ভয় : একটি রক্ষাকবচ :: সৌরভ কুমার ভূঞ্যা।

0
767

করোনা, মহামারী, বিশ্ব বিপর্যয় প্রভৃতি ব্যাপারগুলো আপাতত একটু সরিয়ে রেখে বরং দুটো গল্প বলি। গল্প দুটি আমার নয়। একটি পড়া এবং অপরটি শোনা। অনেকেই এই গল্পদুটির সঙ্গে পরিচিত আছেন। তবুও এই মুহূর্তে গল্প দুটি বলার ইচ্ছে হচ্ছে। প্রথম গল্পটি পড়েছিলাম কোনো নীতিগল্পের বইতে। অনেকদিন আগে পড়া। ঠিকঠাক মনে নেই। তবে গল্পটি মোটামুটি এইরকম…চার বন্ধু গুরুগৃহে শিক্ষা সম্পন্ন করে বাড়ি ফিরছে। রাস্তা দিয়ে আসতে আসতে তারা দেখে এক জায়গায় কিছু হাড়গোড় পড়ে আছে। কাছে গিয়ে বুঝতে পারে সেগুলো বাঘের। বন্ধুরা স্থির করল তাদের বিদ্যাশিক্ষা ঠিকঠাক হয়েছে কিনা পরীক্ষা করবে। তারা স্থির করল ওই বাঘটিকে বাঁচিয়ে তুলবে। প্রথম তিন বন্ধু খুব উৎসাহী হয়ে পড়লেও চতুর্থ বন্ধু কিছুতেই রাজি হয় না। খুব ভয় পেয়ে যায় সে। সে বারবার তাদের বারণ করতে থাকে। কিন্তু তার কথা কানে দেওয়া দূরে থাক, বাকিরা তাকে ভীরু, কাপুরুষ প্রভৃতি নানান কথা বলে উপহাস করে। তারা কঙ্কালের পাশে বসে পড়ে কিন্তু চতুর্থ বন্ধু ভয় পেয়ে একটি উঁচু গাছে উঠে বসে। তিন বন্ধু তাদের কাজ শুরু করে। প্রথম বন্ধু তার বিদ্যা কাজে লাগিয়ে বাঘের অস্থি সংযোজন করে। দ্বিতীয় বন্ধু তার বিদ্যা কাজে লাগিয়ে বাঘের শরীরে মাংস, চামড়া, রক্ত প্রভৃতি সংযোজন করে। এবার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। তৃতীয় বন্ধু তার বিদ্যা কাজে লাগিয়ে বাঘের মধ্যে প্রাণ সঞ্চার করে। আর মরা বাঘ পুনরায় জীবন ফিরে পেয়ে ‘কৃতজ্ঞতা’ জানিয়ে তিন বন্ধুকেই মেরে ফেলে। চতুর্থ বন্ধু গাছে থাকার জন্য বেঁচে যায়। এই গল্পের মধ্যে শিক্ষার অনেক কিছু আছে। আমি কেবল দুটো জিনিসের কথা উল্লেখ করতে চাই। প্রথমত জেনেশুনে নিজের বিপদ ডেকে আনাটা মূর্খামির পরিচয়। দ্বিতীয়ত ভয় থাকা ভালো। আমরা সাধারণ কথায় বলি, ভয় পাওয়া উচিৎ নয়। কিন্তু এটাও ঠিক ভয় অনেক সময় আমাদের নিরাপত্তার ঢাল হিসাবে কাজ করে। কারও মনে হতে পারে ভয় নয় চতুর্থ বন্ধু রক্ষা পেয়েছে তার সচেতনতার জন্য। অবশ্যই, সেটাই আসল কারণ। কিন্তু এটাও অস্বীকার করা যাবে না সচেতনতার পেছনে ভয়ও একটা ফ্যাক্টর। ভয় থেকে যেমন অনেকক্ষেত্রে ভক্তি আসে, তেমনি আসে সচেতনতাও।

দ্বিতীয় গল্পটি বেশ মজাদার। ক্লাস ইলেভেনে এক অধ্যাপকের কাছে ফিজিক্স পড়তে যেতাম। সে অনেকদিন আগের কথা। নন্দীগ্রাম বাসস্টান্ডের কাছাকাছি ছিল তাঁর বাড়ি। পড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে তিনি বেশ মজাদার গল্প বলতেন। একদিন ‘ইলেকট্রন’ পড়াতে পড়াতে বজ্রের প্রসঙ্গ আসে। তখন তিনি আমাদের গল্পটি বলেন। এটাকে গল্প না বলে জোকসও বলা যায়। একদিন তিনবন্ধু বাড়ি ফিরছিল। হঠাৎ জোর বৃষ্টি আসে সেই সঙ্গে প্রচণ্ড বজ্রপাত। আশেপাশে কোনো ঘরবাড়ি নেই। একটা মাটির চালাঘর দেখতে পেয়ে তারা তার নীচে গিয়ে আশ্রয় নেয়। সহসা তারা স্থির করে তাদের মধ্যে কে সাহসী সেটা পরীক্ষা করবে। চালা থেকে কিছুটা দূরে একটা তালগাছ। চ্যালেঞ্জ হয়, প্রত্যেককে সেটা ছুঁয়ে ফিরে আসতে হবে। প্রথম বন্ধু গিয়ে ছুঁয়ে ফিরে আসে। দ্বিতীয় বন্ধুও তাই করে। এবার তৃতীয় বন্ধুর পালা। কিন্তু সে বেঁকে বসে। ঝোঁকের মাথায় রাজি হয়ে গিয়েছিল সে। কিন্তু এত ঘন ঘন বাজ পড়ছিল যে সে ভয় পেয়ে যায়। সে কিছুতেই যেতে চায় না। কিন্তু বন্ধুরা ছাড়ার পাত্র নয়। তারা তাকে বারবার বলে যাওয়ার জন্য কিন্তু তৃতীয় বন্ধু চালাঘরের খুঁটি জোর করে আঁকড়ে ধরে থাকে। বাকি দুই বন্ধু খুব রেগে যায়। দুজনে মিলে তাকে চ্যাঁদোলা করে নিয়ে গিয়ে তালগাছের নীচে ফেলে দিয়ে চালাঘরে ফিরে আসে। আর তখনই চালাঘরের ওপর বাজ পড়ে। দুই বন্ধু মারা যায়। কিন্তু তৃতীয় বন্ধুটি বেঁচে যায়। আগেই বলেছি এটা একটা মজার গল্প। এর মধ্যে কোনো নীতিকথা নেই। যারা নিয়তি বিশ্বাস করে তারা বলবে তৃতীয়জন কপালের জোরে বেঁচে গেছে। হয়তো তাই। কিন্তু এটাও ঠিক তার এই বেঁচে যাওয়ার পেছনে পরোক্ষভাবে কাজ করছে ভয়। যদিও এই বেঁচে যাওয়ার পেছনে যুক্তিগ্রাহ্য কোনো ব্যাখ্যা নেই।

এই যে দুই ভয়, এর ব্যাখ্যা সরিয়ে রেখে শুধু একটি কথা বলতে চাই, ভয় অনেক সময় মানুষের রক্ষাকবচ হিসাবে কাজ করে। একটু যদি গভীরভাবে আমরা বিশ্লেষণ করি তাহলে দেখতে পাবো মানুষ ভয়ের কারণে এমন অনেক কাজ করা থেকে বিরত থাকে যা তার সুস্থ জীবনের রক্ষাকবচ হিসাবে কাজ করে। অর্থাৎ ভয় মানুষের হৃদয় ও মনকে নিয়ন্ত্রিত করে। প্রাচীন গ্রিক নাট্যকার ইস্কুলাসের কথায়, “There are times when fear is good. It must keep its watchful place at the heart’s controls.” আমরা জানি পাপ কিংবা নরকের ভয় থেকে অনেক মানুষ খারাপ কাজ করা থেকে বিরত থাকে, শাস্তির ভয়ের কারণে বহু মানুষ অন্যায় থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখে, শাষণের ভয়ে ছাত্রছাত্রীরা সুশৃক্ষল হয় প্রভৃতি। মনে রাখতে হবে ভয় থাকা মানেই কিন্তু কেউ ভীতু নয়। ভীতু হওয়া একদমই ঠিক নয়। মনে ভয় থাকবে এবং আমরা অবশ্যই ভয়কে জয় করার চেষ্টা করব। এভাবেই আমরা নিজেদের সমৃদ্ধ করতে পারব।

চীনের উহানে যখন করোনা ভাইরাসের আক্রমণ শুরু হয় তখন আমরা অনেকেই ভয় পাইনি। এমনকি সেখানে যখন আক্রান্তের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছিল, সেই সঙ্গে দীর্ঘ্য হচ্ছিল মৃতের তালিকা, তখন চীনের দূর্দশা দেখে আমরা সমবেদনা প্রকাশ করেছি, উহু-আহা করেছি কিন্তু ভয় পাইনি। কোথায় চীন আর কোথায় আমরা! ভয় পেতে যাবো কেন? কিন্তু করোনা যখন চীন ছাড়িয়ে বিশ্ব ভ্রমণে বের হয় তখন তা একটু একটু করে মাথাব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

আমেরিকা, ইতালি, ফ্রান্স, স্পেন প্রভৃতি দেশগুলি চীনের বিপর্যয় দেখেও ভয় পায়নি। এমনকি নিজেদের দেশে যখন একটু একটু জোর হচ্ছিল করোনার কাঁটা তখনও। অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস তাদের দুঃসাহসী করে তুলেছিল। তারা হয়তো ভেবেছিলেন খুব সহজেই রুখে দেবেন করোনা তাণ্ডব। অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ দেশ, চিকিৎসা পরিকাঠামো উন্নত, সুতরাং ভয় কী? আর ভয় পায়নি বলে করোনা মোকাবিলায় আগাম যে সচেতনতা নেওয়া দরকার ছিল তা তারা ঠিকঠাক নেয়নি। তার পরিণতি আমরা দেখতে পাচ্ছি। মৃত্যুর মিছিল চলছে ওই দেশগুলিতে। শুধু আমেরিকায় আক্রান্তের সংখ্যা এখনই ১৩ লক্ষ ছাড়িয়ে গেছে, মৃত্যু পঁচাত্তর হাজার ছুঁইছুঁই। করোনা তাদের কার্যত দিশেহারা করে দিয়েছে। করোণার মতো একটা ক্ষুদ্র ভাইরাসের কাছে তারা যে কতখানি অসহায় হয়ে পড়েছেন সেটা আমরা দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস আর ডোন্ট কেয়ার মানসিকতা সরিয়ে রেখে তারা যদি করোনাকে ভয় পেতেন, তাহলে নিজেদের আগাম সচেতন করতে পারতেন। এই বিপর্যয় হয়তো তখন দেখতে হত না।

শত্রুকে যুদ্ধক্ষেত্রে হারিয়ে জয়লাভ করব, সবসময় এই মনোভাব চলে না। অনেক সময় শত্রুকেও মর্যাদা দিতে হয়। বিবেচনা করতে হয় যুদ্ধের পরিস্থিতি। যুদ্ধে ‘Good Retret’ বলে একটি কথা আছে। সরাসরি জয়ের সম্ভাবনা না থাকলে, উল্টে বিস্তর প্রাণহানি ও ক্ষতির সম্ভাবনা থাকলে, তখন আপাতত পিছিয়ে এসে নিজেকে সুরক্ষিত করতে হয়। বোকার মতো শহীদ হওয়ার থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখাটা বুদ্ধিমানের কাজ। আর এই পিছিয়ে যাওয়া মানে ভয় পাওয়া নয়। এটাও যুদ্ধের একটা কৌশল। মনে রাখতে হবে সফল পশ্চাদসারণ একটা বড়ো জয়। বিখ্যাত লেখক নর্মান ভিনসেন্ট পেল-এর কথায়, “Part of the happiness of life consists not in fighting battles, but in avoiding them. A masterly retreat is in itself a victory.” করোনার বিরুদ্ধে সরাসরি লড়াই করার অস্ত্র যদি আমার হাতে না থাকে, তাহলে তার বিরুদ্ধে ঔদ্ধত্য না দেখিয়ে আপাতত কিছুটা পিছিয়ে আসাই বুদ্ধিমানের কাজ। নিজেকে যতটা সম্ভব সুরক্ষিত করে তার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কৌশল ঠিক করা। কিন্তু ওইসব দেশগুলি তা করেনি। তার ফলে যা হওয়ার কথা ছিল তাই হয়েছে।

একশো তিরিশ কোটি মানুষের দেশ ভরতবর্ষ। দেশের পরিচালকরা (কেন্দ্র রাজ্য উভয়ই) কিন্তু করোনার বিরুদ্ধে দুঃসাহস দেখাননি। তারা করোনাকে ভয় পেয়েছেন। অচেনা শত্রুর বিরুদ্ধে ঔদ্ধত্য না দেখিয়ে তাকে তার প্রাপ্য গুরুত্ব দিয়েছেন। দেশে করোনার প্রকোপ যখন একটু একটু করে বাড়ছিল তখন কিছু কিছু আশ্বাসবাণী ভিস্যুয়াল মিডিয়া, প্রিন্টেড মিডয়া, সোশ্যাল মিডিয়া প্রভৃতিতে ঘোরাফেরা করছিল। ভারতবর্ষে এই গ্রীষ্মে যা তাপমাত্রা তাতে করোনা ভাইরাস বেঁচে থাকতে পারবে না। যে সময় ভারতে করোনা আক্রমণ হয়েছে সেটা করোনার down storm period. তাই এর আঘাত মারাত্মক হবে না। অনেকে এমনও বলেন দরিদ্র প্রধান দেশ ভারতবর্ষের মানুষেদর গড় ইমিউনিটি অনেক ভালো। তাই করোনা মানুষকে কাবু করতে পারবে না। মনে রাখতে হবে এইসব কথাগুলো কোনো সাধারণ মানুষের নয়। চিকিৎসক, গবেষক প্রমুখ বিশিষ্ট মানুষদের। কিন্তু আমাদের দেশ ও রাজ্যের পরিচালকরা এসব শুনে নিশ্চিন্ত হয়ে বসে থাকেননি। তাদের মনে ভয় ছিল কোনোভাবে যদি করোনা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে তাহলে ভয়ংকর অবস্থা সৃষ্টি হবে। অবস্থা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। কেননা নিজেদের অর্থনৈতিক দুর্বলতা ও চিকিৎসা ব্যবস্থার অপ্রতুলতার বিষয়ে ভালোমতই সচেতন তারা। তাই সময় থাকতে থাকতে তারা সচেতন হয়েছিলেন যাতে করে করোনার বিরুদ্ধে লড়াই করার সময় ও সুযোগ পাওয়া যায়। সে কারণেই আমাদের দেশ এখনো করোনায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েনি।

ভারতবর্ষে প্রথম করোনা সংক্রমণ ধরা পড়ে ৩০ জানুয়ারি, কেরালায়। মার্চের মাঝামাঝি সংখ্যাটা গিয়ে দাঁড়ায় একশো। ২৪ মার্চ সংখ্যাটা পাঁচশো ছাড়ায়। ভারতবর্ষের মতো বিশাল জনসংখ্যার দেশে সংখ্যাটি খুবই নগন্য। কিন্তু সেদিনই প্রধানমন্ত্রী সারা দেশে একুশ দিনের লকডাউন ঘোষণা করেন। কিছু কিছু রাজ্য তারও আগে লকডাউন ঘোষণা করে দিয়েছিল। যাই হোক তিন দফায় লকডাউন বৃদ্ধি পেয়ে আগামী ১৭ মে পর্যন্ত কার্যকর হয়েছে। আক্রান্তের দিন থেকে ধরলে ইতিমধ্যে আমরা প্রায় একশোদিন পেরিয়ে এসেছি। এখন আমাদের দেশে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ৫৩ হাজার আর মৃত্যের সংখ্যা প্রায় ১৮০০। একটি মৃত্যুও বেদনার। কিন্তু বিশ্বের নিরিখে যদি আমরা তুলনা করি তাহলে দেখতে পাবো আমাদের অবস্থা এখনও বেশ ভালো। করোনা এখনও পর্যন্ত আমাদের পুরোপুরি বিপর্যস্ত করে দিতে পারেনি। এখনও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। আগামী সময়ে অবস্থা কী হবে তা সময়ই বলবে। হয়তো করোনা যুদ্ধে আমরা বিশ্বে একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারব। হয়তো বললাম এই কারণে, একটা আশঙ্কাও আছে। সেটা হল ভয় ভুলে মানুষের দুঃসাহসী হয়ে ওঠা। কেউ কেউ বলছেন আমাদের দেশ করোনা আক্রমণের পিক পিরিয়ড পেরিয়ে এসেছে, কেউ বলছেন সবচেয়ে ভয়ের সময় মে মাসের শেষ থেকে জুনের মাঝামাঝি। এইসব তথ্যে সরিয়ে একটি কথা বলার, করোণার সংক্রমণ আমাদের দেশে কিন্তু ধীরে ধীরে বাড়ছে। সেই সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুর সংখ্যাও। এই অবস্থায় আমরা যদি অতিরিক্ত দুঃসাহসী হয়ে পড়ি, যদি স্বাস্থ্যবিধি না মানি তাহলে পরিণাম কী হবে সেটা আগাম অনুমান করাও সম্ভব নয়।

করোনা মোকাবিলয়া প্রথম যখন লকডাউন ঘোষণা হয় তখন দেখা যায় বহু মানুষ তা গুরুত্ব সহকারে নেয়নি। ফলে লকডাউন উপেক্ষা করে রাস্তায় ভীড় করেছে মানুষ। পুলিশ লাঠি ধরেছে। তখন দেখা গেছে করোনা নয়, অনেকে পুলিশের ‘ভয়’-এর কারণে গৃহবন্দী থেকেছে। পরবর্তীকালে নানাভাবে মানুষকে সচেতন করা হয়েছে। পাশাপাশি বিশ্বের করোণা তাণ্ডব দেখতে দেখতে ভয় পেয়েছে মানুষ। এসব কারণে তারা নিজেদের অনেকটাই সংশোধন করেছে। ফলে করোণার প্রকোপ আপাতত অনেকটাই ঠেকানো গেছে। সবাই যে পুরোপুরি সব নিয়ম মেনেছে বা এখনও মানছেন এমনটা নয়। যদি মানতো তাহলে আমাদের দেশের বর্তমান ছবিটা আরও উজ্জ্বল হত। তবে একটা কথা স্বীকার করতেই হবে, ভয় বলি কিংবা সচেতনতা, দেশের বেশিরভাগ অংশের মানুষ কিন্তু সরকারি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলছেন। মানছেন না যারা শতাংশের বিচারে তারা খুব কম। কিন্তু সেটা কোনো আশার কথা নয়। কেননা করোনা এমন একটি ভাইরাস যা একটি লোককে আক্রমণ করতে পারলে কয়েকশো গুনের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ার ক্ষমতা রাখে।

দীর্ঘদিন মানুষ গৃহবন্দী। এমন জীবনে অভ্যস্ত নয় মানুষ। ভেতরে ভেতরে ছটফট করছেন তারা, হাঁফিয়ে উঠছেন। লড়াইটা তারাও লড়ছেন। অনেক কষ্ট তবুও তারা প্রাণপণ চেষ্টা করছেন পরিস্থিতির সঙ্গে মোকাবিলা করার। কিন্তু কেউ কেউ ভয়কে তুড়ি মেরে বেপোরোয়া হয়ে উঠছেন। তাই কোথাও কোথাও লকডাউন একটু শিথিল হতেই বিভিন্ন জায়গায় মানুষের যে ভিড় দেখা যাচ্ছে তা আতঙ্কের বাতাবরণ সৃষ্টি করছে। বাজার, রেশন দোকান, ব্যাঙ্ক, মদের দোকান প্রভৃতি জায়গায় মানুষেষ ভীড় এবং সামাজিক দূরত্ব না মানা বেশ আশঙ্কার। কোথাও বাধ্যবাধকতা, কোথাও প্রতিকূলতা, কেথাও আবার সেই ডোন্ট কেয়ার মানসিকতা। এটাই বাস্তব, প্রত্যেকের যে কোনো কাজের পেছনে তার নিজস্ব নিজস্ব যুক্তি রয়েছে। যে লোকটা নিয়মিত মদ খায় আর মাতলমি করে, তাকেও জিজ্ঞেস করলে সে তার কাজের পেছনে একটি যুক্তি দেখাবে। যুক্তি বা অজুহাত যার যাই থাক না কেন পরিস্কার কথা এটাই মানুষের জমায়েত, সামাজিক দূরত্ব না মানা, স্বাস্থ্যবিধি লঙ্ঘন করা একেবারেই ঠিক নয়। কেননা করোনার কাছে কোনো যুক্তি বা অজুহাত টিকবে না। শহীদের গর্বলোভী কিছু কিছু মানুষের এমনও বক্তব্য, মরতে তো একদিন হবেই। এভাবে বিধ্বস্ত জীবন কাটানোর থেকে করোনায় মৃত্যু হয় তাও ভালো। কিন্তু তাদের মনে রাখা দরকার, একজন করোনা আক্রান্ত ব্যক্তি সমাজে অসংখ্য মানুষের করোনা আক্রান্তের কারণ হন। তাই নিজের সচেতনতার পাশাপাশি বাকিদের কথাও ভাবতে হবে। আর একটি কথা না বললেই নয়, তা হল করোনায় মৃত্যু। মৃত্যু কত ভয়ানক, কত নিঃসঙ্গ, কত যন্ত্রণার দেখলে শিউরে উঠতে হয়। মৃত্যু অনিবার্য কিন্তু এমন মৃ্ত্যু কোনো শত্রুরও আমরা বোধহয় চাই না। তাই মানুষের দুঃসাহসী কিংবা অসচেতন হওয়া ঠিক নয়। মনের মধ্যে ভয়টা বাঁচিয়ে রাখতে হবে। সেটা কেবল নিজের জন্য নয়, নিজের পরিবারের জন্য, সমাজের জন্য, দেশের জন্য। দেশ করোনা সংক্রমণমুক্ত হয়নি। কবে হবে কেউ জানে না। তাই যতদিন করোনা বিরুদ্ধে লড়াই করার উপযুক্ত অস্ত্র হাতে না আসছে ততদিন তাকে ভয় করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ।

এই ভয় শুধু বর্তমান সময়ের জন্য নয়, আগামীর জন্যও। দেশে যেদিন করোনা সংক্রমণ শূন্য হয়ে যাবে তখনও আনন্দিত হওয়ার কিছু নেই। সংক্রমণ শূন্য মানে দেশ বা বিশ্ব করোনামুক্ত, এমনটা নয়। সেটা হবে আপাতত ভাইরাসের আক্রমণটাকে ঠেকিয়ে দেওয়া। ভাইরাস কিন্তু থেকে যাবে। যে কোনো মুহূর্তে তার ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকবে। সেই ভয়টা মনের মধ্যে রেখে আমাদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। মনে রাখা দরকার করোনা ভাইরাস একেবারে নতুন কোনো ভাইরাস নয়। বহু বছর ধরেই এটি আছে। কিন্তু এর বর্তমান প্রতিনিধি অর্থাৎ কোভিড-১৯ চরিত্রগতভাবে আগেরগুলি থেকে আলাদা এবং এর সংক্রমণ ক্ষমতা অনেক বেশি। গবেষকরা এর চরিত্র নিয়ে নিরন্তর গবেষণা করে চলেছেন। বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীরা উঠেপড়ে লেগেছেন এর প্রতিষেধক আবিস্কার করার। কবে সেই প্রতিষেধক আবিস্কার হবে, কবে মানুষের তা মানুষের শরীরে প্রয়োগের পরিস্থিতি আসবে তা জানা নেই। যতদিন না তা আবিস্কার হচ্ছে করোনাকে ভয় করতে হবে মানুষকে। আর যদি শেষমেষ প্রতিষেধক আবিস্কার হয়ও, একেবারে ভয়মুক্ত হওয়ারও কোনো কারণ নেই। আমরা চাইছি ভাইরাসকে মেরে ফেলতে। ভাইরাসও চাইবে নিজের মিউটেশন ঘটিয়ে তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে। সেই মিউটেশনের হাত ধরে করোনার এই নতুন শক্তিশালী প্রতিনিধির আবির্ভাব। তাই আগামী সময়ে চরিত্র বদলে করোনা যে নতুন কোনো চেহারা নিয়ে হাজির হবে না তার তো কোনো নিশ্চয়তা নেই। পাশাপাশি এটাও বলার, করোনাকে যদিও বা নিয়ন্ত্রণ করা যায়ও, অন্য কোনো ভাইরাস আসতে পারে। মনে রাখতে হবে পৃথিবীকে পুরোপুরি ভাইরাস মুক্ত করে দেওয়া সম্ভব নয়। ভাইরাস ছিল, আছে এবং আগামীতেও থাকবে। মাঝে মাঝে কেউ কেউ তার তাণ্ডব চালানোর চেষ্টা করবে। এইসব নিয়েই আমাদের বেঁচে থাকতে হবে। আমাদের সচেতন হতে হবে। সেকারণেই মনের মধ্যেকার ভয় নামক বস্তুটিকে আমাদের একেবারে নির্মূল করে দেওয়াটা ঠিক হবে না। কেননা ওটাই পারে আমাদের আরও বেশি করে সচেতন হতে।

প্রসঙ্গত বলি, ভয় আর আতঙ্ক দুটো এক জিনিস নয়। অর্থের দিক দিয়ে প্রায় এক হলেও শব্দদুটির মধ্যে পার্থক্য আছে। ভয় হল একটা আবেগ এবং যেটা স্বাভাবিক কিন্তু আতঙ্ক ভয়ের নেতিবাচক এবং মাত্রাতিরিক্ত প্রকাশ। ভয় মানুষকে সচেতন করে, আতঙ্ক ভুল পথে চালিত করে। ভয় মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে, আতঙ্কিত হলে মানুষ সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। ভুলভাল কাজ করে। সহজকথায় বলি ভয় ইতিবাচক কিন্তু আতঙ্ক নেতিবাচক। এককথায় ‘নেতিবাচক ভয়’ হল আতঙ্ক। কোনো অবস্থাতেই আমাদের আতঙ্কিত হওয়া উচিত নয়। কেননা আতঙ্ক মানুষের খারাপই ডেকে আনে। কিন্তু ভয় এমন এক জিনিস যা মানুষের হৃদয় ও মনকে নিয়ন্ত্রিত করার মাধ্যমে তাকে একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলে। তাই ভয় কোনো ভাইরাস নয়। বরং বলা যেতে পারে ভয় হল এক ধরনের প্রতিষেধক। যে প্রতিষেধক শরীরের মধ্যে থাকলে আমরা অনেক খারাপ কিছুর সঙ্গে ঠিকঠাকভাবে লড়াই করতে পারি।

সবশেষে যেটা বলার, ভয়কে আমরা সবসময়ই জয় করার চেষ্টা করব। আমরা সাহসী হব। কিন্তু সেটা ভয়কে পুরোপুরি সরিয়ে দিয়ে নয়। ভয় না থাকা মানেই কেউ সাহসী এমনটা নয়। ভয় থাকবে এবং তাকে জয় করতে হবে, এটাই একজন সাহসী মানুষের পরিচয়। নেলসন ম্যান্ডেলার কথায়, “I learned that courage was not the absence of fear, but the triumph over it. The brave man is not he who does not feel afraid, but he who conquers that fear.” তাই মনের মধ্যে ভয় থাক আর সেই সঙ্গে থাক তাকে জয় করার প্রচেষ্টা। তার মাধ্যমে জাতি হোক সচেতন ও সাহসী, যা আমাদের অস্তিত্বের স্বাভাবিক ধারার জন্য অত্যন্ত অপরিহার্য।

বিদ্রঃ – মৃত্যু ও আক্রান্ত ৭ মে-এর তথ্য অনুযায়ী।

৭ মে, ২০২০।