যে গাছ প্রাণ দাত্রী সেই গাছই কী প্রাণঘাতী ? : প্রশান্ত কুমার দাস।

0
702

(পরিবেশ দিবসে বিশেষ নিবন্ধ)

কি নিষ্ঠুর পরিহাস ! যে গাছ আমাদের প্রাণ দান করে , যে গাছ আমাদের বিশুদ্ধ বায়ু দিয়ে প্রাণ বাঁচায় , ফুল-ফল-শাক-শবজী দিয়ে মানুষসহ সকল প্রাণীজগতের রক্ষা করে এবং আমাদের পরিবেশকে নির্মল ও শীতল করে , সেই গাছেই “আমপান” নামক সুপার সাইক্লোনের তান্ডবের ফলে আধুনিক সভ্যতার অসংখ্য মানুষের মৃত্যুর ও দুর্ভোগের কারন হয়ে দাঁড়ালো । একদিনে আমপান ঘূর্ণিঝড় বাংলার বুকে যেন বুলডোজার চালিয়ে দিয়ে গেল। এর ফলে কয়েক হাজার গাছ উপড়ে পড়লো কিংবা ভেঙ্গে পড়লো। শুধু কলকাতা শহরতলীতেই সাত হাজার গাছ উপড়ে বা ভেঙ্গে পড়েছে এবং তার ফলে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে বেশ কয়েকজনের প্রাণহানি হয়েছে। এখানে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পরোক্ষভাবে গাছের আঘাতে ইলেকট্রিকের তার ছিঁড়ে গিয়ে কিংবা ইলেকট্রিক পোষ্ট ভেঙ্গে গিয়ে সট্সার্কিট এ অনেক বেশি অতি আধুনিক সভ্যতায় মানুষ মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছে। এর সাথে শতশত মানুষ ইলেকট্রিক সংযোগের অভাবে জল ও বিদ্যুৎ না পেয়ে এই প্রখর গ্রীষ্মের ভেপসা গরমে মৃতপ্রায় অবস্থায় ঘরের মধ্যে বৃদ্ধ-বৃদ্ধা-শিশু দিন- রাত ছটফট করেছে – সেটাও একপ্রকার নরক যন্ত্রণা বা মৃত্যুযন্ত্রনার সমতুল্য । এক্ষেত্রে প্রাথমিক ভাবে মনে হয়েছে গাছই আমাদের এতগুলো মানুষের প্রাণ কেড়ে নিলো এবং শতশত মানুষকে দুঃখ-কষ্ট ও দুর্ভোগ-দুর্যোগ এর মধ্যে ফেলে দিল। সুতরাং গাছই এই সব আধুনিক সভ্যতায় মৃত্যু ও অঘটনের জন্য দায়ী। গাছ আমাদের কাছে প্রাণদায়ী না হয়ে প্রাণঘাতী হলো।
কিন্তু সত্যিই কি তাই ? এত সহজ দৃষ্টিতে গাছের মূল্যায়ন করবো ? এত সহজ দৃষ্টিতে গাছের ক্ষতিকে বড় করে দেখবো ? আমাদের ভাল করে বুঝতে হবে যে, এত মানুষের মৃত্যু ও নরক যন্ত্রনার জন্য গাছ প্রকৃতপক্ষে কতখানি দায়ী ? সত্যিকারের দায়ী হচ্ছে প্রকৃতির খামখেয়ালীপনা ,আর প্রকৃতির খামখেয়ালীপনার জন্য আমরা অর্থাৎ বিশ্বের সকল আধুনিক নাগরিকবৃন্দই দায়ী। আমরাই কারনে – অকারনে সমুদ্রসৈকতে ম্যানগ্রোভ গাছ ধ্বংস করে বসতি তৈরী করেছি, বনাঞ্চল ধ্বংস করে কলকারখানা তৈরী করেছি এবং আমাদের বসবাসের জন্য ইঁট-কাঠ-পাথর-লোহা দিয়ে কংক্রিটের খাঁচা তৈরী করে শহর- নগর তৈরি করেছি, সবুজায়ন নষ্ট করে মরুময় ভূমি গঠন করেছি, পরিবেশ দূষণ ঘটিয়ে জীবজন্তুকে হত্যা করেছি এবং সর্বোপরি পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করেছি। সুতরাং স্পষ্ট করে বলতে গেলে আমরা নিজেরাই নিজেদের মৃত্যুফাঁদ তৈরী করেছি।
আমাদের এই কঠিন পরিস্থিতিতে আমাদের ধৈর্য ধরে সহ্য করতে হবে এবং ভবিষ্যতে আমাদের কি করণীয় তাও সকল শিক্ষিত আধুনিক সমাজকে ভাবতে হবে। সেই মত ভবিষ্যতের পরিকল্পনা করে কাজে এগিয়ে যেতে হবে।
আমাদের যেটা সবচেয়ে বড় প্রয়োজন সেটা হচ্ছে বৃক্ষরোপণ । যতগুলি গাছ এই মহাতান্ডবে উৎপাটিত হয়েছে বা ভেঙ্গেছে তার দ্বিগুণ গাছ আমাদের লাগাতে হবে। এই ঘূর্ণিঝড়ের তান্ডবে সুন্দরবন আর সুন্দর নেই,তাকে আবার সুন্দর করতে হবে ,ম্যানগ্রোভকে আবার বাঁচিয়ে তুলতে হবে। আমাদের সামনেই আসছে ৫ ই জুন – “বিশ্বপরিবেশ দিবস”। এই দিবসের সার্থক রূপায়ন করতে হবে।আমাদের সকলকেই বুঝতে হবে এবং অপরকে বোঝাতে হবে যে ,গাছ ছাড়া আমাদের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়বে।দূরদর্শী কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গাছের উপযোগিতার কথা চিন্তা করে অনেক পূর্বেই বিশ্বভারতীতে বৃক্ষরোপণ বা বনমহোৎসব পালনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন । তিনি ভালোভাবে অনুভব করেছিলেন যে গাছই হচ্ছে আমাদের প্রাণ ধারনের শ্রেষ্ঠ উপাদান। তাই তিনি গাছকে ভালবেসে গাছ রোপণের সময়ে শান্তিনিকেতনে গাছের বন্দনা করে গেয়েছিলেন –

“মরুবিজয়ের কেতন উড়াও শূন্যে,
হে প্রবল প্রাণ,
মাধুরি ভরিবে ফুলে ফলে পল্লবে
হে মোহন প্রাণ।”
গাছই যে আমাদের প্রাণ,আমাদের প্রাণের উৎস একথা বিশ্বকবি খুব ভালোভাবেই অনুভব করেছিলেন। তাই তাঁর কণ্ঠে শোনা গিয়েছিল – “অন্ধ ভূমি হতে শুনে ছিলাম সূর্যের আহ্বান
প্রাণের প্রথম জাগরণ, তুমি বৃক্ষ আদি প্রাণ।”
রবীন্দ্রনাথ গাছকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন –“মৃত্তিকার বীর সন্তান”
আমাদের সেই বীর সন্তান ,প্রাণের বন্ধু গাছ –তাই গাছ শুধু রোপন করলেই চলবে না তাকে সন্তান তূল্য লালন পালন করতে হবে,গাছ যাতে সহজে উপরে না যায় তার জন্য গাছের গোড়ায় পর্যাপ্ত মাটি দিয়ে ভরাট করে দিতে হবে।
আজ আমাদের নিজের বাঁচার তাগিদেই বৃক্ষরোপণ ও সবুজায়ন অত্যন্ত প্রয়োজন ।বনসৃজন – বনসংরক্ষন –সবুজায়ন-সৌন্দর্যায়ন-এই কথাগুলো আর বিলাসিতা নয় বরং এগুলো হচ্ছে মানবসভ্যতার বেঁচে থাকার মূল চাবিকাঠি। তাই বর্তমানে গাছের দ্বারা আমাদের কিছু মানুষের অপমৃত্যুজনিত আঘাত সহ্য করে বৃহত্তর

কল্যাণের জন্য আমাদের গাছ লাগানোর শপথ নিতে হবে।আগামী ৫ই জুন , “বিশ্বপরিবেশ দিবস” হিসাবে সর্বদেশ ব্যাপী বৃক্ষরোপণ উৎসবপালন করা কর্তব্য।
অবশ্য একটা কথা খেয়াল রাখতে হবে,বর্তমানে আমাদের দেশ তথা বিশ্ব অতিমহামারী করোনা ভাইরাসের আতঙ্কে বিপর্যস্ত । আর এই অজানা ভাইরাসের সতর্কতার কথা মাথায় রেখে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখেই আমরা প্রতেকে ব্যাক্তিগত উদ্যোগে নিজেদের বাড়ির মধ্যে কিংবা বাড়ির আশপাশে দুই-চার সঙ্গী নিয়ে একদম আড়ম্বরহীন ভাবে বৃক্ষরোপন করতে উদ্যোগ নেবো। বৃক্ষরোপনে এগিয়ে আসার জন্য সকল শ্রেণীর মানুষকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানাচ্ছি । শুধু সরকারের খরচে ও উদ্যোগে বৃক্ষরোপণ করবে এই আশায় বসে থাকলে চলবে না । আমাদের সকলের মনে রাখতে হবে ‘একটা গাছ ,একটা প্রাণ’ এই শ্লোগানই হবে আমাদের একমাত্র রক্ষাকবজ। কারণ একটা কোলের শিশু কিংবা ইনহেলার নেওয়া হাইপ্রেসারের রুগির কাছে সবুজ গাছ আর প্রকৃতির নির্মল অক্সিজেন কতটা মূল্যবান ও অমূল্য সম্পদ সেটা শিক্ষিত মানবসমাজ আর কতদিনে বুঝবে? আর একটা কথা মনে রাখতে হবে শুধু মাত্র ৫ই জুন ‘বিশ্বপরিবেশ’ দিবস উপলক্ষ্যে বৃক্ষরোপন করলেই চলবে না, বরং প্রতিদিন অর্থাৎ বছরে ৩৬৫ দিনই আমাদের মননে সবুজায়ন ও বনসৃজনকে অগ্রাধিকার দিয়ে কাজে হাত লাগাতে হবে –
তবেই আমরা এই বসুন্ধরাকে ‘সুন্দর কুসুমিত মনোহরা’ জননীরূপে গড়ে তুলতে পারবো, তবেই আমরা আমাদের বাঁচাতে পারবো , অন্য সকলকে বাঁচাবার পরিবেশ সৃষ্টি করবো এবং একই সঙ্গে বিশ্বজগতের সকল প্রাণীকুলকে বাঁচাতে পারবো।এজন্য আমাদের পৃথিবীকে সবুজায়ন করার স্বপ্ন দেখতে হবে,এ স্বপ্ন ঘুমের মধ্যে নয় ,বরং এ স্বপ্ন আমাদের ঘুমোতে দেবে না। এই স্বপ্নকে সার্থক করলে তবেই এই বিশ্ব হয়ে উঠবে আগামী দিনে নবজাতকের বাসযোগ্য।

প্রশান্ত কুমার দাস,
শিক্ষারত্ন প্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক, বাজিতপুর উচ্চ বিদ্যালয়(উঃমাঃ),
পোঃ-পাথাই, ময়ূরেশ্বর-১,বীরভূম,
মোবাইলঃ-9474731116, e-mail- prasantakd1971@gmail.com