দূরদৃষ্টি — একটি পর্যালোচনা : দিলীপ রায়।

0
585

দূরদৃষ্টি অর্থ এক কথায়, মানুষের সহজাত প্রবৃত্তির বহির্প্রকাশ । জ্ঞানের উত্তোরন । উপলব্ধির ব্যাপ্তি । ভবিষ্যৎ চিন্তার প্রকাশ । এটাও ঠিক, কোনো মানুষ তাঁর বুদ্ধির সাহায্যে ভবিষ্যতে কাজের ধারনা বিশ্বাস করতে পারলে সেটাই তাঁর দূরদৃষ্টি, তবে শর্ত হচ্ছে দূরদৃষ্টির সাথে কাজের মিল থাকা বাঞ্ছনীয় । আবার অনেকে দূরদৃষ্টির মূল্যায়ন মানুষের ভাবনার নিরিখে করে থাকেন । এইজন্য মানুষের দূরদৃষ্টির নিরিখে তাঁদের মূল্যায়ন বিভিন্নভাবে পরিলক্ষিত । সু-দূরদৃষ্টি সব সময় কাম্য । সাদামাটা আমরা যেটা বুঝি, দূরদৃষ্টি ভাল রাখাটা নিজের ক্ষেত্রে, সমাজের ক্ষেত্রে এমনকি দেশের ক্ষেত্রে মঙ্গলজনক । বাড়ির সকল মানুষের দূরদৃষ্টি ভাল থাকলে বাড়িতে সুশৃঙ্খল জীবন যাপন নিশ্চিত ।
দূরদৃষ্টি অর্থ কতকগুলি শব্দের অবতারনা যেমন বিচক্ষণতা, দূরদর্শিতা, ভবিষ্যৎ সমন্ধে আন্দাজ করা, কল্পনাশক্তি, ইত্যাদি । তাই আমরা অনায়াসে বলতে পারি, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন হলে বড় ব্যবসায়িতে প্রতিষ্ঠিত হতে শুধু সময়ের অপেক্ষা ।
মানুষের সঠিক দূরদৃষ্টি্র প্রতিফলন ব্যবহারিক জীবনে বিশেষভাবে লক্ষণীয় । ব্যক্তি জীবনে দূরদৃষ্টির ভাল মন্দ’র উদাহরন অনেক। সেইজন্য মানুষ কোনো বড় কাজ করার আগে কাজটার বাস্তবায়ন সমন্ধে অনেক চিন্তা ভাবনা করেন । যেমন বাড়ি তৈরীর আগে বাড়ির ভিত কটা ফ্লোরের হবে । তার একটাই কারণ ভবিষ্যতে ফ্লোর বাড়ানোর ইচ্ছা থাকলে, অনায়াসে বাড়াতে পারবে । অনেকের মধ্যে চিন্তা ভাবনা, তাঁদের সামর্থ্যের প্রশ্ন নিয়ে । অল্প সামর্থ্যের কথা ভেবে অনেকের আগ্রহ ঐ এক তলা পর্য্যন্তই । তবুও ভিত তিন তলা রাখতে সচেষ্ট একটাই কারণে তিন তলার ভিত থাকলে ভবিষ্যতে পরবর্তী সন্তানেরা ইচ্ছা করলে প্রয়োজনে তিন তলা পর্যন্ত বাড়ি নির্মান করতে পারবেন । সেইক্ষেত্রে পরবর্তীকালে ঐ সন্তানেরা অবশ্যই বলবেন, তাঁদের বাবা-মায়ের দূরদৃষ্টি ছিলো প্রশংসাজনক ।
বেলঘড়িয়ার সাধন কেরানীর তিন মেয়ে । মেয়েদের বিয়ের কথা ভেবে অনেক কষ্টে সে পাঁচ কাঠা জমি কিনলো । হঠাৎ তাঁর গিন্নি বললেন, তুমি অহেতুক বিরাটীতে ডোবা জায়গা কেন কিনলে ?
“তুমি বুঝবে না গিন্নি”, প্রতি উত্তরে সাধন কেরানী তাঁর গিন্নিকে বললেন ।
তারপর বেশকিছুদিন চুপচাপ । মেয়ের বিয়ের সময় ঐ জমির অনেক দাম ! পাঁচ কাঠা জমি বিক্রির টাকায় প্রায় তাঁদের বড় মেয়ের বিয়ের খরচ উঠে এল । তারপর সাধন কেরানী হাসতে হাসতে গিন্নিকে বললো, “জলা-ডোবা জমি কেনার ব্যাপারে কী বুঝলে ?” গিন্নিও তাঁর দু-পাটি দাঁত বের করে একগাল হেসে উত্তর দিলো, তোমার দূরদৃষ্টির বলিহারি যাই বাপু !
সামাজিক প্রেক্ষাপটে দূরদৃষ্টির ভূমিকা অতীব প্রয়োজনীয় । মানুষের একসঙ্গে বসবাসকে কেন্দ্র করেই সমাজ গঠন, সেটা ধর্ম ভিত্তিক হোক বা জাতি ভিত্তিক হোক । সেই সমাজের মানুষের উন্নয়নের নিরিখে সামাজিক দূষ্টিভঙ্গির প্রয়োজনীতা অবশ্যাম্ভাবি । গাঁয়ের পরিত্যক্ত জমি সমাজের কতিপয় মানুষ প্রাচীর দিয়ে ঘিরে রাখে । শোনা যায় ঐ জমির মালিক দেশ ভাগের সময় ভয়ে এদেশ ছেড়ে পাকিস্তানে পালিয়ে গিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন । ফলে জমিটা পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়েছিলো । পরবর্তী সময়ে গাঁয়ের মানুষ সেখানে জলাশয় বানিয়েছেন এবং সেই জলাশয়ে এখন মাছ চাষ চলছে । জলাশয়টি লিজে দেওয়ার সমাজের সামগ্রিক সিদ্ধান্ত । ঐ লিজের টাকা গাঁয়ের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যেমন দুর্গা পূজা, প্রয়োজনে গরীব মানুষের মেয়ের বিয়েতে, কাজে লাগছে । এখানে গাঁয়ের মানুষের দূরদৃষ্টির জন্য পরিত্যক্ত জমি সমাজের উন্নয়নের কর্মকান্ডে নিমজ্জিত ।
দেশের উন্নয়নে সরকারের দূরদৃষ্টি থাকাটা অবশ্যাম্ভাবী । যেমন অসম রাজ্যের ডিব্রূগড় থেকে লখীমপুরের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য ব্রম্মপূত্র নদের উপর বগীবিল ব্রীজ তৈরীর সিদ্ধান্ত অনেক আগের । সম্প্রতি ব্রম্মপূত্র নদের উপর সেই বগীবিল ব্রীজ তৈরী হওয়ার দরুন ডিব্রূগড়ের সঙ্গে লখীমপুরের সড়ক ও রেল যোগাযোগ সম্ভব হয়েছে । বলার অপেক্ষা রাখে না যে, যাতায়াতে মানুষের অনেক সময় সাশ্রয় ঘটেছে । এখানে সরকারের দূরদৃষ্টির জন্য ব্রম্মপূত্রের দুই পারের মানুষের যোগাযোগের ক্ষেত্রে বহুত উন্নতিসাধন ঘটলো ।
দূরদৃষ্টির অভাবে অনেক ক্ষতিসাধন ঘটেছে, তার উদাহরন অনেক । বেথুয়াডহরির সন্নিকট পাটিকাবাড়ির হরিসাধনবাবু অনেক ভেবে চিন্তে তাঁর দরমা বাঁশের বেড়া ও টালির চালের বাড়ির সম্মুখে দুটি গাছ লাগালেন । যাতে গাছ দুটি বড় হওয়ার পর বিক্রি করলে ভাল দাম পাওয়া যাবে । সুতরাং ঐ টাকায় পাঁচ ইঞ্চির গাথনির পাকা ঘর তৈরী সম্ভব হবে । গাছ বড় হওয়ার পর দেখা গেল বৈশাখ মাসের ঝড়ে গাছ ভেঙ্গে টালির চালার উপর গিয়ে পড়লো । হরিসাধনবাবুর ভুল দূরদৃষ্টির জন্য তাঁর পাঁচ ইঞ্চি গাথনির পাকা বাড়ি তৈরীর স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল ।
সকলেই অবগত আছেন, কলকাতার মাঝেরহাট সেতু ভেঙ্গে যাওয়ার খবর । সেতুর রক্ষণাবেক্ষণের সদিচ্ছার অভাবের কারণেই ঐ দূর্ঘটনা । সেতুতে একটা চিড় দেখা দেখা দিয়েছিলো এবং সেটার মেরামতির ব্যবস্থা হয়নি, যার জন্য ঐ দুর্ঘটনা । এখানে দায়িত্বে থাকা সরকারি দপ্তরের পরিচালনব্যবস্থার বিচক্ষণতার সামগ্রিক অভাব ছিলো । সরকারি দপ্তরের ভাল্ভাবেই জানা, কলকাতার মানুষের কাছে যোগাযোগের নিরিখে সেতুর উপযোগিতা অপরিসীম । সেতুর রক্ষণাবেক্ষণের ভবিষ্যতের ভাবনা সংশ্লিষ্ট দপ্তরের মোটেই ছিলো না । সুতরাং এখানে প্রশাসনের দূরদৃষ্টির অভাবের কারণে যথা সময়ে রক্ষণাবেক্ষণ হয়নি । নতুবা দূর্ঘটনা এড়ানো যেত ।
তবে এটাও ঠিক, দূরদৃষ্টির সঙ্গে দূরদর্শিতার অপূর্ব মিল রয়েছে । দূরদৃষ্টি অর্থ আমরা বলতে পারি পূর্বদৃষ্টি বা ভবিষ্যৎ সমন্ধে ধারনা অথবা পূর্বানুমান । অনুরূপভাবে দূরদর্শিতার অর্থও প্রায় এক, বিচক্ষণতা বা পূর্বদৃষ্টি । সুতরাং ভবিষ্যৎ ভাবনা, ভবিষ্যৎ চিন্তা, পূর্বদৃষ্টি, এইসব নিয়েই দূরদৃষ্টি । তাই দূরদৃষ্টি সঠিক হওয়া বাঞ্ছনীয় । তবে এটাও ঠিক, সু-দূরদৃষ্টি মানুষের হির্তার্থে কাম্য ।

———————————-০————————————–
এ-১০ক্স/৩৪, কল্যাণী, নদীয়া-৭৪১২৩৫ । মো-৯৪৩৩৪৬২৮৫৪, email ID : roydk1958@gmail.com