মুর্শিদাবাদ — বাংলার নবাবি ঐতিহ্যের মহিমাময় রাজধানী।

বাংলার ইতিহাসের অধ্যায়ে যদি কোনও শহরকে রাজকীয় ঐশ্বর্য, স্থাপত্যশিল্প, সংস্কৃতি ও করুণ পরিণতির প্রতীক হিসেবে দেখা যায়, তবে তা নিঃসন্দেহে মুর্শিদাবাদ। ভাগীরথীর তীরে অবস্থিত এই ঐতিহাসিক শহর একসময় ছিল সমগ্র বাংলার রাজধানী—যে রাজধানী থেকে শাসন হতো বাংলা, বিহার ও ওড়িশা। আজও মুর্শিদাবাদের পথে-ঘাটে হাঁটলে সেই নবাবি আমলের গৌরবময় ছায়া অনুভব করা যায়।


ইতিহাসের পটভূমি

মুর্শিদাবাদ-এর নামকরণ হয় নবাব মুর্শিদ কুলি খাঁ-এর নামে। তিনি ছিলেন বাংলার প্রথম নবাব, যিনি ১৭০৪ খ্রিষ্টাব্দে রাজধানী ঢাকা থেকে সরিয়ে ভাগীরথীর তীরে স্থাপন করেন নতুন রাজধানী—মুর্শিদাবাদ। তাঁর নাম থেকেই শহরের নাম হয় মুর্শিদাবাদ

অষ্টাদশ শতকে এই শহর ছিল পূর্ব ভারতের অন্যতম সমৃদ্ধ নগরী। বলা হয়, সে সময়ে মুর্শিদাবাদের বাজারে যে রকম সোনা ও রেশমের ব্যাবসা হতো, তা ইউরোপের শহরগুলিকেও পিছনে ফেলেছিল। নবাবি আমলে এটি হয়ে উঠেছিল প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র।


ঐতিহাসিক স্থাপত্য

১. হাজারদুয়ারি প্রাসাদ

মুর্শিদাবাদের পরিচয় বহন করে এই প্রাসাদ। ১৮৩৭ সালে নবাব নাজিম হামিদ আলি খান এই প্রাসাদটি নির্মাণ করেন। ইংরেজ স্থপতি ডানকান ম্যাকলয়েডের নকশায় তৈরি এই বিশাল প্রাসাদে রয়েছে ১০০০ দরজা, যার মধ্যে ৯০০ আসল ও ১০০টি মিথ্যে। বর্তমানে এটি একটি জাদুঘর, যেখানে নবাবদের ব্যবহৃত আসবাব, অস্ত্র, চিত্রকলা ও ইউরোপীয় অলঙ্কার সংরক্ষিত আছে।

২. কাটরা মসজিদ

মুর্শিদ কুলি খাঁ নিজেই এই মসজিদের প্রতিষ্ঠা করেন (১৭২৩ খ্রিষ্টাব্দে)। তিনি মৃত্যুর পর সমাধিস্থ হন মসজিদের সিঁড়ির নিচে। বিশাল আয়তনের এই মসজিদে একসঙ্গে হাজার হাজার মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারেন। এটি বাংলার অন্যতম প্রাচীন ইসলামি স্থাপত্যের নিদর্শন।

৩. কাঠগোলা বাগানবাড়ি

নবাবি আমলের সমৃদ্ধ বণিকদের ঐশ্বর্য প্রতিফলিত করে কাঠগোলা বাগানবাড়ি। ইটালিয়ান ধাঁচের এই প্রাসাদের ভেতরে রয়েছে বিলাসবহুল হলরুম, ঝাড়বাতি, মার্বেল মেঝে, ইউরোপীয় ভাস্কর্য এবং মনোমুগ্ধকর বাগান।

৪. নিমতলা কেল্লা

ভাগীরথীর পাড়ে অবস্থিত এই দুর্গ একসময় ছিল নবাবদের প্রতিরক্ষার কেন্দ্র। এখানেই ছিল রাজকীয় সৈন্যদের প্রশিক্ষণ ক্ষেত্র ও গুদামঘর। বর্তমানে এর ধ্বংসাবশেষই বলে দেয় অতীতের রাজকীয়তার গল্প।

৫. খোশবাগ

ভাগীরথীর অপর পাড়ে অবস্থিত খোশবাগ, নবাব সিরাজউদ্দৌলার সমাধিক্ষেত্র। সিরাজ, তাঁর স্ত্রী লুৎফুন্নিসা ও নানা আত্মীয়দের সমাধি এখানে রয়েছে। নিস্তব্ধ বাগান আর গাছগাছালিতে ঘেরা এই স্থানটি ইতিহাসপ্রেমীদের আবেগময় করে তোলে।


প্রকৃতি ও পরিবেশ

মুর্শিদাবাদ শহর ভাগীরথীর তীরে অবস্থিত বলে এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অপূর্ব। নদীর জলে প্রতিফলিত হাজারদুয়ারির রূপ যেন এক স্বপ্নময় দৃশ্য। বসন্তকালে কাঠগোলার বাগানে রঙিন ফুলের সমারোহ আর পাখির কলরব মিলে মুর্শিদাবাদকে এক কবিতার শহরে পরিণত করে।


দর্শনীয় স্থানগুলির সংক্ষিপ্ত তালিকা

  1. হাজারদুয়ারি প্রাসাদ
  2. ইমামবাড়া
  3. নবাব মসজিদ
  4. কাঠগোলা বাগানবাড়ি
  5. নিমতলা কেল্লা
  6. খোশবাগ
  7. কাটরা মসজিদ
  8. জাহানকোশ মসজিদ
  9. রোসনা বাগান
  10. মোতি ঝিল

কীভাবে পৌঁছানো যায়

  • রেলপথে: কলকাতা থেকে বহরমপুর কোর্ট বা মুর্শিদাবাদ স্টেশনে সরাসরি ট্রেন যায়। (সময় লাগে প্রায় ৪–৫ ঘণ্টা)
  • সড়কপথে: NH34 ধরে প্রায় ২০০ কিলোমিটার দূরত্ব। নিজস্ব গাড়ি বা বাসে সহজেই পৌঁছানো যায়।
  • বাসপথে: কলকাতার এসপ্ল্যানেড বা শিয়ালদা থেকে দৈনিক বাস পরিষেবা রয়েছে।

থাকার ব্যবস্থা

মুর্শিদাবাদে রয়েছে সরকারি ও বেসরকারি বহু হোটেল ও লজ। “বঙ্গদর্শন ট্যুরিস্ট লজ”, “হাজারদুয়ারি ট্যুরিস্ট লজ” এবং “ইম্পেরিয়াল গেস্ট হাউস” পর্যটকদের মধ্যে জনপ্রিয়। এছাড়া বহরমপুর শহরেও ভালো মানের হোটেল পাওয়া যায়।


স্থানীয় খাদ্যরস

মুর্শিদাবাদের খাবারেও লুকিয়ে আছে নবাবি ছোঁয়া। বিরিয়ানি, রেশমি কাবাব, মুর্গ মুসল্লম, এবং “ছানা মিষ্টির পরোটা” এখানকার বিশেষত্ব। মিষ্টান্নপ্রেমীদের জন্য চানার মোহন, পান্তুয়া, এবং ছানার পায়েস একবার খেয়েই মনে গেঁথে যাবে।


ভ্রমণের সেরা সময়

অক্টোবর থেকে মার্চ মাস মুর্শিদাবাদ ভ্রমণের জন্য উপযুক্ত। শীতকালে নদীর তীরের আবহাওয়া মনোরম থাকে, আর ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলি ঘোরা যায় স্বাচ্ছন্দ্যে।


✨ উপসংহার

মুর্শিদাবাদ এক ইতিহাসের পাঠশালা, যেখানে প্রতিটি ইট-পাথর একেকটি কাহিনি বলে। নবাবি ঐশ্বর্য, ব্রিটিশ আগ্রাসনের বেদনা, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আর স্থাপত্যের নিপুণতা—সব মিলিয়ে এটি বাংলার গৌরবের প্রতীক।

যখন ভাগীরথীর তীরে সূর্য অস্ত যায় আর হাজারদুয়ারির গম্বুজে সোনালি আলো পড়ে, তখন মনে হয়—এই শহর শুধু অতীত নয়, এটি এক অনন্ত ইতিহাস, যা এখনও বেঁচে আছে নদীর হাওয়ায়, প্রাসাদের নিঃশব্দ ছায়ায়, আর মানুষের হৃদয়ে।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *