পুরুলিয়ার পাঞ্চেত জলাধার : পাহাড়, নদী আর সূর্যাস্তের সোনালি জলে ভেসে থাকা এক অপূর্ব স্বপ্নভূমি ।

বাংলার পশ্চিম প্রান্তে, পুরুলিয়া জেলার সবুজ-ধূসর পাহাড়ের কোলে, বয়ে চলা দামোদর নদীকে বুকে জড়িয়ে আছে এক অনিন্দ্য সুন্দর স্থান— পাঞ্চেত জলাধার (Panchet Dam)। এটি শুধু একটি বাঁধ নয়, বরং প্রকৃতি, প্রকৌশল ও পর্যটনের এক অনন্য মেলবন্ধন। নীল আকাশের নিচে শান্ত জলের বিশাল বিস্তার, চারপাশে পাহাড়-জঙ্গলে ঘেরা প্রকৃতি, আর সন্ধ্যাবেলার সূর্যাস্তের দৃশ্য— সব মিলিয়ে পাঞ্চেত একবার গেলে ভুলে থাকা যায় না।


পাঞ্চেত জলাধারের পরিচয়

পাঞ্চেত জলাধারটি অবস্থিত দামোদর নদীর উপর, পুরুলিয়া জেলার রঘুনাথপুর মহকুমার অন্তর্গত পাঞ্চেত পাহাড়ের পাদদেশে। এটি দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশন (DVC)-এর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বাঁধ।
১৯৫৯ সালে নির্মিত এই বাঁধটি ভারতের অন্যতম প্রাচীন বহু-উদ্দেশ্য জলাধার প্রকল্পের একটি অংশ, যা মূলত জল সংরক্ষণ, বন্যা নিয়ন্ত্রণ, সেচ এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য গঠিত হয়েছিল।

জলাধারটি প্রায় ৬,০০০ হেক্টর এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এবং এর পাশেই রয়েছে এক মনোরম পাঞ্চেত পাহাড়, যা এই অঞ্চলের সৌন্দর্যকে আরও বৃদ্ধি করেছে।


️ পাঞ্চেত জলাধারের সৌন্দর্য

পাঞ্চেতে পৌঁছালে প্রথমেই চোখে পড়ে জলের অপরিসীম নীলিমা। চারপাশে ঘন সবুজ পাহাড়, মাঝে বিশাল জলাশয়, আর দূরে ভেসে থাকা নৌকা— প্রকৃতির এমন সুষমা শহরের কোলাহল থেকে মুক্তি দেয়।

দুপুরের তপ্ত রোদে কিংবা সন্ধ্যার কোমল আলোয়, পাঞ্চেতের জলরাশি যেন রঙ বদলায়। সন্ধ্যাবেলায় যখন সূর্য ডোবে, আকাশ রাঙিয়ে ওঠে লাল, কমলা আর সোনালি আভায়— তখন মনে হয় প্রকৃতি যেন নিজের রঙতুলি দিয়ে জলকে রাঙিয়ে তুলেছে।


️ প্রকৌশল ও ঐতিহাসিক তাৎপর্য

পাঞ্চেত বাঁধ ভারতের স্বাধীনতার পর নির্মিত প্রথম দিকের বড় জলাধারগুলির একটি। এর দৈর্ঘ্য প্রায় ৬,৭৭০ মিটার এবং উচ্চতা ৪৫ মিটার। দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশন (DVC)-এর এই বাঁধ দামোদর নদীর প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে এবং ঝাড়খণ্ড ও পশ্চিমবঙ্গের কৃষিক্ষেত্রে জল সরবরাহ করে।

বাঁধটির গঠন প্রকৌশল দিক থেকে অত্যন্ত মজবুত ও আধুনিক, যা সেই সময়ে ভারতীয় প্রকৌশল ইতিহাসে এক বড় অধ্যায়ের সূচনা করেছিল।


আশেপাশের পর্যটন আকর্ষণ

পাঞ্চেতে শুধু জলাধারই নয়, আশেপাশে রয়েছে আরও অনেক দর্শনীয় স্থান—

পাঞ্চেত পাহাড়

জলাধারের পাশেই এই পাহাড়টি অবস্থিত। ট্রেকার ও প্রকৃতিপ্রেমীদের কাছে এটি একটি প্রিয় স্থান। শীর্ষে উঠে চারপাশের প্রাকৃতিক দৃশ্যপট দেখা সত্যিই অতুলনীয়।

পুরাতন পাঞ্চেত রাজবাড়ি ও দুর্গ

এটি একসময় স্থানীয় রাজাদের আবাসস্থল ছিল। যদিও বর্তমানে ধ্বংসপ্রাপ্ত, তবু সেই স্থাপত্যের ভগ্ন সৌন্দর্যে আজও ইতিহাসের ছোঁয়া লেগে আছে।

আয়োধ্যা পাহাড়

পাঞ্চেত থেকে প্রায় ২৫ কিমি দূরে অবস্থিত এই পাহাড়টি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অসাধারণ ঠিকানা। একসঙ্গে ঘুরে দেখা যায় দুটি স্থানই।

বোটিং ও পিকনিক স্পট

জলাধারের পাশে বোটিং-এর সুযোগ রয়েছে। পর্যটকেরা এখানে নৌকায় চড়ে জলের ওপর ভেসে বেড়াতে পারেন। এছাড়া বাঁধের আশেপাশে পিকনিকের জন্য নির্দিষ্ট স্থানও রয়েছে।


প্রকৃতি ও বন্যপ্রাণ

পাঞ্চেতের আশেপাশে ঘন বনাঞ্চল রয়েছে, যেখানে নানা প্রজাতির পাখি দেখা যায়। ভোরবেলায় জলাধারের ধার দিয়ে হাঁটলে পাখির ডাক ও হালকা কুয়াশা মিলিয়ে যে দৃশ্য তৈরি হয়, তা যেন কবিতার মতো। শীতকালে এখানে অভিবাসী পাখিদের আগমন ঘটে, যা পক্ষীপ্রেমীদের কাছে এক বড় আকর্ষণ।


️ কীভাবে পৌঁছাবেন

  • ট্রেনে: কলকাতা থেকে আসানসোল বা রঘুনাথপুর স্টেশনে নামতে হয়। সেখান থেকে ট্যাক্সি বা গাড়ি ভাড়া করে পাঞ্চেত পৌঁছানো যায়।
  • বাসে: পুরুলিয়া বা দুর্গাপুর থেকে নিয়মিত বাস চলে পাঞ্চেতের দিকে।
  • নিজস্ব গাড়িতে: NH-19 (পুরাতন GT রোড) ধরে দুর্গাপুর হয়ে পাঞ্চেত যাওয়া যায়। কলকাতা থেকে দূরত্ব প্রায় ২৫০ কিমি

থাকার ব্যবস্থা

পাঞ্চেতের আশেপাশে বেশ কিছু সুন্দর পর্যটন বাংলো ও রিসোর্ট রয়েছে—

  • DVC গেস্ট হাউস
  • পাঞ্চেত ট্যুরিস্ট লজ
  • স্থানীয় হোমস্টে বা পুরুলিয়া শহরের হোটেলেও থাকা যায়।

খাওয়া-দাওয়া

এখানে স্থানীয় খাবারের স্বাদ অনন্য— দেশি মুরগি, পাথরচাপা মাছ, পলাশ ফুলের বড়া, মহুয়া দিয়ে তৈরি স্থানীয় পানীয়— সব কিছুতেই আছে গ্রামবাংলার সরলতা। পিকনিকের মৌসুমে স্থানীয় দোকানেও খাবার ও চা-কফির ব্যবস্থা থাকে।


️ ভ্রমণের উপযুক্ত সময়

অক্টোবর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত সময়টি ভ্রমণের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত। শীতের হালকা ঠান্ডা আর নির্মল আবহাওয়া পাঞ্চেত ভ্রমণকে করে তোলে মনোরম। বর্ষাকালে বাঁধে জলের পরিমাণ বেড়ে যায়, তখন জলাধারের দৃশ্য হয় আরও রূপময়, তবে কিছুটা বিপজ্জনকও হতে পারে।


শেষ কথা

পাঞ্চেত জলাধার কেবল একটি বাঁধ নয়— এটি প্রকৃতি ও মানুষের মিলনের এক অনন্য উদাহরণ। এখানে প্রকৃতির সৌন্দর্য যেমন মুগ্ধ করে, তেমনি মানুষের সৃষ্টিশীলতার প্রতীকও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। পাহাড়, জল, সূর্যাস্ত, পাখির ডাক— সব মিলে পাঞ্চেত এমন এক জায়গা যেখানে মন শান্ত হয়, আত্মা প্রশান্তি পায়।


“যেখানে পাহাড় মিশেছে জলে,
আর সূর্যাস্ত রাঙায় আকাশ—
সেখানেই যেন স্বর্গের স্পর্শ।”


 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *