
মধ্যপ্রদেশের হৃদয়ভূমি ভোপাল শহর থেকে মাত্র ৪৬ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত সাঁচি (Sanchi), ভারতের বৌদ্ধ ঐতিহ্যের এক অনন্য প্রতীক। সবুজ পাহাড়ের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা সাঁচি স্তূপ (Sanchi Stupa) শুধু একটি স্থাপত্য নয়, বরং এটি ইতিহাস, ধর্ম, দর্শন ও শিল্পকলার এক অপূর্ব সমন্বয়। ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী এই স্থানটি ভারতের বৌদ্ধ ইতিহাসের সবচেয়ে প্রাচীন ও সংরক্ষিত নিদর্শনগুলির একটি।
️ ইতিহাসের পাতায় সাঁচি
সাঁচি স্তূপের ইতিহাস প্রায় খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দী পর্যন্ত প্রসারিত। মহান সম্রাট অশোক যখন বৌদ্ধধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করেন, তখন তিনি শান্তি ও ধর্ম প্রচারের প্রতীক হিসেবে এই বিশাল স্তূপটি নির্মাণ করেন। মূল স্তূপটি তৈরি হয়েছিল ইট ও পাথর দিয়ে, পরে শুঙ্গ ও সাতবাহন রাজবংশের আমলে এর সৌন্দর্য বৃদ্ধি করা হয় পাথরের ঘের ও খোদাই করা তোড়ণ (Torana) দিয়ে।
এই স্তূপে অশোকের সময়কার কিছু ধর্মাবশেষ (relics) সংরক্ষিত আছে বলে ইতিহাসবিদরা মনে করেন।
স্থাপত্যের জাদু
সাঁচি স্তূপের গঠন অনন্য।
এটি একটি গোলাকার গম্বুজাকৃতি স্থাপনা (hemispherical dome), যা ‘মহাপরিনির্বাণ’-এর প্রতীক — অর্থাৎ বুদ্ধের চূড়ান্ত শান্তির অবস্থা।
স্তূপটির উপরে আছে একটি চক্র বা ছত্রভেদ (harmika), যা বুদ্ধের ধর্মচক্রকে নির্দেশ করে।
স্তূপের চারদিক ঘিরে আছে চারটি তোড়ণ (gateway) — পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর ও দক্ষিণ দিকে।
এই তোড়ণগুলিতে অসাধারণ পাথর খোদাই করা দৃশ্য দেখা যায় —
- বুদ্ধের জীবনের নানা পর্ব (জন্ম, বোধিলাভ, ধর্ম প্রচার, মহাপরিনির্বাণ),
- জাতক কাহিনি (বুদ্ধের পূর্বজন্মের গল্প),
- হস্তী, অশ্ব, বোধিবৃক্ষ, ধর্মচক্র প্রভৃতি প্রতীকচিত্র।
এই খোদাইগুলিতে কোনো মানব আকৃতি নেই, বরং বুদ্ধকে প্রতীকীভাবে প্রকাশ করা হয়েছে — যেমন সিংহাসন, পদচিহ্ন, বা বৃক্ষের মাধ্যমে। এটাই সাঁচির শিল্পকলার বৈশিষ্ট্য।
️ শান্তির আধ্যাত্মিক আবেশ
সাঁচি স্তূপে পৌঁছানোর পর এক অদ্ভুত প্রশান্তি অনুভব হয়।
সবুজ পাহাড়ের কোলে নীরব দাঁড়িয়ে থাকা এই স্তূপ যেন এক অন্তহীন ধ্যানের প্রতীক।
চারপাশে শোনা যায় শুধু পাখির ডাক, হালকা বাতাসের শব্দ, আর মনকে ভরে দেয় সেই প্রাচীন শান্তির স্পন্দন।
