ভাষাতেও ভাসছে পুরুষতান্ত্রিকতার ছায়া : কাজী নুদরত হোসেন।

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘অমৃতস্য পুত্রাঃ’ থেকে সরে এসে, কথাসাহিত্যিক কমল দাস যখন তাঁর উপন্যাসের নাম দিলেন ‘অমৃতস্য পুত্রী’, ধাক্কাটা লেগেছিল মৃদু। তসলিমার ধাক্কাটা এলো সজোরে। ‘আমার মেয়েবেলা’ নামকরণটা একটা প্রতিবাদ হয়ে এলো। পুরুষতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে জোরদার নালিশ যেন ! নালিশটা ব্যক্তিবিশেষের কাছে নয়, মাতৃভাষার দরবারে। তারপরে এনিয়ে বিক্ষিপ্ত কিছু আলোচনা, ব্যতিক্রমী কিছু শব্দপ্রয়োগ ছাড়া বিশেষ কিছু চোখে পড়ে না।

আমাদের ব্যবহৃত ভাষাতে পুরুষতান্ত্রিক আগ্রাসন যে বেশ তীব্র, কান খোলা রাখলেই তা স্পষ্ট হয়। সাথে সাথে মনও খোলা রাখলে একথা স্বীকার করে নিতে হয় যে, প্রাচীনকাল থেকে সমাজের মর্মমূলে পক্ষপাতদুষ্ট ভাবনা প্রভাব বিস্তার করেছে মাতৃভাষার উপর। ‘ভাগের মা’ এক্ষেত্রে গঙ্গা পাননি। পুরুষতন্ত্রের ‘নিধিরাম সর্দার’-রা ভাষাকে করেছেন যেন শুধু ‘ছেলের হাতের মোয়া’।

ভাষা একদিনে সৃষ্টির কোন বিষয় নয়। কালের ধারাপ্রবাহে তার সৃষ্টি, তার রূপান্তর। সমাজের রীতি-নীতি, প্রথা প্রকরণের চিহ্নসমূহকেই সে শুধু বহন করেনা, বহন করে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিকেও। তাই ‘নারীঅনুক্রমে’ নয়, ‘পুরুষানুক্রমে’-ই এই পুং-প্রভাবিত মাতৃভাষাকে আমরা বহন করে চলেছি লেখায়, কথাবার্তায়। এখন, ‘সাতনারী’ বা ‘চোদ্দনারী’ নয়, আমাদের পূর্বপুরুষেরা ‘সাতপুরুষ’ ‘চোদ্দপুরুষ’ ধরে যা বহন করে নিয়ে এলেন, বর্তমান প্রজন্ম অথবা আমাদের ‘উত্তরপুরুষে’রা যদি তাতে লিঙ্গবৈষম্যের অভিযোগ তোলে, তবে দোষ দেওয়া যায় না। ‘বাপ ঠাকুরদা’-র আমল থেকেই এমন শব্দ ব্যবহৃত হয়ে আসছে’-বলে দায় এড়ালে চলে না। আমলটা ‘মা-ঠাকুরমা’-র নয় কেন, সে প্রশ্নকেও সঙ্গত বলে মেনে নিতে হয়।

‘বালাই’– বালকের অহিত,তাই দিয়ে বালিকার অহিতকেও আমাদের মেনে নিতে হয়। স্ত্রীবাচক বা উভলিঙ্গবাচক কোনো শব্দ তৈরী না হওয়ার কারণে। একই কারণে যুবতীদের সামিল করে ‘যুব সম্মেলন’ করি আমরা। ‘শিক্ষক সংগঠনে’ শিক্ষিকারাও ঢোকেন বাধ্য হয়ে। ‘ছাত্রসংসদে’ ছাত্রীরা থেকেও লিঙ্গ পরিচয়ের মাহাত্ম্য বহন করেনা। ‘মানবজন্ম’ বা ‘নরকুলে’ জন্ম নিতে হয় আমাদের নারীদের। কেউ কেউ অবশ্য আপন কীর্তির বা খ্যাতির জোরে মহাপুরুষের দলে প্রবেশাধিকার পেয়ে যান। কারণ,’মহানারী’-র কোন শব্দসংস্থান ভাষায় নেই।

