
পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলা তার ঐতিহাসিক নিদর্শন, রাজকীয় স্থাপত্য ও ধর্মীয় ঐতিহ্যের জন্য সুপরিচিত। এই জেলার মাটিতে যেমন রাজবাড়ির ঐতিহ্য মিশে আছে, তেমনই গাঁথা রয়েছে অসংখ্য প্রাচীন মন্দিরের ইতিহাস। তার মধ্যেই অন্যতম হল “শীতলেশ্বর মন্দির”, যা ভক্তি, স্থাপত্য ও সংস্কৃতির এক চমৎকার সংমিশ্রণ।
মন্দিরের অবস্থান ও পরিচিতি
শীতলেশ্বর মন্দিরটি অবস্থিত বর্ধমান শহরের কেন্দ্রস্থলে, রাজবাড়ির কাছাকাছি। এটি জেলার প্রাচীনতম ও শ্রদ্ধেয় মন্দিরগুলির একটি। স্থানীয় মানুষের বিশ্বাস অনুযায়ী, এই মন্দিরে শ্রী শীতলেশ্বর শিব স্বয়ং বিরাজমান, যিনি বর্ধমানবাসীর আরাধ্য দেবতা। প্রতিবছর হাজারো ভক্ত এখানে এসে প্রার্থনা করেন, বিশেষত শিবরাত্রির সময় ভিড় উপচে পড়ে।
ঐতিহাসিক পটভূমি
ঐতিহাসিক তথ্য অনুযায়ী, বর্ধমান রাজবংশের শাসনামলে এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। ধারণা করা হয়, ১৭শ শতকে মহারাজা কির্তিচন্দ্র বা তার উত্তরসূরিদের আমলে এই মন্দির নির্মিত হয়। রাজপরিবারের পৃষ্ঠপোষকতায় এই শিবমন্দিরটি কেবল একটি ধর্মস্থল নয়, ছিল রাজকীয় আচার-বিধির কেন্দ্রও।
মন্দিরের নামের সঙ্গে “শীতলেশ্বর” শব্দটির বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। কথিত আছে, একসময় এই অঞ্চলে ভীষণ গরম ও খরা দেখা দিলে এক সন্ন্যাসী এখানে মহাদেবের তপস্যা করে বৃষ্টি ও শীতলতা আনেন। সেই থেকেই মন্দিরের দেবতার নাম হয় “শীতলেশ্বর” — অর্থাৎ যিনি তাপ প্রশমিত করেন।
️ স্থাপত্য ও শৈলী
শীতলেশ্বর মন্দিরের স্থাপত্যশৈলী নিঃসন্দেহে বর্ধমানের ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্যের অন্যতম নিদর্শন।
- মন্দিরটি আটচালা শৈলীতে নির্মিত, যার উপর রয়েছে অলঙ্কৃত শিখর।
- প্রাচীরজুড়ে আছে টেরাকোটা ফলক, যেখানে রামায়ণ ও মহাভারতের নানা দৃশ্য ফুটে উঠেছে।
- মূল গর্ভগৃহে রয়েছে শিবলিঙ্গ, যা কালো পাথরে তৈরি এবং চিরন্তন আভা ছড়ায়।
- মন্দির চত্বরের চারপাশে রয়েছে ছোট ছোট দেবদেবীর মন্দির, যেমন পার্বতী, গণেশ ও কার্তিকের মূর্তি।
এই মন্দিরের শান্ত পরিবেশ, ঘণ্টার ধ্বনি ও ধূপের গন্ধ মিলিয়ে যেন এক অনন্য পবিত্রতা সৃষ্টি করে।
শীতলেশ্বর মন্দির পরিদর্শনের অভিজ্ঞতা
আমি যখন প্রথম শীতলেশ্বর মন্দিরে গিয়েছিলাম, তখন সকালবেলার সূর্য আলতো আলো ছড়াচ্ছিল মন্দিরের গায়ে। পায়ে ধুতি পরে, হাতে ফুল ও বেলপাতা নিয়ে ভক্তরা একে একে শিবলিঙ্গে জল ঢালছিলেন। মন্দিরের প্রাঙ্গণে ভেসে আসছিল “ওম নমঃ শিবায়” ধ্বনি। সেই মুহূর্তে মনে হচ্ছিল, যেন সময় থমকে গেছে — আমি যেন প্রাচীন ভারতের কোনো রাজবংশের আচার অনুষ্ঠানের সাক্ষী।
উৎসব ও বিশেষ অনুষ্ঠান
- মহাশিবরাত্রি: এই দিনটি মন্দিরের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ উৎসব। সারারাত ধরে চলে আরতি, ভজন ও শিবপূজা। ভক্তরা উপবাস থেকে শিবের আশীর্বাদ প্রার্থনা করেন।
- শ্রাবণ মাস: প্রতিটি সোমবার ভক্তদের ঢল নামে। দোলকাঁঠা, ফুল, বেলপাতা ও গঙ্গাজলে স্নান করিয়ে শিবলিঙ্গে নিবেদন করা হয়।
- এছাড়া চৈত্রসংক্রান্তি ও দুর্গাপূজার সময়ও এখানে বিশেষ পুজো অনুষ্ঠিত হয়।
চারপাশের পরিবেশ ও দর্শনীয় স্থান
মন্দিরের আশেপাশে রয়েছে বর্ধমানের আরও বেশ কিছু ঐতিহাসিক নিদর্শন — যেমন বর্ধমান রাজবাড়ি, কঙ্কালেশ্বরী মন্দির, এবং করনেশ্বর শিবমন্দির। তাই শীতলেশ্বর মন্দিরে ভ্রমণ করতে গেলে পুরো এলাকাই একসঙ্গে ঘুরে দেখা যায়।
ধর্মীয় তাৎপর্য
স্থানীয় বিশ্বাস অনুযায়ী, শীতলেশ্বর শিব জীবনের উষ্ণতা, ক্লেশ ও দুঃখ প্রশমিত করেন। তিনি “শীতলতার দেবতা”, যিনি মানুষের মনকে শান্তি ও স্নিগ্ধতা প্রদান করেন। অনেকেই বিশ্বাস করেন, এখানে আন্তরিক ভক্তি নিয়ে প্রার্থনা করলে মানসিক শান্তি ও পারিবারিক সুখ লাভ করা যায়।
✍️ উপসংহার
বর্ধমান জেলার শীতলেশ্বর মন্দির কেবল একটি পবিত্র তীর্থস্থান নয়—এটি বর্ধমানের সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ভক্তির প্রতীক। মন্দিরের শৈল্পিক সৌন্দর্য, প্রাচীনতার গাম্ভীর্য এবং আধ্যাত্মিক আবেশ মনকে ভরিয়ে তোলে এক অদ্ভুত শান্তিতে।
সারসংক্ষেপে:
“শীতলেশ্বর মন্দিরে পা রাখলে মনে হয়, যেন ঈশ্বরের শীতল করুণায় জীবনের সমস্ত দুঃখ দূর হয়ে যায় —
সেখানে সময়, ইতিহাস ও ভক্তি একাকার হয়ে মিশে যায় মহাদেবের চরণে।”
ছবি : প্রতিকি।












Leave a Reply