নবদ্বীপ সমাজবাড়ির প্রতিষ্ঠাতাচার্য্য শ্রীল রাধারমণ চরণদাসদেব তখন পুরীতে। পুরীবাসীরা তাঁকে ‘বড়বাবা’ বলে সম্মান দিতেন। ত্রিকালদর্শী ,সিদ্ধ বড়বাবা বুঝলেন যে নবগ্রহ কুপিত হয়েছে। আগামী কয়েকদিনের মধ্যেই পুরীতে ভয়ানক শোচনীয় দশা আসতে চলেছে ,যা শ্রীজগন্নাথের সেবাতেও বিঘ্ন ঘটাবার চেষ্টা করবে। তিনি মঠে নয়দিন ব্যাপী সঙ্কীর্তন উৎসবের সূচনা করলেন।
পুরীর ঝাঁঝপিঠা মঠে তখন একটি তোতা ও একটি ময়না পাখি থাকতো। তোতাটি সর্বক্ষণ “ভজ নিতাইগৌর রাধেশ্যাম, জপ হরেকৃষ্ণ হরেরাম” বলতো। সঙ্কীর্তনের মাঝে বড়বাবা একদিন আদেশ দিলেন , তোতা-ময়নাকে ছেড়ে দিতে। স্নান করিয়ে , প্রসাদ পাইয়ে তাঁদেরকে ছেড়ে দেওয়া হল। অথচ, কী আশ্চর্য্য , পাখিদের যা স্বভাবসিদ্ধ নিয়ম , যে , ছাড়া পেলে উড়ে যায় , তারা কিন্তু তা করলো না। উপরন্তু , মন্দিরের গর্ভগৃহের মধ্যে শ্রীশ্রীরাধাকান্ত বিগ্রহের চরণপ্রান্তে উড়ে এসে বসলো দুজনাই । সকলে অবাক হয়ে দেখলেন, মধ্যাহ্নকালে ভোগের সময় তোতা বেড়িয়ে এসে আসর পরিক্রমা করতে থাকল। তারপর একসময় তোতা তুলসী মঞ্চের ওপর এসে বসল। কীর্তন চলছে , আর ওদিকে তোতাও “ভজ নিতাইগৌর রাধেশ্যাম, জপ হরেকৃষ্ণ হরেরাম” বলে চলেছে অবিরাম।বড়বাবা নিজের বাম হাতখানি দিয়ে পরম স্নেহে তোতার গায়ে হাত বোলাতে থাকলেন। আর , ধীরে ধীরে তোতা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লো।
সকলে তোতার সৌভাগ্যের ব্যাপারে আলোচনা করতে থাকলেন এই বলে যে , একটা পাখি হয়েও কীর্তন করে ,পরিক্রমা করে , বাবার হাতের স্পর্শ পেয়ে প্রাণত্যাগ করলো ! উদ্ধার হয়ে গেল! কত তার নাম-প্রচেষ্টা! অথচ, আমরা মানুষরা নাম করি না । বড়বাবা শুধু এটুকু বললেন, “এ তোতা পূর্বজন্মে একজন বড় সাধক ছিল”। হঠাৎ , একটি আজব ব্যাপার ঘটলো। বড়বাবা তোতার মৃত শরীরটি তুলে নিলেন আর নিজের বুকের মধ্যে জাপটে ধরে নৃত্য করতে থাকলেন ।
উপস্থিত ভক্তরা সকলে বিস্মিত ,বাবার কান্ড দেখে। তবে, কেউ আর কিছু বলতে সাহস পেলেন না। একসময় বাবা কীর্তনের আসর ছেড়ে উঠে গিয়ে নিজের ঘরে চলে গেলেন। তিনি তোতার মৃত শরীরটি বুকের ওপর রেখে শুয়ে পড়লেন। অনেক পরে তিনি এলেন আসরে। তখনও তাঁর বুকের ওপর সেই মৃত তোতার দেহখানি যত্ন করে ধরা। তিনি সেভাবেই নৃত্য-কীর্তন করতে থাকলেন। রাত্রিবেলা নিজের বুকের ওপর তোতার দেহ রেখে শুয়েও পড়লেন। তোতার মৃত্যু এত ভালো ভাবে হয়েছে , ওকে তো এবার তাহলে সুন্দর করে সমাধি দিতে লাগে। কিন্তু , বাবা তোতাকে সমাধি দেবার কথা না ভেবে কেন যে এমন আচরণ করছেন , কেউ তা বুঝতে পারছেন না; আবার ভাবে বিভোর বাবাকে কেউ তা জিজ্ঞাসাও করতে পারছেন না। অথচ সকলের মনেই তীব্র উৎকন্ঠা।
দিনরাত্রি ব্যাপী অখন্ড নাম চলে চলেছে মঠে। নয় দিনের সংকল্পে নামযজ্ঞ শুরু হয়েছে । অপূর্ব অনুভূতি , অদ্ভুত আবেশ সেখানে। সকালের আলো ফুটে গেছে , তাও বড়বাবা আজ শয়ণে রয়েছেন । তবে তাঁর বুকের ওপর রাখা মৃত তোতাটি আর নেই। সকলেই উৎসুক জানতে, তোতার কী হল! বেশ সাহস করেই ভক্তেরা বললেন, “বাবা, তোতাকে দেখছি না। আপনার ঘরেও তো নেই তার দেহ । কোথায় গেল?”
বড়বাবা বললেন, “তোতা তার শরীর নিয়ে রাধাকৃষ্ণের নিত্যলীলায় প্রবেশ করেছে।” ভক্তরা অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে। এও আবার হয় নাকি যে শরীর নিয়ে গেছে ! অন্তর্য্যামী বাবা ভক্তদের মনের ভাব বুঝলেন । তিনি বললেন, “কেন, সশরীরে স্বর্গে যাওয়ার কথা তো তোমরা শুনেছ , তবে কেন সশরীরে রাধাকৃষ্ণের নিত্যলীলায় প্রবেশ করতে পারবে না?”
তখন ললিতা সখীমা বললেন, “কিন্তু, তোতা তো গতকাল মধ্যাহ্নেই দেহ ছেড়ে দিয়েছে। তবে কী ভাবে আবার শরীর নিয়ে যাবে ?”
বড়বাবা–“হ্যাঁ, যথার্থ প্রশ্নই করেছো। তোতা তার শরীর ত্যাগ করলেও , সূক্ষ্মদেহে এখানেই ছিল আসরে, কীর্তনে মেতে। তার আত্মা এই দেহে আবার প্রবেশ করে । প্রাণ পায় সে। তারপর একসময় শরীর সমেত অন্তর্ধান করে । যুগলকিশোরের নিত্যলীলায় স্থান পায় ।”
নামের প্রতি তোতার কী ভীষণ অনুরাগ , নিষ্ঠা ছিল তা ভেবে তখন সকলে অশ্রুবিহ্বল । পক্ষীকূলে জন্ম নিয়েও নামের গুণে নিত্যলীলায় প্রবেশ করলো সে, যা অভাবনীয়, অচিন্ত্য । তার প্রতি বড়বাবার কৃপাও কত সুমহান ! তিনিই তো তবে তার প্রাণ ফিরিয়ে এনেছিলেন নামের গুণে !
আহা, নাম, শ্রীনাম—- তোমার কী অদ্ভুত ক্ষমতা! বিশ্বাস, ভালোবাসা, আর নিষ্ঠা নিয়ে নিত্য নাম নিলে কত না অসাধ্যই সাধিত হতে পারে আপনা থেকে !
——- নম্রানতা
রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক।