ফ্রানৎস ফানোঁ : ক্ষণজন্মা একজন দার্শনিকে্র কালকে অতিক্রম :: রহমতুল্লাহ লিখন।

0
743

ফ্রানৎস ফানোঁ একজন ফরাসি দার্শনিক এবং মনোচিকিৎসক যিনি তাঁর জীবনকাল অতিবাহিত করেছেন সমাজের শোষিত মানুষদের মনস্তত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করে। কিন্তু বড় অসময়ে মাত্র ৩৬ বছর বয়সে তিনি পরলোক যাত্রা করেন লিউকমিয়া্র কাছে হার মেনে।এই অকাল প্রয়াত দার্শনিক মত্যুর পর তাঁর তত্ত্বের জন্য সমাদৃত হয়েছেন। তাঁর তত্ত্বের মূল বিষয় এক কথায় প্রকাশ করলে যা দাঁড়ায় তা হল উপনিবেশায়নের ফলে শোষিতদের মনোজাগতিক পরিবর্তনের নিরীক্ষণ। তিনি জীবনের এক পর্যায়ে এসে সাম্যবাদের চাহিদায় বিপ্লবী হয়েছিলেন। তাঁর কাজের প্রভাব রয়েছে উত্তর ঔপনিবেশিক অধ্যয়ন, সমালোচনামূলক তত্ত্ব, মার্কসবাদের ক্ষেত্রগুলোতে। তিনি ছিলেন সমাজতান্ত্রিক সাম্যবাদের বিপ্লবে বিশ্বাসী, প্যান আফ্রিকানবাদী এবং মার্ক্সীয় মানবতাবাদী । তাঁর সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পাওয়া যায় বিউপনিবেশয়ায়নের মানবিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সাথে।
এখন প্রশ্ন হল তাঁর ভিতর এই বিপ্লবী মনোভাবের সন্নিবেশন কোথা হতে এল। অত্যাচারিতদের প্রতি তাঁর যে মারাত্মক টান, তাদেরকে পড়ার যে স্পৃহা তিনি আজীবন অনুভব করেছেন তাঁর সূত্রপাত কোথায়? ইতিহাস খুঁজে তাঁর এক জুতসই উত্তর পাওয়া যায়। ফরাসিদের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানের সময় তাঁকে একটি হাসপাতালের দায়িত্ব দেয়া হয়। সেখানেই তিনি প্রথম বিপ্লবীদের সংস্পর্শে আসেন। বিপ্লবীদের মনস্তত্ত্ব নিয়ে নিরীক্ষা করতে করতে তাঁর নিজের ভিতরেই একজন বিপ্লবী জন্ম নেয়।যার বৈপ্লবিক বিস্ফোরণ দেখতে পাওয়া যায় ২৭ বছর বয়সে তাঁর প্রকাশিত বই “জগতের লাঞ্ছিত ভাগ্যহত” এর মাঝে। এই হল তাঁর জগতের ভাগ্যহতদের সাথে মাখামাখির সূচনা। এর পর হতে তিনি উপনিবিশিত মানুষের জীবনের গভীর হতে গভীরতর পর্যায়ে গমন করেছেন।
তিনি মারা যাবার পর তাঁর তাত্ত্বিক আলোচনাগুলো নিয়ে একটি গ্রন্থ সংকলন করা হয়। যার নাম দেয়া হয় “ফ্রানৎস ফানোঁর বিপ্লবী চিন্তা”। বেঁচে থাকাকালীন সময়ে কেন তাঁকে সঠিকভাবে বা ব্যপকভাবে অধ্যয়ন করা হয় নাই ? একটি সদুত্তর বের করা যায় তা হল সেই কাল টি ছিল প্রধানত পুঁজিবাদী আগ্রাসনের ঊষালগ্ন। সমাজের একটি শ্রেণিকে শোষণের মাধ্যমেই পুঁজিবাদ মাথাচাড়া দেয়। তাই তাঁর মুল্যয়ন ব্যপকভাবে কখনো হয়ে উঠে নাই। হাতে গোনা কিছু মানুষ তাঁকে নিয়ে হৈ চৈ করেছে।
তাঁর লেখার মুল উপজীব্যই ছিল উপনিবেশবাদের কারণে অত্যাচারিত মানুষের স্বাধনতা। তাঁর বৈপ্লবিক ভাবনা কেন্দ্রবিন্দু হল কলোনাইজড মানুষের মনঃস্তাত্ত্বিক স্বাধীনতা। কারণ তিনি তাদের সাথে থেকে উপলব্ধি করেছিলেন যে তারা যতটা না শারীরিকভাবে অত্যাচারিত তার চেয়ে ভয়ংকরভাবে মনস্তাত্ত্বিক ভাবে নিগৃহিত। বশ্যতা স্বীকার করার একটি মোহ তাদের আবেশিত করে ফেলেছে। একজন মনস্তত্ত্ববিদ হিসাবে এই তত্ত্বের মূলৎপাটন ছিল তাঁর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব।
তাঁর এই সমালচনামূলক বিপ্লবী লেখাগুলো পরবর্তী প্রজন্মের চিন্তাবিদদের ভাবনার জগতকে আলোড়িত করেছে। উপনিবেশের দীর্ঘ প্রভাবের জায়গা খুঁজে বের করতে সহযোগিতা করেছে। তাঁর লেখা “ White skin, Black Mask” বইটি বর্ণবাদের বহুমুখী শাখার এমন এক বিশ্লেষণ যা আলোচনা করে জাতিগত সচেতনাতার উপর উপনিবেশবাদের প্রভাব নিয়ে। যার সাথে মনঃসমীক্ষণ, ফেনমেনলজি, অস্তিত্ববাদ সবকিছুই জড়িত থাকছে দারুণভাবে। ফানোঁ স্পষ্টভাবে একটি বিস্তৃত চিত্র তুলে ধরেছেন কলোনাইজড জনগনের এবং সেখানে তাদের মানসিক প্রতিবিম্ব উপনিবেশবাদের কারণে কেমন হয়েছে তা চমৎকার ভাবে ফুটে উঠেছে। ১৯৬১ সালে প্রকাশিত “ The Wretched of the Earth” বইটি ফানোঁকে বিশ্বদরবারে প্রতিষ্ঠিত করে উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে অগ্রগণ্য় বুদ্ধিজীবি হিসেবে। তাঁর আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু ছিল বেউপনিবেশবাদ, উত্তর-ঔপনিবেশিক ভাবনা, বিপ্লব, উপনিবেশবাদের কারণে বর্ণবাদের মনোরোগ। তাঁর যে তত্ত্বটি নিয়ে আলোচনা সবচেয়ে বেশি হয় বা আরও বেশি গবেষণার প্রয়জন তা হল Double Consciousness।
তাঁর উপর কাদের প্রভাব পড়েছে তাঁর একটি লম্বা তালিকা লরা যায়। যার ভিতর উল্লেখযোগ্যভাবে নাম পাওয়া যাবে কার্ল মার্কস, ফ্রয়েড, গ্যস্টভ, সাত্রে, হেগেল, ম্যক্স ওয়েবার আর অনেকের নামই নেয়া যায়। ন্যাগ্রেটিউড মুভমেন্ট তাঁকে বিশেষভাবে আলোড়িত করেছে আজীবন।
মন্তব্যে বলা যায়, এই ক্ষণজন্মা দার্শনিক তাঁর নিজেস্ব কালকে অতিক্রম করেছেন মূলত তাঁর ভাবনার জগতকে এমন সামাজিক শ্রেণির সাথে সংযুক্তির মাধ্যমে যারা আজও নানারকম বৈষম্যের স্বীকার। তাই ফানোঁকে নিয়ে ব্যপক গবেষণার প্রয়োজন এই ঐতিহাসিক সংকট উত্তরয়ণের জন্য।