প্রণব মুখার্জী, ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি – শ্রদ্ধাঞ্জলি : দিলীপ রায় ।

0
718

শেষ হোলো পাঁচ দশকের পথচলা (জন্ম ঃ ১১-১২-১৯৩৫ ও মৃত্যু ঃ ৩১-০৮-২০২০) । অর্থনীতির কিংবদন্তী ও জাতীয় রাজনীতির এক সময়ের চাণক্য, প্রণব মুখার্জী আজ আমাদের মধ্যে আর নেই । তাঁর মস্তিস্কে রক্ত জমাট বাধার কারণে গত ১০ই আগষ্ট ভর্তি হয়েছিলেন দিল্লির সেনা হাসপাতালে । তারপর দীর্ঘ বাইশ দিন লড়াই করার পর আজ শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করলেন । মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিলো ৮৫ বছর ।
প্রয়াত প্রণব মুখার্জীর জন্ম পশ্চিম বঙ্গের বীরভূম জেলার নানুর থানার মিরাটি গ্রামে । ঐ গ্রামেই তাঁর বেড়ে ওঠা । বাবা ঁকামদা কিংকর মুখোপ্যাধায় ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী । তিনি শিউরি বিদ্যাসাগর কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন । তারপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান পাশ করেন । ১৯৬৩ সালে বিদ্যাসাগর কলেজে অধ্যাপনা শুরু করেন । মাঝখানে কিছুদিন “দেশের ডাক” নামে একটি পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেন ।
১৯৬৯ সালে ইন্দিরা গান্ধির নজরে পড়েন । সেই বছরেই ইন্দিরা গান্ধির দলে যোগদান এবং রাজ্যসভার সাংসদ নির্বাচিত হন । এর পর চারবার রাজ্যসভার সাংসদ নির্বাচিত হয়েছিলেন । ২০০৪ সালে প্রথমবার মুর্শিদাবাদ জেলার জঙ্গীপুর থেকে লোক সভা ভোটে জেতেন । ১৯৭৩ সালে প্রথম ইন্দিরা গান্ধির মন্ত্রী সভায় শিল্পোন্নয়ন মন্ত্রকের প্রতিমন্ত্রী হিসাবে তাঁর যোগদান । তারপর জ্রুরি অবস্থার সময়ে ইন্দিরা গান্ধির পাশে পাশে সর্বক্ষণ থাকেন । তারপর কেন্দ্রে বিভিন্ন সময়ে কেন্দ্রিয় মন্ত্রীসভায় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদ অলংকৃত করেন । বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য অর্থমন্ত্রী (প্রথম বার ১৯৮২-১৯৮৪/ তারপর ২০০৯-২০১২), বিদেশ মন্ত্রী (১৯৯৫-৯৬/২০০৬-০৯), প্রতিরক্ষা মন্ত্রী (২০০৪-০৬) । আরও অনেক পদ তিনি অলংকৃত করেছিলেন, যেমন লোক সভার নেতা, প্লানিং কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান, ইত্যাদি । প্রণব মুখার্জীর বুদ্ধী ছিলো তুখোড় । স্বয়ং মনমোহন সিং তাঁর প্রধান মন্ত্রী জামানায় অর্থনীতি ও বৈদেশিক ইস্যু নিয়ে নির্দ্বিধায় অগ্রজ প্রণব মুখার্জীর সঙ্গে পরামর্শ করতেন । এমনকি এখনকার প্রধান মন্ত্রীকেও কিছু কিছু ব্যাপারে প্রণব মুখার্জীর সঙ্গে পরামর্শ করতে দেখা গেছে ।
তারপর তার জীবনে আসে আন-লাকি ১৩, লাকি হিসাবে । অর্থাৎ প্রণব মুখার্জী নির্বাচিত হন দেশের ১৩ তম রাষ্ট্রপতি হিসাবে (২৫-০৭-২০১২ – ২৫-০৭২০১৭) । দেশের ইতিহাসে তিনিই প্রথম বাঙ্গালী রাষ্টপতি ।
প্রণব মুখার্জীর একটা সময় দুঃসময় এসেছিলো । সেটা রাজীব গান্ধির জামানায় । ইন্দিরা গান্ধির হত্যার পর রাজীবের সঙ্গে মতানৈক্যের কারণে কংগ্রেস থেকে তাঁকে বহিষ্কার করা হয় । সেই সময় রাষ্ট্রীয় সমাজবাদী কংগ্রেস নামে একটি দল গঠন করেন তিনি। তবে তা তেমন সাফল্যের মুখ দেখেনি। ১৯৮৯ সালে ফের কংগ্রেসে যোগ দেন ।
প্রণব মুখার্জীকে পশ্চিম বাংলার মানুষ বীরভূমের মিরিটির ছেলে হিসাবে ভাবেন । প্রতিবার দুর্গা পূজার সময় তাঁকে নানুর থানার মিরিটি গ্রামে আসা চাই । শোনা যায় প্রণব মিখার্জীর বাবা কামদা কিংকর মুখোপ্যাধায় বাড়িতে দুর্গা পূজা চালু করেন । সেই পূজার বয়স এখন ১২৩ বছর । বাড়ির পূজোয় ঘট আনা থেকে দশমী পর্য্যন্ত তিনি কাটান । দুর্গা পূজায় তাঁর স্বকন্ঠে চন্ডী পাঠ উল্লেখযোগ্য । ২০১৯শে দুর্গা পূজার সময় তিনি মিরিটিতেই ছিলেন । এবছর পূজোর আগেই তাঁর বিদায় ।
প্রণব মুখার্জীর সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ আমার জন্ম জেলা মুর্শিদাবাদের বহরমপুরে । তারপর কলকাতার জাদুঘরের পেছনে স্যার আশুতোষ হলে । সেখানে রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাঙ্ক আধিকারিকদের সংগঠনের অনুষ্ঠানে । তিনি অর্থ মন্ত্রী হিসাবে প্রধান অতিথি ছিলেন । প্রাক্তন প্রধান মন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি যে চিন্তাভাবনায় ব্যাঙ্ক জাতীয়করন করেছিলেন সেই প্রেক্ষাপটে তাঁর সঙ্গে দু-চারটে কথা । তারপর তিনি আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন তাঁর ঢাকুরিয়া বাস ভবনে । ঢাকুরিয়া বাস ভবনে যে স্নেহমাখা ভাষায় আমার সঙ্গে কথা বলেছিলেন তার দুই একটা বাক্য উল্লেখ করলাম । “দিলীপ, তুমি আমার পাশে বসো । তোমার গৌরীনগর গ্রামে আমি যাইনি একথা ঠিক, কিন্তু তোমার এলাকা আমি চিনি । সালার, বাজারসৌ, কান্দি, আমার পরিচিত এলাকা । সেই হিসাবে তুমি আমার দেশের ছেলে । তুমি লিখছো জেনে আমি খুব খুশী হলাম । তোমার “নারী জাগরণের দশটি উপন্যাস” আমার পড়ার ইচ্ছা রইলো । আর একটা কথা, তুমি কিন্তু লেখা ছাড়বে না । আমৃত্যু লিখে যাও । পাঠক তোমাকে সম্মান দেবে ।“ স্যারের স্নেহমাখা কথাগুলি আমার কাছে অমৃত সমান । তাঁর প্রতি আমার বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি ।