শ্রীগৌরাঙ্গের শ্যামসুন্দররূপ ধারণ লীলা : রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক।

0
544

দ্বাপর যুগে শ্রীকৃষ্ণের ব্রজলীলায় পরম বান্ধব ছিলেন সুদামা বিপ্র । যখন শ্রীকৃষ্ণ অধীশ্বর হয়ে রাজত্ব করছেন অপার বৈভবে দ্বারকায়, তখন বাল্যবন্ধু সুদামা দারিদ্র জ্বালায় জর্জরিত হয়ে দিন কাটাচ্ছেন ব্রজে । শেষে ইচ্ছা না থাকলেও পত্নীর পীড়াপীড়িতে এক রকম বাধ্য হয়েই এলেন তিনি দ্বারকায় প্রাণসখা শ্রীকৃষ্ণের কাছে , কিছু ধন প্রাপ্তির জন্য । সেখানে শ্রীকৃষ্ণ ও তাঁর পত্নী রুক্মিণীর আতিথেয়তায় , ভালোবাসায় সুদামা মুগ্ধ হয়ে গেলেন। এমনকী কৃষ্ণ-রুক্মিণী তাঁকে ব্রাহ্মণজ্ঞানে সম্মান জানাতে তাঁর পদধৌত পর্যন্ত করে দেন, আরতিও করেন। এসবে সুদামা এত অভিভূত ও প্রসন্ন হলেন যে লজ্জায় কোন ধন চাইতেই পারলেন না নিজমুখে। নিজের প্রয়োজনের কথা বলতেই পারলেন না তিনি। বাল্যবন্ধু কানাইয়ের বর্তমান রাজকীয় বৈভব দেখে নিজের আনা সামান্য উপহার দ্রব্য ক্ষুদটুকুও আর দিতে পারলেন না। কিন্তু ,অন্তর্য্যামী প্রভু নিজেই যেচে উপহার চাইলেন বান্ধব সুদামা বিপ্রের কাছে । বলা যায় একপ্রকার সুদামার থেকে কেড়ে নিলেন তা। সেই ক্ষুদান্ন পরম আনন্দে মুষ্টিতে তুলে ভক্ষণ করলেন।

সুদামা কোন ধন না চেয়েই বিদায় নিলেন শেষে। গ্রামে ফিরে গিয়ে তিনি যেন আকাশ থেকে পড়লেন! অত্যন্ত অবাক হলেন দেখে যে, তাঁর দরিদ্র কুটীর প্রাসাদে রূপান্তরিত হয়েছে। দাস-দাসী , ধনসম্পদ , প্রাচুর্য্যে সে ভবন পরিপূর্ণ । স্ত্রীও তাঁর মহাসুখী । সুদামার বুঝে নিতে অসুবিধা হল না যে , সর্বান্তর্য্যামী শ্রীকৃষ্ণ তাঁর সর্ব অভাব পূরণ করতেই এত সব ব্যবস্থা করে দিয়েছেন নিজের থেকে। কিন্তু , তিনি বিমর্ষ হলেন এই ভেবে যে, শ্রীকৃষ্ণ ধন সম্পদ প্রদান করে তাঁকে বঞ্চনাই করেছেন একপ্রকার। তিনি তো ধনের কাঙ্গাল নন , তিনি চান শ্রীকৃষ্ণচরণ । ধন প্রাপ্তি হলে যদি শ্রীকৃষ্ণের চরণচিন্তা ভুলে যান তাই ধনের কামনা তিনি করেন না কখনো। তাঁর এক মাত্র অভিলাষ ভগবানের শ্রীচরণসেবা । তিনি তো কৃষ্ণপ্রেমধন চান! তা কী করুণাময় কৃষ্ণ তাঁকে তবে দেবেন না কখনো !————-এহেন প্রেমিক, মহান মনের মালিক সুদামা বিপ্রই কলিযুগে আবির্ভূত হন ভিক্ষুক বনমালীরূপে । তাঁকে কেমন ভাবে শ্রীগৌরাঙ্গ শ্যামসুন্দর রূপে দর্শন দিয়েছিলেন, এবার সে প্রসঙ্গ জানবো আমরা।

শ্রীবনমালী পূর্ববঙ্গবাসী এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ ছিলেন। ভিক্ষান্নে জীবন অতিবাহিত করতেন তিনি। ভগবানের নামগুণ কীর্তনে প্রেমানন্দে সর্বদা মগ্ন থাকতেন। যখন তিনি জানলেন যে ব্রজেন্দ্রনন্দন কৃষ্ণ কলিতে নদীয়ায় অবির্ভূত হয়েছেন , তখন একবার অন্তত দর্শন করে নিজ জীবন ধন্য করার আশায় পুত্রকে সাথে নিয়ে এলেন নবদ্বীপে ।

ভক্তগণ পরিবৃত হয়ে শ্রীগৌরসুন্দর ভুবন আলো করে বসে আছেন। তাঁর অমন স্নিগ্ধ, মনোহর , জ্যোতির্ময় প্রেমতনু দর্শন করে বনমালীর অন্তর আনন্দে ভরে উঠল । সাক্ষাৎ ইশ্বর সত্যই দর্শন হল এতদিনে! —–এই ভেবে বারংবার নিজের সৌভাগ্যের প্রশংসা করতে থাকলেন তিনি । প্রেমানন্দে নৃত্যও করতে থাকলেন। বনমালী বিপ্র যে প্রভুর নিজজন—-দ্বাপরলীলার বান্ধব সুদামা ! তাই প্রভুও অন্তরে পরম সুখী হলেন ভিক্ষুক বনমালীকে পেয়ে । তিনিও পিতা-পুত্রের সঙ্গে সংকীর্তন করে অন্তরের উল্লাস ব্যক্ত করলেন। প্রভু দুজনকেই কৃপা করে প্রেমধন অর্পণ করলেন। ক্ষণেতেই সকল দুঃখের অবসান হল তাঁদের ।
পরদিন যখন সংকীর্তন শুরু হল , প্রেমানন্দে গোরা রায় নৃত্য ধরলেন , তখন আচম্বিতে পিতা-পুত্র লক্ষ্য করলেন যে গৌরাঙ্গের গৌরবর্ণ তনুখানি শ্যামল বর্ণের হয়ে গিয়েছে। কটিতে পীতবাস , হস্তে বেণু, মস্তকে ময়ূর পাখার চূড়া তাঁর । গৌরাঙ্গ নন, শ্যামসুন্দর শ্রীকৃষ্ণ নৃত্য করছেন। পাশে শ্রীমতী রাধারাণী । নবদ্বীপের কীর্তন অঙ্গন নেই তখন আর সেখানে। পরিবর্তে বৃন্দাবনের বিপিন। যমুনা পুলিন আর গিরি গোবর্ধন সেখানে ।ভান্ডীর বন , মধুবন , তালবন, গোপ-গোপী , ধেনু, গো-বাছুর—-এসব দর্শন হল দুই বিপ্রের । আর, তৎক্ষণাৎ মূর্ছিত হয়ে গেলেন তাঁরা । সকলে “ধর্‌ ধর্‌” বলে তাঁদেরকে ধরতে ছুটে এলেন। তাঁদের তখন পুলকিত অঙ্গ , সজল নয়ন ; ঘন ঘন হুঙ্কার করেছেন তাঁরা।
“ওই যে কৃষ্ণ ! কৃষ্ণ প্রেমের হাট পেতেছেন এখানে”—-এই বলে প্রলাপ করছেন দুজনেই । সকলে তাঁদের কাছে সব বৃত্তান্ত শুনলেন। সকলে ধন্য ধন্য করলেন বিপ্রের প্রতি গৌরাঙ্গের কৃপা দেখে । আসলে ,পূর্বলীলায় সুদামা যে আশা করেছিলেন , সেই আশাই পরিপূর্ণ করলেন শ্রীভগবান এযুগে। পূর্বে ঐশ্বর্য্য অর্পণ করে পরীক্ষা করেছিলেন । এই লীলায় প্রেমধন দিয়ে নিজের স্বরূপ দর্শন করিয়ে কৃপা করলেন প্রকৃতই। সুদামার মনের অভিলাষ পূর্ণ হল এই গৌরলীলায়। শুধু তাই নয় , পুত্রসহ কৃপা করেছেন ভিক্ষুক বনমালীকে করুণানিদান প্রভু। ঐশ্বর্য্য অপেক্ষা যে প্রেম শ্রেষ্ঠ সর্বকালে—-তা সুদামা বিপ্র তথা ভিক্ষুক বনমালীর দ্বারা জগৎকে জানিয়েছেন শ্রীভগবান।
ভক্তি করা, স্তুতি করা—এসব আমি কিছুই জানি না। ওহে, ভিক্ষুক বনমালী! কৃপা করে আমার মত জীবাধমাকে বিশুদ্ধ প্রেমধন প্রাপ্ত করান।

——-ভক্তকৃপাভিখারিণী
নম্রানতা
রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here