আশ্চর্য অলৌকিক লীলায় প্রভুপাদ প্রাণগোপাল গোস্বামীজী (পর্ব-২) : রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক।

0
586

(পূর্ব প্রকাশের পর)
………..প্রভুপাদ শ্রীল প্রাণগোপাল গোস্বামীজী শাস্ত্রসম্মত যুক্তিনিষ্ঠ ব্যাখ্যায় বলে দিচ্ছিলেন সেই ভদ্রলোকের প্রশ্নের সব উত্তর‌। কিন্তু, হলে হবে কী! ভদ্রলোকের উদ্দেশ্য ঠিক ছিল না। তিনি যেন উত্যক্ত করার চেষ্টাতেই অমন সব প্রশ্ন করছিলেন । উপস্থিত সকলেই অনুভব করতে পারছিলেন ভদ্রলোকের হীন উদ্দেশ্যটি। অবশেষে , প্রবচন শুনতে আসা ভক্তদের অস্বস্তি ও বিরক্তি অনুধাবন করে প্রভুপাদ বললেন, “মহাশয় , প্রবচন শেষ না হওয়া পর্যন্ত আপনি একটু চুপ থাকুন।” এইবলেই তিনি আবার শ্রীমদ্ ভাগবত কথা শুরু করে দিলেন। এদিকে সেকথা শুনে ওই ভদ্রলোক প্রত্যুত্তরে কিছু বলতে চেয়েছিলেন, কিন্তু, এ কী! তাঁর কন্ঠ দিয়ে তো কোন শব্দই বের করতে পারছেন না! তিনি বলতে চাইছেন , অথচ পারছেন না। কী আশ্চর্য! কেউ যেন কন্ঠের শব্দযন্ত্রটিকে চেপে ধরে রেখেছেন। অনেক চেষ্টা করেও একটা শব্দও বের করতে পারলেন না মুখ থেকে। ভীত অন্তরে স্থানুর মত বসে রইলেন তিনি । প্রভুপাদ প্রবচন শেষ করে নিজের জপমালাটি সেই ব্যক্তির মস্তকে স্পর্শ করালেন । আর , অমনি কন্ঠটি যেন খুলে গেল । ভদ্রলোক কথা বলে উঠলেন। এমন অবিশ্বাস্য ঘটনা দেখে , ভদ্রলোকসহ উপস্থিত সকলের যে কী বিস্ময়কর মনের অবস্থা তা সহজেই অনুমিত হয়। প্রভুপাদের অলৌকিক প্রভাবে সকলে আশ্চর্য্য তখন। আসলে, যেখানে কৃষ্ণকথা আলোচনা হয় , আর ভক্তরা খুব মন দিয়ে তা শ্রবণাস্বাদন করেন ,সেখানে তখন সেসব ভক্তদের সঙ্গ পেতে স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ এসে হাজির হন। তিনিও কথা শ্রবণ করেন । আর , যখন কেউ সেই আলোচনায় বিঘ্ন সৃষ্টি করেন , তখন তাঁকে শাস্তি দেন শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ংই। একারণেই , ভগবানের নাম ও কথা যখন কোথাও হয় , তখন সেখানে বিঘ্ন বা অসুবিধা সৃষ্টি করে তা ভঙ্গ করতে নেই। শ্রীকৃষ্ণ তো পৃথিবীর সকল অপরাধই ক্ষমা করে দেন। করেন না শুধু এদুটিই— ১)বৈষ্ণব অপরাধ আর ২) নাম-কথায় বিঘ্নতা সৃষ্টি করা।

প্রতিবছর নিয়মসেবার সময় অর্থাৎ কার্তিক মাসে প্রভুপাদ বাংলাদেশের ঢাকায় যেতেন আর তার আগমনের সংবাদেই চতুর্দিকে যেন আনন্দময় আবহ তৈরি হয়ে যেত। কারণ, দূর-দূরান্ত থেকে ভক্তেরা ছুটে চলে আসতেন তাঁর অপূর্ব ভাগবতী কথা আস্বাদন করতে। আগামী কিছুদিন প্রভুপাদের শ্রীমুখের শ্রীমদ্ ভাগবত কথা আস্বাদনে, ভক্তসঙ্গে ভালো কাটবে—এই আনন্দে সকলে মাততেন। সেসময় প্রতিদিন প্রায় সতেরো-আঠারো জায়গায় তাঁকে পাঠ করতে হত। যা প্রায় অবিশ্বাস্য হলেও সত্য । আর, সবথেকে আশ্চর্যের বিষয় হল এই যে, এত জায়গায় পাঠ করেও, তিনি কখনও অবসন্ন বা ক্লান্ত হতেন না। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত একের পর এক স্থানে পাঠ-প্রবচন করে যেতেন। শুধু তো ঢাকা নয়, ঢাকার বাইরে অন্যান্য জায়গাতেও প্রভুপাদকে পাঠের জন্য যেতে হত।
বাংলাদেশে কতশত-সহস্রজন যে তাঁর থেকে দীক্ষা নিয়ে ভজনপরায়ণ হয়েছিলেন, তার ইয়াত্তা নেই। সেখানে পাড়ায় পাড়ায় প্রতি ঘরে ঘরে সকাল-সন্ধ্যায় মঙ্গলারতি, সন্ধ্যারতির কাঁসর-ঘন্টা-কীর্তনের অনুরণনে এক দিব্য পরিবেশ তৈরি হত । পাঠ-প্রবচন শ্রবণ করতে ভক্তরা কত উৎসাহী , যত্নশীল হয়েছিলেন । প্রভুপাদের মহিমায় সদাচার , বৈষ্ণবাচার পালনকারীর সংখ্যা বহুমাত্রায় বৃদ্ধি পেয়ে যায় বাংলাদেশে। ঢাকা হয়ে ওঠে দ্বিতীয় নবদ্বীপ। নবদ্বীপের পথে পথে যেমন নিতাই গৌরাঙ্গ নৃত্য করতে করতে সঙ্কীর্তনানন্দে বিহার করতেন, ঠিক তেমন সাক্ষাৎ শ্রীনিতাই প্রভুপাদ প্রাণগোপাল গোস্বামীজী নৃত্যবিনোদীয়া হয়ে বাংলাদেশের পথে পথে সঙ্কীর্তনের প্লাবন আনতেন। মানুষ যেন আনন্দে অবগাহন করতে করতে ভেসে যেত সে প্লাবনে।

তবে, বাংলাদেশে শ্রীল প্রভুপাদের সবথেকে বড় অবদান অন্যকিছু। সেখানে বৈষ্ণব ধর্মের অপসম্প্রদায়ীদের প্রকোপ প্রচন্ড তখন । এই অপসম্প্রদায়ীরা দেহতত্ত্ববাদী ও ব্যভিচারদুষ্ট ছিল । তারা গুরু-শিষ্যকে শ্রীকৃষ্ণ-রাধা জ্ঞান করে প্রেমসাধনা করতো। আর , সব থেকে মন্দ কথা হল, এসব কাজে তারা শ্রীরূপ-সনাতন গোস্বামীর নাম করে আসলে ‘শ্রীরূপ কবিরাজ’ কর্তৃক প্রদত্ত , আচরিত সেই অপমতের প্রচার চালাচ্ছিল , যা শ্রীমন্ মহাপ্রভুর অনুমিত আদর্শ ছিল না।

একবার কাশিম বাজারে শ্রীযুক্ত নন্দীমহারাজের রাজবাড়ীতে প্রবচন শুরু করেছেন প্রভুপাদ প্রাণগোপাল গোস্বামীজী। বেশ কিছুদিন ধরে পাঠ চলবে সেখানে তখন । সেসময় হঠাৎ একদিন রাত্রে তাঁর স্বপ্নে শ্রীল নরোত্তম ঠাকুর দর্শন দিলেন। তিনি আদেশ দিলেন , রাজশাহীতে গিয়ে যেন শ্রীমদ্ ভাগবত কথা পরিবেশন করেন তিনি। প্রভুপাদ স্বপ্নাদেশ শিরোধার্য করে চলে এলেন রাজশাহীতে। তিনি প্রবচন প্রারম্ভ করলেন। তাঁর প্রবচনে ষড় গোস্বামী দ্বারা প্রদর্শিত বিশুদ্ধ গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মাদর্শ প্রচার পেতে থাকলো। এদিকে রাজশাহীতে তখন অপসম্প্রদায়ীদের প্রাদুর্ভাব। রাজশাহীবাসীরা যাতে পথভ্রষ্ট না হয়ে যায় , বিশুদ্ধ ভজনপথের সন্ধান পায়— এই উদ্দেশ্যেই শ্রীল নরোত্তম ঠাকুর সেখানে পাঠিয়েছিলেন প্রভুপাদকে । তাই, যখন, প্রভুপাদের ব্যাখ্যায় সেই অপসম্প্রদায়ীদের নিন্দনীয় মত ও পথ ক্রমশঃ প্রকাশ হয়ে যেতে থাকে, তখন তাদের শিরে যেন বজ্রাঘাত হল। তারা প্রবচন বন্ধ করার বিবিধ প্রচেষ্টা চালালো । কিন্তু, তা যখন করা গেল না, তখন প্রভুপাদের জীবন নাশের পর্যন্ত নানা পরিকল্পনা শুরু করলো। প্রভুপাদ নিজের প্রাণ বিপন্ন জেনেও লড়াই করে গেলেন । তাঁকে বাণ পর্যন্ত নিক্ষেপ করা হয় বেশ কয়েকবার । কিন্তু, রাখে হরি , মারে কে! উদ্দেশ্য যেখানে সৎ, আচরণ যেখানে ন্যায়সঙ্গত , লক্ষ্য যেখানে স্থির হয়—সেখানে অলক্ষ্যে থেকে যে ভগবান চালনা করেন। আর তাই, অসম্প্রদায়ীদের সকল চেষ্টা বিফলে গেল । প্রভুপাদের প্রচেষ্টায় রাজশাহীর মানুষ শ্রীমন্ মহাপ্রভুর দ্বারা নির্দেশিত , ছয় গোস্বামী দ্বারা প্রবর্তিত বিশুদ্ধ ভজনপন্থা যাজন শুরু করলো। অসম্প্রদায়ীরা ক্রমশঃ শক্তি হারিয়ে মুষ্টিমেয় সংখ্যায় এসে দাঁড়াতে থাকলো ।

বাংলাদেশের ঢাকা জেলার বুতনী গ্রামে এখনও পর্যন্ত ‘মদনমোহন বৃক্ষ’ নামে একটি বট বৃক্ষ দর্শন হয় , যে বৃক্ষের গাত্রের মধ্যে প্রভুপাদ প্রাণগোপাল গোস্বামীজী দর্শন পেয়েছিলেন নবদ্বীপের শ্রীশ্রীরাধামদনমোহন বিগ্রহের । তখন তাঁর বাল্যকাল । ওই সাত-আট বৎসর বয়স হয়তো বা। তিনি বিগ্রহ দর্শন করেই মূর্ছা গিয়েছিলেন । পরবর্তীতে পরিণত বয়সে , যখন নবদ্বীপে শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য বাবাজীর কুটীরে তিনি শ্রীশ্রীরাধামদনমোহন বিগ্রহকে দর্শন করেন, তখন দর্শনমাত্র তাঁর মনে পড়ে যায় যে, এই বিগ্রহের স্বরূপ তো তাঁর পূর্বপরিচিত ! তিনি তো এঁনাদেরকেই দর্শন করেছিলেন তাঁর বাল্যকালে বুতনী গ্রামেতে! শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য বাবাজীর সেবা গ্রহণের পূর্বে শ্রীবিগ্রহরা ছিলেন রাজস্থানে। যে কারণে , এই বিগ্রহদের গঠনশৈলী কিন্তু একটু ভিন্ন ধরণের । শ্রীমুখের আদলে বঙ্গশৈলী নয়, রাজস্থানী শৈলীর প্রকাশ । তাই, বিগ্রহ দর্শনমাত্র বাল্যকালের স্মৃতি ফিরে পেতে অসুবিধা হয়নি প্রভুপাদের সেসময়। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে সেই মদনমোহন বৃক্ষে এখনও পর্যন্ত হিন্দু-মুসলিমরা নির্বিশেষে পূজা দেন, ঢিল বেঁধে, সুতো বেঁধে মানত করেন তাঁরা । প্রচলিত বিশ্বাস যে, সকলের মনোবাসনা নাকি পূরণ হয় সেই বৃক্ষের কৃপায় । অতএব, শ্রীল প্রভুপাদের কল্যাণেই যে ,মদনমোহন বৃক্ষ বাংলাদেশের হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের এক দ্যোতক রূপে দন্ডায়মান আজও, তা বলা যায় নিঃসন্দেহে।

নবদ্বীপে থাকাকালীন সময়ে মাঝে মধ্যেই প্রভুপাদকে আমন্ত্রণ জানানো হত সমাজবাড়িতে শ্রীমদ্ ভাগবত কথা বলার জন্য । শ্রীরামদাস বাবাজীসহ অন্যান্য বৈষ্ণব সজ্জনরা প্রবচন শুনতে বসতেন। একেক দিন প্রবচনের আগে রামদাস বাবাজী কীর্তন করতেন । তাঁর প্রগাঢ় ভক্তিবিমিশ্রিত কন্ঠের দরদভরা কীর্তন শ্রবণ করে প্রভুপাদও আবেগে ভাসতেন। উভয়েই উভয়ের গুণমুগ্ধ ছিলেন। সুগভীর হৃদ্যতা ছিল তাঁদের পরস্পরের মধ্যে। একদিন ‘জয় জয় নিতাই’ বলে রামদাস বাবাজী এমন প্রাণকাড়া , হৃদয়নাড়া একটি কীর্তন করলেন যে প্রভুপাদ উঠে এসে নিজের হরিনামের মালাখানি বাবাজী মহারাজের মস্তকে ঠেকিয়ে আবেগঘন হয়ে বললেন,”ভাই , তুমি বাস্তবিক নিতাইচাঁদকে আপন করতে পেরেছো, ভালোবাসতে পেরেছো।” তখন রামদাস বাবাজী মৃদু হেসে অশ্রুসজল নয়নে বলেছিলেন, “সাক্ষাৎ নিতাইচাঁদ যখন বললেন, তখন মনে হচ্ছে একটু হলেও ভালোবাসতে পেরেছি। নিশ্চিন্ত হলাম আজ।” এরপর উভয়ে উভয়কে প্রেমালিঙ্গনে আবদ্ধ‌ করলেন। এক অসাধারণ মুহুর্তের সাক্ষী রইলেন উপস্থিত সকলে।

একবার প্রভুপাদ প্রাণগোপাল গোস্বামী পূর্ববঙ্গের ফতেয়াবাদ নামক স্হানে এলেন শ্রীমদ্ ভাগবত কথা পরিবেশন করতে । সেখানে নিকটেই মেখল নামক গ্রাম। উল্লেখ্য যে , এই মেখল গ্রাম হল মহাপ্রভুর প্রিয় পার্ষদ শ্রীপুন্ডরীক বিদ্যানিধির জন্মস্থান। শ্রীগোবিন্দ সাহা নামে একজন ধনাঢ্য ব্যক্তি বাস করতেন ওই গ্রামে । তাঁর পূর্বপুরুষদের দ্বারা স্থাপিত একটি মন্দির ছিল। কিন্তু, সে মন্দিরের বিগ্রহসেবা পূর্বে বড় প্রেমভরে করা হলেও , বর্তমানে গোবিন্দ সাহার আমলে তেমন ভাবে পরিচালনা করা হত না। সে সেবায় কোন‌ প্রেম ছিল না। কেবল , নিয়ম-নীতি মেনে বৈধীভক্তিতে নিত্য দায়সারা কর্তব্যপালন চলছিল । এদিকে গোবিন্দ সাহার গৃহের আশেপাশের লোকজন মাঝেমধ্যেই মন্দিরের চারপাশে এক অশরীরি আত্মার উপস্থিতি টের পেতেন । একদিন হল কী, একজন প্রতিবেশী ভয়ানক ভয় পেয়ে চিৎকার করে উঠলেন । তিনি দেখলেন মন্দিরের চারপাশে এক প্রেতাত্মা ঘুরছেন। তাঁর চীৎকারে গোবিন্দ সাহা ছুটে এলেন। ওই প্রতিবেশী আঙ্গুল দিয়ে গোবিন্দ সাহাদের মন্দিরটি দেখালেন। দেখে আশ্চর্য হলেন গোবিন্দ সাহাও । মন্দিরের দ্বার অমন রুদ্ধ কেন , এই সন্ধ্যাকালে ! তাঁর কৌতুহলপূর্ণ মুখ দেখে তখন সেই ভীত প্রতিবেশী ব্যক্তিটি নিম্ন কন্ঠে জানালেন যে, মন্দিরের মধ্যে প্রেতাত্মা প্রবেশ করে ভিতর থেকে মন্দিরের দ্বার রুদ্ধ করে দিয়েছে । গোবিন্দ সাহা যেন আকাশ থেকে পড়লেন এবার। প্রেতাত্মারা তো ঠাকুর-দেবতা থেকে ভয়ে দূরে পালায়। জীবনে তো তিনি এই প্রথম শুনলেন যে কোন প্রেতাত্মা মন্দিরের গর্ভগৃহে প্রবেশ করে দ্বার রুদ্ধ করে দিতে পারে ! মন্দিরের দ্বারের নীচে ফাঁকা ছিল একটু। সেই ফাঁকা দিয়ে দেখার জন্য ঝুকঁলেন গোবিন্দ সাহা আর তাঁর প্রতিবেশী। ওমা , একী দেখছেন ! ওল্টানো পায়ের পাতার কোন প্রেতাত্মাই তো মন্দিরের গর্ভগৃহের মধ্যে হেঁটে বেড়োচ্ছে যে! …….
(ক্রমশঃ)

ভক্তকৃপা-প্রার্থিনী
রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক।