বক্সা দুর্গ – ডুয়ার্সের পাহাড়ি গহীনে ইতিহাসের নিঃশব্দ সাক্ষী।

উত্তরবঙ্গের ঘন সবুজ বনভূমি ও পাহাড়ি প্রান্তরের বুক চিরে দাঁড়িয়ে আছে এক সময়ের মহিমাময় ইতিহাস— বক্সা দুর্গ। এই দুর্গটি অবস্থিত আলিপুরদুয়ার জেলার বক্সা টাইগার রিজার্ভের অন্তর্গত মনোমুগ্ধকর পাহাড়ি অঞ্চলে, ভুটানের সীমান্ত সংলগ্ন এক উঁচু চূড়ায়। প্রায় ২৬০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত এই দুর্গ কেবল এক ঐতিহাসিক নিদর্শনই নয়, বরং উত্তরবঙ্গ ভ্রমণের অন্যতম রোমাঞ্চকর ও রহস্যে মোড়া গন্তব্য।


ইতিহাসের পাতায় বক্সা দুর্গ

বক্সা দুর্গের ইতিহাস প্রাচীন ও বহুমাত্রিক। প্রাচীনকালে এই দুর্গটি ছিল ভুটান রাজাদের অধীনস্থ এক সামরিক দুর্গ, যা ভারতের উত্তর-পূর্ব সীমান্ত রক্ষার গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হতো। ১৮৬৫ সালে ভুটান যুদ্ধের পর ব্রিটিশরা বক্সা দুর্গ দখল করে নেয় এবং এটিকে তারা সামরিক ও প্রশাসনিক কাজে ব্যবহার করতে শুরু করে।

পরে, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়, ব্রিটিশরা বক্সা দুর্গকে রাজনৈতিক বন্দিশালা হিসেবে ব্যবহার করে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের এখানে বন্দি রাখা হতো। ১৯৩০ থেকে ১৯৪৫ সালের মধ্যে সুভাষচন্দ্র বসুর অনুগামী এবং বিপ্লবী সংগঠনের অনেক সদস্যকেই এখানে আটক রাখা হয়েছিল।

স্বাধীনতার পরে এই দুর্গ কিছু সময় ব্যবহৃত হয় তিব্বত থেকে আগত শরণার্থীদের আশ্রয় শিবির হিসেবে। ফলে, বক্সা দুর্গ শুধু সামরিক শক্তির নয়, মানবতারও এক অনন্য সাক্ষ্য বহন করে।


প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বুকে বক্সা দুর্গ

বক্সা দুর্গের পথে যেতে যেতে চোখে পড়ে প্রকৃতির অপরূপ রূপ। নিচে বিস্তৃত বক্সা টাইগার রিজার্ভের ঘন জঙ্গল, যেখানে রয়েছে হাতি, চিতা, বাইসন, নানা প্রজাতির হরিণ ও অসংখ্য পাখির আবাস।

বক্সা ফোর্ট ট্রেক পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম জনপ্রিয় ট্রেকিং রুট। সাধারণত সান্তালাবাড়ি থেকে প্রায় ৫ কিলোমিটার দীর্ঘ উঁচু পথে হেঁটে দুর্গে পৌঁছানো যায়। পথে রয়েছে ঘন বন, পাহাড়ি ঝরনা, আর দূরে দূরে চা-বাগানের সবুজ মায়া। প্রতিটি বাঁকে প্রকৃতি যেন নতুন রূপে ধরা দেয়।

দুর্গের উপরে পৌঁছালে চোখে পড়ে প্রাচীন ইট-পাথরের ধ্বংসাবশেষ, পুরোনো প্রাচীরের ফাঁকে শ্যাওলার পরত, আর চারপাশে অসীম সবুজ উপত্যকার মনোমুগ্ধকর দৃশ্য। মেঘলা দিনে দুর্গের উপর ভেসে বেড়ায় কুয়াশার আস্তর, যা এই স্থানকে আরও রহস্যময় করে তোলে।


দুর্গের স্থাপত্য ও বর্তমান অবস্থা

বর্তমানে বক্সা দুর্গের বেশিরভাগ অংশ ধ্বংসপ্রাপ্ত, তবে এখনও দেখা যায় তার দৃঢ় প্রাচীর, প্রবেশদ্বার, ও কয়েকটি কক্ষের ধ্বংসাবশেষ। কিছু জায়গায় ব্রিটিশ আমলের লোহার বারযুক্ত জানালা ও পুরনো ইটের দেয়াল ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

সরকার এই দুর্গকে পুরাতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক ঐতিহ্য হিসেবে সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে। দুর্গের চারপাশে পর্যটকদের জন্য একটি ছোট ভিউপয়েন্ট এবং বিশ্রামাগারের ব্যবস্থাও রয়েছে।


ভ্রমণ নির্দেশিকা

  • কীভাবে পৌঁছাবেন:
    নিকটবর্তী রেলস্টেশন হলো আলিপুরদুয়ার জংশন বা নিউ জলপাইগুড়ি। এখান থেকে গাড়িতে সান্তালাবাড়ি পৌঁছানো যায়, সেখান থেকেই শুরু হয় বক্সা দুর্গের ট্রেক।
  • ভ্রমণের সময়:
    অক্টোবর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত সময়টি সবচেয়ে উপযুক্ত। এই সময় আবহাওয়া ঠান্ডা ও পরিষ্কার থাকে, ফলে দুর্গের আশেপাশের দৃশ্য উপভোগ করা যায় সহজেই।
  • থাকার ব্যবস্থা:
    বক্সা ও জয়ন্তি অঞ্চলে বনদপ্তরের রেস্ট হাউস ও হোমস্টে পাওয়া যায়। চাইলে আলিপুরদুয়ার শহরেও থাকা যায়, যেখান থেকে বক্সা এক দিনের ভ্রমণ হিসেবে ঘোরা সম্ভব।

ভ্রমণ অভিজ্ঞতার রোমাঞ্চ

বক্সা দুর্গে ওঠার সময় আপনি অনুভব করবেন এক অদ্ভুত নীরবতা— যেন পাহাড়, বাতাস আর ইতিহাস মিলে কোনো নিঃশব্দ গল্প শোনাচ্ছে। পাখির ডাক, পাতার মর্মর, আর দূর থেকে শোনা পাহাড়ি ঝরনার আওয়াজ মিলেমিশে তৈরি করে এক অনন্য পরিবেশ।

দুর্গের উপরে দাঁড়িয়ে নিচের দিকে তাকালে মনে হয় আপনি ইতিহাসের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেছেন। এখানে সূর্যাস্তের দৃশ্য বিশেষভাবে বিখ্যাত— সূর্যের শেষ আলো যখন দুর্গের প্রাচীরে লাল আভা ফেলে, তখন চারপাশের সবুজ পাহাড়ও যেন সোনালি রঙে রঞ্জিত হয়ে ওঠে।


উপসংহার

বক্সা দুর্গ শুধু একটি ঐতিহাসিক স্থান নয়, এটি এক অতীতের জীবন্ত প্রতীক। এটি দেখায় কীভাবে সময়, প্রকৃতি ও মানুষ মিলে ইতিহাস রচনা করে। স্বাধীনতার স্মৃতি, ব্রিটিশ শাসনের ছাপ, তিব্বতী শরণার্থীদের কাহিনি— সবকিছুই যেন এই দুর্গের ইটের ভাঁজে লুকিয়ে আছে।

যারা ইতিহাস, প্রকৃতি ও অভিযানের প্রেমিক— তাদের কাছে বক্সা দুর্গ এক অনিবার্য গন্তব্য। ডুয়ার্সের পাহাড়ি প্রান্তরে দাঁড়িয়ে থাকা এই প্রাচীন দুর্গ আজও বলে চলে— “আমি ইতিহাসের সাক্ষী, আমি স্বাধীনতার নীরব প্রহরী।”

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *