
দার্জিলিং — এই নামেই যেন মিশে আছে পাহাড়, কুয়াশা, চা-বাগান আর টয় ট্রেনের স্মৃতি। এই পাহাড়ি শহরের বুকে এমনই এক অনন্য বিস্ময় হলো বাতাসিয়া লুপ, যেখানে প্রকৃতির রূপ, প্রকৌশলের কৌশল আর ইতিহাসের গৌরব একাকার হয়েছে। দার্জিলিং ভ্রমণে গেলে যাঁরা টয় ট্রেনে চড়েন, তাঁদের যাত্রার অন্যতম মনোমুগ্ধকর মুহূর্ত হল এই বাতাসিয়া লুপ পার হওয়া।
অবস্থান ও পরিচয়
বাতাসিয়া লুপ অবস্থিত দার্জিলিং শহর থেকে প্রায় ৫ কিলোমিটার দূরে, ঘুম রেলওয়ে স্টেশনের ঠিক নীচে। এটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৭,০০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত। এখানকার “লুপ” মানে হলো — একটি ঘূর্ণায়মান রেলপথ, যা পাহাড়ের ঢালে বৃত্তাকারে তৈরি, যাতে ট্রেন খুব খাড়া ঢাল বেয়ে ওঠা বা নামা সহজে করতে পারে।
১৮৮১ সালে দার্জিলিং হিমালয়ান রেলওয়ে (DHR) নির্মাণের সময় এই লুপটি তৈরি করা হয়। পাহাড়ি পথের খাড়া ঢাল অতিক্রম করার জন্য প্রকৌশলীরা তৈরি করেন এই বৃত্তাকার রেলপথ— যা আজ UNESCO বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ।
টয় ট্রেনের সুরে এক রূপকথা
যখন দার্জিলিং হিমালয়ান রেলওয়ের ছোট্ট নীল-সাদা টয় ট্রেনটি বাতাসিয়া লুপে প্রবেশ করে, তখন মনে হয় যেন কোনো সিনেমার দৃশ্য চলছে। ধীরে ধীরে পাহাড় বেয়ে ট্রেনটি পাক খেতে খেতে উঠে যায়, আর জানালার বাইরে দেখা যায় কাঞ্চনজঙ্ঘার ঝলমলে চূড়া, সবুজ উপত্যকা, আর দার্জিলিং শহরের চা-বাগানের মোহনীয় দৃশ্য।
ট্রেনের বাঁকে দাঁড়িয়ে যদি নিচের দিকে তাকাও, দেখা যাবে সেই একই ট্রেন একটু নিচের রেললাইনে পাক খেয়ে চলছে — যেন নিজেকেই একবার ঘুরে দেখে নিচ্ছে! এই লুপের নকশা এমন নিখুঁত যে ট্রেন ৩৬০° ঘুরে আবার সামনের দিকে চলে যায়, কিন্তু যাত্রীদের মনে রেখে যায় বিস্ময় আর আনন্দের রেখা।
বাতাসিয়া গার্ডেন – ফুলের রঙে পাহাড়ের হাসি
বাতাসিয়া লুপ শুধু রেলপথ নয়, এটি এক অপূর্ব উদ্যান (Batasia Eco Garden)। এখানে বিভিন্ন প্রজাতির পাহাড়ি ফুল, পাইনগাছ, ও ঘাসের স্নিগ্ধ সৌন্দর্য মিলে তৈরি হয়েছে এক স্বর্গীয় আবহ। বসন্তে এলে চারপাশ জুড়ে ফুটে ওঠে রঙিন ফুল—রডোডেনড্রন, অর্কিড, আজেলিয়া ইত্যাদি।
পাহাড়ি বাতাসে দুলে ওঠা ফুলের ঘ্রাণ আর দূরে ভেসে আসা ট্রেনের হুইসেল—এই মিলনেই যেন বাতাসিয়ার নামটি আরও অর্থপূর্ণ হয়েছে, কারণ ‘বাতাসিয়া’ শব্দের মানে হলো “যেখানে বাতাস বয়ে চলে”।
️ যুদ্ধস্মৃতি স্তম্ভ – বীরদের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি
বাতাসিয়া লুপের কেন্দ্রে রয়েছে এক গম্ভীর অথচ গর্বিত স্থাপনা—গোর্খা যোদ্ধাদের স্মৃতিস্তম্ভ (War Memorial)।
এই স্মৃতিস্তম্ভটি তৈরি হয়েছে ভারতের সেনাবাহিনীতে শহিদ হওয়া গোর্খা সৈনিকদের স্মরণে। ১৯৯৫ সালে উদ্বোধিত এই মনুমেন্টের চারপাশে নীরবতার মধ্যে শোনা যায় তিস্তার হাওয়া, যা যেন শহিদ বীরদের আত্মার সঙ্গে কথা বলে।
বীরদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে এখানে পর্যটকরা প্রণাম করেন, ছবি তোলেন, এবং পাহাড়ের নীচে ছড়িয়ে থাকা দার্জিলিং শহরকে তাকিয়ে দেখেন এক অন্য দৃষ্টিতে—যেখানে দেশপ্রেম ও প্রকৃতির মেলবন্ধন ঘটে।
️ প্রকৃতির অপার রূপ
বাতাসিয়া লুপ থেকে দার্জিলিং শহরের সম্পূর্ণ দৃশ্য দেখা যায় পাখির চোখে।
দূরে কাঞ্চনজঙ্ঘা পর্বতের তুষারঢাকা শিখর, নিচে ছড়ানো চা-বাগানের সবুজ সমুদ্র, আর মাঝখানে রঙিন ঘর-বাড়ি—পুরো দৃশ্যটি যেন প্রকৃতির আঁকা এক জীবন্ত চিত্রকর্ম।
পরিষ্কার আকাশে দাঁড়ালে মনে হয়, এই লুপে দাঁড়িয়ে পুরো হিমালয়কেই যেন হাত ছুঁয়ে দেখা যায়।
️ ইতিহাসের ছোঁয়া
বাতাসিয়া লুপের নির্মাণ ইতিহাস রেলপ্রকৌশলের এক অনন্য উদাহরণ। দার্জিলিং হিমালয়ান রেলওয়ে নির্মিত হয়েছিল ব্রিটিশ যুগে পাহাড়ে চা-বাগান সংযোগ সহজ করার জন্য। সেই সময় এত উচ্চতা পার হওয়ার প্রযুক্তি ছিল না, তাই প্রকৌশলীরা এই “লুপ” ডিজাইন করেন।
আজও ১৪০ বছরেরও বেশি সময় পর এই রেলপথ সক্রিয়, এবং টয় ট্রেনের হুইসেলে বাজে সেই পুরোনো দিনের স্মৃতি।
ফটোগ্রাফার ও প্রকৃতিপ্রেমীদের স্বর্গ
বাতাসিয়া লুপ দার্জিলিংয়ের অন্যতম ফটোস্পট।
যে কোনো মুহূর্তেই এখানে দেখা যায় হাতে ক্যামেরা ধরা পর্যটক, কেউ ট্রেনের আগমনের অপেক্ষায়, কেউ বা কাঞ্চনজঙ্ঘার রঙ বদলানোর দৃশ্য বন্দি করতে ব্যস্ত। ভোরবেলায় যখন সূর্য আলো ছড়ায়, তখন ট্রেনের ধোঁয়া আর মেঘ মিলে আকাশে তৈরি করে অপূর্ব এক মায়াবী দৃশ্য।
ভ্রমণের সময় ও উপদেশ
- দার্জিলিং থেকে দূরত্ব: প্রায় ৫ কিমি
- কীভাবে যাবেন: টয় ট্রেন বা ট্যাক্সিতে
- খোলার সময়: সকাল ৫টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা
- সেরা সময়: মার্চ থেকে মে ও অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর
- টিপস: সকালে গেলে সূর্যের আলোয় কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায় স্পষ্টভাবে। ঠান্ডা থেকে রক্ষা পেতে গরম পোশাক নিন।
শেষ কথা
বাতাসিয়া লুপ শুধু একটি রেলপথ নয়, এটি প্রকৃতি, প্রকৌশল ও ইতিহাসের এক মিলিত কবিতা। এখানে দাঁড়িয়ে একদিকে যেমন দেখা যায় দার্জিলিংয়ের পাহাড়ি সৌন্দর্য, তেমনি শোনা যায় অতীতের ট্রেনের ছন্দ ও বীরদের গল্প।
যখন টয় ট্রেনটি বাঁক খেতে খেতে চলে যায় পাহাড়ের বুক চিরে, মনে হয় যেন পৃথিবী থেমে গেছে সেই মুহূর্তে—
শুধু চলছে এক অদৃশ্য সুর, যার নাম বাতাসিয়া। ️












Leave a Reply