অনেক বৌদ্ধ ভিক্ষু এখানে ধ্যান করেন, পর্যটকরা নীরবে হাঁটেন স্তূপের চারপাশে প্রদক্ষিণপথে (circumambulation path), যাকে বলে “প্রদক্ষিণা”।
এ যেন আত্মাকে পরিশুদ্ধ করার এক যাত্রা।
সাঁচি কমপ্লেক্সের অন্যান্য নিদর্শন
সাঁচি শুধু একটি স্তূপ নয়, এটি এক বৃহৎ ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক কমপ্লেক্স।
এখানে রয়েছে —
- সাঁচি স্তূপ নং ২ ও ৩,
- অশোক স্তম্ভ (Ashokan Pillar),
- বৌদ্ধ বিহার বা মঠের ধ্বংসাবশেষ,
- চৈত্যগৃহ,
- এবং একটি ছোট জাদুঘর (Sanchi Museum), যেখানে সংরক্ষিত আছে প্রাচীন মূর্তি, ধাতব বস্তু, এবং অশোকের মূল স্তম্ভের অংশবিশেষ।
অশোক স্তম্ভের উপর খোদাই করা সিংহচূড় চিহ্ন (Lion Capital) পরবর্তীকালে ভারতের জাতীয় প্রতীকে স্থান পেয়েছে — যা আজও ভারতের গর্বের প্রতীক।
ভ্রমণ অভিজ্ঞতা
ভোপাল থেকে সকালে গাড়ি নিয়ে রওনা হলে প্রায় দেড় ঘণ্টায় পৌঁছানো যায় সাঁচিতে। পাহাড়ের গা বেয়ে উপরে উঠলে সামনে উদ্ভাসিত হয় বিশাল গম্বুজ, যেন সময় থমকে গেছে খ্রিষ্টপূর্ব যুগে।
সেখানে দাঁড়িয়ে মনে হয় — এখানে বুদ্ধ একদিন হেঁটেছিলেন, এখানে অশোক ধ্যান করেছিলেন, আর এখান থেকেই শান্তির বার্তা ছড়িয়ে পড়েছিল সমগ্র ভারত ও এশিয়া জুড়ে।
ভ্রমণের সময় সূর্যাস্তের মুহূর্তে স্তূপের পাথরগুলিতে যখন সোনালি আলো পড়ে, তখন দৃশ্যটি অবর্ণনীয়।
কীভাবে যাবেন
- নিকটতম শহর: ভোপাল (৪৬ কিমি)
- নিকটতম রেলস্টেশন: ভোপাল জংশন বা বিদিশা (১০ কিমি)
- নিকটতম বিমানবন্দর: রাজা ভোজ বিমানবন্দর, ভোপাল
- সময়: প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত খোলা
- প্রবেশমূল্য: ভারতীয়দের জন্য ₹২৫, বিদেশিদের জন্য ₹৩০০ (আর্কিওলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া কর্তৃক নির্ধারিত)
ভ্রমণ টিপস
- সকালে বা বিকেলের দিকে ঘুরলে রোদ কম থাকে এবং ছবি তোলার জন্য আলো সবচেয়ে ভালো।
- আরামদায়ক জুতো ও টুপি সঙ্গে রাখুন, কারণ কিছুটা উঁচুতে হাঁটতে হয়।
- স্থানীয় গাইড নিলে ইতিহাসের সূক্ষ্ম দিকগুলো আরও ভালোভাবে জানা যায়।
শেষকথা
সাঁচি স্তূপ কেবল এক ধর্মীয় স্থাপনা নয়; এটি ভারতের আত্মা, যা বুদ্ধের করুণা ও শান্তির বার্তা বহন করে হাজার বছর ধরে।
এখানে এসে মনে হয়, পৃথিবীর সমস্ত অস্থিরতা, হিংসা ও বিভেদের মাঝে একটিই সত্য — শান্তি।
সাঁচির স্তূপ তাই কেবল ইতিহাসের নিদর্শন নয়, এটি মানুষের হৃদয়ে স্থায়ী হয়ে থাকা এক চিরন্তন ধ্যানমূর্তি, যা প্রতিটি আগন্তুককে শেখায় —
“অন্তরের শান্তিই প্রকৃত মুক্তি।”












Leave a Reply