃত। এখানে ঢেউয়ের শব্দ, বাতাসের শোঁ শোঁ আওয়াজ আর দূরে সাদা বালুরাশি মনকে শান্ত করে দেয়। এটি এক প্রকার “hidden gem” — প্রকৃতি-প্রেমীদের জন্য স্বর্গতুল্য।
দিউ মিউজিয়াম – ইতিহাস ও সংস্কৃতির ভাণ্ডার
পুরনো সেন্ট থমাস চার্চ-এর ভবনে তৈরি দিউ মিউজিয়াম আজ ইতিহাসের নিদর্শন বহন করছে। এখানে আছে প্রাচীন ভাস্কর্য, কাঠের শিল্পকর্ম, ধর্মীয় চিত্রকলা এবং পর্তুগিজ শাসনকালীন নানা নিদর্শন। এটি দেখে বোঝা যায় দিউ একসময় বাণিজ্য, ধর্ম ও রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিল।
দিউয়ের খাবার ও রাত্রিবাস
দিউয়ের খাবারে পর্তুগিজ স্বাদ এখনও বর্তমান। এখানে পাওয়া যায় সিফুড ডেলিকেসি, যেমন ফিশ কারি, প্রন মালাই, গ্রিলড লবস্টার, এবং কাঁকড়ার পদ।
থাকার জন্য সমুদ্রতীরবর্তী রিসর্ট থেকে শুরু করে বাজেট হোটেল—সবই পাওয়া যায়। বিশেষত নাগোয়া বিচের আশেপাশে অনেক সুন্দর রিসর্ট রয়েছে, যেখানে ভোরে বারান্দা থেকে সমুদ্রদৃশ্য উপভোগ করা যায়।
কীভাবে যাবেন দিউ
- বিমান পথে: নিকটতম বিমানবন্দর দিউ নিজেই। আহমেদাবাদ বা মুম্বাই থেকে নিয়মিত ফ্লাইট রয়েছে।
- রেল পথে: নিকটতম রেলস্টেশন ভেরাভল (Veraval), সেখান থেকে গাড়িতে প্রায় ২ ঘণ্টার পথ।
- সড়ক পথে: আহমেদাবাদ, রাজকোট বা সুরাট থেকে বাস ও ব্যক্তিগত গাড়িতে দিউ সহজেই পৌঁছানো যায়।
সেরা ভ্রমণ সময়
দিউ ভ্রমণের সেরা সময় অক্টোবর থেকে মার্চ মাস। এই সময়ে আবহাওয়া মনোরম থাকে, সমুদ্রতটে হাঁটাহাঁটি ও দর্শনীয় স্থান ঘোরা সবচেয়ে আরামদায়ক হয়।
শেষ কথা
দিউ এমন এক ভ্রমণ গন্তব্য যেখানে ইতিহাস, প্রকৃতি ও আধুনিকতার মেলবন্ধন ঘটেছে। এখানে একদিকে আছে পর্তুগিজ স্থাপত্যের ছোঁয়া, অন্যদিকে শান্ত সমুদ্রতটে মুগ্ধতা ছড়ানো প্রকৃতি।
যে কেউ যদি শহরের কোলাহল থেকে একটু মুক্তি চান, তবে দিউ হবে তার জন্য এক পরম আশ্রয় — সমুদ্রের বুকে শান্তির দ্বীপ।












Leave a Reply