আশ্চর্য অলৌকিক লীলায় প্রভুপাদ প্রাণগোপাল গোস্বামী….৯ম পর্ব) : রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক।

0
564

(পূর্ব প্রকাশের পর)
নবদ্বীপের ব্রজানন্দ গোস্বামী রোডে অবস্থিত শ্রীশ্রীরাধামদনমোহন মন্দিরে অনুষ্ঠিত হয়ে চলেছে ৯১তম শ্রীশ্রীগুরুনির্য্যাণ মহোৎসব। দীর্ঘ এগারো দিন উৎসবের আজ তার পঞ্চম দিন। ৮ম পর্বে আমরা জেনেছি এই উৎসবের আয়োজক স্বয়ং প্রভুপাদ প্রাণগোপাল গোস্বামী। তিনি তাঁর শ্রীগুরুদেবী তথা মাতৃদেবী শ্রীমতী সারদা মাতা গোস্বামীনীর বিরহকে উপলক্ষ্য করে এই উৎসবের সূচনা করেন। এই উৎসব যে কেবল শাস্ত্র পারায়ণ, কীর্তন, ভোগরাগের অনুষ্ঠান—-তা নয় ; এ যে দরিদ্র নারায়ণ সেবার এক সুবৃহৎ দৃষ্টান্তোৎসব তা আমরা সহজেই অনুমান করতে পেরেছি বা বলা ভালো সে সত্য উপলব্ধি করতে পেরেছি গত পর্বে পড়া এবছরের সেবা তালিকায়। বর্তমান সময়ে আমরা এখন অনেক উৎসবেই দেখি যে, সেখানেও দরিদ্রনারায়ণ সেবা হচ্ছে বা হয়ে আসছে বিগত বেশ কিছু বৎসর ধরে। কিন্তু, মনে রাখতে হবে যে , এধরণের উৎসবের অর্থাৎ , ধার্মিকতা ও মানবিকতার এই মেলবন্ধনের উৎসবের প্রচলন কিন্তু প্রভুপাদ প্রাণগোপাল গোস্বামীর হাত ধরেই।তার পূর্বে কিন্তু এমনটা হয়নি বা কেউ হবার কথা কল্পনাও করেননি। অতএব, গৌড়ীয় বৈষ্ণব সমাজে অনেক অবদানের মধ্যে এটি একটি বিশেষ অবদান তাঁর।

শুধু কী তাই! ব্রাক্ষ্মণ্যধর্মের কৌলিন্যমুক্ত এক উদার উৎসবের দৃষ্টান্ত এটি। কেন , কীভাবে —সে প্রসঙ্গে আসছি।

উৎসবে লক্ষ-লক্ষ লোকের সমাগম হয়েছে। নবদ্বীপের ভক্তরা যেমন উপস্থিত আছেন , তেমন আছেন নীলাচল ও বৃন্দাবনের আমন্ত্রিত ভক্তরাও। হাজার হাজার বৈষ্ণব ও ব্রাক্ষ্মণগণেরা নিমন্ত্রণে সাড়া দিতে উপস্থিত সকলে। প্রতিদিন সন্ধ্যায় ভাগবত প্রবচন করেন স্বয়ং প্রভুপাদ। আর প্রবচনের আগে পরে কীর্তন করেন নবদ্বীপ সমাজবাড়ির প্রতিষ্ঠাতা আচার্য শ্রীল রাধারমণ চরণদাস বাবার শিষ্য তথা বরানগর পাঠবাড়ির আচার্য, বৈষ্ণবচূড়ামণি শ্রীপাদ রামদাস বাবাজী। তিনি শ্রীনিত্যানন্দ মহিমা কীর্তন করতেন। প্রভুপাদ আর বাবাজী মহারাজের সেই মণি-কাঞ্চন যোগের ফলে যে অপূর্ব, অনাস্বাদিতপূর্ব ভাববিহ্বলতার তথা ভাবসন্ধির সৃষ্টি হত তা অবর্ণনীয় , কেবল অনুভবীজন দ্বারা অনুভববেদ্য।

গুণীজনের উপস্থিতিতে হত শাস্ত্রপারায়ণ। প্রভুপাদ এজন্য আমন্ত্রণ জানাতেন তৎকালীন স্বনামধন্য পন্ডিতদের। সেইসকল পন্ডিতদের সম্মিলিত মণীষা , নবদ্বীপ যে একসময় ভারতবর্ষে বিদ্যাচর্চার প্রধান পীঠস্থান ছিল–সেই সত্যবোধ জাগরুক করতো উপস্থিত জনার মননে । আবার যাঁরা পালা কীর্তন করতে আসতেন তাঁরাও হতেন সেসময়ের বিখ্যাত সব কীর্তনীয়ারা। যেমন, যদুনন্দন দাস, গনেশ দাস,অবধূত ব্যানার্জী , যামিনী মুখোপাধ্যায় ও অারও অনেকে।

উৎসবের প্রথম দিনেই মধ্যাহ্ন প্রসাদ বিতরণ কালে এক ঘটনা ঘটলো। মন্দির চত্বরে তো একসঙ্গে প্রায় হাজারজনকে বসিয়ে প্রসাদ পাওয়ানো সম্ভব নয় , তাই মন্দিরের পার্শ্ববর্তী এক মাঠে প্রসাদের ব্যবস্থা করা হয়েছিল বড় বড় চাঁদোয়া টাঙিয়ে । ব্রাক্ষ্মণ, বৈষ্ণব সকলেই সেখানে প্রসাদ পাবেন, এই ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু, প্রসাদ পেতে বাধ সাধলেন নবদ্বীপের গোঁড়া ব্রাক্ষ্মণ সমাজ। তাঁদের ব্রাক্ষ্মণ্যত্বের কৌলিন্য ধর্ম হোঁচট খেল সেখানে বৈষ্ণবদের সাথে এক চাঁদোয়ার তলায় প্রসাদ পেতে। তাঁরা ঘোষনা করে দিলেন যে , “আমরা শূদ্রদের সাথে একসঙ্গে প্রসাদ নেব না এক জায়গায় বসে।”

প্রভুপাদ একথা শুনে কোন বাক্ বিতণ্ডায় না গিয়ে নাটমন্দিরে ও মন্দিরের দু’দিকের বারান্দায় সেইসকল ব্রাক্ষ্মণদের বসার ব্যবস্থা করে দিলেন। কারণ, অতিথিকে নারায়ণ জ্ঞানে সেবা করতে হয়। তাই, কোনরূপ অসম্মান অনুচিৎ। ব্রাক্ষ্মণদের বসিয়ে প্রসাদ পাইয়ে সন্তুষ্ট করলেন । এবার তাঁর নিজের প্রসাদ পাবার পালা সকলের শেষে। তিনি গমন করতে উদ্যত হলেন ওই মাঠের দিকে যেখানে সকলের বসার জায়গা। একজন গোড়া ব্রাক্ষ্মণ উচ্চকণ্ঠে বলে ফেললেন,
“প্রভু , এ আপনি কী করতে চলেছেন? স্বয়ং গোস্বামী বংশের প্রভুপাদ হয়ে কিনা চলেছেন ওখানে সকলের সাথে প্রসাদ পেতে! এ কী উচিৎ কাজ হবে বলে আপনার মনে হয়? এরপরে কী সমাজ আপনাকে আগের মত করে সম্মান জানিয়ে গ্রহণ করবে আদৌ?”

প্রভুপাদ তখন হেসে ফেললেন, বললেন, “বেশ তো, আমায় না হয় আপনারা একঘরেই করে দিন না ! কী আছে , তখন না হয় থাকবো এদের সঙ্গে এদেরকে নিয়ে একঘরে হয়ে! ক্ষতি কী! এখন আছি , তখনো থাকবো।”
এই কথা শুনে তাঁর শ্বশুড়ালয়ের একজন বলে বসলেন, “চলুন, আমিও তাহলে , আপনার সাথে ওখানে বসেই প্রসাদ নেব ।” প্রভুপাদ তখন ব্রাক্ষ্মণদের দিকে চেয়ে হেসে বললেন, “দেখুন, ছিলাম একঘরে, এখন দু’ঘরে হলাম! ভালোই হল।”
গোড়া ব্রাক্ষ্মণরা বুঝলেন যে , প্রভুপাদ তাঁর সিদ্ধান্তে অটল। তিনি লোকাপেক্ষার ধার ধারেন না। তাঁর মন জাত-পাত বা কৌলিন্য প্রথার বেড়াজালে সীমাবদ্ধ নয় । তাঁর জীবনদর্শন অন্য পর্যায়ের, অন্য মাত্রার । এমনই সঙ্কীর্নতামুক্ত উদার মনের মানুষ ছিলেন প্রভুপাদ প্রাণগোপাল গোস্বামী।

আর , ভবিষ্যতে তাঁর উত্তরসূরিদের মধ্যেও যাতে জাতের অহঙ্কারের কড়াল ছায়া না পড়ে তার জন্য করেছিলেন তিনি এক বিশেষ অমোঘ নিয়ম। উৎসবের শেষ দিনে যেদিন ৬৪মোহান্তের ভোগ হবে সেদিন যারাই প্রসাদ পাবে, জাতি,ধর্ম,বর্ণ নির্বিশেষে সকলের উচ্ছিষ্টকণা সংগ্রহ করে রাখা হবে। আর দিনের শেষে সেই উচ্ছিষ্ট প্রসাদ গ্রহণ করতে হবে তাঁর বংশজ প্রভুপাদগণকে। এমন অবিশ্বাস্য নিয়মের কথা শুনে আশা করি পাঠকগণ চমৎকৃত হয়েছেন। কিন্তু, এ চরম বাস্তব। সেই ধারা অব্যাহত । আজও, সেই নিয়মকে সসম্মানে শিরোধার্য করে প্রভুপাদ প্রেমগোপাল গোস্বামী সেই উচ্ছিষ্ট প্রসাদেই নিজের উদর পূর্তি করেন দিনের শেষে উৎসবের শেষ দিনে।

এমন প্রভুপাদগণের শ্রীচরণে সহস্র বিনম্র নমন।

(ক্রমশঃ)
ভক্ত-কৃপাপ্রার্থিনী
রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক