মরণের পরে : সমীর ঘোষ।

0
866

গণেশ বাবু মারা গেলেন। সাদা কাপড়ে ঢাকা বারান্দায় শোয়ানো আছে তার নিথর দেহ।
উঠোনে গ্রামের মানুষের জমায়েত।শ্মশানযাত্রার আয়োজন করছে শ্মশান বান্ধবরা।
পম্পা ভাবছে কিছুক্ষণ আগের জীবন্ত শরীরটা এখন একটা লাশ মাত্র। আর কিছুক্ষণ পরেই সেটা পুড়ে ছাই হয়ে যাবে এইতো জীবন! এই জীবন নিয়েই মানুষের কত অহংকার।কত আদিখ্যেতা।
পম্পার অপলক চোখের সামনে যেন একটা জায়ান্ট স্ক্রিন ঝুলছে। তাতে বারে বারেই ভেসে উঠছে টুকরো টুকরো স্মৃতির কোলাজ।
গণেশ বাবু পুলিশ বিভাগে চাকরি করতেন। নির্মেদ- সুঠাম চেহারা। মানুষ হিসেবেও খুব সহজ সরল। গ্রামের প্রায় সকলের অতি প্রিয় মানুষ।
গণেশ বাবুর আরও তিনজন ভাই আছে ।দাদার প্রয়াণে তারাও চোখের জল ফেলছে।
পম্পার চোখের সামনে ভেসে উঠছে, চাকরিস্থলে থেকে বাবা ফিরছে, তখন সে ক্লাস এইটে পড়ে। বাবার দুহাতে দুটো ভারী ব্যাগ একটাতে পুলিশের রেশন, অন্যটাতে বাড়ির নিত্যপ্রয়োজনীয় দোকান বাজার।
বারান্দায় ব্যাগ দুটো নামিয়েই মেয়েকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে লাগলেন।
পম্পা জিজ্ঞাসা করল- বাবা তুমি আমার চুরিদার এনেছো?
গণেশবাবু নিরুত্তর।মনে পড়ে গেছে, মেয়ে তো বলেছিল আসার সময় আমার জন্যে—-
– আমি একেবারে ভুলে গেছি মা। পরেরবার ঠিক মনে থাকবে ।
পম্পা চিৎকার করে কাঁদে আর বাবার বুকে কিল মারতে থাকে।
– তুমি কেন ভুলে যাবে? প্রিয় মা চিৎকার করে ওঠে,
-এই তুই কি আরম্ভ করেছিস বলতো? মানুষটা এইতো সবে এল একটু হাত-মুখে জল নিতেও দিবি না?
– না দেবো না, আমাকে আজকেই চাই।
– মেয়েছেলের এত জেদ ভালো নয়, আর তুমি তো ওকে লাই দিয়ে দিয়ে মাথায় তুলেছো।
গণেশ বাবু হাসতে হাসতে বলেন,
– তুমি থামো তো ।
তারপর মেয়েকে বললেন
– তোকে আজকেই কিনে দেবো মা—
গণেশবাবুর এক বোন কেঁদে কেঁদে এসে উঠোনে আছড়ে পড়তেই ক্ষীন হয়ে আসা কান্নার রোল আবার তীব্র হলো।
উঠোনে বসে কীর্তনীয়ারা খোল আর করতাল সহযোগে উচ্চঃস্বরে হরিনাম সংকীর্তন করছে।
মানুষ এই পৃথিবীতে আসে মাত্র কিছুদিনের জন্য ভ্রমণ করতে। রিটার্ন জার্নির টিকিট কেটেই এখানে আসা। ফিরে যেতে হবে জেনেও শিল্পী গেয়ে ওঠেন,
-এই সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে মন যেতে নাহি চায়, নাহি চায়।
তবু ও নিঠুর মরণ কেনো এখান থেকে ডেকে নিয়ে যায়।
জানিনা কোথায়?
চোখের সামনে পম্পা দেখছে,
তার কাকার মেয়ে ডায়না একদিন তাকে শাঁকচুন্নি বলেছিল বলে,যখন সে বাবার কাছে নালিশ জানিয়ে ছিল তখন গণেশ বাবু ডায়না কে বলেছিলেন,
– এ্যাই ডায়না তুই আমার খেপিকে শাঁকচুন্নি বলেছিস কেন?
ডায়না বলে,
– ও আমাকে ডাইনি বলবে কেন?
– ও তোকে ডাইনি বলেছে বলে তুই ওকে শাঁকচুন্নি বলবি?
– তুমিইতো বলেছ জেঠু, ও যখন তোকে ডাইনি বলবে তুই ওকে বলবি—
পম্পা চিৎকার করে কেঁদে ওঠে,
– বাবা তুমি—-
– নারে মা আমার লক্ষী মেয়েকে আমি কখনো—
পুরোহিত এসেছে চন্দ্রায়ন হবে। তারপর শ্মশান যাত্রা।
উঠোনে উপস্থিত জনতার অশ্রুভেজা স্বরে নানান গল্পগাঁথা।
– একজন ভালো মানুষ চলে গেল ।
– ভালো মানুষরাই আগে যায় ।
– আমি কাকার লাল সুতোয় বাঁধা এক প্যাকেট করে বিড়ি কিনে এনে দিতাম। বিনিময়ে আমাকে দশ টাকা করে দিত। আমি না নিলেও জোর করে আমার হাতে গুঁজে দিয়ে বলতো ছেলের জন্যে চকলেট বিস্কুট কিনে নিয়ে যাবি।
গণেশ বাবুর তখন পশ্চিমাঞ্চলের এক থানায় পোস্টিং ।সুন্দর মুখের জয় সর্বত্র ।তাই গণেশ বাবু থানার সকল স্টাফের খুব কাছের মানুষ ছিলেন। ওই অঞ্চলে তখন এক নিষিদ্ধ সংগঠনের চোরাগোপ্তা আক্রমণের আতঙ্ক।
গোপন সূত্রে খবর পেয়ে থানার ওসি কয়েকজন কনস্টেবল নিয়ে নির্দিষ্ট স্থানে হাজির হতেই শুরু হলো ঝাঁকে ঝাঁকে গুলিবর্ষণ।
প্রত্যাঘাত করার আগেই একটা গ্রেনেডে এসে ফাটলো গণেশবাবুর পায়ের কাছে।
গণেশ বাবুর রক্তাক্ত- ক্ষতবিক্ষত শরীরটা অ্যাম্বুলেন্স হুটার বাজিয়ে তাড়াতাড়ি নিয়ে ছুটলো হাসপাতালে।
শ্বশুরবাড়িতে টিভির স্ক্রিনে বাবার রক্তাক্ত ছবিটা দেখে চিনতে পেরে পম্পা যখন কান্নায় ভেঙে পড়েছে তখন পম্পার শশুর তাচ্ছিল্যের সুরে বলেছিল ,
-ও মরে গেছে ,আর কি হবে—–
দীর্ঘ কয়েক মাস মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে যমের দুয়ারে কাঁটা দিয়ে ফিরে এলেও একটা চোখ চিরদিনের জন্য হারিয়ে আসতে হয়েছিল হাসপাতালে।
তখন হাসপাতালে দেখতে এসে কত মন্ত্রীর
প্রশংসা আর শুভকামনা।
তারপর চাকরি থেকে অবসর নিয়ে বাড়িতে।
অবসরের দিন সহকর্মীদের চোখের জল আর রঙিন ফুলের সম্ভারে বিদায় সম্ভাষণ।
সেদিনের সেই লড়াকু শরীরটা আজ নীরব নিথর নিস্পন্দ।
মেয়ের বিয়ের আগে তার শ্বশুরবাড়ির মানুষগুলোকে গণেশ বাবু চিনতে পারেননি।পরে জেনেছেন পম্পার শ্বশুরবাড়ির কারোর সঙ্গেই গ্রামের কোন লোকের ঠিকমতো বনিবনা নাই।
পম্পার উপর শ্বশুরবাড়ির শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন দেখে নীরবে চোখের জল ফেলতেন।
পম্পা এখন চোখের সামনে অদৃশ্য স্ক্রিনে দেখছে,
তার বাবা যেন পুলিশের রেশন ভর্তি ব্যাগ নিয়ে তার শ্বশুরবাড়িতে ঢুকছে। সদা হাসিখুশি মানুষটাকে তার অসভ্য শশুরের অপমান হজম করে ফিরে আসতে হচ্ছে।
মনে পড়ছে তার বাবার একটাই আফসোস মেয়েকে তিনি উপযুক্ত ঘর এবং বর দেখে দিতে পারলেন না।
পম্পা বাবাকে বুঝিয়েছে, – আর আফসোস করে কি হবে সবই আমার কপাল! কে শোনে কার কথা। এর জন্য একমাত্র নিজেকেই দায়ী করে বুক চাপড়ে চোখের জল ফেলতেন।
সমস্ত নীরবতা ভেঙে দিয়ে পম্পা এখন চিৎকার করে কাঁদছে।
– আমি এবার কাকে বাবা বলে ডাকবো——
প্রতিবেশী কয়েকজন মহিলা তাকে ধরে সান্ত্বনা দিচ্ছে, চোখে মুখে জল দিচ্ছে ।
– মানুষটা যা কষ্ট পাচ্ছিল —-।
এইতো কদিন আগেই পম্পা যখন বাপের বাড়ি এসেছিল গণেশ বাবু তখন অসুস্থ হয়ে একেবারে শয্যাশায়ী।
সারা শরীরে অসহ্য যন্ত্রণা। পম্পা বাবার হাত পা গুলো মেসেজ করে দিচ্ছিল। গণেশ বাবু যন্ত্রণা কাতর কণ্ঠে মেয়েকে বলেছিলেন,
– মারে ভগবান কে বল আমাকে তাড়াতাড়ি নিয়ে নিতে আমি যে আর যন্ত্রণা সহ্য করতে পারছিনা। তোর মাকে বল না আমাকে একটু বিষ এনে দিতে আমি আর এভাবে বেঁচে থাকতে চাইনা।
পরক্ষণেই আবার ভুল বকতে শুরু করেন,
– ওই দ্যাখ,দ্যাখ জানলার কাছে আমার বাবা দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে নিয়ে যেতে এসেছে রে। না না আমি যাব না। আমি চলে গেলে আমার মেয়েটাকে দেখবে কে? পম্পা বাবার শরীরটাকে ঝাঁকুনি দিয়ে বলে,
– কি হল বাবা এমন করছো কেন?
– তোর দাদু আমাকে ডাকছে। আমি যেই বলেছি যাব না, আমাকে বলল মরতে যদি এত ভয় তাহলে জন্ম নিয়েছিলে কেন?
সেদিনও পম্পার দু চোখ জলে ভরে গিয়েছিল বাড়ি ফিরে এসে কত রাত ঘুমাতে পারেনি বাবার কথা ভেবে।
উঠোনে ফুল দিয়ে সাজানো খাট আনা হয়েছে। যে খাটে শুয়ে গণেশ বাবুর নির্বাক- নিশ্চল দেহটা চলে যাবে সাজানো সংসার ছেড়ে।
ফেরে না কেউ যেথায় গেলে হায় !
সাধ করে আর কেই বা বল সেথায় যেতে চায়?
তবু একদিন সবাইকেই যেতে হবে পৃথিবী নামক রঙ্গমঞ্চের নাটক শেষ করে।
তাইতো শেক্সপীয়ার লিখেছেন,
All the world’s a stage,
And all the men and women merely players;
They have their exits and entrances,
And one man in his time plays many parts,——-
দীর্ঘ রোগভোগের পর গণেশ বাবু আজ মারা গেলেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল — । তিনি রেখে গেলেন স্ত্রী এবং- – – -। আর কিছু অপূর্ণ স্বপ্ন।
গ্রামের প্রবীণ ব্যক্তিরা এখন অন্তিম কালীন বিধান দিয়ে যাচ্ছেন। পম্পার মা জলভরা চোখে তার যৌবনের সফরসঙ্গী সুখ-দুঃখের জীবনসঙ্গীকে এখন গোবরগোলা জল ছিটিয়ে বিদায়-সম্ভাষণ জানাচ্ছে।
একজন একটা তুলসী গাছের চারা নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে ।
চিতা নেভানোর পর ওই চারাটা চিতার উপর পুঁতে দেওয়া হবে।
এখন থেকে গণেশ বাবু একটা তুলসী গাছ হয়েই বেঁচে থাকবেন।