প্রচলিত বাংলা ভাষাতে ছেলের পরিচয় দানে, ‘ছেলে’ শব্দটি যথেষ্ট হলেও, মেয়ের পরিচয় দানে কখনো কখনো ছেলেকেও জুড়ে দিয়ে বলতে হয় ‘মেয়েছেলে’। আবার মেয়েকে ধরার সম্ভাবনা প্রায় আট আনা থাকলেও শিশু অপহরণকারী ‘মেয়েধরা’ হয়না, তার সর্বজনগ্রাহ্য পরিচয় ‘ছেলেধরা’ হিসেবেই। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলেরই থাকছে ‘ছেলেবেলা’। সে-বয়সে মেয়ে হয়েও ‘মেয়েখেলা’ করা যায় না, ‘ছেলেখেলা’ই খেলতে হয়। মেয়ের সামান্য অপরাধকেও ‘ছেলেমানুষি’ বলতে হয়। ‘বালকোচিত’- ‘বালিকোচিত’ হয়না। মেয়েকে ভোলাতে চাইলেও ‘ছেলেভোলানো’ কোন কিছুকে আশ্রয় করতে হয়। আমাদের যা কিছু দেখা, না-দেখা তা ‘বাপের জন্মে’। ‘মায়ের জন্মে’ কিছু দেখি না আমরা। তেমনি ভাবে, আমাদের মামি থাকলেও আছে কেবল ‘মামাবাড়ি’। ছেলে-মেয়ে উভয়ের আবদার ‘মামাবাড়িতে’ চলে। প্রায় সকল নারীই ‘পিতৃকুলে’ জন্ম গ্রহণ করে’ ‘পিতৃগৃহে’ বড়ো হয়ে, ‘শ্বশুরবাড়ি’তে যায়। তাদের ‘শ্বশুরকুল’ আছে, ‘শ্বশুরবাড়ি’ আছে, শাশুড়ি থাকলেও তার বাড়ি থাকতে নেই। নরনারী নির্বিশেষে চারিত্রিক দুর্বলতার কারণে ‘কাপুরুষ’ বনে যান, ‘কানারী’ হওয়ার আলাদা সংস্থান ভাষা তাদের জন্য রাখেনি।

উল্লিখিত শব্দগুলি তাদের বাচ্যার্থকে অতিক্রম করে অর্থবিস্তার লাভ করেছে, বলে দায় এড়ালে চলে না। যেসব শব্দের স্পষ্ট স্ত্রীলিঙ্গবাচক শব্দ ভাষায় বর্তমান, সেসব ক্ষেত্রে শুধু পুংলিঙ্গ বাচক শব্দ দিয়ে উভয়কে বোঝানোর রীতিটা বলপূর্বক দুর্বলের উপর সবলের অধিকার কায়েম বলেই মনে হয়। এসব ক্ষেত্রে ভাষাকে আমরা ‘ছেলের হাতের মোয়া’-র মতোই ব্যবহার করেছি। শিক্ষা নামক মোয়াটি মেয়েদের হাতেও সমানভাবে তুলে দিতে না পারার প্রভাব ভাষাতেও স্পষ্টভাবে প্রকাশিত আজ।

আজকের সমাজের ‘তরুণপ্রজন্মে’-র তরুণীরা যদি প্রশ্ন তোলে, রাজপুত্র রাজকন্যা নবাবজাদা নবাবজাদীরা কেন রানীপুত্র বেগমপুত্র হয়ে মাতৃপরিচয়ের সৌভাগ্য পাবে না, সে প্রশ্ন অবান্তর নয়। অথবা আরও সহজ কথায় ‘ছেলেপুলে নেই’- বললে ধরতে হবে ‘মেয়েও না-থাকা’-কে। ছেলে থাকলে সে হবে ‘হিরের টুকরো’,মেয়ে কীসের টুকরো হবে, আমাদের প্রচলিত মাতৃভাষা সে প্রশ্নের উত্তর দিতে চায় না।
———————-
কাজী নুদরত হোসেন
নলহাটি-বীরভূম (প.ব)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *