হুইলচেয়ারে বসেই ৬২ কিলোমিটার পাড়ি! ভাইফোঁটা দিতে বাপের বাড়ি গেলেন রমা ভৌমিক চ্যাটার্জি।

দক্ষিণ দিনাজপুর, নিজস্ব সংবাদদাতাঃ- বোনের প্রতি ভাইয়ের ভালোবাসার অনন্য উদাহরণ হল ভাই ফোঁটা। আর এই ভাইফোঁটায় শারীরিক প্রতিবন্ধকতা যে কোন বাধা হতে পারে না তার চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল রমা ভৌমিক চ্যাটার্জি। ২০১৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি এক দুর্ঘটনায় বছর চল্লিশের গৃহবধূ রমার কোমর থেকে পা পর্যন্ত অসাড়। চলাফেরার সঙ্গী বলতে হুইল চেয়ার। কিন্তু তাতে কি হয়েছে। অদম্য জেদ আর ইচ্ছা শক্তির জেরে বালুরঘাটে তার শ্বশুরবাড়ি থেকে প্রায় ৬২ কিলোমিটার দূরে গঙ্গারামপুর সাব ডিভিশনের ঠ্যাঙ্গাপাড়াতে অটোতে করে বৃহস্পতিবার সকাল আটটার সময় স্বামী শিব শংকর চ্যাটার্জী ও একমাত্র মেয়ে রূপমাকে নিয়ে বাপের বাড়ি গিয়ে তার পাঁচ ভাইকে ভাইফোঁটা দিলেন। এত শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে নিয়ে এতদূর প্রায় ৬২ কিলোমিটার ঠ্যাঙ্গাপাড়াতে গিয়ে ভাইফোঁটা দিয়ে কেমন লাগলো জিজ্ঞেস করতে চোখ জলে ভরে ওঠে রমার। বললেন, “এই দিনটা আমার কাছে ভীষণ বিশেষ একটি দিন। আমরা পাঁচ ভাই, পাঁচ বোন। প্রত্যেক বছর এই দিনটিতে আমি বাপের বাড়ি গিয়ে ভাইদের ভাই ফোঁটা দি। এ বছরও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ভাইদের জন্য নিজের সাধ্যমত উপহার নিয়ে গেছি। পরিবারের সবার সঙ্গে এক হতে পেরে ভীষণ ভালো লাগছে।”
২০০৮ সালে বিয়ে হয়ে রমা বালুরঘাটে আসেন। আর্থিক সমস্যা ছিল নিত্যসঙ্গী। স্বামী সামান্য জজমানি করেন এবং টুকটাক সংবাদ পরিবেশনের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। বিয়ের পর থেকে আর্থিক অনটনকে নিত্য সঙ্গী করে তাদের দিন চলছিল। কিন্তু সবকিছু ওলট-পালট হয়ে যায় ২০১৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি। ঐদিন বালুরঘাটের বাড়িতে ছাদে উঠে ঠাকুর পূজা করার জন্য পা পিছলে ছাদ থেকে পড়ে যান রমা। কিছুক্ষণের জন্য অজ্ঞান হয়ে যান। তারপর বাড়ির লোকজন ধরাধরি করে প্রথমে তাকে বালুরঘাট জেলা হাসপাতাল তারপর মালদা এবং কলকাতাতে অস্থি বিশেষজ্ঞর দ্বারা তার চিকিৎসা হয়। কষ্ট করে তার স্বামী তাকে ব্যাঙ্গালোরেও চিকিৎসা করানোর জন্য নিয়ে গেছিলেন। সব জায়গার চিকিৎসকেরা তাকে একই কথা বলে যে তিনি আর কোনদিনই উঠে দাঁড়াতে পারবেন না। কারণ তার মেরুদন্ডের হাড় টুকরো টুকরো হয়ে যায় এবং মেরুদন্ডের সঙ্গে যে নার্ভের সাহায্যে হাঁটাচলা করা হয় সেই নার্ভ পেঁচিয়ে জড়িয়ে গেছে। অত্যন্ত জটিল পরিস্থিতিতে তার অপারেশন করেন কলকাতার এস এস কে এম হাসপাতালের অস্থিরোগ বিশেষজ্ঞ। তারপর থেকেই বিছানায় শয্যাশায়ী রমা। দীর্ঘদিন ফিজিওথেরাপির মাধ্যমে বিছানা থেকে কোন রকমে উঠে বসতে পেরেছেন। সাফল্য বলতে ব্যাস ওইটুকুই। তারপর থেকেই সঙ্গী হলো হুইল চেয়ার। স্নান বা নিত্য প্রয়োজনীয় কাজকর্মের জন্য স্বামীর উপর নির্ভরশীল রমা। কিন্তু হার না মানা লড়াইয়ের জেরে তিনি এখন রান্না এবং সেলাইয়ের কাজ করছেন। স্বামী এবং মেয়ে কিভাবে তাকে সহযোগিতা করছেন বলতে গিয়ে রমা বলেন, “আমার স্বামী এবং মেয়ের উপর আমি ভীষণ কৃতজ্ঞ। ওরা না থাকলে আমি এখন যে অবস্থায় আছি সেই অবস্থায় আসতে পারতাম না। ওদের কথাতেই আজকে আমি বাপের বাড়িতে গিয়ে ভাইদের ভাই ফোঁটা দিলাম।”
সংসার চালাতে কোন অসুবিধা হচ্ছে না, জিজ্ঞেস করাতে রমা বললেন, “অসুবিধা তো হচ্ছেই। আমার স্বামীর আয় সামান্য। তাই আমি মেয়ে এবং মহিলাদের বিভিন্ন পোশাক তৈরি করে কোন রকমের সংসার করছি। মেয়ে দশম শ্রেণীতে বালুরঘাট গার্লস স্কুলে পড়ে। ওই এখন আমার স্বপ্ন। আমি কৃতজ্ঞ আমাদের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপর। রাজ্য সরকার থেকে প্রতিবন্ধী ভাতা ১০০০ টাকা পাই। তাছাড়া লক্ষীর ভান্ডার থেকে আরও ১০০০ টাকা পাই। এই টাকা আমার সংসারে কাজে লাগে। বিভিন্ন রকমের ওষুধপত্র এবং মাঝে মাঝে ফিজিওথেরাপি করার জন্য যে টাকা লাগে তার সংস্থান এখান থেকেই হয়। স্বামীর পাশে আমি সব সময় আমার শারীরিক প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও আছি।”
স্বামী শিব শংকর চ্যাটার্জি বলেন, “প্রতিবারই ভাই ফোঁটার সময় আমি ওকে নিয়ে আমার শ্বশুরবাড়ি ঠ্যাঙ্গাপাড়াতে যাই। ওর ভাই ফোঁটা আমি থাকতে কখনো বন্ধ হতে দেব না। রমার অটোতে উঠতে বা নামতে ভীষণ কষ্ট হয়। হুইল চেয়ারে করে ধরাধরি করে ওকে অটোতে ওঠাতে হয়। আবার সেখান থেকে নামাতে হয়। হুইল চেয়ারে বসেই ও ভাইদের ভাই ফোঁটা দেয়। ওকে এরকম অবস্থায় দেখে আমি আমার নিজের চোখের জল ধরে রাখতে পারি না। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি ও যেন ভালো থাকে, সুস্থ থাকে।”
ভাই ফোঁটার দিন, বোন রমা কে পেয়ে দাদা সমীরন ভৌমিক উচ্ছ্বসিত। চোখে জল ধরে রাখতে পারেন না, যখন অটো এসে বাড়ির সামনে থামল। তখন সমীরন ই গিয়ে তার বোনকে অটো থেকে নামিয়ে বাড়িতে নিয়ে আসেন। শুরু হয় ভাই ফোঁটা। শঙ্খ, উলুধ্বনি এবং মিষ্টি সহযোগে ধান দুর্বার আশীর্বাদে ভাইফোঁটা সম্পন্ন হয়। দুপুরে খাওয়া দাওয়া হয় বেশ জমিয়ে।
সমীরন বলেন, “আমার বোনের মতো যারা এরকম শারীরিক প্রতিবন্ধকতায় ভুগছে আমার বোন তাদের কাছে একটা আদর্শ উদাহরণ। ভালো থাকার অদম্য ইচ্ছা শক্তির দ্বারা সমস্ত প্রতিবন্ধকতাকে যে জয় করা যায় তা রমা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। আমি গর্বিত আমার বোনের জন্য। ও ভালো থাকুক এই আশীর্বাদ করলাম আজ ভাই ফোঁটা তে। প্রতি বছরই এই বিশেষ দিন ফিরে ফিরে আসুক ভাই এবং বোনেদের জীবনে।”
দিনটা ভালোভাবে কাটিয়ে রমা আবার তার স্বামী এবং মেয়েকে নিয়ে সন্ধ্যায় বালুরঘাটের উদ্দেশ্যে চোখে জল নিয়ে রওনা হন। পরদিন থেকেই আবার শুরু হবে জীবন সংগ্রাম এবং বেঁচে থাকার লড়াই। ভাই ফোঁটার এই বিশেষ দিন রমার জীবনে যেন একটু টাটকা হওয়া এবং অক্সিজেন যুগিয়ে দিল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *