মহিলা ঢাকির ঝাঁঝ (ধারাবাহিক উপন্যাস; অন্তিম পর্ব) : দিলীপ রায় (+৯১ ৯৪৩৩৪৬২৮৫৪)।

0
654

তারপর খেমটি খোঁজ নিয়ে জানলো, জেলা শাসক জরুরি কাজের চাপে বহরমপুরে নিজের অফিসে রয়েছেন ।
সময় নষ্ট না করে খেমটি বায়েন পাড়ার কয়েকজন মহিলাকে নিয়ে সোজা বহরমপুর জেলা শাসকের অফিস । খেমটির কাঁধে ঢাক । তারা একদল বায়েন পাড়ার মহিলা জেলা শাসকের অফিসের সম্মুখে তাদের দাবী জানানোর জন্য বসে পড়লো । খেমটি কিছুক্ষণ ঢাক বাজালো যাতে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যায় । তখন বিকেল চারটে । তাদের সরাতে অফিস আধিকারিকেরা চেষ্টা করলেন । কিন্তু খেমটির দাবী, জেলা শাসক মহাশয়কে নিজে এসে তাদের কথা শুনতে হবে । তেজি ভাষায় খেমটির বক্তব্য, অসহায় মানুষের পাশে যতোক্ষণ জেলা প্রশাসন না দাঁড়াচ্ছেন, ততোক্ষণ তারা উঠবে না ।
প্রায় ঘন্টা খানেক তারা বসা । কিন্তু জেলা শাসক মহাশয় দেখা করলেন না । সেই সময় খেমটি শুরু করলো ঢাক বাজানো । অফিসে ছুটির সময় । একেই পূজোর পরে অফিসে স্টাফ কম । তবুও যাঁরা অফিসে রয়েছেন তাঁরা ঢাকের বাজনায় অতীষ্ট ।
খেমটি ক্ষুধায় তৃষ্ণায় পরিশ্রান্ত । মানসিক কষ্টে বিষন্ন । তার মধ্যেও মার্জিতভাবে ঢাক বাজাচ্ছে । ঢাকের শব্দে দো-তলার অফিস ঘরে কান পাতা দায় ! খেমটির ঢাক বাজনার তালে তালে অন্যান্য মহিলারা হাততালি দিচ্ছে । প্রত্যেক মহিলার বুকে সাদা কাগজ সাটা, তাতে লেখা “আমাদের বাঁচান ।“ খেমটির বুকে ও পিঠে প্লাকার্ড । সেখানেও একই কথা লেখা, “আমাদের বাঁচান ।“ বিল্ডিংয়ের সমস্ত ফ্লোরে খবর চাউর হয়ে গেল, একটা বায়েনদের মেয়ে ঢাক বাজিয়ে জেলা প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইছে । কয়েকজন আধিকারিক এসে কিযেনো বলতে চাইছিলেন, কিন্তু ঢাকের বাদ্যের জন্য সেকথা শোনা যায়নি । দেখা গেলো কিছুক্ষণ পর জেলার পুলিশ সুপারিন্টেন্ডেন্ট জেলা শাসকের ঘরে ঢুকলেন ।
খেমটির ঢাক বাজছে অনবরত । হঠাৎ পুলিশ সুপারিন্টেন্ডেন্ট খেমটিকে বললেন, ঢাক বাজনা বন্ধ করতে এবং সেখান থেকে চলে যেতে ।
খেমটি হাত জোড় করে এস-পি সাহেবকে বললো, “স্যার নিরুপায় হয়ে আমরা জেলা শাসকের দ্বারস্থ হয়েছি । প্লীজ ডি-এম স্যারকে আমাদের কথা একটু শুনতে বলুন । তারপর আমরা চলে যাবো” ।
এস-পি সাহেব ও খেমটির মধ্যে কথাবার্তার সময় পাড়ার অন্যান্য মহিলারা দো-তলার মেঝেতে শুয়ে পড়লো । মুখে তাদের একটাই দাবী, “আমাদের বাঁচতে দিন । আমাদের বাঁচান ।“
ইতিমধ্যে প্রেস, মিডিয়ায় খবর চারিদিকে চাউর হয়ে গেলো । টিভিতে লাইভ টেলিকাস্ট হচ্ছে, খেমটি উদ্দাম ঢাক বাজাচ্ছে এবং অন্যদিকে গাঁয়ের মহিলারা মেঝেতে শুয়ে পড়েছে । বিভিন্ন চ্যানেলের লাইভ টেলিকাস্ট দেখে প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তিরা নড়েচড়ে বসলেন ।
এস-পি সাহেব পুনরায় ডি-এম সাহেবের ঘরে ঢুকলেন । আর বের হচ্ছেন না । খেমটির ঢাকের বাদ্য বেজেই যাচ্ছে । খেমটির শরীর আর ধকল নিতে পারছে না । টানা কয়েকদিন পূজোর বাজনা তার উপর তাকে অপহরণ । সারাদিন না খাওয়া । বাবার মৃত্যু’র জন্য মানসিক বিমর্ষতা । খোলা আকাশের নীচে ত্রিপলের ভিতর মায়ের কান্না । সব মিলিয়ে খেমটির শরীরের অবস্থা টালমাটাল । ঢাক বাজানোর মধ্যে শারীরিক ভারসাম্যে বজায় রাখাটাই কষ্ট । তখন সন্ধ্যা সাড়ে ছ’টা । প্রিন্ট মিডিয়ার সাংবাদিকেরাও এসে হাজির । দূরদর্শনে লাইভ টেলিকাস্ট হওয়ায় সমস্ত প্রশাসনিক দপ্তরগুলিতে খবর রটে গেলো । খেমটির অভিনব কায়দায় ঢাক বাজিয়ে প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করার প্রচেষ্টা আলাদা মাত্রা পেলো । জেলা শাসকের দপ্তরের আধিকারিকেরা নড়েচড়ে বসলেন ।
অন্যদিকে কুহক ও অনল কম করে ষাট জন গ্রামবাসীকে সঙ্গে নিয়ে জেলা শাসকের দপ্তরে উপস্থিত । তারাও খেমটিদের সাথে তেজি গলায় শ্লোগান দিতে থাকলো, “আমাদের বাঁচান” ?
গাঁয়ের মানুষের হল্লার কারণে বিরাট পুলিশ বাহিনী খেমটিদের দলকে পুলিশি বেষ্টনী করে রাখলো । কিন্তু গ্রামবাসীরা আজ ভয়ডরহীন । তারাও মরিয়া । গাঁয়ে তাদের নিরাপত্তা এখন প্রশ্ন চিহ্নের মধ্যে ? বিনা অপরাধে একদল অসাধু দুস্কৃতিদের অভব্যতার জন্য সহজ সরল বায়েন সম্প্রদায়ের মানুষদের খোলা আকাশের নীচে পথে বসার জোগাড় । এভাবে বায়েন জাতি আর কতোদিন সমাজে অমর্যাদার শিকার হবে ? কতো সাহস, উৎখাত করার জন্য বাড়ি ঘর আগুনে জ্বালিয়ে দেওয়া ! এরকম জঘন্য ও ন্যক্কারজনক কাজের জন্য দোষীরা উপযুক্ত শাস্তি পাক্‌ । নতুবা ভবিষ্যতে এরকম অঘটন আরও ঘটতে বাধ্য ।
খেমটির শরীর টলোমলো । আর ঢাক বাজাতে পারছে না । কষ্টে ক্লান্তিতে সে অবসন্ন । ভাল মতো চোখ মেলে তাকাতে পারছে না । শরীরের ভারসাম্য খেমটি আর ধরে রাখতে পারছে না । ঠিক সাতটা নাগাদ ঢাক সমেত খেমটি মাথা ঘুরে মেঝেতে পড়ে গেল । পুলিশদের মধ্যে তখন হুটোপাটি, “মেয়েটাকে বাঁচান” ! অনল ও কুহক ছুটে খেমটির কাছে গিয়ে দেখে তার কপালে রক্ত ।
বিভিন্ন সংবাদ চ্যানেলের ক্যামেরায় সমস্ত ঘটনা রেকর্ড হয়ে রইলো ।
শেষ পর্যন্ত জেলা শাসক মহাশয় ঘটনাস্থলে এলেন । এসেই প্রথমে ডাক্তার বাবুকে ডেকে পাঠালেন । খেমটি সুস্থ হওয়ার পর খেমটিদের মাঝখানে স্যার বসলেন । খেমটিদের দুঃখজনক দুরাবস্থা ও অসহায়তার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনলেন । বিশেষ করে খেমটির করুণ দুর্ভাগ্যজনক কাহিনী শুনে তিনি স্পষ্টতই মুষড়ে পড়লেন । নিন্দনীয় ও ন্যক্কারজনক ঘটনা শুনে ডাকসাইটে জেলা শাসকেরও কথা বলার ভাষা কিছুক্ষণের জন্য রুদ্ধ হয়ে গেলো । ডি-এম স্যার সব কথা শোনার পর কথা দিলেন, পরেরদিন আগুনে পুড়ে ছারখার হয়ে যাওয়া বাড়ির স্পটে তিনি নিজে যাবেন । সরেজমিনে তদন্ত করবেন ।
শারীরিকভাবে নাজেহাল খেমটি । তা সত্বেও ডি-এম সাহেবের পা চেপে ধরে বললো, “স্যার আপনি মানুষ নন, ভগবান” । তখনও খেমটি অঝোরে কেঁদে যাচ্ছে ।
স্যার খেমটির দিকে তাকিয়ে বললেন, “আপনি কান্না থামান । এবার সকলকে নিয়ে প্লীজ বাড়ি ফিরে যান । আমি বুঝতে পারছি, বাড়িতে আপনার এখন অনেক কাজ” !
জেলা শাসক স্যার উঠে অফিস ঘরে ঢুকলেন ।
এস-পি সাহেব সকলকে অনুরোধ করে বললেন, “আপনাদের জন্য অল্প বিস্তর জলযোগের ব্যবস্থা করা হয়েছে । একটু মুখে দিয়ে বাড়ি ফিরবেন” ।
তারপর অনেক রাত্রিতে বাড়ি ফিরলো খেমটি ও অন্যান্য সকল গ্রামবাসী । খেয়া নৌকা পার হওয়ার সময় তারা জানতে পারলো ঘোড়াডাঙা গাঁয়ে প্রচুর সংখ্যায় পুলিশ । পুলিশ সারা গ্রাম টহল দিচ্ছে । তিনটে পুলিশ ভ্যান স্কুল মাঠে দাঁড় করানো । আরও কয়েক গাড়ি পুলিশ নাকি আসার সম্ভাবনা । পুলিশের কাছে খবর আছে, আন্তর্জাতিক খ্যাতনামা নারীপাচারকারি ঘোড়াডাঙা গাঁয়ে ঘাটি গেড়েছে । ঐ নারীপাচারকারি দলকে তাঁরা ধরতে মরিয়া । এটা নাকি উপর মহলের নির্দেশ ।
খেমটি বুঝতে পারলো, জেলা শাসকের অফিসে ঢাক বাজানো সার্থক হয়েছে । যার জন্য প্রশাসনিক মহলে টনক নড়েছে ।
তারপর কুহক, অনল ও খেমটি তিনজনে খোলা আকাশের নীচে বায়েন পাড়ায় ত্রিপল টাঙানো ঘরে গিয়ে উঠলো । অনল খেমটিকে আস্বস্ত করে বললো, যতোদিন তার বাবার পারলৌকিক ক্রিয়াকলাপ শেষ না হচ্ছে, ততোদিন সে ঘোড়াডাঙায় তাদের সঙ্গে থাকবে । আর তাছাড়া ……।
“আর তাছাড়া কী অনল” ? খেমটি জানতে চাইলো ।
“আর তাছাড়া দুস্কৃতিদের না ধরা পর্যন্ত তার শান্তি নেই । অনলের ধারণা যদিও আগে ব্যক্ত করেছে তবুও আবার বললো, দুটো নাশকতাই একই জায়গা থেকে সংঘটিত হয়েছে । ঐ ষন্ডামার্কা গুন্ডাগুলি নৌকা থেকে ঝাঁপ দিয়ে না পালালে, কিছুটা হদিস সে পেতো” । সঙ্গে সঙ্গে অনল আরও বললো, “এবার পুলিশ বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে চিরুনি তল্লাশির অভিযান চালাচ্ছে । সুতরাং দোষী ধরা পড়তে বাধ্য । সে জানে, পুলিশ সক্রিয় হলে দুস্কৃতিদের হদিস করা অনায়াসে সম্ভব । দুস্কৃতিদের ধরার ব্যাপারে পুলিশের উপর তার আস্থা ষোলোআনা” ।
“খেমটি ম্যাডাম কী ঘরে রয়েছেন” ? রাস্তায় দাঁড়িয়ে থানার বড় বাবু হাঁক দিলেন ।
কে ডাকছেন ?
আমি থানার বড় বাবু, ম্যাডাম ।
ত্রিপলের ভিতর থেকে আলুথালু বেশে বেরিয়ে থানার বড় বাবুকে নমস্কার দিয়ে বললো, “আসুন বড় বাবু” । তারপর খেমটির আবার কান্না !
কাঁদছেন কেন ম্যাডাম ?
আপনাকে বসতে দেবো এমন একটি চেয়ার বা জলচৌকি ঘরে অক্ষত নেই । সব আগুনে পুড়ে ছারখার ।
“আপনি অযথা উতলা হবেন না । আপনি বরং আপনার সদ্য প্রয়াত বাবার পারলৌকিক কাজে মনোযোগ দিন । তবে আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি, “আগুন লাগানোর মূল পান্ডা এবং আপনাকে অপহরণ করার মূল দুস্কৃতিকে আজ রাত্রেই ধরে ফেলবো” । থানার বড় বাবু জোর দিয়ে কথাগুলি বললেন ।
এতটা জোর দিচ্ছেন কেন স্যার । আপনারা কী দলের পান্ডার হদিস পেয়েছেন ?
তদন্তের স্বার্থে বেশী কিছু বলা সম্ভব না । তবে রাত্রিতেই ধরার আমাদের মরিয়া প্রয়াস অব্যাহত থাকবে । প্রায় শতাধিক পুলিশ গ্রামটিকে ঘিরে জোরকদমে তল্লাশি চালাচ্ছে । আপনি এবার বিশ্রাম নিন । আমরা অন্যত্র যাচ্ছি ।
নমস্কার স্যার । কোনো ইতিবাচক খবর থাকলে অবশ্যই জানাবেন ।
অবশ্যই ম্যাডাম ।
রাত্রিতে অনল বায়েন পাড়ায় তার বন্ধু দিগম্বরের বাড়ি গিয়ে উঠলো । কুহক নিজের বাড়ি ফিরলো । বাড়িতে কুহকের মা একা । তিনি চুপচাপ বসে রয়েছেন । কুহককে দেখামাত্র তার মা বললেন, “খেমটি এখন কেমন আছে বাবা” ?
খেমটি এখন অনেকটাই ভাল ।
তার বাবার পারলৌকিক কাজের জন্য তুই কিন্তু খেমটিকে কিছু টাকা দিস্‌ । খেমটিকে দেওয়ার জন্য আলাদা করে কিছু টাকা গুছিয়ে রেখেছি ।
সত্যিই তোমার তুলনা হয় না মা । তুমি হচ্ছো আমার কাছে শ্রেষ্ট মা । ওর বিপদের মুহূর্তে তুমি গিয়ে যেভাবে খেমটিকে সান্ত্বনা দিয়েছিলে, সেকথা সে আমাকে গর্বের সঙ্গে বলেছে ।
কুহকের মা সঙ্গে সঙ্গে বললেন, কী বলিস কুহক ! এইটুকু মেয়েকে অপহরণ ! ভাবতে পারছিস বাবা আমরা কোন্‌ দেশে বাস করছি । মেয়েদের নিরাপত্তা বলে কিচ্ছু নেই । একটি অজ পাড়া গাঁ থেকে তাকে তুলে পালাবার চেষ্টা । এই মুহূর্তে অপরাধীদের ধরতে না পারলে গাঁয়ের মেয়েদের নিরাপত্তার দিক দিয়ে ভবিষ্যৎ অন্ধকার । যদিও খেমটিকে ছাড়াও অন্যান্য মেয়েদের আমি প্রায়শই পরামর্শ দিই, “নিজের নিরাপত্তার দায়িত্ব প্রথমে নিজের স্কন্ধে । তার জন্য প্রয়োজন হলে ক্যারাটের প্রশিক্ষণ আব্যশক । “আত্মবিশ্বাস” বাড়ানো নিজেকে বাঁচানোর রসদ” ।
কিন্তু মা, খেমটিকে দুবৃত্তরা ঘুমন্ত অবস্থায় তুলে নিয়ে গিয়েছিলো । মুখে রাসায়নিক কিছু প্রয়োগ করে তাকে অজ্ঞান করেছিলো প্রথমে, তারপরে শোওয়া থেকে তুলে নদী দিয়ে পালাবার প্রচেষ্টা ।
ভাগ্যিস অনল ছেলেটা সময় মতো স্পটে পৌঁছেছিলো । নতুবা অস্ত্র সম্ভারে সজ্জিত দুর্বৃত্তদের মুখোমুখি সম্মুখীন হওয়া কারও সাহসে কুলাতো না । অনল দুর্বৃত্তদের তোয়াক্কা না করে যেভাবে খেমটিকে উদ্ধার করলো, সেটা এক কথায় দুঃসাহসিক কাজ ! এমন পরোপকারী ছেলে এজগতে দুর্লভ ।
হঠাৎ কুহক মাকে জিজ্ঞাসা করলো। “বাবা কোথায় গেছেন । বাবাকে দেখছি না কেন ?”
