
বাংলার ইতিহাসের এক অপরূপ অধ্যায়ের কেন্দ্রস্থল মুর্শিদাবাদ। নবাবি আমলের শৌর্য, সমৃদ্ধি, স্থাপত্য ও সংস্কৃতির অমর নিদর্শনে ভরপুর এই জেলা আজও ইতিহাসপ্রেমীদের কাছে এক স্বপ্নভূমি। হাজারদুয়ারি প্রাসাদ, খোশবাগ, কাঠগোলা বাগানবাড়ি, নিমতলা কেল্লা—প্রতিটি স্থাপনাই নবাবি ঐতিহ্যের সাক্ষ্য বহন করে। তবে এই ঐতিহ্যের মুকুটে এক বিশেষ রত্ন হল কাটরা মসজিদ, যা শুধু ধর্মীয় স্থাপনা নয়, বরং এক জীবন্ত ইতিহাসের স্মারক।
ইতিহাসের সূচনা
কাটরা মসজিদ নির্মিত হয়েছিল 1723–1724 খ্রিস্টাব্দে, বাংলার প্রথম নবাব মুর্শিদ কুলি খাঁ-এর উদ্যোগে। তিনি তাঁর জীবনের শেষভাগে ধর্মীয় নিষ্ঠায় আত্মনিয়োগ করেন এবং নিজের সমাধির জন্যই এই মসজিদের সংলগ্ন স্থানে জায়গা নির্ধারণ করেছিলেন।
ইতিহাস বলে, মুর্শিদ কুলি খাঁ নিজের হাতে এই মসজিদের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন এবং মৃত্যুর পর তাঁকে মসজিদের সামনের সিঁড়ির নিচে সমাধিস্থ করা হয়। বলা হয়ে থাকে, তাঁর ইচ্ছা ছিল—“যাতে মসজিদে প্রবেশের সময় প্রত্যেক ভক্ত তাঁর সমাধির উপর দিয়ে পা রাখে, যেন মৃত্যুর পরও তাঁর অহংকার বিনাশ হয়।” এই অনন্য চিন্তাধারা নবাবের গভীর বিনয় ও ধর্মবিশ্বাসের পরিচয় দেয়।
️ স্থাপত্যের শৌর্য
কাটরা মসজিদ এক অনন্য স্থাপত্যশৈলীর নিদর্শন। এটি এক বিশাল দুই তলা মসজিদ, যার দৈর্ঘ্য প্রায় ১৩৫ ফুট এবং প্রস্থ প্রায় ১১৫ ফুট। স্থাপনাটি সম্পূর্ণ ইট ও চুন-সুরকি দিয়ে তৈরি, যা আজও মজবুতভাবে টিকে আছে তিন শতাব্দীর ঝড়ঝাপটা পেরিয়ে।
মসজিদের চারপাশে উঁচু প্রাচীর ঘেরা প্রাঙ্গণ, আর প্রাচীরের কোণে কোণে চারটি গম্বুজাকৃতি মিনার। একসময় এই মিনারগুলির উচ্চতা ছিল প্রায় ৭০ ফুট, যা মুর্শিদাবাদের সর্বোচ্চ স্থাপনাগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল।
মসজিদের সামনের বিশাল অঙ্গন বা প্রার্থনাক্ষেত্র, যেখানে প্রায় ২০০০ জন মুসল্লি একসঙ্গে নামাজ পড়তে পারতেন। দেয়ালে রয়েছে সূক্ষ্ম আরবি লিপি ও ফুলের নকশা, যা মুঘল শিল্পশৈলীর সৌন্দর্যকে প্রতিফলিত করে।
মসজিদের আধ্যাত্মিক গুরুত্ব
কাটরা মসজিদ শুধু স্থাপত্যের নিদর্শন নয়, এটি বাংলার ইসলামী সংস্কৃতির অন্যতম কেন্দ্র। নবাব মুর্শিদ কুলি খাঁর আমলে এটি ছিল ধর্মীয় শিক্ষা ও সমাজচর্চার কেন্দ্রস্থল। মসজিদের পাশেই ছিল মাদ্রাসা ও ধর্মীয় বিদ্যালয়, যেখানে ছাত্ররা ইসলামি শিক্ষা লাভ করত।
আজও প্রতিদিন বহু মানুষ এখানে নামাজ পড়তে আসেন, বিশেষ করে শুক্রবারে বা ঈদের সময়ে মসজিদের প্রাঙ্গণ ভরে ওঠে হাজারো ভক্তে। এই স্থানটি স্থানীয়দের কাছে পবিত্র ও ঐতিহাসিক এক আবেগের প্রতীক।
পরিবেশ ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য
কাটরা মসজিদ অবস্থিত মুর্শিদাবাদ শহরের কেন্দ্র থেকে প্রায় ২ কিলোমিটার দূরে, ভাগীরথী নদীর তীরে। চারপাশে সবুজ ঘাসের চাদর, নারকেল গাছের সারি, আর নদীর জলের প্রতিফলনে দাঁড়িয়ে থাকা মসজিদের গম্বুজ—এই দৃশ্য যেন এক জীবন্ত চিত্রপট।
সকালবেলার নরম রোদে বা বিকেলের সূর্যাস্তে কাটরা মসজিদের আবহ সম্পূর্ণ অন্যরকম হয়ে ওঠে। স্থিরতা, ইতিহাস, ও প্রকৃতি এখানে যেন একাকার হয়ে যায়।
স্থাপত্যের বিশেষত্ব
১. মসজিদের মুখোমুখি পাঁচটি বিশাল প্রবেশদ্বার।
২. ভিতরে মোট ৭০টি ছোট ছোট গম্বুজ, যেগুলি শীতকালে উষ্ণ ও গ্রীষ্মে শীতল রাখে প্রার্থনাস্থলকে।
৩. মসজিদের মূল গম্বুজের চারপাশে খোদাই করা আছে কোরআনের বাণী।
৪. নবাব মুর্শিদ কুলি খাঁর সমাধি মসজিদের সামনের সিঁড়ির নিচে অবস্থিত—এটি স্থাপত্যের দিক থেকে এক বিরল দৃষ্টান্ত।
কীভাবে পৌঁছানো যায়
- রেলপথে: কলকাতা থেকে বহরমপুর কোর্ট বা মুর্শিদাবাদ স্টেশনে পৌঁছে স্থানীয় গাড়িতে সহজেই পৌঁছানো যায় কাটরা মসজিদে।
- সড়কপথে: NH34 ধরে মুর্শিদাবাদ শহর পর্যন্ত গেলে, শহর থেকে মাত্র কয়েক মিনিটের দূরত্বেই অবস্থিত এই মসজিদ।
- নৌকাপথেও: ভাগীরথী নদীর উপর নৌকায় চড়ে মসজিদ দেখা এক আলাদা অভিজ্ঞতা হতে পারে।
️ ভ্রমণের উপযুক্ত সময়
অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত কাটরা মসজিদ ভ্রমণের সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। শীতকালের আবহাওয়া মুর্শিদাবাদের ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলি ঘোরার জন্য আদর্শ।
✨ উপসংহার
কাটরা মসজিদ কেবল এক ধর্মীয় স্থান নয়; এটি বাংলার নবাবি ইতিহাসের এক জীবন্ত দলিল। তিন শতাব্দী পেরিয়েও আজও এটি দাঁড়িয়ে আছে রাজকীয় স্থাপত্য, গভীর ধর্মবিশ্বাস, আর এক বিনয়ী নবাবের চিরন্তন স্মৃতির প্রতীক হয়ে।
যখন ভাগীরথীর বাতাসে মৃদু ঢেউ খেলে যায়, আর সূর্যাস্তের আলো মসজিদের গম্বুজে পড়ে সোনালি আভা ছড়ায়, তখন মনে হয়—এই স্থাপনা শুধু ইট-পাথর নয়, এটি এক ইতিহাসের নিঃশব্দ প্রার্থনা, এক আত্মার চিরন্তন শান্তি।











Leave a Reply