বিক্রি নেই : উজ্জ্বল সামন্ত।

0
543

(১)
বাচ্চাটির ফুলের মতো নিষ্পাপ মুখ দেখে মায়ের দুঃখের অন্ত নেই।যত দিন অতিবাহিত হয় যন্ত্রনা দুঃখ ক্রমশ বাড়তেই থাকে। মোহিনী দেবীও মেয়েকে জীবনের থেকেও বেশি ভালোবাসেন। এদিকে পাখির আবদার দিন দিন বেড়েই চলেছে। পাখির তখন ৩ বছর। ও অনেক উঁচু থেকে নীচে পড়ে যায়। প্রাণে বেঁচে গেলেও অপারেশনে একটি অঙ্গ বাদ যায়। ৫ বছরের জন্মদিন আগত। পাখি জন্মদিনের আগে মলে যাবে, চিড়িয়াখানায় যাবে ঘুরতে এই ইচ্ছা । স্কুলে খুব একটা যায় না, ঘরের মধ্যেও দিন কাটে। ঘরে থেকে থেকে ও টিভির প্রতি আসক্ত ,কার্টুন দেখতে খুব ভালোবাসে পাখি।

ওর মা বলে ডেকে বলে , পাখি! জন্মদিনে কি নেবে ?
পাখি: মা, যে জিনিস কোনদিন দাওনি সেটা কি কিনে দেবে?

হুইল চেয়ারে বসে বসে পাখি ক্লান্ত। মেয়ের এ হেন আবদারে মোহিনী দেবী চমকে ওঠেন।

মোহিনী: কি চাই তোর , বল , পাপা বা আমি এনে দেব।

পাখি: না, মা। আমি নিজে যাব। তুমি কি আমাকে নিয়ে যাবে?
মোহিনী: এখন আমি বলতে পারছি না ।তোমার বাবাকে জিজ্ঞেস করব, উনি রাজি হলে তারপর দেখা যাবে।

(২)
মোহিনীর পূর্বের ঘটনার কথা মনে পড়ে। পাখি আগের জন্মাবার আগেই ওর বাবা কত শখ করে ওর জামা কাপড় , দোলনা , খেলনা কিনে এনেছিলেন। পাখির জন্ম হলো। ‌ কিন্তু তিন বছরের মাথায় অ্যাকসিডেন্ট। ওর একটি পা কেটে বাদ দেওয়া হয়। কৃত্রিম পা লাগানো যায়নি। ডাক্তার জানিয়েছে সময় লাগবে। সেই থেকে হুইল চেয়ার ই ওর সঙ্গী।
স্বপন বাবু বাড়ি ফিরে স্ত্রীর কাছে মেয়ের আবদারের কথা শোনেন। পাখি তার নয়নের মনি।
তাই অগত্যা ছুটির দিনে গাড়ি ভাড়া করে পাখিকে ও মোহিনী কে নিয়ে বের হন।

চিড়িয়াখানায় নিয়ে যান। পাখি খুব খুশি । বন্যপ্রাণী তাদের কে এতদিন পড়ার বইয়ের ছবিতে ও টিভিতে দেখেছে তাদের সামনাসামনি দেখে আনন্দে আত্মহারা ।
স্বপন: কেমন লাগছে মা ,পাখি?

মোহিনী: পাখির মুখের চওয়া হাসিটা দেখেও বুঝতে পারছো না!

স্বপন : পাখি খুব খুশি হয়েছে মনে হচ্ছে। চলো অনেকক্ষণ চিড়িয়াখানায় আছি। তুমি কি কিনবো বলছিলে পাখি?
পাখি: এখন বলা যাবে না। নিজে গিয়ে পছন্দ করে কিনব।
স্বপন বাবু আশ্চর্য হয়ে পড়েন মেয়ের কথা শুনে। যাইহোক মেয়েকে নিয়ে আবার গাড়িতে করে বেরিয়ে পড়েন সঙ্গে মোহিনী। ওকে শপিংমলে নিয়ে যান। জামা, কাপড় , কেক জন্মদিনের সামগ্রী কেনাকাটা করেন। বাবা জিজ্ঞেস করে আর কি নেবে পাখি?
পাখি বলে রাস্তায় দেখতে পেলে বলবো।

(৩)

কিছুক্ষণ পর গাড়ি থামাতে বলে পাখি। গাড়ি থামে। রাস্তার বেরিয়ে আসেন মোহিনী ও স্বপন, পাখি হুইল চেয়ারে। পাখি আঙ্গুল দেখিয়ে বলে ওইখানে যাব। দোকানের সামনে পৌঁছে দেখা যায় একটি বড় জুতোর দোকান। বাইরে বিভিন্ন ধরনের জুতো সাজিয়ে রাখা আছে বিশেষত বাচ্চাদের। কাঁচের বাইরে থেকে দেখা যাচ্ছে। ব্যাস পাখির মুখে বিদ্যুতের ঝিলিক এর মত হাসি। পাখির বাবা ও মায়ের বুকটা ছ্যাত করে ওঠে। দুজন দুজনের দিকে তাকাতাকি করে কিছু বলতে চায়। চোখের ইশারায় যেন কিছু অস্পষ্ট কথা হয়।

(৪)
শোরুমে জুতোর সারি । রিভলভিং লোকেশন এ কাচের ভিতর একটি জুতো আলাদা করে রাখা আছে। নবজাতকের জুতো। পাখির ওই জুতোটি বেশ পছন্দ। ও বায়না করতে থাকে ।জুতোর নিচের ট্যাগে লেখা: #বাচ্চার জুতোটি বিক্রির জন্য নয়”।
পাখির বাবা লেখাটির লক্ষ্য করে বলে মা তুমি অন্য জুতো পছন্দ করো। সেলসম্যান কে ডাকলে সে জানায় সূত্রটি বিক্রির জন্য নয়। পাখি নারাজ। অগত্যা দোকানের ম্যানেজারের শরণাপন্ন হয়। ম্যানেজার বলেন ওই জুতো টি বিক্রির জন্য নয়। কিন্তু কেন? প্রশ্ন করে স্বপন বাবু।
ম্যাডামের সঙ্গে কথা বলতে হবে। ম্যাডাম উপর তলায় আছেন।
ম্যাডামের কাছে গিয়ে স্বপন বাবু তার মেয়ের আবদারের কথা বলেন।
ম্যাডাম বলেন জুতোটি বিক্রির জন্য নয় ওটার সঙ্গে আমার স্মৃতি জড়িয়ে আছে।
ম্যাডাম: আমি যখন সন্তান সম্ভবা ছিলাম আমার ভাবী সন্তানের জন্য পোশাক ,খেলনা, দোলনা ও ওই জুতোটি
পছন্দ করে রেখেছিলাম । কিন্তু সন্তান জন্ম বার আগে একটা একসিডেন্ট ঘটে যায়। আমার গর্ভস্থ সন্তান পৃথিবীর আলো দেখেনি। ওর নামে কেনা সবকিছু এখনো গচ্ছিত আছে সযত্নে আমার কাছে। তাই জুতোটি বিক্রি সম্ভব নয়।

(৫)
স্বপন জানেন পাখি একগুঁয়ে জেদি। ম্যাডাম আপনি দয়া করে একবার নিচে আসুন আমার মেয়েকে যদি বুঝিয়ে বলেন।
অগত্যা ম্যাডাম নিচে এসে দেখেন হুইলচেয়ার একটি ফুটফুটে সুন্দর বাচ্চা মেয়ে বসে রয়েছে।
ওকে দেখেই যেন ম্যাডাম ভিড়বেন এইটুকু একটা মেয়ে হাঁটতে চলতে পারে না। অথচ এই জুতা কিনবে, কেন?
জিজ্ঞেস করেন তুমি এই জুতোটা কিনবে কেন?
পাখি: কাল আমার জন্মদিন। ওই জুতোটাই নেব আমার মেয়ের জন্য।
ম্যাডাম: তোমার মেয়ে?
পাখি: আমার ডল (খুশি)।
ম্যাডাম: পাখির মাথায় হাত স্নেহের পরশ ছুঁয়ে ম্যানেজারকে ডাকেন।
ম্যানেজার এলে ম্যাডাম বলেন: এই জুতোটা প্যাক করে দিন কিন্তু কোন টাকা নেবেন না ।
জুতোটা ওর জন্মদিনে আমার তরফ থেকে গিফট রইল স্বপন বাবু।
ম্যাডামের চোখের কোন ভেজে।
পাখি জুতোটি নিয়ে হাসতে হাসতে বাড়ি ফেরে…