ইতালির পিসা — হেলানো টাওয়ারের শহরে ইতিহাসের হাতছানি ।

ইতালির হৃদয়ে, টাস্কানি প্রদেশের এক শান্ত শহর পিসা (Pisa) — নাম শুনলেই সবার মনে ভেসে ওঠে সেই বিস্ময়কর হেলানো টাওয়ার, যা সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে এক অদ্ভুত স্থাপত্য বিস্ময় হিসেবে পরিচিত। কিন্তু পিসা কেবল এই টাওয়ারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, এর প্রতিটি গলিতে লুকিয়ে আছে রোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাস, শিল্প, সংস্কৃতি এবং এক অপরূপ ইউরোপীয় সৌন্দর্যের ছোঁয়া।


পিসা শহরের পরিচয়

পিসা অবস্থিত আরনো নদীর তীরে, ফ্লোরেন্স থেকে প্রায় ৮০ কিলোমিটার দূরে। একসময় এটি ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ বন্দরনগরী, যা রোমান আমল থেকেই ইউরোপের বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত ছিল। আজ পিসা তার সমৃদ্ধ অতীতের স্মৃতি বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক ঐতিহাসিক ও শিক্ষানগরী হিসেবে — কারণ এখানেই রয়েছে বিখ্যাত University of Pisa, ইউরোপের প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয়গুলির একটি।


লিনিং টাওয়ার অফ পিসা — বিস্ময়ের প্রতীক

পিসা শহরের কেন্দ্রবিন্দু হলো Piazza dei Miracoli (Square of Miracles) — অর্থাৎ “অলৌকিক চত্বর”। এই চত্বরে দাঁড়িয়ে আছে চারটি বিশ্ববিখ্যাত স্থাপনা —
1️⃣ The Cathedral (Duomo di Pisa)
2️⃣ The Baptistery
3️⃣ The Camposanto Monumentale (শ্মশান উদ্যান)
4️⃣ এবং সর্বাধিক পরিচিত Leaning Tower of Pisa

হেলানো এই টাওয়ারটির নির্মাণ শুরু হয় ১১৭৩ সালে, কিন্তু মাটি দুর্বল হওয়ায় এটি ধীরে ধীরে এক পাশে হেলতে থাকে। টাওয়ারের উচ্চতা প্রায় ৫৬ মিটার, এবং আজ এটি প্রায় ৪ ডিগ্রি কোণে হেলানো। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বিজ্ঞানী ও স্থপতিরা চেষ্টা করেছেন এটি স্থিতিশীল রাখতে, আর এখন এটি নিরাপদভাবে দাঁড়িয়ে আছে — পৃথিবীর অন্যতম স্থাপত্য আশ্চর্য হিসেবে।

যখন আপনি টাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে তাকান, মনে হয় যেন আকাশের দিকে ঝুঁকে পড়েছে এক বিশাল সাদা মার্বেলের স্তম্ভ। আর টাওয়ারে উঠতে উঠতে যখন চারপাশে শহরের দৃশ্য চোখে পড়ে, তখন মনে হয় — ইতিহাসের বুক থেকে যেন এক নতুন পৃথিবী জেগে উঠেছে।


The Cathedral of Santa Maria Assunta — ধর্মীয় ঐশ্বর্যের নিদর্শন

হেলানো টাওয়ারের পাশেই রয়েছে Duomo di Pisa, এক অপূর্ব রোমানেস্ক স্থাপত্যশৈলীর গির্জা। এর বাহিরের মার্বেল কারুকাজ, অভ্যন্তরের সোনালি মোজাইক ও গম্বুজের শিল্পকর্ম প্রতিটি দর্শককে বিমোহিত করে। এখানে দাঁড়িয়ে যেন অনুভব করা যায় মধ্যযুগীয় ইউরোপের শিল্প ও ধর্মের মিলন।


The Baptistery — সুরের মন্দির

Duomo-র সামনে দাঁড়িয়ে আছে Baptistery of St. John, যা ইউরোপের সবচেয়ে বড় ব্যাপ্টিস্ট্রি। এর ভেতরের গম্বুজে এমন অনন্য শব্দ প্রতিফলন ঘটে যে, একজন গায়ক একা দাঁড়িয়ে গান গাইলেও শুনতে পাওয়া যায় বহুস্বরের সুর। এই স্থাপনাটি শিল্প, সঙ্গীত ও ধর্মের এক অপূর্ব সংমিশ্রণ।


Camposanto Monumentale — ইতিহাসের নিঃশব্দ সাক্ষী

চত্বরের শেষ প্রান্তে রয়েছে Camposanto, যেখানে পবিত্র মাটিতে বহু বিখ্যাত ব্যক্তির সমাধি। এর দেয়ালে মধ্যযুগীয় চিত্রকর্মগুলো একসময়ে ইউরোপীয় শিল্পের মহিমা প্রকাশ করত।


জ্ঞান ও বিজ্ঞানের শহর

পিসা শুধু ঐতিহাসিক স্থাপত্যের জন্যই নয়, বরং তার বিজ্ঞান ও শিক্ষার ঐতিহ্যের জন্যও বিখ্যাত। এখানেই জন্ম নিয়েছিলেন গ্যালিলিও গ্যালিলেই, যিনি পদার্থবিজ্ঞান ও জ্যোতির্বিজ্ঞানের নতুন যুগের সূচনা করেছিলেন। কিংবদন্তি আছে, গ্যালিলিও নাকি পিসার টাওয়ার থেকেই তার বিখ্যাত ‘free fall’ পরীক্ষা করেছিলেন!


নদীর ধারে পিসার সন্ধ্যা

সন্ধ্যার সময় যখন আরনো নদীর তীরে সূর্যের আলো ম্লান হয়ে আসে, তখন নদীর ওপরের সেতুগুলি, পুরোনো বাড়িগুলি আর ক্যাফেগুলির আলো ঝিলিক দেয়। নদীর ধারে বসে এক কাপ ইতালীয় কফি হাতে, পর্যটকের মনে জেগে ওঠে এক অদ্ভুত প্রশান্তি।


ইতালীয় স্বাদের আসর

পিসায় আসলে অবশ্যই চেখে দেখতে হয় স্থানীয় ইতালিয়ান খাবার — পাস্তা, পিজ়া, তিরামিসু, এবং জেলাটো আইসক্রিম। ছোট ছোট রেস্টুরেন্ট বা “Trattoria”-তে বসে স্থানীয় ওয়াইন আর সুস্বাদু খাবারের সঙ্গে উপভোগ করা যায় শহরের উষ্ণ আতিথেয়তা।


শেষ কথা

পিসা কেবল একটি পর্যটনকেন্দ্র নয়, এটি ইউরোপীয় ইতিহাস ও বিজ্ঞানের এক জীবন্ত প্রতীক। এখানে একদিকে রয়েছে ধর্ম ও শিল্পের ঐতিহ্য, অন্যদিকে জ্ঞানের আলোকশিখা। হেলানো টাওয়ারটি যেন সময়ের প্রতীক — যে বলছে, সবকিছুই হেলে পড়তে পারে, কিন্তু সৌন্দর্য ও ইতিহাস কখনো পতিত হয় না।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *