
ভারতের দক্ষিণ উপকূলের মুক্তোর শহর চেন্নাই মানেই সাগর, সূর্য, আর এক অন্তহীন নোনাজলের সুর। এই শহরের গর্ব, এর প্রাণকেন্দ্র, আর ভ্রমণপ্রেমীদের স্বর্গ — সেই বিখ্যাত মারিনা বিচ (Marina Beach)। বঙ্গোপসাগরের তীরে প্রায় ১৩ কিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত এই সৈকত শুধু ভারতের দীর্ঘতম নয়, বরং বিশ্বেরও অন্যতম বৃহৎ সমুদ্রসৈকত। এর নীল তরঙ্গ, সোনালি বালি আর সূর্যাস্তের অপার সৌন্দর্য একে করে তুলেছে অনন্য।
ভোরের আলোয় মারিনা বিচ
চেন্নাই শহরে সকালের শুরু যেন হয় মারিনা বিচে।
ভোরবেলায় যখন আকাশে প্রথম সূর্যরশ্মি পড়ে, তখন সাগরের জল ঝিকমিক করে ওঠে সোনার মত। সেই মুহূর্তে হাঁটতে হাঁটতে বাতাসে ভেসে আসে নোনাজলের গন্ধ, দূরে জেলেদের নৌকা দুলে ওঠে তরঙ্গে, আর সাগরের ঢেউয়ের শব্দে মিলেমিশে যায় মানুষের প্রাণের স্পন্দন।
প্রতিদিন শত শত মানুষ আসে ভোরবেলায় — কেউ জগিং করতে, কেউ ধ্যান করতে, কেউ আবার শুধু প্রকৃতির কোলে একটু শান্তি খুঁজতে।
সৈকতের বিস্তার ও সৌন্দর্য
মারিনা বিচের দৈর্ঘ্য প্রায় ১৩ কিমি, শুরু হয়েছে ফোর্ট সেন্ট জর্জ (Fort St. George) থেকে এবং শেষ হয়েছে বেসান্ত নগর (Besant Nagar) পর্যন্ত। এই বিশাল বালুকাবেলায় হাঁটতে হাঁটতে যেন শেষ দেখা যায় না। সৈকতের প্রতিটি কোণেই আলাদা গল্প — কোথাও শিশুরা ঘুড়ি উড়াচ্ছে, কোথাও পরিবার নিয়ে পিকনিক, আবার কোথাও স্থানীয় শিল্পীরা শাঁখা-বালা বিক্রি করছেন পর্যটকদের হাসিমুখে।
বালির ওপর ছুটে বেড়ানো ঘোড়া, ঢেউয়ের মাঝে ছিটকে আসা ঠান্ডা জল, আর আকাশে ভেসে থাকা রঙিন ঘুড়ির মেলা — মারিনা বিচ যেন এক জীবন্ত উৎসব।
️ ইতিহাস ও ঐতিহ্য
মারিনা বিচ কেবল একটি সৈকত নয়, এটি চেন্নাইয়ের ইতিহাস ও সংস্কৃতির প্রতীক।
১৮৮০ সালের দিকে ব্রিটিশ গভর্নর মাউন্ট স্টুয়ার্ট এলফিনস্টোন গ্রান্ট-ডাফ এই সৈকতকে আধুনিক রূপ দেন। তিনি উপকূলের পাশে গাছপালা রোপণ ও রাস্তা নির্মাণ করেন, যার ফলেই আজকের সুন্দর মারিনা গড়ে ওঠে।
সৈকতের আশেপাশে দেখা যায় বহু ঐতিহাসিক স্থাপনা ও ভাস্কর্য — যেমন
- অন্নাদুরাই ও এম.জি. রামচন্দ্রনের সমাধি,
- মহাত্মা গান্ধীর মূর্তি,
- তামিল কবি সুব্রহ্মণ্য ভারতীর স্মারক,
- আইসিএস অফিসারদের পুরোনো স্থাপত্য ভবন।
এই স্থান শুধু সৌন্দর্যের নয়, স্মৃতি আর ইতিহাসেরও এক আশ্রয়।
সন্ধ্যার মারিনা – প্রাণের মেলা
দিনের শেষে যখন সূর্য অস্ত যায়, তখন মারিনা বিচ যেন এক নতুন রূপ নেয়।
সোনালি আভায় রাঙা আকাশে সাগরের জলও হয়ে ওঠে রক্তিম। সৈকতের পাশে তখন শুরু হয় এক উৎসব —
বেলুন বিক্রেতা, ঝালমুড়ি ও ভেলপুরি ওয়ালা, ঘোড়ার গাড়ি, আইসক্রিম বিক্রেতা, আর সঙ্গীতের তালে তালে মানুষজনের আনন্দ।
সন্ধ্যার মারিনা এক অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা — যেখানে ঢেউয়ের ছন্দে শহরের হৃদস্পন্দন ধ্বনিত হয়।
সৈকতের পাশে দর্শনীয় স্থান
মারিনা বিচের আশেপাশেই রয়েছে আরও অনেক আকর্ষণীয় স্থান —
- লাইটহাউস (Light House): এখান থেকে সমুদ্রের দৃশ্য দেখা যায় ৪৬ মিটার উঁচু থেকে।
- সেন্ট জর্জ ফোর্ট: ব্রিটিশ আমলের প্রাচীন দুর্গ।
- মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক ভবন,
- সেনেট হাউস,
- তামিলনাড়ু পুলিশ মেমোরিয়াল,
- এবং নিকটবর্তী সান থোম বাসিলিকা চার্চ।
প্রতিটি স্থানেই আছে একেকটা ইতিহাস, একেকটা আলাদা গল্প।
☕ ভ্রমণ পরামর্শ
- অবস্থান: চেন্নাই সেন্ট্রাল রেলস্টেশন থেকে প্রায় ৪ কিমি দূরে।
- ️ সময়: ভোর ৫টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত খোলা থাকে।
- সতর্কতা: সাগরে সাঁতার কাটা নিষিদ্ধ, কারণ ঢেউ অনেক গভীর ও প্রবল।
- খাবার: সৈকতের আশেপাশে স্থানীয় খাবারের দোকান ও কফি হাউসের অভাব নেই।
শেষ কথা
চেন্নাইয়ের মারিনা বিচ কেবল একটি পর্যটন কেন্দ্র নয়, এটি এক অনুভব — প্রকৃতি, মানুষ ও ইতিহাসের এক মিলনমেলা। এখানে গেলে বোঝা যায় কেন এই সৈকত তামিল সংস্কৃতির আত্মার সঙ্গে এত গভীরভাবে জড়িয়ে।
যখন সূর্য সমুদ্রের কোলে ডুবে যায়, তখন মনে হয় — জীবনও যেন এই সাগরের মতো বিশাল, শান্ত আর অফুরন্ত।
মারিনা বিচে একবার গেলে, সেই ঢেউয়ের সুর, সেই বালির গন্ধ আর সেই আকাশের রঙ চিরদিন হৃদয়ে রয়ে যায়।












Leave a Reply