সেই মিছিলে : শতাব্দী মজুমদার।

0
538

বাবা মায়ের সঙ্গে কলকাতা চলে এসেছিলাম সেই কবে !আমার পড়াশুনা কলকাতাতেই ,তার মানে স্কুলে ভর্তি হওয়ার আগেই মফস্বলের আমাদের সেই বিরাট বাড়ি আর কত লোকজন, সবাইকে ছেড়ে কলকাতা শহরে ভাড়া বাড়িতে থাকতে শুরু করেছিলাম।

আমার কিন্তু আবছা আবছা হলেও এখনো মনে আছে ওই বাড়িতে অনেকগুলো ঘর ,লম্বা একটা বারান্দা ছিল ,বাড়ির সামনে অনেকটা ফাঁকা জায়গা ছিল ,একটা পুকুর আর অনেক গাছপালা ছিল।

আমি সবার কোলে চড়ে ঘুরে বেড়াতাম।দাদু,ঠাকুমা,কাকু ,কাকিমা,পিসি সবাই ছিল আমার।একটা তিন চাকার সাইকেল ছিল ,বেশ মনে আছে।ওটা চড়ে আমি সারা উঠোনময় ঘুরে বেড়াতাম।আমাদের মফস্বলের ওই বাড়িটায় কিন্তু খুব মজা ছিল।

কলকাতার বাড়িতে শুধু আমি মা আর বাবা।বাবা অফিসে বেরিয়ে যেতেন সকালে।আর আমারও মর্নিং স্কুল ছিল।মায়ের সঙ্গে স্কুল যেতাম ফিরতামও মায়ের সঙ্গে।খুব সকালে ঘুম থেকে উঠতাম বলে স্কুল থেকে ফিরেই স্নান করিয়ে খাইয়ে মা আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দিতেন।বিকেলে মা বাড়ির পাশে পার্কে খেলতে নিয়ে যেতেন ।সন্ধ্যেবেলায় স্কুলের হোমটাস্ক করিয়ে খাইয়ে তাড়াতাড়ি ঘুম পাড়িয়ে দিতেন।শৈশব এই ভাবেই কেটেছিল।আরেকটু বড় হতেই পড়াশুনার চাপ বাড়লো।সঙ্গে ছবি আঁকার ক্লাস ,ক্যারাটের ক্লাস,স্কুলের বন্ধুবান্ধব আর টিভিতে কার্টুন দেখতে দেখতে কখন যেন আমার কৈশোরও পেরিয়ে গেল।এম কম শেষ করে প্রাইভেট ব্যাংকে চাকরি পেতেই তড়িঘড়ি ম্যাট্রিমনি সাইটে বিজ্ঞাপন দিয়ে সম্বন্ধ করে বিয়েটাও হয়ে গেল।

আসলে মা বোধহয় আমাকে ছোটবেলা থেকে সবসময় ব্যস্ত রাখতেন, নিজেও যেন আমাকে নিয়ে আরও বেশি ব্যস্ত থাকতেন।কিছু ভুলে থাকতে চাইতেন কি!বা আমাকে ভুলিয়ে রাখতেই হয়তো ব্যস্ততার না না আয়োজন করতেন।

ছুটির দিনগুলোতেও মা বাবা আমি বেরিয়ে পড়তাম।শহরেরই না না জায়গায় দক্ষিণেশ্বর ,কালীঘাট,ভিক্টরিয়া,গড়েরমাঠ,
চিড়িয়াখানা,সিনেমা ,নাটক….।

কিন্তু কখনো আমরা আমাদের সেই মফস্বলের বাড়িতে বেড়াতে যেতাম না।

কেন যেতাম না ,বড় হতে হতে না না প্রশ্ন জাগতো মনে।তবে কি পারিবারিক বিবাদ?কিন্তু পরক্ষণেই মনে হতো আমার মা বাবার সঙ্গে কারুর বিবাদ হতেই পারেনা।পাড়া প্রতিবেশী ,বন্ধুবান্ধব সবার সঙ্গেই তো আমাদের সুন্দর সম্পর্ক।

বাইক চালিয়ে আসতে আসতে আমার এই কথাগুলোই মনে পড়ছিল।

আসলে মাঝে মাঝেই মনে পড়তো।নিজের জন্মস্থান,ছেলেবেলার সেই বাড়ি।আর মনে পড়তো বাড়িতে অনেক লোক এসেছিলো, সবাই কাঁদছিল,সবার কান্না দেখে আমিও কাঁদছিলাম।কাকিমা আমাকে একটা ঘরে নিয়ে এসে অনেক খেলনা দিয়ে ছিলেন।

কাউকে কিছু না বলে তাই আজই বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম আমার সেই গোবরডাঙ্গার বাড়ির উদ্দেশ্যে।

মা বাবা বউ কেউ জানে না।জানলে ওরা তো আমায় আসতেই দিত না।একে বাইক নিয়ে এতোটা রাস্তা ,তার ওপর এই বাড়ির নাম বাড়িতে উচ্চারিতই হতো না।দাদু ,ঠাকুমা ,পিসি ,কাকা সবাই যে কোথায় জানতে চেয়েছিলাম অনেকবার কিন্তু প্রতিবারই আমাকে বলা হতো ,

“ওনারা সবাই ভালো আছেন এবং ওই বাড়িতেই আছেন”।

এর বেশি কিছু আর এ প্রসঙ্গে বলা হতো না,প্রসঙ্গ পাল্টে যেত।আর তাই বোধহয় আমার আগ্রহ বাড়ছিল।কেন এতো গোপনীয়তা ,কিসের জন্য!
……………….

বাড়ির গেটে মাধবীলতা তার ফুল পাতা মেলে আমাকে অভ্যর্থনা জানালো।উঠোনের এক কোনে আমগাছটার নীচে আমার সেই তিন চাকার ছোট্ট সাইকেলটা।সেই চকচকে লাল রং টা ,এখনো দেখে মনে হচ্ছে যেন নতুন কেনা।মায়া হলো ভীষণ দেখে সঙ্গে ভালোলাগাও ,হাত দিয়ে ছুঁয়ে নিলামএকবার।

-দাদুভাই ভিতরে এসো, দাদু ডাকছেন আমায়।

ঠাকুমাও এসে দাঁড়িয়েছেন।
-সেই চার বছর বয়সে চলে গেলি আর এতো দিন পর বাড়ির কথা মনে পড়লো?

আমার ভীষণ লজ্জা লজ্জা করছিল।সত্যিই তো, এতোদিন কেন আসিনি এখানে।আসা তো যেতই এতো বছরে অন্তত একবারও।

কাকিমা সুন্দর একটা প্লেটে লুচি ,
সাদা আলুর তরকারি আর সুজির হালুয়া এনে বললেন ,
-বাবান তুমি যা যা খেতে ভালোবাসতে সব বানিয়েছি আজ নিজের হাতে।
আমি খুব আগ্রহ সহকারে খাবারের প্লেটটি দেখলাম।
-ছোটবেলায় একদম মাছ খেতে চাইতে না এখন খাও কি ?
আমি বললাম,
-তাই নাকি আমি মাছ খেতাম না !আমি তো ভীষণ মাছ ভক্ত।

কাকুর সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে পুকুর পাড়ে গেলাম।চারদিকে বাঁধানো বড় পুকুর।লাল রঙের সিঁড়ি বেয়ে পুকুরের টলটলে জল ছোঁয়ার জন্য নামছিলাম।

-বাবান একদম জলে নামবে না ।উঠে এসো।

কাকুর ধমক খেয়ে উঠে এলাম।কিন্ত্ত কাকু এভাবে বললেন কেন, কিসের এতো ভয় পুকুরের জলে কাকুর?

কাকু আমাকে নিয়ে সোজা বাড়ির ভিতরে চলে এলেন।

বসার ঘরে বাঁধানো ফ্রেমে পিসির বড় একটা ছবি দেখলাম।

দুপুরে কাকিমার হাতে তৈরি তেল কই আর সর্ষে পার্শে খেয়ে খানিকটা ভরসা করেই জিজ্ঞেস করে ফেললাম পিসির কথা ,আচ্ছা কাকিমা পিসি কে দেখছি না তো?কাকিমা বললেন ও বোধহয় আর আসবে না। আসলে ওর জন্যই তো সব শেষ হয়ে গেল।

পিসির জন্য সব শেষ হযে গেল ,একথার মানে আমি ঠিক প্রথমটায় বুঝলাম না।

সেই বিভীষিকাময় ভয়ংকর অতীত এই বাড়ির কথা আমি এবার জানলাম।কে যেন আমায় সব বলে দিল।

পিসি দড়ি কলসি নিয়ে বাড়ির ওই পুকুরের জলেই ডুবে মরেছিল ,প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়ে অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায়।

দাদু দোষারোপ করলেন ঠাকুমাকে ,কেন মেয়ে কে নজরে নজরে রাখা হয়নি।ঠাকুমা গায়ে আগুন দিলেন।পর পর এই দুটো শোক সামলাতে না পেরে দাদু বিষ খেলেন।

কি শুনলাম !আমি যেন নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছি না।আমার প্রিয়জনরা এভাবে একে একে….।

এরপর আরও বাকি আছে।

প্রথম সন্তান জন্মদিতে গিয়ে কাকিমা সন্তান সহ মারা গেলেন।আর কাকু শেষ পর্যন্ত গলায় দড়ি দিয়েছিলেন।

মৃত্যর মিছিল লেগে গিয়েছিল এই বাড়িতে।

পর পর এতো গুলো অপমৃত্যু ঘটে গিয়েছিল এক বছরের মধ্যে।আমাকে নিয়ে তড়িঘড়ি আমার বাবা মা এই বাড়ি ছাড়লেন।
………….

পঁচিশ বছর বয়স পর্যন্ত আমি এসবের কিছুই জানতাম না।আমাকে বোধহয় পারিবারিক কলঙ্কময় অতীত জানাতে মা বাবা কুন্ঠিত বোধ করতেন ।তাদের ভয় ছিল এই বাড়ি মানেই মৃত্যুপুরী ,তাই বোধহয় এর থেকে দূরে থাকাই শ্রেয় কিন্তু পারলাম কই আর দূরে থাকতে ! কোনো এক অমোঘ আকর্ষণে চলে তো এলাম ঠিক এই বাড়িতে।

হ্যাঁ, মাঝে মাঝেই আসতে ইচ্ছে করতো।বিশেষ করে একলা থাকার মুহূর্তগুলিই আমাকে যেন এই বাড়ির কথা করিয়ে দিত। বিশ বছর পেরিয়ে গেলেও সেই সুন্দর রঙিন চলমান কয়েকটি মানুষের দৈনন্দিনতার স্পষ্ট চিত্রই যেন বার বার আমার চোখের সামনে ধরা দিত।

যশোর রোডের ওপরেই এক্সিডেন্ট টা করেছিলাম।

কিভাবে যে অন্যমনষ্ক হয়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছিলাম !উল্টে পড়তেই কোথা থেকে যেন বিশাল একটা ট্রাক এসে পিষে দিয়ে গেল।

স্পট ডেথ হলাম বলেই তো এতো তাড়াতাড়ি আমার শৈশবের স্মৃতি জড়ানো বাড়িতে এসে পৌঁছে সবার সঙ্গে দেখা করতে পারলাম।

অতীতের হাতছানি কে উপেক্ষা করা এতো সহজ নয় তো! মৃত্যুর সেই মিছিলে এবার আমিও সামিল হলাম।
সমাপ্ত