বীরভূমের লোকশিব এবং জপেশ্বর মন্দিরের স্থানীয় মিথ ::: ঝিলিক কর্মকার।।।

0
1343

সিন্ধু সভ্যতা মূলত দ্রাবিড়ী । অতএব সিন্ধু সভ্যতায় প্রথম যে পাশুপত মূর্তি পাওয়া যায় তা দ্রাবিড় ভাষী পূজিত এবং রুদ্রশিবের ভিত্তি রচয়িতা। ক্রমে আর্য রুদ্র ও অনার্য শিবের সমাবেশ দেখা গেল। আনুমানিক ৬০০ খ্রি: পূর্বাব্দর আগে প্রচলন হল শিবপূজার। আর ১৫০ খ্রি: পূর্বাব্দর আগে গঠিত হল শিবমূর্তি। খ্রিস্টাব্দের প্রথম থেকে সাহিত্যে উল্লেখিত হতে থাকলেন শিব দেবতা।

   শিব সাধনার প্রসারিত ক্ষেত্রে তিনটি ধারা পাশাপাশি বহমান- ভূত শক্তি আশ্রিত রুদ্রপূজা, উপনিষদ ও দর্শন আশ্রয়ী শৈবধর্ম এবং মিশ্র সংস্কৃতি সম্পন্ন লৌকিক শিবপুজা।
  বাংলাদেশের ভারতশিবের আত্মপ্রকাশের প্রাচীনতম পরিচয় পাওয়া যায় বাণগড়ের ধ্বংসস্তূপে। গুপ্ত রাজত্বকালে( চতুর্থ- ষষ্ঠ শতাব্দী) পুরাণ শিব বাংলায় প্রাধান্য বিস্তার করতে থাকেন। শশাঙ্ক (ষষ্ঠ- সপ্তম) ছিলেন শৈব। তাঁর স্বর্ণ মুদ্রায় নন্দিবাহন মহাদেব খোদিত থাকত  । বর্মা- খড়্গ- ভরদ্বাজ প্রভৃতি রাজবংশও শৈবধর্ম এর পোষকতা করতেন।
 আর্যাবর্তের শৈব সম্প্রদায়ের মধ্যে মাহেশ্বর পাশুপতের নাম বাংলায় পাল আমল ( ৮ম- ১২শ) থেকেই শোনা যায়। এসময় মহাযানী বৌদ্ধধর্ম এবং শাক্ত ধর্মের তান্ত্রিক বিবর্তনের ফলে শক্তিসহ শিবের যোগ প্রাধান্য পেতে থাকে। পাল রাজাদের উদার নীতির সহায়ে শিব সম্প্রসারিত হওয়ার সুযোগ পান। মহাযানী বৌদ্ধধর্মের পতন এবং সেন রাজাদের (১২শ- ১৩শ) প্রত্যক্ষ ভাবে পৌরাণিক ব্রাহ্মন্য ধর্ম প্রচারের ফলে শিবের প্রতিষ্ঠা ভূমির পরিধি বিস্তৃত হলো । বাংলায় বৈষ্ণব মতের বহু পূর্বে শৈব মতের প্রাদুর্ভাব। বৌদ্ধ যুগের অবসানে পুরাণ ধর্মের প্রতিষ্ঠাকালে নেতৃত্ব করে শৈবধর্ম।
  বৈদিক শিব বাঙালির অনুভবে ও অনুভাবে হয়ে উঠলেন লোকশিব। বাংলায় তিনি আবির্ভুত হলেন যোগাশ্রিত শৈবধর্ম ও পুরাণ কথার আশ্রয়ে। বাংলা সাহিত্য জগতেও স্থান পেলেন এই লোকশিব। বাঙালী তাঁর দেবতার বর্ম পরিহার করে তাঁকে গড়ে তুললেন মধ্যযুগীয় মানুষের প্রতিরূপ রূপে। এই শিব কখনোই পুরাণের ধ্যানী- যোগী শিব নয়। এ শিব গ্রামবাংলার মানুষের চরিত্রায়ন।
  সমগ্র বাংলার মধ্যে বীরভূমে কয়েকটি শিবমন্দির গড়ে উঠেছে নানান লোককাহিনি কে আশ্রয় করে।  তেমনই একটি শিব মন্দির হলো বীরভূমের কীর্নাহারে জুবুটিয়া গ্রামে জপেশ্বর মহাদেবের মন্দির।
 শোনা যায় ১১৩৫ শকাব্দে সাহেবরাম চক্রবর্তী যিনি চক্রধর রাজা নামে পরিচিত তিনি এ মন্দির নির্মাণ করেন। জনশ্রুতি আছে এক গোয়ালা রোজ দুগ্ধ ভান্ড গাছ তলায় রাখতেন। (গাছতলাটি ৫টি গাছের সমাহার- পাকুড়, নাকুর, মোল, সুবাউস ও নিম) এবং নিত্য তার দুগ্ধ ভান্ড খোয়া যেত। পরবর্তী তে গোয়ালা স্বপ্নদর্শনে দুধচুরির ঘটনা জানতে পারেন ও মন্দির নির্মাণের আদেশ পান ।
১১৩৫শকাব্দে যখন মন্দির নির্মিত হয় সেসময় পরপর ৬টি টেরাকোটা মন্দির স্থাপনা করা হয়। প্রত্যেক মন্দিরে ভিন্ন ভিন্ন শিবলিঙ্গের আরাধনা করা হত। কিন্তু ভগ্ন মন্দিরের পুনর্নির্মাণ কালে মাত্র ১টি টেরাকোটা মন্দির অবশিষ্ট আছে। সেখানে  ৫টি শিবলিঙ্গ ও মহাকাল ভৈরব পূজিত হন।
মূল যে মন্দিরটি জপেশ্বর নামে পরিচিত সেটি পুনর্নির্মাণ হয় ১৪১১সালের ৪ঠা কার্তিক। প্রতিরক্ষামন্ত্রী প্রণব কুমার মুখোপাধ্যায় পুনর্নির্মাণের সমস্ত উদ্যোগ ও অর্থ বহন করেন।
  আদিদেবতা শিব এখানে তাঁর বৈদিক রূপ পরিহার করে লৌকিক দেবতার আসন গ্রহণ করেছেন। মন্দিরের পার্শ্ববর্তী এলাকার মানুষের লৌকিক জীবনচেতনা মিশ্রিত হয়ে আছে বাবা জপেশ্বর কে কেন্দ্র করে। ‘বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর’- জপেশ্বর বাবার বিশ্বাসে গদগদ একাধিক মানুষ। গৃহপালিত পশুর বাচ্চা হওয়া, গাছের ফল সুস্থ থাকা, পড়াশোনার আগ্রহ বৃদ্ধির জন্য তারা শরণাপন্ন হন বাবার।
মন্দিরে হওয়া গাজন উৎসবকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে স্থানীয় মিথ। জানা যায় গাজনের সময় ভক্তেরা বিনা অস্ত্রে মহাদেবের চানজল ছিটিয়ে রাত্রির অন্ধকারে বড় গাছ উপড়ে আনেন। পাশাপাশি কিংবদন্তি আছে কোনো এক সময় গাজনের ভক্তেরা গঙ্গা স্নানের জন্য পাড়ি দেয়। পথে স্বয়ং জপেশ্বর পরীক্ষক হিসাবে অগ্নিপ্রজ্জ্বলন করেন। কিন্তু ভক্তেরা সে বাধা অতিক্রম করলে বাবা তুষ্ট হয়ে স্বপ্না দেশে বলে ওঠেন মন্দিরে দুধ গঙ্গাজল ঢাললে সে জল ৫-৬ কিমি দূরে মাটি খুঁড়ে পাওয়া যাবে। সে জলে স্নান করলে গঙ্গা স্নানের সমতুল্য শুদ্ধতা পাওয়া যাবে। বর্তমানে ভক্তেরা সে পথেরই অনুগামী।
 হিমশীতল আবহাওয়া থেকে নিজেদের রক্ষাকর্তাকে নিবৃত্তি দিতে পুরোহিত সম্প্রদায় নির্মাণ করেছেন কাঁথা। অঘ্রাণ মাসে নবান্ন পালিত হবার পর থেকে শিবরাত্রির আগের দিন পর্যন্ত শিবলিঙ্গ কাঁথায় আবৃত থাকে।
 গ্রামবাংলার কোলে লুকিয়ে থাকা হাজার বছরের ইতিহাসকে বাঁচিয়ে রেখেছে এ মন্দির। নির্মাণ কর্তাকে যেমন আজও জীবিত রেখেছে, তেমনি মানুষের ভক্তি, বিশ্বাস, জীবনচেতনার প্রতীক হয়ে উঠেছে জুবুটিয়ার জপেশ্বর বাবার মন্দির।