রিজেকশন থেকে পদ্মশ্রীঃ দ্য লাইফ অব দ্য রিয়েল পাই : অভিরূপ দাস।

0
679

সালটা ১৯৮৮।দিল্লির ন্যাশনাল স্কুল ড্রামা-তে এলেন বিখ্যাত পরিচালক মীরা নায়র।তিনি তখন কাস্ট খুঁজছেন তার নতুন সিনেমা ‘সালাম বোম্বে’-র জন্য।হঠাৎই তার চোখ গেল থার্ড ইয়ারের এক ছাত্রের দিকে।ছেলেটির অভিনয় দক্ষতা এতই মুগ্ধ করল তাকে যে তাকেই কাস্ট করা হল মেন রোলের জন্য।কিন্তু দুমাস ওয়ার্কশপের পর হঠাৎ মীরা নায়রের মনে হল–তিনি যেমন চান এই ছেলেটির বয়স তার থেকে বেশি।তারপর আর কি? বাদ।ছেলেটির রোল আর স্বপ্ন হয়ত সেদিনই চুরমার হয়ে যেতে পারত একসাথে। কিন্তু না, তিনি যে ইরফান খান।স্বপ্ন তো তার এই প্রথম ভাঙেনি। রাজস্থানের তঙ্ক জেলার অখ্যাত গ্রাম খেজুরিয়ায় প্রেমপ্রকাশ আর জেমস সিনেমা হলে বসে দিলীপ কুমার, নাসিরউদ্দিন শাহদের ছবি দেখতে দেখতে প্রথম যখন তিনি ভেবেছিলেন সিনেমাই হবে তার ফিল্ড অব সাকসেস সেদিনই তো জানতেন রাস্তা সহজ নয়। না আছে তার হিরোদের মত কনভেনশনাল চেহারা, না আছে হিরোর মত সুন্দর মুখ।তার ওপর আবার আছে স্বভাবসিদ্ধ লাজুক ভঙ্গি।গলার স্বর মাস্টারমশাইদের কান অব্দিই ঠিকঠাক পৌঁছায় না তো দর্শক।প্রথম যে বন্ধুকে বললেন অভিনেতা হবার স্বপ্নের কথা। তারাই খেপাতে শুরু করল কদিন বাদ থেকে।এদিকে বাবা চান ছেলে তার বড় টায়ারের ব্যবসার দায়িত্ব নিক, মা চান তিনি প্রফেসর হোন।ক্রিকেটার হতেও কোন বাধা নেই। এমনিতেই আন্ডার ২৩ টিমের হয়ে রীতিমতো ক্রিকেট খেলেছেন ইরফান। কিন্তু সিনেমা? জায়গীরদার বংশের ছেলে শেষমেষ নাচা গাওয়ার কাজ করবে?
এভাবেই চলছিলো কলেজও কম্পিল্ট করলেন ইরফান।পড়াশোনায় তিনি কোনদিনই তেমন ভাল ছিলেন না।এর মধ্যেই আকাশ ভেঙে পড়ল মাথায়। মারা গেলেন বাবা ইয়াসিন আলি খান।আকাশের ঘুড়ি ওড়ানোর শখ ছেড়ে ইরফানকে নেমে আসতে হল বাস্তবের মাটিতে। কিন্তু স্বপ্ন সে কি সহজে পিছু ছাড়ে।এরই মধ্যে ডাক এল ন্যাশানাল স্কুল অব ড্রামা থেকে। দোনামোনাতেই হয়ত কেটে যেত সময়। কিন্তু এগিয়ে এলেন ইরফানের ছোট ভাই। দাদাকে এগিয়ে দিতে তিনিই দায়িত্বনিলেন বাবার ব্যবসার।মাকে যদিও তার স্বপ্নের কথা খুলে বলা হল না।মাকে বলতে হল প্রথম মিথ্যে–ড্রামা স্কুলে তিনি অভিনয়কে কেরিয়ার করতে যাচ্ছেন না যাচ্ছেন ডিগ্রি নিয়ে এসে জয়পুর ইউনিভার্সিটিতে প্রফেসারি করবেন বলে। দ্বিতীয় মিথ্যে বলতে হল ড্রামা স্কুলে। নাটকে অভিনয় সম্পর্কে প্রায় কিছুই না জানা ইরফানকে বলতে হল তিনি দশটি নাটকে অভিনয় করেছেন।
ড্রামা স্কুল ইরফানের জীবনের খুবই গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এখানেই তার পরিচয় হয় স্ত্রী সুতপা সিকদার ও পরিচালক তিগ্মাংশু ধুলিয়ার সাথে।মীরা নায়ারের ছবি থেকে বাদ পড়াই ইরফানের জীবনের একমাত্র রিজেকশন নয়। গোবিন্দ নেহলানির ডাকে মুম্বাই এসে ‘পিতা’, ‘জজিরে’-র মত টেলি ছবিতে কাজ করার পরেও বড় পর্দার ছবিতে ডাক পাননি।বিভিন্ন ইন্টারভিউতে ইরফান নিজেই বলেছেন-কত ডিরেক্টর যে বারোটার সময় টাইম দিয়ে নিজেই ভুলে গেছেন সেকথা তার শেষ নেই।
পেটের দায়েই ইরফানকে শুরু করতে হয় সিরিয়াল – “চানক্য”, “বানেঙ্গি আপনি বাত” থেকে “জয় হনুমান” পর্যন্ত করতে হয় সবই। কিন্তু মন ভরছিল না।এরই মাঝে ২০০১ সালে আসে আসিফ কাপাডিয়ার ছবি “দ্য ওয়ারিয়র”।এই হলিউডি ছবির প্রায় একই সাথে তিগ্মাংশু ধুলিয়া শুরু করেন ” হাসিল” ছবিটি।ভিলেন চরিত্রে অসাধারণ অভিনয় ইরফানকে এনে দেয় “ফ্লিম ফেয়ার অ্যাওয়ার্ড”। জীবনের টার্নিং পয়েন্ট শুরু তো হল এই সিনেমার পর থেকে। কিন্তু রোজই আসে একই রকম সিনেমার অফার। নতুন কিছু করার সু্যোগ নেই।ক্লান্ত হয়ে পড়লেন ইরফান।জয়পুর ফিরে যাবার কথা ঠিক করলেন মনে মনে।কিন্তু বন্ধু তিগ্মাংশুকে সেকথা বলতেই তিনি হেসে বললেন–” আগে তোকে একটা ন্যাশান্যাল অ্যাওয়ার্ড তো পাইয়ে দিতে দে তারপর যাস।”
এরপরই ইরফান অভিনয় করলেন “পান সিং তোমর” ছবির মুখ্য চরিত্রে। এই চরিত্রের জন্য ন্যাশানাল অ্যাওয়ার্ডও পান তিনি।এরপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি ইরফানকে। একের পর এক “দ্য নেমসেক”, “দ্য লাঞ্চবক্স”, “স্লাম ডগ মিলিনেয়র”, “লাইফ ইন এ মেট্রো”, “মকবুল”, “লাইফ অব পাই ” সহ অসংখ্য সিনেমায় চরিত্রাভিনেতা হিসাবে আলাদা আইডেন্টিটি গড়ে তুলেছেন ইরফান। সেই মীরা নায়ারের সাথেই কাজ করেছেন “দ্য নেমসেক”সিনেমায়, যার ছবির মুখ্য চরিত্র থেকে একসময় বাদ পড়েছিলেন তিনি।২০১১ সালে অভিনয়ে অসামান্য কৃতিত্বের জন্য ইরফান খানকে সম্মানিত করা হয় “পদ্মশ্রী” সম্মানে।
খেজুরিয়ার আকাশে ঘুড়ি ওড়াতে ওড়াতে আথবা সিনেমাহলের অন্ধকার সিটে বসে অভিনেতা হবার স্বপ্নের ঘুড়িতে উড়ান দিয়েছিল যে ছেলেটি, একদিন যার হাতে “জুরাসিক পার্ক” সিনেমার টিকিট কেনার পয়সা অব্দি ছিল না তিনিই পরবর্তীকালে অভিনয় করলেন জুরাসিক পার্কের মালিকের চরিত্রে।এটাই ইরফান খানের ইরফান খান হয়ে ওঠার গল্প।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here