ছেঁড়া ডাইরির পাতা : ডঃ অশোকা রায়।

0
660

 

অনিন্দিতা, ডাইরি পাতাগুলো চেয়ে আছে আমার দিকে |
সেই কোন যুগ থেকে ওতে হাত পড়েনি| ডাইরির পাতা রঙ পাল্টেছে | পোকার কামড়ও খেয়েছে | কিন্তু কি যে খেয়াল হলো, মনে হচ্ছে এতে তোমার কথা লিখি | মনের রেচন ক্রিয়ার সাধ আর কি! হ্যাঁ, এতেই লিখি দু- চার কথা | বড়ো মনে পড়ে তোমার কথা, তোমার চলে যাবার আগে আর পরের দিন গুলোর কথা | হ্যাঁ তুমি গেছো চলে | বলে তুমি যাওনি কিছু।
হঠাৎ করেই চলে গেলে|
ফিরে আসার নাছোড় আবদার করিনি |
আবদারের সুযোগ আমি পাইনি |
করবোই বা কাকে আর কোথায় ?
ঠিকানা রেখে যাওনি তুমি |
অফিস থেকে ফিরে দেখেছি বাড়ি খালি |আঁতিপাঁতি করে খুঁজছিলাম,
বিছানার তোশক, বালিশের তলা|
তোলপাড় টেবিলের ড্রয়ার, আলমারি, সোফার গদি |
মেঝেতে জামাকাপড়ের স্তুুপ |
সব সব কিছু খুঁজেছি|
সেদিন ঠিক ছিল গয়নার বাক্স, ক্যাশ বাক্সের টাকা | রান্না ঘরের সেল্ফ যথাযথ | ওখানেই তো কাটাতে বেশ কিছু সময়, আমার অনুপস্থিতিতে | তাই আমার খোঁজার তালিকায় বাদ ছিল না রান্না ঘর |
আজ, কাল, পরশু করে কেটেছে অনেক পল-অনুপল।
ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টেছে, ক্যালেন্ডার পাল্টেছে |
ব্যাথার সমারোহে সমব্যথী বেশ কিছু বছর|
বৈধ-অবৈধ কিছু প্রশ্ন মরা তুলসীগাছের পাতায় ।
নিভন্ত সাঁঝবাতির সাথে নিভেছে শপথ |
অপমান রক্ত হয়ে ঝরেছে।
তবুও ভুলিনি তোমাকে।
তোমার-আমার নষ্ট চাঁদ বেডরুমে বসে আজ চুপ করে মুড়ি চিবোয়।
হ্যাঁ সেই শো-পিসের কথা বলছি, যা তুমি কিনেছিলে
যোধপুর পার্কের কি এক এক্সজিবিশন থেকে|
জানো, আজো কাজ করার সময়, আগে, পরে তোমার কথা মনে পড়ে|
তুমি একবারো ভাবো, বিছানায় আজ কি রঙের বেডকভার বিছানো হলো?
রঙ নিয়ে মিছিমিছি মারপিটের কথা তোমার মনে পড়ে?
জানতে ইচ্ছে হয় না, বাজার থেকে কি মাছ আনলাম,
কিংবা মাংস?
একবারো ঝগড়া করতে ইচ্ছে হয় না, এটা কেনো আনলে বলে?
নাকি ঝগড়া করতে গেছো ভুলে?
আমার রান্নাঘর থেকে ভাত ফোটার আর বিবিধ ফোড়নের গন্ধ গেছে হারিয়ে |
তুমি চলে যাওয়ায় হোম- ডেলিভারিতে অভ্যস্ত আমি| চাটা নিজেই বানাই| আর তুমি থাকতেই ব্রেডে বাটার লাগানোর দায়িত্ব দিয়েছিলে আমায় | বলতে হেসে, ওতে তুমি ওস্তাদ | তাই অফিসে মই চড়তে আর বৌকে রসে বশে রাখতে তোমার জুড়ি নেই | তাহলে কেনো তুমি আমায় ছাড়লে আর আমার চাকরি আমি কেন ছাড়লাম তোমার যাওয়ার পর পর?
আচ্ছা অনিন্দিতা, তোমার কি মনে পড়ে খিদিরপুর ডক?
বলে‌ছিলে, দ্যাখো, চাঁদটা কেমন মাখো মাখো|
বড়ো জানতে ইচ্ছে করে, আজো কি তোমার ছাতের পাশে ঝাঁকড়া শ্যাওড়া গাছের ফাঁকে দুষ্টু ছেলের মতো
চাঁদ উঁকি মারে?
ছেলে বলব না মেয়ে বলব, তা নিয়েও দোনামনা |
ঝাঁকি দর্শনে চাঁদ কি আগের মতো আমার নাম উচ্চারণ করে তোমার কানে ?
রকিং চেয়ারে দোল খাবার অভ্যাস এখনো আছে?
আচ্ছা তোমার চিবুকের সেই লাল তিলটা আজো কি ফিসফিস করে বলা আমার কথা শুনতে চায় ?
তুমি কি আজো ডুরে শাড়ি পরে জানলায় দাঁড়াও এসে?
সেই মায়াময় অলসতা ভিড় করে তোমায়?
নস্টালজিয়া ঘিরে ফেলে তোমায়?
বাস ট্রামের শব্দে তোমার চটকা ভাঙে?
আগের মতো তুমি বিরক্ত হও রাস্তায় জল জমলে|
মনে পড়ে, বৃষ্টির সন্ধ্যায় দেখা করতে বললে নন্দনে,
বলতে, রঞ্জন সান্যাল,
যাবো না ওখানে, বড়ো জল জমে|
আমি ওড়াতাম ফুৎকারে, ধুর! ওটা কোন ব্যাপারই নয়|
তুমি আসতে প্রাণের তাগিদে|
আজ কি সেই তাগিদ একেবারে মুছে ফেলেছো অনিন্দিতা?
তোমার কলকাতা শহরটা এখনো সেরকমই আছে,
না সেও বদলে ফেলেছে নিজেকে ?
মেঘ ভাঙা রোদ এখনো কি গায়ে মাখো তুমি?
পীচ গলা রাস্তায় চটির স্ট্যাপ আটকে যায়? তোমার অসহায় চাউনি আমার মুখে, ” এই যাঃ” |
এখনো হঠাৎ গুঁড়ো গুঁড়ো বৃষ্টির দু চার কণা তোমার এলোখোঁপায় চিকচিক করে?
রিণিঝিণি চুড়ির আওয়াজে ঝেড়ে ফেলো তুমি? বলো
” কি বিচ্ছিরি স্বভাব তোর, শুকনো চুল ভেজালি তো? ”
সন্তোষ পুরের তোমাদের পুরোনো বাড়ির পুরোনো পুকুরের ধারে শরতের কাশবন কি তোমাকে আমার কথা বলে?
তোমার হেমন্ত সন্ধ্যা কাকে দাও তুমি?
সেই পাহাড়ী দেশে বেড়াতে যাওয়ার কথা তোমার মনে আছে? জানো, গতবছর আমি ঘুরে এলাম| এবার একা, একদম একা|
দেখলাম , শীতের গালিচা বিহীন উপত্যকা বেয়ে শীর্ণ নদীটা তেমনি করে আজো
গড়িমসি বয়ে যায়|
রডোড্রেনডন গাছের ফাঁকে সেই নাম না জানা পাখি, এদিক ওদিক ঘুরে ফিরে তাকায়|
হয়তো বা তোমাকে খোঁজে আমার পাশে|
এক চিমটি বিষন্নতা আমার ঠোঁটে ঝুলিয়ে বলি, সে তো হারিয়ে গেছে |
আজো তোমার থেকে এতো দূরে বসে তোমার এক কাপ স্মৃতি চারণ।
মেদুর আকাশ কেমন কাঁদছে দেখো।
আমার পুড়ে যাওয়া প্রেম কি বেহায়া!
বেলা শেষে নতুন করে বেলা শুরুর স্বপ্ন দেখায়। আজ এতো বছর বাদে ডাইরির এই পাতা আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নিল মুচলেকা , আমি তোমার জন্য আজো কাঁদি অনিন্দিতা, “l miss you every single moment “. পারো যদি ফিরে এসো |
আমার ভাঙা চোরা বসত বাটির সামনে আস্ত একটা ভালোবাসার বাগান আপনা আপনি গজিয়ে ওঠে ।
তাতেই আমার অনেক খানি কাছে এসে দাঁড়াও|
হোক না স্বপ্ন, তুমিও তো আবার একই স্বপ্ন দেখতে পারো।
পারো না?
পুনশ্চ. এটা ছেঁড়া ডাইরির একটা পাতা | আজো জানি না তোমার ঠিকানা বললে ভুল হবে | অনেক বছর বাদে শুচিস্মিতার সাথে দেখা হয়েছিল আমার | শুচিস্মিতা তোমার বন্ধু | মুখ ফসকে হয়তো বলে ফেলেছিল কথায় কথায়, ” অনিন্দিতা তো বাপের বাড়ি |” আমার তরফ থেকে কোন রি এ্যাকশন না পেয়ে হয়তো আর এ প্রসঙ্গে কিছু বলেনি সে| আমার পুরুষত্ব মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিল | অভিমান হলো, বিনা কারণে কেন আমি দোষী সাব্যস্ত হলাম | এ যেন অপরাধী জানল না তার কি অপরাধ, তার ফাঁসি হয়ে গেলো!!! আমি চিঠি লেখার উদ্যোগ নিইনি, ফিরিয়ে আনারও নয় | যদিও মাঝে মাঝে জানতে ইচ্ছে করে কেমন আছো তুমি | আমার এই ছেঁড়া ডাইরির লেখা পাতা রইলো | যদি কোনো দিন তোমার হাতে পড়ে, ভেজা মনের কথা তোমার মন ছুঁয়ে যাবে কিনা জানি না, তবে এই ডাইরির ছেঁড়া পাতা আমার কাছে আমার ছেঁড়া মনের তার |
10/12 /2020
5:20