অভিনয় : নির্মাল্য বিশ্বাস।

0
798

লজ্জায়,অপমানে ফর্সা মুখটা লাল হয়ে গিয়েছিল সুমনের। চোখের জল চেপে বাড়ি ফিরতে ফিরতে ভেবেছিল মেয়েদের মন বলে কিছু আছে কি? নাকি পুরোটাই অভিনয়?
নেহাত অঙ্কের মাষ্টারমশাই ওদের আর্থিক অসংগতির জন্য কম টাকায় পড়ান তা না’হলে সেদিনই কোচিনের রাস্তাটা আর মাড়াত না। কয়েকমাস বাদেই উচ্চমাধ্যমিক তাই মুখ নীচু করে হলেও কোচিনে যেতেই হয়েছিল। যদিও সেদিনের পর থেকে চোখ তুলে তাকাতে পারত না কারোর দিকে। সবসময়ই মনে হত আড়ালে ওকে নিয়ে হাসাহাসি হচ্ছে। শুধু মাষ্টারমশায়ের কাছে যেটুকু অঙ্ক দেখার দেখে নিত আর মনে মনে ভাবত অঙ্ক বিষয়টা এত জটিল কেন? ফর্মুলা একটু এদিক ওদিক হলেই আর মিলতে চায় না।
এইরকম একটা অপ্রস্তুত অবস্থার মধ্যে পড়তে হবে কোনদিন ভাবেনি সুমন। নিজের হঠকারিতায় নিজের ওপরেই বিরক্ত হয়। সুমন চায়নি ওর ভালবাসার ব্যাপারটা এভাবে পাঁচকান হোক। একদিন কথা প্রসঙ্গে বিকাশের কাছে সত্যিটা স্বীকার করে নিয়েছিল সুমন।বিকাশ ছেলেটা পেট থেকে কথা বার করার জন্য স্পেশাল কোন কোর্স করেছে বোধহয়।পুলিশের চাকরিতে গেলে অনেক নাম করবে ছেলেটা। কিছুর একটা গন্ধ পেলেই হল, ব্যস বিকাশের হাত থেকে আর নিস্তার নেই।সেদিনও নিরামিষ কিছুর গন্ধ পেয়ে সুমনকে চেপেচুপে ধরতে ও গড়গড় করে বলেই দেয়, অতসীকে ওর ভালো লাগে। সেই কথাটাই পাসিং দ্য বল খেলার মত চিন্ময়ী,রম্যবীণা হয়ে অতসীর কানে পৌঁছেছে। অতসী সব শুনে সুমনের সাথে কথা বলতে চেয়েছে।
একথা শোনার পর থেকেই সুমনের আত্মারাম খাঁচা ছাড়া হবার উপক্রম। নিজের আর্থিক অবস্থার কথা খুব ভালো মত জানে। গ্রামের ছেলে। দু’বছর হল কলকাতায় পড়তে এসেছে। হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করে। অভাবের সংসার। গ্রামে পাকা বাড়ি নেই। দু’চালার ঘর। জমিজমা যেটুকু আছে সেটা চাষ করে কোনরকমে সংসার চালান বাবা। এদিকে অতসী শুধু রূপসীই নয় যথেষ্ট উচ্চবিত্ত ঘরের মেয়ে সেটা ওর সাজ পোশাক দেখেই বোঝা যায়। কথাবার্তা সেভাবে বলেইনি কোনদিন। যা কথা বলে সেটা ওই বিকাশ,রম্যবীণাদের সাথেই। বড়লোকের মেয়ের দেমাক থাকবে এটাই স্বাভাবিক।এমন মেয়েকে প্রেমের প্রস্তাব দেবে এতটা মূর্খ সুমন নয়। ভালোলাগার জিনিস ভালো লেগেছে সেটা দোষের কিছু নয় কিন্তু ভালো লাগাটাকে জীবনের সাথে জুড়ে দিতে চাওয়াটা একপ্রকার বোকামি ছাড়া কিছু নয়।
দু’চোখের কোণ দিয়ে অতসীকে দেখত শুধু। কথা যে বলবে এমন সাহস হয়নি কোনদিন। এ হেন অতসী যে সুমনের প্রেমে পড়তে পারে এমন চিন্তা সুদূর কল্পনাতেও কোনদিন মাথায় আসেনি। প্রথম যখন বিকাশের মুখে কথাটা শুনল তখন আকাশ থেকে পড়ল যেন। রাম ফাজিল বিকাশের একটা কথাও বিশ্বাস হয় না সুমনের কিন্তু রম্যবীণারাও যখন বিকাশের কথায় সায় দিল তখন নিজের কানের ওপরেও বিশ্বাস হারাল সুমন।
– তোরা কি সব ফাজলামো মারছিস? অতসী আমার দিকে ফিরেও তাকায় না,কথা বলা তো দূরের কথা। সে আমাকে ভালবাসে?
– বিকাশ নিরীহ মুখ করে বলল, – আরে এটাই তো প্রেমের লক্ষণ। যাকে ভালবাসে তার সাথে প্রথমে কথা বলে না জানিস না?
রম্যবীণা ফুট কাটে।- হ্যাঁ একটা লজ্জা লজ্জা ভাব থাকে সব সময়। কথা বলতে কেমন একটা অস্বস্তি হয়। আমারও প্রথম প্রথম এরকম হয়েছিল অয়নের সাথে অ্যাফেয়ারের সময়।
চিন্ময়ী আরো এককাঠি ওপরে উঠে বলল, – অত ভাবনা-চিন্তা করার কিছু নেই। ভালো যখন লেগেছে তখন ঝুলে পড়।
ঝুলতে সুমন চায়নি।অন্তত এভাবে। শুধু ভালো লাগার কথাটাই অতসীকে জানাতে গেছে।তাও সত্যি হয়তো কোনদিন জানানোও হত না যদি না বিকাশরা পিছনে ঠেলা দিত। অতসীকে আগে থেকেই বলাই ছিল। ও নিজেও নাকি কথা বলতে আগ্রহী।
ধর্মতলায় মেট্রো সিনেমার সামনে দাঁড়াবার কথা ছিল অতসীর। নির্দিষ্ট সময়ে সুমন সেখানে উপস্থিত হয়েছে। দেখল অতসী তার আগেই এসে পৌঁছেছে। লাল রঙের একটা ওয়েস্টার্ন টপ পড়েছে অতসী। তার ওপর সাদা জ্যাকেট। পা থেকে মাথা পর্যন্ত সব কিছুই ভীষণ রকম পলিশড। তার পাশে সুমনকে পুরনো আদ্যিকালের জামা আর ঢোলা প্যান্টে একদমই বেমানান লাগছিল। চোখাচোখি হতেই অতসী হাসল।- চলো,আমরা রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসি।
– রেস্টুরেন্ট কেন? মেট্রো স্টেশনেই বসি না?
– না, মেট্রো স্টেশনে অতক্ষণ বসতে দেয় না। চলো আমার সঙ্গে।
– কোথায়?
– আরে এসোই না।
একটা দামী রেস্টুরেন্টে এসে বসল দু’জনে। বসল মানে অতসীই টেনে বসাল। সুমন কিন্তু কিন্তু করছিল। পকেটে খুব একটা পয়সা নেই। তবে সেটা জানাতেও কেমন একটা বাধোবাধো ঠেকছিল। দোনামনা করে ঢুকেই পড়ল ভিতরে। এসি রেস্টুরেন্টের ঠাণ্ডা হাওয়ায় মনটা ফুরফুরে হয়ে যাবার কথা কিন্তু মেনুকার্ড দেখেই সুমন ঘামতে শুরু করল। নিজের জন্য শুধু একটা ভেজ চাউমিন অর্ডার করল আর অতসী নিল মিক্সড ফ্রায়েড রাইস,চিলি গার্লিক ফিস আর সাথে একটা মকটেল।
ম্যাঙ্গো ব্লসমে স্ট্র ডুবিয়ে একটা টান মেরে চোখটা ওপরের দিকে তুলল অতসী।
– চিনু,রোমিরা কি যেন বলছিল, তোমার নাকি আমাকে ভালো লাগে?
মুহূর্তে অপ্রস্তুত সুমন। মুখ নামিয়ে নিয়েছে।চিনু মানে চিন্ময়ী, রোমি মানে রম্যবীণা বুঝতেও সময় লাগল খানিক।
ওদিকে অতসীর ধৈর্য কমছে।একই প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি।এবার ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানায় সুমন।
কাঁধ ঝাঁকিয়ে অতসীর প্রশ্ন – তা কি দেখে আমাকে ভালো লাগল? আমার লুকস? আমার ফিগার? আমার ড্রেসিং সেন্স? না আমার পার্সোনালিটি?
– তোমার সবকিছুই ভালো লাগে। প্রথম যেদিন তোমায় দেখেছিলাম সেদিনই তোমায় ভালবেসে ফেলেছিলাম। তোমাকে নিয়ে কবিতাও লিখেছি অনেক।
– রিয়েলি! কই দেখি আছে নাকি সাথে?
সুমন ঝটপট ব্যাগ থেকে একটা খাতা বার করে অতসীর সামনে রাখে।অতসী সেটায় এক ঝলক চোখ বুলিয়ে বলল, – ওঃ গ্রেট। শুনে খুশী হলাম। তা ভালো যখন বেসেছো তখন কি তুমি জানো আমি কে? আমি কোন বাড়ির মেয়ে? কী আমার স্টেটাস?
– অত কিছু তো ভেবে দেখিনি। ভালো লাগার সময় তো ওইসব মাথায় আসেনি।
অতসী চোখ কপালে তুলে বলল,
– স্ট্রেঞ্জ। তুমি একজনকে ভালবাসবে,তাকে নিয়ে কবিতা লিখবে আর তার সম্পর্কে জানবে না কিছু? ওয়েল ওয়েল ওয়েল।
টেবিলে রাখা গ্লাসের শেষ জলটুকু গলায় ঢেলে সুমন বলল -চিন্ময়ী,বিকাশরা বলছিল আমাকেও নাকি তোমার ভালো লাগে?
খুব জোরে একটা বিষম খেল অতসী। আইব্রো করা ভুরু দুটো নাচিয়ে বলল, – কি বললে? চিনু,বিকিরা বলেছে একথা, তোমার প্রতি আমার উইকনেস আছে?
সুমন দ্বিধাগ্রস্থের মত বলে, – হ্যাঁ তাই তো বলল!
– ওয়েল ওয়েল ওয়েল। তা আমাকে টানবার ক্ষমতা আছে তো তোমার?
– টানবো মানে? কি টানবো?
অতসী মুখটা বিচ্ছিরি রকম ব্যাজার করে বলল, -উফ্‌,ডিজগাসটিং! টানবে মানে অ্যাফোর্ট করার ক্যাপাসিটি আছে তো তোমার? লুক অ্যাট মাই শ্যু। দেখতে পাচ্ছো জুতোটা?
সুমন জুতোটার দিকে তাকায়।
– ডু ইউ হ্যাভ এনি আইডিয়া অ্যাবাউট ইটস কস্ট?
অতসীর স্বর চড়ছে।সুমন নিরুত্তর।
অতসী বলে চলে, – ফোর থাউজেন্ড রুপিস। আমার ওয়েস্টার্ন আউটফিটটা দেখেছ? এটার দাম জানো? ফাইভ থাউজেন্ড। জিন্সটা থ্রি থাউজেন্ড। জ্যাকেটটাও তাই। প্রতি মাসে আমার এরকম দুটো করে ড্রেস লাগে। এছাড়া কসমেটিকস আছে, হেয়ার স্পা আছে।ড্রেস আর কসমেটিকসের পিছনেই আমার জন্য বাপির প্রতি মাসে টোয়েন্টি থাউজেন্ডের ওপর খরচ হয়ে যায়। পারবে তো অ্যাফোর্ট করতে?
সুমনের গলা শুকিয়ে আসে। আমতা আমতা করে বলে, – আমি তো এত কিছু ভেবে দেখিনি। ভালোলাগার কথাটাই শুধু জানাতে এসেছি। তাও জানানো হত না যদি না বিকাশরা জোর করে পাঠাত। আর তুমিও কথা বলতে রাজী আছো বললে…
– ওরা বলল বলেই তুমি ঠকঠক করে চলে এলে! আগেপিছে কিছু ভাবলে না? বাহ্! নিজের লুকসটা একবার ভাবো।তারপর আমার দিকে তাকাও। নিজেকে মেনটেন করতে হয় কিভাবে আগে শেখো তারপর কোন বড়লোকের মেয়েকে প্রপোজ করতে এসো।
সুমন একটা কথাও বলতে পারল না। কোনরকমে খাবারটা শেষ করল। অতসী খেতে খেতে মাঝে মাঝেই ঠোঁট চিপে হেসেছে আর উপদেশ দেবার ছলে খোঁচা মেরেছে।
খাবার শেষ হতে বিল এসেছে। খাবারের দামটা মেনু কার্ড দেখার সময়ই মনে মনে হিসেব করে নিয়েছিল সুমন। বিল আসতে দেখল যা দেখেছিল তার থেকে অনেক বেশী এসেছে। ফিফটিন পারসেন্ট সার্ভিস চার্জ জুড়ে দিয়েছে।মানিব্যাগে চিরুনি তল্লাশি করে সব খুচরো টাকা এক করেও দেখা গেল কুড়ি টাকা কম হচ্ছে। এ.সি রেস্টুরেন্টে সার্ভিস চার্জ লাগে এটা জানা ছিল না সুমনের। তাই লজ্জার মাথা খেয়ে কুড়িটা টাকা চাইতেই হল অতসীর কাছে। অতসী উত্তর করল না। শুধু ভুরুটা ওপরে তুলে আরো একবার দেখল সুমনের মুখটা। তারপর ব্যাগ থেকে ডেবিট কার্ডটা বার করে বিলটা পেমেন্ট করল। সুমনের দিকে তাকিয়ে বলল, – হাঁ করে দেখছ কি মুখের দিকে? টিপসটা দিয়ে টাকাটা পকেটে ঢুকিয়ে নাও আর শোনো এত কম টাকা নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ো না। আজ না হয় আমি ছিলাম বলে পেমেন্টটা করতে পারলাম না হলে কি হত ভাবো তো একবার!
সুমন কথা বাড়ায়নি আর। ওর সামনে দুটো পথ খোলা ছিল। তর্ক করা আর না’হলে মানে মানে ওখান থেকে বেরিয়ে আসা। সুমন পরের কাজটাই করেছে। কথা বাড়ালেই কথা বাড়বে। ওখান থেকে বেরিয়ে সোজা হস্টেলের বাস ধরেছে।তারপর উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ না হওয়া অবধি কয়েকমাস মুখ নীচু করে মাধব স্যারের কোচিনে কাটিয়েছে।

…বারোটা বছর পার হয়ে গেছে। বিয়ে করব করব করেও এখনো করা হল না অতসীর। ভালো লেগেছে অনেককেই,কিন্তু সেই ভালোলাগা আর একটু পথ হেঁটে ভালবাসার দিকে এগোয়নি বরং মাঝ পথেই হারিয়ে গেছে অনেক ভালো লাগা। আসলে অতসী নিজেই জানে না নিজের পথ কোনটা। দিকভ্রান্ত পথিকের মত ছুটে বেরিয়েছে শুধু। আসলে শুধু অর্থ আর যশ এই দুটোর পিছনে ছুটতে ছুটতে ভালবাসা নামক বস্তুটা মরীচিকা হয়েই রয়ে গেছে অতসীর জীবনে।
এই বারোটা বছরে বেশ কিছু ছেলে এসেছিল ওর জীবনে। কাউকেই শেষ অবধি মনে ধরেনি। মানে জীবনসঙ্গী করবার মত উপযুক্ত মনে হয়নি কাউকেই। সবার মধ্যেই কিছু না কিছু একটা খুঁত আবিষ্কার করেছে।
গত দু’বছরে অতসীর ভালোলাগার তালিকায় আরো একজনের নাম সংযোজন হয়েছে। সে হল রাজ। বাংলা চলচ্চিত্র জগতের মেগাস্টার। যেমন স্মার্ট,তেমনি হ্যান্ডসাম আর নাচেও তেমনি। ঠিক যেন ঋত্বিক রোশন। দু’বছর হল ইন্ডাস্ট্রিতে এসেছে,এসেই পরপর তিনটে ছবি সুপারহিট আর তিনটেই আলাদা আলাদা নতুন নায়িকার সাথে। টলিউডের চিত্র পরিচালকরা এখন ওকে ছাড়া অন্য কাউকে নায়ক করার কথা ভাবতেই পারছেন না। বাংলা সিনেমায় মরা গাঙে যেন জোয়ার এনে দিয়েছে এই ছেলেটা।
অতসীর অনেক দিনের বাসনা রাজকে একাবার ছুঁয়ে দেখার। দিবা-রাত্র শুধু ওরই স্বপ্ন দেখে। ওর হাঁটা, চলা, কথাবার্তা, তাকানোর ভঙ্গী পাগল করে দেবার মতই। ওর ভালবাসা পাওয়াটা অনেক দূরের স্বপ্ন, তবু লক্ষ্যটা বড় না হলে স্বপ্নের কাছাকাছি পৌঁছানোও যায় না। আপাতত অভিনয়টা ঠিকভাবে শিখলেই রাজের কাছাকাছি পৌঁছানো যাবে। বাপির যা সোর্স আছে সেটা কাজে লাগিয়ে নায়িকার রোল পেতেও অসুবিধা হবে না। ওই জায়গায় পৌঁছোতে পারলে তবে রাজকে নিজের ভালোলাগার কথা জানাবে। রাজ রাজী হলে বিয়েটাও সেরে ফেলবে।
ওর নিষ্ঠা আর অধ্যাবসায় দেখে বাপিও অবাক। মেয়েকে এত সিরিয়াসলি কোন কাজ করতে দেখেননি। অভিনয়ের জন্য যে মেয়েটা এভাবে প্রাণ ঢেলে দেবে উনি কল্পনাও করেননি কখনো। অনেকদিন থেকেই মডেলিং করত অতসী। নাচটাও জানা। অভিনয়টা যদিও কোনদিন শেখেনি তবে কলেজের সোশ্যালে দু’একবার অভিনয় করেছিল। সেটাই ঘষেমেজে তৈরী করতে হবে।
খুব বেশী দিন অপেক্ষা করতে হল না। দু’বছরের মধ্যেই অপ্রত্যাশিত ভাবে একটা সুযোগ এসে গেল অতসীর কাছে। যে নায়িকার সাথে রাজের সিনেমাটা করার কথা ছিল, ব্যক্তিগত কোন সমস্যার জন্য সে সেরে দাঁড়িয়েছে। অগত্যা পরিচালক চুক্তিপত্র নিয়ে নিজেই এসে উপস্থিত অতসীর বাড়িতে। এর মধ্যে ছোটখাটো পার্শ্বচরিত্রে দু’তিনটে সিনেমাতে অভিনয় করলেও রাজের নায়িকা হবার সৌভাগ্য এত তাড়াতাড়ি ঘটে যাবে এটা ভাবতেই পারেনি অতসী।পরিচালকের মুখে যা শুনল তাতে বিস্ময় আরো কয়েক গুণ বেড়েছে।রাজই নাকি পরিচালককে অতসীর কাছে পাঠিয়েছে। ‘মনের মানুষ’ সিনেমাতে অতসীর ছোট্ট রোলটা নাকি রাজের মন কেড়েছে।
শুটিং ফ্লোরে রাজের সাথে পরিচয় হবার পর অতসী আরো উৎফুল্ল। একেবারে বিদেশী কায়দায় গালে গাল ঠেকিয়ে অভিবাদন জানিয়েছে নায়ক। রাজকে যত দেখছে তত মুগ্ধ হচ্ছে। শুটিং এর সময় ভীষণ রকম সিরিয়াস। কোথাও ভুল ত্রুটি হলে শুধরে দিচ্ছে আবার অবসর সময়ে দারুণ ফুর্তিবাজ এক মানুষ। একবার এর পিছনে লাগছে আবার পরক্ষনেই অন্যজনের। মুডটাকে কি দারুণ অফ অন করতে পারে মানুষটা।
রাজের মুখটাকে যেন ভীষণরকম চেনা চেনা লাগে। আগে সিনেমায় ঠিক বোঝা যেত না। সামনাসামনি দেখলে মনে হয় কোথাও যেন দেখেছে,ঠিক মনে করতে পারে না। রাজকে একদিন কথাচ্ছলে জিজ্ঞেস করেছিল।রাজ হো হো করে হেসে বলেছিল,
– সিনেমা ছাড়া অন্য কোথাও দেখেছো নাকি? মার্ডার করতে দেখোনি তো আবার?
টানা ছ’মাস ধরে শুটিং চলল। এবার শেষ পর্যায়। একটা গানের শুটিং এর জন্য বিদেশ যেতে হবে। বিদেশ মানে একেবারে স্যুইজারল্যান্ড। অতসীর আনন্দ আর ধরে না। স্বপ্নের নায়কের সাথে স্বপ্নের দেশে পাড়ি দেবে। এই কয়েক মাসে দু’জনে অনেকটা কাছাকাছি এসেছে। লং ড্রাইভে একসাথে অনেকটা পথ ঘুরেছে। প্রাথমিক অস্বস্তিটা কাটিয়ে ড্রাইভারের অলক্ষ্যে নিজের হাতটা রাজের হাতের ওপর রেখেছে।প্রত্যুত্তরের অপেক্ষায় থেকেছে। রাজ হাত সরায়নি বরং মুঠোটা শক্ত করে ধরেছে। সম্পর্কটা সহজ হবার সাথে সাথে রাজের কাঁধে মাথা রেখেছে। রাজ দ্বিগুণ উৎসাহে কাঁধটা জড়িয়ে ধরেছে। কখনো ড্রাইভারকে ছুটি দিয়ে নিজেরাই বেরিয়ে পড়েছে। কাঁচ তুলে দিতেই ঘন অন্ধকার নেমে এসেছে গাড়ির ভিতরে। দু’হাত বাড়িয়ে রাজকে বুকের কাছে টেনে এনেছে। দু’চোখে তিমির তৃষ্ণা। ওর ঠোঁট দুটো রাজের বুক ছুঁয়ে,গাল ছুঁয়ে,পুরু দুটো ঠোঁটের অন্ধকারে মিলিয়ে গেছে। খুব বেশী দুষ্টুমি করেনি রাজ। করলেও আপত্তির কিছু ছিল না। রাজকে ভালোবাসার কথাটা বাপিকে বলে দিয়েছে। ওকেই বিয়ে করবে। ঠিক এইরকমই একটা দৃশ্য আছে সিনেমার শেষ পর্বে।
কলকাতায় থাকলে দু’জনার একসাথে কোথাও যাওয়ার সুযোগ খুব একটা মেলে না। যেখানেই যাবে সেখানেই হয় মিডিয়ার তাড়া নয় ভক্তদের ছবি তোলার আব্দার। বিদেশে একান্ত নিরিবিলিতে অনেকটা সময় কাটানো যাবে। অতসীর স্বপ্নের উড়ান পাখা মেলে স্যুইজারল্যান্ডের মাটি ছুঁয়েছে।
শুটিং এর পর এখানে অখণ্ড অবসর। প্রকৃতি যেন এখানে পটে আঁকা ছবি। ইচ্ছে মত যখন খুশী গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে পড়া যায়। সেদিনও বেড়িয়েছিল দু’জনে। পাহাড়ের কোলে একটা সুন্দর রেস্টুরেন্ট। গুঁড়ো গুঁড়ো বরফ পড়ছে। মোমবাতির আলোয় পরিবেশটা আরো মায়াময় হয়ে উঠেছে। গ্লাসে ওয়াইন ঢেলেছে রাজ। একটু একটু করে চুমুক দিচ্ছে আর কথাবার্তা বলছে দু’জনে।
রাজের হাতে হাত রেখে আঙ্গুলে আঙ্গুল ছোঁয়াছুঁয়ির খেলা খেলছে অতসী। খেলতে খেলতেই বলল, – আমার কথা তো অনেক বলেছি। আজ তোমার কথা কিছু বল। আমি শুনব। কিভাবে সিনেমার জগতে এলে? এত নাম করলে?
রাজ হালকা গাম্ভীর্যে বলল, – সে অনেক কথা।জীবনে কখনো ভাবিনি এখানে আসব।অভিনয় করব।পরিস্থিতি এখানে নিয়ে এসেছে।ছাড়ো সেসব কথা। বিকাশ,চিন্ময়ীরা কেমন আছে? যোগাযোগ আছে এখনো?
অতসী আকাশ থেকে পড়ল যেন।
– তুমি চেনো ওদের?
– চিনবো না? একসাথে এত বছর অঙ্ক স্যারের কোচিনে ক্লাস করলাম!
অতসী দেখছে। রাজের মুখের দিকে চেয়ে বিস্মরণের ধাপগুলো পেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে। স্বগোতক্তির মত বলেছে, -তুমি…
অতসীর মুখের কথা কেড়ে বলল – আমি সুমন। চিনতে পেরেছ এবার? নাম বদলে আমি রাজ। শুধু নামটাই বা বলি কেন সব কিছুই বদলে ফেলেছি। কিভাবে এই বদল সম্ভব হল আমি সত্যিই জানি না।
অতসী অবাক হচ্ছে মনে মনে। সেই সাথে খুশীও। তার ভালোলাগার মানুষটাই তার প্রেমে পড়েছিল। আজ এই মানুষটাকে প্রেমের প্রস্তাব দিতে আর দ্বিধা রইল না।
– বাপিকে তোমার কথা বলেছি। বাপি বলেছে এই সিনেমার শুটিং এর পরেই তোমার বাবার সাথে কথা বলবে যাতে এনগেজমেন্টটা তাড়াতাড়ি সেরে ফেলা যায়।
রাজ হাসে।
– কাল শুটিং-এর শেষ দিন। কাজটা আগে ভালোভাবে শেষ করি তারপর এই নিয়ে কথা বলা যাবে।
শুটিং শেষ। এবার প্যাকআপের পালা। কিছুক্ষণ আগেই শুটিং ফ্লোরটা হাততালিতে ফেটে পড়ছিল; এত সাবলীল হয়েছে শেষ দৃশ্যে ওদের রোমান্টিক প্রেমের শর্টটা।পরিচালক ভীষণ খুশী।
গতকালই রাজ বলেছিল শুটিং শেষ হলে অতসীকে ট্রিট দেবে। জীবনে প্রথমবার এত বড় একটা মঞ্চে এত সুন্দর অভিনয়ের পুরস্কার। রেস্টুরেন্টে খেতে খেতে এনগেজমেন্টের কথাটা তুলেছে অতসী। অস্ফুট হেসেছে রাজ। বলেছে, – লোভ যে একেবারেই হচ্ছে না তা নয়। কিন্তু উপায় নেই বন্ধু। আমি একজনকে ভালবাসি আর সেও ভালবাসে আমাকে। আজ নয়,দীর্ঘ এগারো বছর ধরে তার সাথে আমার সম্পর্ক। সে না থাকলে আমার এখানে আসা হত না। আজ বুঝতে পারি তোমার প্রতি যে ফিলিংসটা ছিল সেটা ভালবাসা নয়,ওটা এক ধরনের ইনফ্যাচুয়েশান। ভালো আমি একজনকেই বেসেছি। আর বিয়ে করলে তাকেই করব।
রাগে অতসী থরথর করে কাঁপছে। ওর জ্বলন্ত চোখ দুটো রাজকে একবার বিদ্ধ করে বলল
– আমার সাথে তাহলে অভিনয় করলে তুমি?
-যেটুকু করেছি সেটা মুভিটার প্রয়োজনেই করেছি। তার বেশী কিছু নয়। আমাদের মধ্যে একটা ইমোশানাল অ্যাটাচমেন্ট তৈরি না হলে শেষ দৃশ্যের ওই অভিনয়টা করা সম্ভব ছিল না। এই মুভিটা দারুণ হিট করবে দেখো। তুমি মার্কেটে দাঁড়িয়ে যাবে।
অতসী এসব কিছুই চায়নি। সে যাকে চেয়েছে সে অন্য একজনকে ভালবাসে। আধ খাওয়া প্লেটটা টেবিলে রেখে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে এসেছে। হোটেলে ফিরতে ফিরতে ভেবেছে- ছেলেদের মন বলে কিছু আছে কি? নাকি পুরোটাই অভিনয়!
রাজ ওর চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে এক যুগ আগের একটা দৃশ্যের কথা ভেবে চলেছে। সেদিনও সুমন রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে ভেবেছিল- মেয়েদের মন বলে কিছু আছে? নাকি……