তোর বাবা নবমীর রাত্রিতে বীরভূমের দুবরাজপুর পিসির বাড়িতে পূজা কাটাতে গেছেন ।
কবে ফিরবে ?
কিচ্ছু বলে যায়নি বাবা ।
পরে বাবা কী আর ফোন করেছিলো ?
তোর বাবা একবারের জন্যেও ফোন করেননি । তবুও আমি চেষ্টা করেছিলাম তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করতে । কিন্তু তাঁর ফোনে সুইচ অফ্‌ । সম্ভবত ফোনে চার্জ নেই ।
তারপর আবার তিনি কুহককে বললেন, “তুই সাবান দিয়ে ভালভাবে হাত ধুয়ে আয় । তোর খাবার দিচ্ছি” ।
কী রান্না করেছো মা ?
তোর প্রিয় খিচুড়ি রেঁধেছি ।
একটু হেসে কুহক তার মাকে বললো, “আমি এক্ষুণি হাত ধুয়ে খেতে বসছি” । তারপর আবার মায়ের দিকে তাকিয়ে কুহক কৌতুহলবশত মাকে জিজ্ঞাসা করলো, “বাবা তো কোনোকালে খুড়তুতো পিসির বাড়ি দুবরাজপুরে যান না । এবার হঠাৎ কেন গেলেন ” ?
তোর বাবা যেটা বলেছিলেন, “তোর পিসি নাকি ফোন করেছিলেন । তাই তাঁর হঠাৎ দুবরাজপুরে যাওয়া” ।
পুনরায় কুহকের মা তাগাদা দিয়ে বললেন, “তুই শিগগির হাত-মুখ ধুয়ে আয় বাবা । রাত অনেক হয়েছে । এখন না খেলে খিচুড়ি ঠান্ডা হয়ে যাবে” ।
তবে খিচুড়ির সাথে ডাবল ডিমের ওম্‌লেট চাই ?
যথা আজ্ঞা ! এবার দয়া করে বাথ রুমে ঢুকে ফ্রেস হয়ে এসো ।
তারপর মা-বেটা দুজনে রাতের খাবার খিচুড়ি খেয়ে টি-ভি খুলে বসলো । টিভি’র খবরে দেখাচ্ছে, “ঘোড়াডাঙায় নারীপাচারকারিদের দল ধরার জন্য প্রচুর পুলিশের মোতায়েন । পুলিশি অভিযান ! পুলিশি অভিযানের নেতৃত্বে থানার বড় বাবু স্বয়ং” । টিভির খবর দেখে কুহকের মা অবাক ! নিশ্চয় খেমটির জন্য এই পুলিশি অভিযান ! অপরাধীদের ধরার পুলিশি তৎপরতা ! তিনি কুহকের দিকে তাকিয়ে বললেন, “এবার যদি খেমটিকে অপহরণ করার আসল দুর্বৃত্ত ধরা পড়ে । আমি চাই, এই জঘন্য কান্ডের অপরাধী ধরা পড়ুক এবং উপযুক্ত শাস্তি পাক্‌” ।
মা-বেটা কথা বলতে বলতে অনেক রাত হওয়ায় টিভি বন্ধ করে দুঘরে দুজনে শুয়ে পড়লো । কুহক সারাদিনের ধকলে বড্ড ক্লান্ত । তাই নিমেষেই ঘুমিয়ে পড়লো । আর কুহকের মা শুয়ে শুয়ে সাতপাঁচ ভাবতে থাকলেন । সহজে তাঁর ঘুম আসছে না । ছেলের ঘরে ঢুকে দেখলেন কুহক ঘুমিয়ে পড়েছে, কিন্তু মশারিটা টাঙায়নি । তাই তিনি ছেলের মশারিটা টাঙিয়ে দিয়ে তার গায়ে বিছানার চাদর জড়িয়ে দিলেন । পূজো শেষ । তাই শেষ রাত্রির দিকে খানিকটা ঠান্ডার আমেজ । তারপর আবার তিনি বিছানায় শুয়ে ঘুমোবার চেষ্টা করলেন । কিন্তু ঘুরেফিরে সেই ছেলেকে নিয়ে তাঁর মাথায় নানান চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে, “ শান্তশিষ্ট কী সুন্দর তাঁর ছেলে, কুহক ! তার একটাই অপরাধ, সে একটা নীচু জাতের মেয়েকে ভালবাসে । এজন্য কুহকের বাবা কুহককে যাচ্ছেতাইভাবে অপমান করেন । গালিগালাজ করেন । অথচ কুহক বাবার উপর দিয়ে একটাও টু-শব্দ করে না । বরং নীরব থাকে । তাছাড়া কুহকের দৃঢ় বিশ্বাস, কিছুদিন পরে তার বাবা নিজের ভুল বুঝতে পারবেন এবং খেমটির সাথে তার ভালবাসার মর্যাদা দেবেন” ।
হঠাৎ সদর দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ !
চমকে গেলেন কুহকের মা ! গভীর রাত্রিতে কারা তাঁদের বাড়িতে ঢুকতে চাইছে ? তিনি ভাবছেন, অনেকদিন ঘোড়াডাঙা গাঁয়ে চোরের উৎপাত শোনেন নি । তাহলে কী দুস্কৃতীদের কুমতলব ? খেমটিকে ভালবাসার জন্য তাঁর ছেলেকে মারার অপচেষ্টা । তাঁর ছেলেকে শায়েস্তা করার ধান্দা ! কুহকের মা রীতিমতো আতঙ্কিত ! ভয়ে, আতঙ্কে তাঁর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম ।
পুনরায় কড়া নাড়ার শব্দ !
ভয়ে ভীতিতে তাঁর মুখখানা শুকিয়ে কাঠ ! তবুও মনটাকে শক্ত করে তিনি জানতে চাইলেন, “কে” ?
ম্যাডাম, আমি থানার বড়বাবু ।
আবার তিনি চমকে উঠলেন ! এত রাত্রিতে হঠাৎ পুলিশ কেন ? অন্য উপায় না পেয়ে কুহককে ঘুম থেকে ডাকলেন । বেচারা ঘুমে বিভোর ! ঘুম না ভাঙার জন্য বিছানায় শোওয়া কুহকের গায়ে আলতোভাবে ধাক্কা দিতেই চিল্লিয়ে উঠে মাকে পাল্টা বললো, “অযথা আমাকে ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিচ্ছো কেন” ?
বাবা, সদর দরজায় পুলিশ !
চমকে গিয়ে কুহক বললো, “পুলিশ” !
কুহকের মা দরজা খুলে দিলেন ।
“নমস্কার বৌদি” ।
নমস্কার । এত রাত্রিতে আপনারা ?
আমাদের মাফ্‌ করবেন ম্যাডাম । এটা নিশ্চয় শিবদাস মোড়লের বাড়ি ?
“হ্যাঁ । শিবদাস মোড়ল তো বাড়িতে নেই”। কুহক বড় বাবুর প্রশ্নের উত্তরে বললো ।
সেটা আমরা জানি ।
তবে গভীর রাত্রিতে আমাদের বিরক্ত কেন ?
“শিবদাস মোড়ল দুবরাজপুর যাননি । আপনাদের বাড়ির আশেপাশে ঘোরাফেরা করছেন । পালানোর চেষ্টা করে তিনি পার পাবেন না, খুব শীঘ্রই পুলিশের জালে ধরা পড়বেন” । বড় বাবু দুজনকে উদ্দেশ্য করে বললেন ।
“আপনি কাকে কী বলছেন ? আপনাদের মাথা ঠিক আছে তো ? তিনি আমার স্বামী । এই গ্রামের মোড়ল । তিনি ব্রাম্মণ সম্প্রদায়ের মাথা” । কুহকের মা কিছুটা বিরক্তির স্বরে কথাগুলি থানার বড় বাবুকে বললেন ।
কুহক মায়ের সঙ্গে তাল দিয়ে থানার বড় বাবুর দিকে তাকিয়ে বললো, “স্যার, আপনাদের কোথাও ভুল হচ্ছে ? আমার বাবা বাড়িতে না জানিয়ে বাড়ির আশেপাশে ঝোঁপে জঙ্গলে কেন লুকিয়ে থাকবে” ?
রাত্রিবেলায় বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত ম্যাডাম । তবে সমস্ত ঘটনাটা একটু পরেই আপনারা টের পাবেন । আমরা এসেছি আপনাদের অনুরোধ করতে, মোড়ল মশায় বাড়িতে ঢুকলে আমাদের জানিয়ে দেবেন ।
কুহকের মা ভয়ে আমতা আমতা করে থানার বড় বাবুকে জিজ্ঞাসা করলেন, “আমার স্বামীর অপরাধ” ?
দুঃখিত ম্যাডাম । তদন্তের স্বার্থে এই মুহূর্তে আমাদের পক্ষে আর কিছু বলা সম্ভব না । এবার আমরা চলি । নমস্কার ।
বড় বাবু চলে গেলেন ।
কুহকের মায়ের ভাবনায় এখন অন্য মাত্রা ! তবে কী কুহকের বাবা খেমটিকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য তাঁর এইসব কারসাজি ? কিন্তু শিবদাস মোড়ল খেমটিকে মারার জন্য কেন ফন্দি আঁটতে পারে কুহকের মায়ের মাথায় কিছুতেই ঢুকছে না । তিনি জানেন, জাতিগত কারণে কুহকের বাবা কুহককে খেমটির সাথে মেলামেশা বন্ধ করতে চাইছেন । এই ধরনের সম্পর্কের ক্ষেত্রে তাঁর সামাজিক মর্যাদার প্রশ্ন ? কুহকের মা এটাও জানেন, কুহকের বাবার কুহকের প্রতি তর্জন গর্জন সাময়িক । সন্তানের মঙ্গলের জন্য তিনি ধীরে ধীরে খেমটিকে ছেলের বৌ হিসাবে মেনে নেবেন । সেইজন্য তিনি কুহকের বাবাকে প্রতিনিয়ত বোঝাচ্ছেন, “ছেলে যদি খেমটিকে বিয়ে করে সুখী হয় সেইক্ষেত্রে বাবা-মা হিসাবে আমাদের আপত্তি কোথায় ? বরং আমাদের সায় দেওয়া উচিৎ” । তাছাড়া খেমটি যথেষ্ট শিক্ষিত ও বুদ্ধিমতী এবং আধুনিক রুচিশীল মেয়ে । এইভাবে বোঝানোর কারণে কুহকের মায়ের ধারণা, মোড়ল মশায় তাঁর কথাটা গভীরভাবে চিন্তা করছেন এবং অচিরেই তিনি তাঁর মত কুহক ও খেমটিদের অনুকূলে দেবেন । তাই বলে তিনি কখনই ধ্বংসাত্মক নন । শিবু বায়েনকে দু-চার কথা শোনাতেন ঠিকই, কিন্তু তার অমঙ্গল ঘূণাক্ষরেও চাননি । অথচ সেই মানুষটাকে পুলিশ কেন খুঁজছে ?
সন্দেহ দানা বাঁধছে কুহকের মায়ের অন্তরে ।
তিনি একজন শান্তিপ্রিয় মহিলা । প্রত্যেকটা মানুষকে শ্রদ্ধা করেন । যথাযথ মর্যাদা দেন । তাঁর শ্রদ্ধা জানানোর ক্ষেত্রে কোনো জাতপাত থাকে না । কুহকের মা আবার ঠাকুর রামকৃষ্ণের ভক্ত । তিনি রামকৃষ্ণের বাণীকে যথেষ্ট মর্যাদা দেন । “মানুষের মধ্যে ঈশ্বর থাকে । মানুষকে সেবা করার অর্থ ঈশ্বর সেবা” রামকৃষ্ণের এই বাণীটা তাঁর খুব প্রিয় । তাঁর চলমান জীবনের চিন্তাভাবনা, মানব সেবার স্বার্থে ।
অন্যদিকে গভীর রাত্রিতে থানার বড় বাবুকে দেখে কুহকও অবাক ! তাঁর বাবা আর যাই করুক, গভীর রাত্রিতে বায়েন পাড়ায় আগুন লাগানোর মতো জঘন্য কাজ করবেন না । সাধারণত কাপুরুষেরা এইসব নোংরা কাজে মত্ত থাকে । তার বাবা শিবদাস মোড়ল এইরুপ নোংরা ন্যক্কারজনক কাজ করে গোটা ব্রাম্মণ সমাজের চোখে তিনি হেয় হবেন কেন ? এইসব উলটপালট চিন্তা তাকে গ্রাস করতে চাইছে । চাইলেও ভাবনা থেকে বিরত থাকতে পারছে না । ঘুরেফিরে বাবার বিরুদ্ধে পুলিশি তল্লাশের কথা মাথায় জোর করে ঢুকছে ! এইসব ভেবে মানসিক পীড়ায় সে জর্জরিত । মনের কষ্টে সে ব্যথিত । আবার ভাবছে, বাবার ধ্বংসাত্মক রূপ জনসমক্ষে উন্মোচিত হলে সে খেমটিকে মুখ দেখাবে কী করে ? এইসব ভাবতে ভাবতে কখন যেনো তার মুখ থেকে বেরিয়ে গেছে, “স্টপ ! স্টপ কুহক ! বেশী ভাববি না” ।
নির্জন রাত্রিতে ঐ শব্দগুলো চিৎকারের মতো শুনতে পেয়ে কুহকের মা ছুটে এসেছেন, “কী হলো বাবা” !
কই ! কিছু না তো !
তুই চিৎকার করে বললি, “স্টপ, স্টপ” !
কুহক নিজেকে সংযত রাখতে পারলো না । কান্নায় মায়ের কোলে ঢলে পড়লো ।
মা তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, “কী হয়েছে বাবা ? খেমটি এখন অনেক স্বাভাবিক । তার জন্য বেশী চিন্তা করিস না” ।
আমি খেমটির জন্য চিন্তা করছি না ।
তবে ?
আমি আমার বাবার কথা ভাবছি ?
ঠিক সেই মুহূর্তে বাড়ির উঠোন দিয়ে লোক দৌড়ানোর আওয়াজ ! মনে হচ্ছে আগন্তুকেরা বাড়ির উঠোনে এপাশ থেকে ওপাশ ছুটে বেড়াচ্ছে !
ঘরে বসেই কুহক চিৎকার করে বললো, “কে ? কে আপনারা” ?
আমরা পুলিশ !
বাড়ির উঠোনে কেন ?
প্লীজ, আপনারা কেউ ঘর থেকে বের হবেন না ।
পুলিশের কথা শুনে আরও ভয় পেয়ে গেলেন কুহকের মা । তাঁদের বাড়িতেই পুলিশের কেন টার্গেট ?
কুহক পুনরায় পুলিশকে উদ্দেশ্যে করে কী যেনো বলতে যাচ্ছিলো, কিন্তু তার মা তাকে চুপ করিয়ে দিলেন । তারপর চুপি চুপি কুহকের কানের কাছে গিয়ে তার মা বললেন, “জানলায় উঁকি দিয়ে দ্যাখ্‌ পুলিশ কী করছে” ?
ধীরে ধীরে কুহক উঠোন বরাবর জানালাটা খুললো । তারপর মাকে ডাকলো । মা-বেটা মিলে বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখতে পেলো, “গোটা পাঁচেক বন্দুকধারী জওয়ান পুলিশ বন্দুক উঁচিয়ে উঠোনে ঘোরাঘুরি করছেন । দূরে আরও কয়েকজন পুলিশের ফিসফিসানির আওয়াজ ! আর তাদের ঠাকুর ঘরের চারিদিকে বড় বড় লাইটের ফোকাস্‌” ।
মাকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে কুহক খুব আস্তে আস্তে বললো, “তুমি কী দেখতে পাচ্ছো থানার বড় বাবু ঠিক ঠাকুর ঘরের সম্মুখে বন্দুক উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে” ?
কুহকের কথা শেষ হতে না হতেই তাদের উঠোনে ক্ষমতাসম্পন্ন বিস্ফোরক বোমা ফাটলো । বোমার ফাটার আওয়াজে কান পাতা দায় ! বোমা ফাটার পর পুরো বাড়িটা ধোঁয়ায় পরিপূর্ণ । বিস্ফোরক বোমা ফাটার আওয়াজে গ্রামের মানুষের ধারণা কুহকদের বাড়িতে ডাকাত পড়েছে । তাই গ্রামের মানুষের জটলা । উদগ্রীব গ্রামবাসী রাস্তার উপরে দাঁড়িয়ে । অন্যদিকে থানার বড় বাবু তাঁর সার্ভিস রিভোলবার থেকে শূন্যে একটি গুলি ফাটালেন ।
চারিদিকে আতঙ্ক !
কুহক কৌতুহলি দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো, “যতো গন্ডগোল তাদের বাড়িতে কেন মা” ?
“নিশ্চয় পুলিশের কাছে কোনো গোপন খবর রয়েছে যে দুর্বৃত্তদের আনাগোনা আমাদের বাড়ির আশে পাশেই । তাই তল্লাশির জন্য তাঁদের বাড়ি টার্গেট” ? কুহকের মায়ের উত্তর ।
কিন্তু আমার খটকা লাগছে, ঠাকুর ঘরের সামনে থানার বড় বাবু দাঁড়িয়ে কেন ?
কুহকের মা বললেন, “ঠাকুর ঘরের পেছনটায় অন্ধকার । সেখানে কোনো দুস্কৃতি গা ঢাকা দিতে পারে” ।
মায়ের কথা শুনে কুহকের খটকা কাটছে না । সে ভাবছে, তাহলে দুস্কৃতিদের কী মা-বেটার উপর হামলার চক্রান্ত ? পুরো ব্যাপারটা কুহকের কাছে ধন্দে ?
হঠাৎ……?
মায়ের অনুমান একদম ঠিক ! হঠাৎ ঠাকুর ঘরের পেছন থেকে সনাতন মাস্টারকে পুলিশ জামার কলার ধরে টেনে এনে উঠোনের উপর ফেলে চিৎকার করে জিজ্ঞাসা করলেন, “ডাক্‌ তোর সাগরেদকে । তাঁর পালাবার পথ বন্ধ ! নিজের ভাল চাইলে, শিগগির ডাক্‌ । নতুবা তোকে আস্ত পুড়িয়ে মারা হবে” ।
ফ্যাল ফ্যাল করে পুলিশের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন সনাতন মাস্টার ।
সনাতন মাস্টারের দৃশ্য দেখে কুহকের কাছে জলের মতো পরিস্কার, খেমটিদের পড়ায় আগুন লাগিয়ে বাড়ি ঘর পুড়িয়ে দেওয়া ও খেমটিকে অপহরণের মূল পান্ডা আর কেউ নয় স্বয়ং তার আরাধ্য পিতৃদেব ।
যেটা অনুমান করেছিলো, সেটাই বাস্তবে সত্যি ঘটলো ।
ঠাকুর ঘরের দরজা ভেঙ্গে থানার বড় বাবু শিবদাস মোড়লকে হাতেনাতে পাকরাও করলেন । সঙ্গে সঙ্গে টীমের অন্য পুলিশ আধিকারিক শিবদাস মোড়লের হাতে হাত-কড়া পরিয়ে দিলেন । তারপর দুজনের পিঠে চাবুক মারতে মারতে তাদেরকে প্রিজন ভ্যানে তুললেন ।
শিবদাস মোড়লের ঐ দৃশ্য দেখে কুহকের মা নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পেরে জ্ঞান হারালেন ।
মায়ের অচৈতন্য হওয়ার দৃশ্য দেখে কুহকের চিৎকার, “মা” !
থানার বড় বাবু কুহকের ঐরূপ বিকট চিৎকার শুনে ছুটে এলেন । কুহক দরজা খুলে দিলে থানার বড় বাবু দেখতে পান, “কুহকের মা বিছানায় সটান শুয়ে রয়েছেন” । তারপর তাঁর চোখে মুখে জলের ছিটা দেওয়ায় তিনি চোখ মেলে তাকালেন ।
কুহকের মায়ের চোখ বেয়ে জলের ধারা অবিরত । একটা কথাই কুহকের মা আওড়াচ্ছেন, “এই দৃশ্য দেখার আগে আমার কেন মরণ হোলো না” !
পরের দিন ঘোড়াডাঙার পুলিশি তল্লাশি অভিযানের খবর দৈনিক খবরের কাগজে হেডলাইন ! মুর্শিদাবাদ জেলায় আন্তর্জাতিক মানের নারীপাচারকারী দলের পান্ডা ধৃত, শিবদাস আচার্য ।
জেলা শাসক মহাশয় তাঁর দেওয়া কথামতো পরেরদিন অফিসিয়ালি খেমটিদের বাড়ি পরিদর্শনে এলেন । জেলাস্তরের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা ছাড়াও এলাকার সাংসদ ও বিধায়ক বায়েন পাড়া ঘুরে গেলেন । প্রত্যেক সরকারি আধিকারিক, জনপ্রতিনিধি আশ্বাস দিলেন, বায়েন পাড়ার মর্যাদা রক্ষায় তাঁরা দায়বদ্ধ ।
জেলা শাসক মহাশয় খেমটিদের পারিবারিক খোঁজখবর নিলেন । খেমটির শিক্ষাগত যোগ্যতা শুনে তিনি স্তম্ভিত । জেলা শাসক মহাশয় খেমটিকে ঢাকের বাজনা চালিয়ে যেতে অনুরোধ জানালেন । কেননা মুর্শিদাবাদ জেলায় তাঁর গোচরে কোনো মহিলা ঢাকি বা ঢুলি নেই । সেই জায়গাটায় খেমটির মর্যাদা অনস্বীকার্য । জেলা শাসক মহাশয়ের অনুপ্রেরণা পেয়ে খেমটি তার ভবিষ্যতের পরিকল্পনা স্যারকে আগাম জানিয়ে রাখলো, “সে মহিলাদের নিয়ে একটি মহিলা ঢাকির দল গড়তে চায় এবং তারা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠানে যেমন পূজাপার্বনে, বিবাহ অনুষ্ঠানে, মুসলমানদের আলকাপে, ঢাকের বাজনা বাজাতে আগ্রহী” ।
খেমটির আগ্রহের কথা ও তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা শুনে জেলা শাসক মহাশয় উৎফুল্ল হয়ে বললেন, “আপনি কাজে এগিয়ে যান । শক্তিশালী মহিলা ঢাকির দল তৈরী করুন । আমি আপনাদের পাশে থাকার আশ্বাস দিচ্ছি” ।
তারপর ধীরে ধীরে বায়েন পাড়ার বায়েনদের স্বাভাবিক জীবন যাপন । অন্যদিকে মহামান্য আদালতের সংশ্লিষ্ট মাননীয় বিচারক শিবদাস আচার্য ও সনাতন মাস্টারকে ছয় বছর সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত করলেন ।
কুহকের মায়ের পরামর্শমতো, খেমটি এখন দুটো বাড়ির দেখভালের দায়িত্বে । তবুও খেমটির দৃষ্টিভঙ্গি, কুহকের বাবা জেল থেকে ছাড়া পেয়ে তাকে পুত্র বধু হিসাবে মেনে নিলে তবেই তাদের বিয়ে । তাদের বিবাহিত জীবন শুরু । নচেৎ কুহককে বিয়ে করা সম্ভব না ।
কিন্তু………?
কিন্তু খেমটির আর পড়াশুনা করা হোলো না । পুরোমাত্রায় তার জাত ব্যবসা ঢাক ও ঢুলির বাজনায় মনোযোগ । প্রতিটা অনুষ্ঠানে খেমটি ঢাকি হিসাবে আমন্ত্রণ পেয়ে নিয়মিত ঢাক বাজাচ্ছে । মহিলা ঢাকি হিসাবে ধীরে ধীরে নিজেকে সমাজে প্রতিষ্ঠা করার প্রয়াস তার অব্যাহত রইলো ।
খেমটির মিষ্টি মধুর ব্যবহার ও সুমধুর ঢাকের বাজনার জন্য মানুষ তাকে ক্রমশ গ্রহণ করছেন । কতিপয় হাতে গোনা সমাজের কয়েকজন মানুষ এখনও খেমটিকে ঢাক বাজাতে নিরুৎসাহিত ও বিরোধিতা করে যাচ্ছে ।
অন্যদিকে অনল তাকে মহিলা ঢাকির টীম তৈরী করার উৎসাহ জুগিয়ে যাচ্ছে । খেমটির ইচ্ছা, গাঁয়ের পাঁচ জন মেয়েদের নিয়ে প্রথম টীম তৈরী করা । ঢাকের বোল তোলার জন্য খেমটি একাই একশো ! তাই ঐপাঁচজন মেয়ে ঢাকিকে বাজনার তালিম দেওয়ার দায়িত্বে সে নিজেই যথেষ্ট ।
ভূপতি এসছিলো । সে চায়, তার শাশুড়িকে কয়েকদিনের জন্য তাদের বাড়িতে রাখতে । কেননা, তনিমা মা হতে চলেছে । যেহেতু বাচ্চা প্রসবের তারিখ দেরীতে, তাই খেমটি ভূপতিকে পরামর্শ দিলো ডেলিভারির এক মাস আগে মাকে নিয়ে যাওয়াটাই যুক্তিযুক্ত । ভূপতি আর পীড়াপীড়ি করলো না, কেননা শাশুড়িকে নিয়ে গেলে খেমটির একা কাটানো দুরুহ হবে । সেটা আবার ভূপতির কাছে দুশ্চিন্তার !
খেমটি এখন অনেকটা হাল্কা । কেননা ঢাকের বাজনায় যেটুকু উপার্জন হচ্ছে তাতে মা-বেটির সংসার স্বাচ্ছন্দ্যে কাটছে । তবুও চাকরির চেষ্টা থেকে খেমটি পিছিয়ে নেই । কিন্তু চাকরির বাজার ভীষণ মন্দা । সরকারি চাকরির বিজ্ঞাপনও খুব কম । চাকরির বাজারেও তেমনি কঠিন প্রতিযোগিতা । চাকরির কথা ভেবে এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জ অফিসে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছে । চাকরি পাওয়ার হাল সে ছাড়ছে না । এই মুহূর্তে চাকরিটা তার সাংসারিক জীবনে ভীষণ দরকার । তার বিশ্বাস, সে কিছু একটা উপার্জনের পথ জোগাড় করতে সক্ষম হবে ।
অন্যদিকে কুহকের একটা ভাল খবর । স্কুলের করণিক পদটা তার কপালে জুটেছে । স্কুলটা খুব একটা দূরে নয় । বাড়ি থেকে বাইকে যাতায়াত অনায়াসে সম্ভব । কুহকের চাকরির খবরে কুহকের মা খুব খুশী । কারণ তাঁর একমাত্র সন্তান বাড়িতেই থাকবে । কুহকের আবার মা-অন্ত প্রাণ ।
তারপর খেমটি মহিলা ঢাকির টীম তৈরী নিয়ে যথেষ্ট নাজেহাল । গাঁয়ে গঞ্জের মানুষেরা মান্ধাতা আমলের ধ্যান ধারণায় বিশ্বাসী । তাঁরা মেয়েদের ঘর সংসারের বাইরে পাঠাতে গররাজী । ধেই ধেই করে নেচে ঢাক বাজানোতে তাঁদের প্রচন্ড আপত্তি । তার উপর মেয়েরা ঢাকির দলের হয়ে ঢাক বাজাতে বিভিন্ন রাজ্যে ছুটবে, সেইক্ষেত্রে রাত্রিযাপন সেখানেই । বয়স্থা মেয়েরা বাবা-মা ছাড়া ভিন্ন জায়গায় রাত কাটালেই সমাজের মানুষ সেটাকে বাঁকা চোখে দেখেন । গাঁয়ের পাঁচজনে পাঁচ কথা বলবে, তাতে তাঁদের মেয়ে বিয়ে দিতে কালঘাম ছুটে যাবে । সুতরাং যেঁচে তাঁরা বিপদ আনতে নারাজ । আবার অন্যদিকে খেমটির অভিজ্ঞতা, যেহেতু আয়ের কোনো সুনির্দিষ্ট বন্দোবস্ত নেই তাই মহিলাদের ঢাকের বাজনার দলে আসতে অনীহা । তাই পাঁচজন মেয়ে জোটানো খুব কঠিন ! মহিলা টীমে ঢাক ও ঢুলি দুটোই থাকছে । তার ইচ্ছা, ঢাকের সাথে সাথে সমানভাবে ঢুলির বাজনাতেও তাদের মহিলা টীম দক্ষ হোক । তাই দুটো বাজনার ক্ষেত্রে টীমকে পারদর্শী হওয়া বাঞ্ছনীয় । শেষ পর্যন্ত অতীব কষ্টে স্বামীদের হাতে পায়ে ধরে রাজী করিয়ে তিনজন বিবাহিত মহিলাদের জোগাড় করতে সমর্থ হোলো খেমটি ।
অনেক চেষ্টা করেও খেমটি, কুহক ও অনল অবশিষ্ট একজন মহিলা জোগাড়ে ব্যর্থ । ভূপতি এগিয়ে এসে তাদের পাশে দাঁড়ালো । ভূপতির অনলস প্রয়াসে অবশেষে শক্তিপুরের সন্নিকট মিঞাগ্রাম থেকে একজন মুসলিম মেয়ে লুতফা শামিমকে পাওয়া গেলো । অল্প শিক্ষিত । কিন্তু কঠোর পরিশ্রমী । দেখতে সুদর্শনা । মুসলিমদের মধ্যে লুতফার মতো সুদর্শনা মেয়ে বিরল । কিন্তু তাকে নিয়ে সমস্যা অন্যত্র । হিন্দুদের পূজায় ঢাক বাজানোর ক্ষেত্রে মুসলিম মেয়েকে টীমে রাখা ভবিষ্যতে কোনো সমস্যা হবে কিনা ? উদ্বিগ্ন খেমটি ! কিন্তু অনলের বক্তব্য, “লুতফা শুধুমাত্র ঢাকি । ঢাকের বাজনা এখন শিল্প সংস্কৃতির অন্যতম অঙ্গ । সে শুধুমাত্র ঢাক বাজাবে, কিন্তু পূজো করার ক্ষেত্রে থাকবেন পুরোহিত ঠাকুর । অন্যদিকে মুসলিমদের আলকাপ বা অন্যান্য অনুষ্ঠানে তাহলে হিন্দুরা ঢাক বাজাচ্ছে কেন ? তবে তাকে নিয়ে হৈ চৈ করার কিছু নেই । সুতরাং ঢাকের টীমে একজন মুসলিম মেয়ের অন্তর্ভূক্তি, ষোলোআনা সঠিক সিদ্ধান্ত” ।
পাঁচজনের টীম । শুরু হোলো তাদের অনুশীলন । অনলের পরামর্শ মতো ঢাকের বাজনা শেখার সাথে সাথে তাদের ক্যারাটে প্রশিক্ষণও চলছে । রাস্তাঘাটে মহিলাদের নিরাপত্তার কথা ভেবে ক্যারাটের প্রশিক্ষণ । কুহকও অনলের সাথে একমত, বাস্তব জীবনে নানান ধরনের উৎপাতের মোকাবিলা করার জন্য নিজেদের যতোটা সম্ভব তৈরী রাখা নিরাপত্তার দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ।
বড়দিনে খেমটিদের দল কলকাতার খ্যাতনামা চার্চে ঢাক বাজানোর ডাক পেলো । খ্রিষ্টান ধর্মের বড়দিনের জাকজমক অনুষ্ঠানে তাদের ঢাকের বাজনা এটাই প্রথম । তাছাড়া কলকাতার উপকন্ঠে তাদের ঢাকের বাজনার উপস্থাপনা, সেটাও প্রথম । খেমটির মতে, কলকাতার যেকোনো অনুষ্ঠানে ঢাক বাজাতে না পারলে মানুষের দৃষ্টিতে তাদের ঢাকের বাজনার সঠিক মূল্যায়ন সম্ভব না । খেমটির উপলব্ধি, বাংলার কৃষ্টি সংস্কৃতির বহিঃপ্রকাশের পীঠস্থান কলকাতা ।
তারপর কাঁধে ঢাক নিয়ে পাঁচজন প্রশিক্ষিত মহিলার ঢাকের বাজনা উপস্থিত সমস্ত খ্রিষ্টান মানুষদের মনোরঞ্জনে সমর্থ হোলো । সেই রাত্রিতেই খেমটিদের ঢাকের মহিলা টীম পরেরদিন টিভি’র একটা প্রোগ্রামে আমন্ত্রণ পেলো । টিভির আমন্ত্রণে খেমটি খুব খুশী । সে জানে, জনপ্রিয়তা পাওয়ার নিরিখে টিভির প্রোগ্রাম খুব গুরুত্বপূর্ণ ।
টিভির লাইভ প্রোগ্রামে সঞ্চালক ম্যাডাম সকলের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পর, তাঁর প্রথম প্রশ্ন লুতফাকে, “মুসলিম মহিলা হিসাবে হিন্দুদের পূজাপার্বনে আপনি কী ধরনের সামাজিক বাধা বিপত্তির সম্মুখীন হচ্ছেন” ?
গাঁয়ে গঞ্জের জল আবহাওয়ায় বেড়ে ওঠা সাধারণ মেয়ে লুতফা । এই প্রথম কোনো টিভির প্রোগ্রামে তার বসা । এতকাল টিভির অনুষ্ঠান শুধুমাত্র বাড়ির দূরদর্শনের পর্দায় দেখে এসেছে । কোনোদিন স্বপ্নেও ভাবেনি, তাকেও একদিন টিভিতে কিছু বলার জন্য বসতে হবে । খেমটির কাছে বল-ভরসা পেয়ে তার টিভির প্রোগ্রামে আসা । যদিও খেমটি তাকে বলে দিয়েছিলো কিছু প্রশ্ন করলে আমাকে দেখিয়ে দেবে তার উত্তর দেওয়ার জন্যে । তবুও ভয়ে রীতিমতো সে গুটিসুটি । প্রশ্নটা শুনে হকচকিয়ে গেলো লুতফা । এই ধরনের প্রশ্নের সম্মুখীন হবে কখনই সে ভাবেনি । তাই খানিকটা বিচলিত । নিজেকে শক্ত করে অতি সন্তর্পনে কায়দা করে সঞ্চালক ম্যাডামকে লুতফা বললো, “আমাদের সমস্ত প্রশ্নের উত্তর দেবেন আমাদের মহিলা ঢাকি টীমের দলনেত্রী খেমটি দিদি” ।
সঞ্চালক ম্যাডাম এবার খেমটির দিকে তাকিয়ে বললেন, “এবার আপনি বলুন । মুসলিম ঢাকিকে নিয়ে কী ধরনের সামাজিক বিপত্তির সম্মুখীন হচ্ছেন” ?
এটি একটি প্রাসঙ্গিক অথচ সঙ্গত প্রশ্ন ? প্রথমত এই মুহূর্তে যে বাধাটা আমরা পাচ্ছি, সেটা মহিলা ঢাকি হওয়ার সুবাদে । পূজার অনুষ্ঠানে গাঁয়ে গঞ্জের মানুষেরা ঋতুগত কারণে শুচি ও অশুচির প্রসঙ্গ টেনে তোলেন । আমরা তাঁদের সবিনয়ে জানাই, আমরা ঢাকি । ঢাক বাজানোই আমাদের প্রাথমিক শর্ত ! সেই শর্ত পালনের নিরিখেই ঢাকের বাজনার পরিবেশন । লুতফা মুসলিম সম্প্রদায় হওয়ার কারণে গত কার্তিক পূজায় আমরা যে সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলাম, আপনি অনুমতি দিলে নিবেদন করতে পারি ।
সিওর । বলুন খেমটি দেবী ।
বনেদি বাড়ির পূজো । মুসলিম মহিলাকে কিছুতেই তাঁরা পূজা মন্ডপে ঢাক বাজাতে দেবেন না । আমি তাঁদের সবিনয়ে জানাই, “বায়েনরা ঢাক বাজায় । সেই বায়েনরা সাধারণত মুচি সম্প্রদায়ের এবং মুচি সম্প্রদায়ের মানুষেরা ঢাকের বাজনার পেশায় নিয়োজিত । আপনারাই বরং নিম্ন বর্গের মানুষদের দেখলে নাক সিট্‌কান । এখন পূজা মন্ডপে যদি মুচি, মেথর, ডোমকে মানতে পারেন, তাহলে মুসলিম মেয়েকে মানতে বাধা কোথায় ? লুতফা আপনাদের পূজায় শ্রদ্ধাঞ্জলি দিচ্ছে না এমনকি পূজায় কোনোরকম পুস্পাঞ্জলিও দিচ্ছে না । শুধুমাত্র মনের আনন্দে ঢাক বাজাচ্ছে । এতে আপনাদের অনীহা থাকা পুরোটাই অযৌক্তিক । তারপর তাঁরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিলেন, লুতফা পূজাতে ঢাক বাজাবে তবে শর্ত সাপেক্ষে । সে ঠাকুরের মূর্তি ছুঁতে পারবে না আর পূজার নৈবদ্যিতে হাত দেবে না । সেখানে আমরা খুব আনন্দের সঙ্গে ঢাকের বাজনা পরিবেশন করলাম । তারপর যতোগুলি পূজার অনুষ্ঠানে ঢাক বাজিয়েছি, সব জায়গায় লুতফাকে নিয়ে কোনোরকম বৈষম্যমূলক আচরণের সম্মুখীন হইনি ।
তারপর টিভিতে তাদের ঢাকের বাজনার পরিবেশন । প্রত্যেকে শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে রুচিশীল মিষ্টতায় ঢাকের বাজনা পরিবেশন করলো । পাঁচজন মহিলার কাঁধে ঢাক । নৃত্যে আর ঢাকের বাজনায় গোটা টিভির অনুষ্ঠানে আলাদা মাধুর্য এনে দিলো । সব শেষে সঞ্চালক ম্যাডাম টিভির প্রোগ্রামে আসার জন্য খেমটিদের ধন্যবাদ জ্ঞাপন করলেন ।
২৬শে জানুয়ারী প্রজাতন্ত্র দিবসে দিল্লি থেকে ডাক পেলো খেমটির মহিলা ঢাকির টীম । লাল কেল্লায় প্রজাতন্ত্র দিবসে সকালে কুজকা আওয়াজের প্রাক্কালে অন্যান্য রাজ্যের ট্যাবলয়েডের মাঝখানে খেমটিদের মহিলা ঢাকির টীম ঢাক বাজাবে । খেমটিদের কাছে এটা একটা বড় সম্মান ও তাদের ঢাকিদের স্বীকৃতি । এব্যাপারে কৃতিত্ব পুরোটাই জেলা শাসকের । তাঁর সুপারিশেই দিল্লিতে প্রজাতন্ত্র দিবসে লালকেল্লায় খেমটিদের ঢাক বাজানোর অনুমতি মিলেছে । শোনা গেছে, মহিলা শক্তির সমৃদ্ধায়নের কথা মাথায় রেখে সরকারি স্বীকৃতি পাওয়া গেছে । দিল্লির মতো জায়গায় যেখানে রাষ্ট্রপতি, প্রধান মন্ত্রী ও মন্ত্রী পরিষদের অন্যান্য সদস্যগণ ও দেশের উচ্চ পদাধিকারী মানুষের সামনে ঢাকের বাজনা পরিবেশন করার সুযোগ পেয়ে ঐ পাঁচজন মহিলা ঢাকি গর্বিত ।
খেমটি চাইছে এই সুযোগ যথাযথভাবে কাজে লাগাতে । সেখান থেকে যেনো সমস্ত ঢাকির ঢাক বাজনা একটা মর্যাদাপূর্ণ শিল্পের প্রচার পায় । সেইজন্য তারা পাচঁজন মহিলা আদাজল খেয়ে অনুশীলনে নেমে পড়লো । দিন রাত্রি তাদের অনুশীলন । খেমটি যেমন পরিশ্রমী তেমনি ঢাকির টীমের অন্যান্য মহিলাদের পরিশ্রমী করে তুলতে তার জুড়ি মেলা ভার । অনবরত তাদের মেহনত । নিখুঁত বাজনার তাল ও বোল সম্পর্কে ষোলোআনা সতর্ক । প্রচন্ড খাটুনি । উৎকৃষ্ট ঢাকের বাজনায় মহিলারা যে কোনো অংশে কম নয় সেটা দেখাতে খেমটি বদ্ধপরিকর । এজন্য তাদের অনলস ত্রুটিহীন প্রয়াস ।
দিল্লিতে মহিলা টীমের সঙ্গে অনল ও কুহক সঙ্গী ।
২৬শে জানুয়ারী । খেমটিদের মধ্যে টান টান উত্তেজনা ! জেলা শাসক মহাশয় শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেছেন, “আমার মান তথা জেলার মান সর্বোপরি রাজ্যের সম্ভ্রম রাখতে হবে” ? সেই কারণে খেমটিদের দায়িত্ব, সর্বোৎকৃষ্ট পারফর্মেন্স দেখানো ?
তারপর …………?
তারপর যথা সময়ে অনুষ্ঠান শুরু । শুরু হোলো মহিলা টীমের ঢাক বাজনা । একমাত্র তারাই মহিলা ঢাকির টীম । নেচে নেচে তাদের ঢাকের বাজনা । নিখুঁত তাদের পারদর্শিতা । খেমটিদের ঢাকের বাজনা পরিবেশনের সময় শ্রোতামন্ডলীর মধ্যে আনন্দোচ্ছ্বাসের ভীষণ উন্মাদনা । পরিশেষে শ্রোতামন্ডলীর সম্মিলিত হাততালিতে খেমটির কাছে স্পষ্ট তাদের পারফর্মেন্সে অতিথিরা সন্তুষ্ট । অন্যদিকে অনল ও কুহক তাদের জানালো, স্বয়ং রাষ্ট্রপতি ও প্রধান মন্ত্রী মহিলা ঢাকিদের পারফর্মেন্স দেখে উভয়েই হাততালি দিয়েছেন । তাদের ঢাকের বাজনার পারফর্মেন্সে অতিথিরা সন্তুষ্ট, এটাই তাদের আগামীদিনে চলার পথের পাথেয় ?
তারপর খেমটিদের বাড়ি ফেরার পালা ।
বাড়ি ফিরে মায়ের কাছ থেকে একটা চিঠি পেয়ে খেমটি খুব আনন্দিত । দিল্লির রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে ঐ চিঠি ।
খেমটি পাচ্ছে আন্তর্জাতিক নারী দিবসে নারী উন্নয়নের দিশারীর প্রতীক হিসাবে দেশের সর্বোচ্চ সম্মান “নারীশক্তি” পুরস্কার ।
মহিলা হয়ে যেভাবে শত বাধা-বিপত্তির মধ্যে ঢাকের বাজনাকে দেশের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে মর্যাদা সহকারে পরিবেশন করে চলেছে তার জন্যেই এই গৌরবোজ্জ্বল স্বীকৃতি । স্বয়ং রাষ্ট্রপতি আন্তর্জাতিক নারী দিবসে এক বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে দিল্লিতে তার হাতে ঐ সম্মানজনক “নারীশক্তি” পুরস্কার তুলে দেবেন । এই খবরে খেমটি আনন্দে উল্লসিত । আনন্দোচ্ছ্বাসে তার হৃদয় ভরপুর ।
গোটা ঘোড়াডাঙা গ্রাম খেমটির “নারীশক্তি” পুরস্কার পাওয়ার খবরে উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ছে ! গ্রামবাসীরা খেমটির জন্য গর্বিত ।
ইতিমধ্যে দু-দুটি মিসড্‌ কল । কল ব্যাক করে খেমটি জানতে পারলো, মিডিয়া থেকে ফোন । তাঁরা খেমটির একটা ইন্টারভিউ নিতে চান ।
ঘোড়াডাঙা বায়েন পাড়া এখন খবরের আলোয় আলোকিত ।
তারপর কুহকের মা বায়েন পাড়ায় এসে খেমটিকে আশীর্বাদ করে বললেন, “তোমার প্রতিভার বিকাশ উদ্ভাসিত হোক নিরন্তর” ।
৮ই মার্চ দিল্লিতে ডাক পড়লো খেমটির ।
খেমটির দিল্লি যাত্রার সাথী হোলো তার মা ও কুহক । যাতায়াতের খরচ ও থাকা-খাওয়ার সরকারি ব্যবস্থাপনা । একমাত্র কুহকের ক্ষেত্রে নিজের খরচ । মেয়ের খবরে খেমটির মা আনন্দে বিহ্বল । যার জন্য তার চোখে আনন্দাশ্রু । খেমটির মা কস্মিন্‌কালে কোনোদিন ভাবতেই পারেনি, বায়েন সম্প্রদায়ের ছা-পোষা মানুষ হয়ে সরকারি আতিথেয়তায় দিল্লিতে রাষ্ট্রপতির অনুষ্ঠানে থাকতে পারবে ? সবটাই সম্ভব হয়েছে তার কৃতী মেয়ের জন্য । মেয়েকে ভীষণ ভালবাসতো তার বাবা । যতোদিন বেঁচেছিলো, মেয়ের পেছনে লেগে থাকতো ঢাকের বোল তোলার জন্য । সেই খেমটির বাবা প্রায় খেমটির মাকে গর্ব সহকারে বলতো, “তাঁর ছোট মেয়েটা একটা পুত্র সন্তানের চেয়েও বেশী । তুমি লিখে রাখো গিন্নি এই মেয়ে আমাদের মুখ উজ্জ্বল করে খ্যাতির উচ্চ শিখরে পৌঁছাবে । তার যেরকম মরিয়া প্রয়াস ও অধ্যবসায়, তাতে সে একদিন ঢাকের বাজনা গোটা দেশের মানুষের দৃষ্টি কাড়বে” ।
দিল্লিতে পৌঁছে খেমটির মা বেশ কয়েকবার খেমটিকে বলেছে, “আজ তোর বাবা বেঁচে থাকলে সবচেয়ে বেশী খুশী হোতো” ।
আন্তর্জাতিক নারী দিবস । আমন্ত্রণ পত্রের দেওয়া সময় মোতাবেক খেমটি সকাল ১০টার মধ্যে অনুষ্ঠান হলে পৌঁছে গেলো । সঙ্গে তার মা ও কুহক । হলে ঢোকার সময় টাইট চেকিং । পায়ের জুতো পর্যন্ত চেকিং । ঠিক ১০টা থেকেই অনুষ্ঠান শুরু । খেমটি শ্রোতামন্ডলীর মাঝখানে বসলো আর পাশেই তার মা ও কুহক । রাষ্ট্রপতি ও প্রধান মন্ত্রী অনুষ্ঠানে আসন অলংকৃত করলেন । চারিদিকে কড়া নিরাপত্তার ঘেরাটোপ ।
তিন নম্বরে ডাক পড়লো খেমটির । খেমটির পরনে শাড়ি । সুন্দর সাজে সজ্জিত খেমটি । তাকে দেখতে অপূর্ব লাগছিলো কুহকের । ধীরে ধীরে মঞ্চে প্রবেশ করলো খেমটি । মাননীয় রাষ্ট্রপতি নিজ হাতে খেমটিকে “নারীশক্তি” পুরস্কার দিয়ে বললেন, “তুমি দেশের গর্ব । নারী জাতির উন্নয়নের ধারক ও বাহক । তোমার উন্নতমানের শিল্প সৃষ্টিতে দেশ আরও সমৃদ্ধ হোক” ।
পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলো খেমটি ।
তারপর মিডিয়ার ক্যামেরার ঝলসানি । খবরের শিরোনামে খেমটি ।
তারপর ………………?
তারপর অনেকদিন ।
কুহক স্কুলের কাজে কর্মব্যস্ত ।
নিকটবর্তী সোনাডাঙ্গা গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একটি মাস্টারির চাকরি জুটলো খেমটির । চাকরিটা পাওয়ায় তাদের সংসারের আর্থিক সমস্যার সুরাহা । ইতিমধ্যে আরও পাঁচজন মেয়ে তাদের ঢাকির টীমে যোগ দেওয়ায় দশজনের মহিলা টীম । তাদের ঢাকের বাজনার সুনামের বাড়-বাড়ন্ত । চতুর্দিক থেকে তারা ডাক পাচ্ছে । ফলে প্রাথমিক স্কুলের মাস্টারির চাকরি বাঁচিয়ে খেমটি ঢাকের বাজনায় মনোযোগ দিলো । জেলা শাসক মহাশয় অন্যত্র বদলী হওয়ার আগে খেমটির সঙ্গে দেখা করে তাকে শুভেচ্ছা জানিয়ে গেছেন ।
তারপর কুহকের মা খেমটিদের বাড়ি এসে তাঁর ছেলের সঙ্গে বিয়ের প্রস্তাব দিলে খেমটি সবিনয়ে একই কথার পুনরুক্তি করে বললো, “কুহকের বাবা জেল থেকে ছাড়া পাক্‌ । তিনি আমাদের বিয়ে মেনে নিলে তবেই বিয়ের পিঁড়িতে বসা । কেননা তাঁর আশীর্বাদ ছাড়া বিয়ে অসম্ভব” !
দেখতে দেখতে বাবলা নদী দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে ভাগীরথী গঙ্গা হয়ে বঙ্গোপসাগরে মিশলো । ঘোড়াডাঙায় এখন জুনিয়র হাই স্কুল । বায়েন পাড়ার সাথে সরাসরি ভরতপুর ও কান্দি যাওয়ার মসৃণ রাস্তা । বায়েন পাড়ায় প্রাথমিক স্কুল চালু হোলো । ভূপতি এখন পুত্র সন্তানের বাবা । তনিমার লেডিস্‌ টেলারিং ব্যবসা এলাকায় ভীষণ জনপ্রিয় । ঘোড়াডাঙা গ্রামের ব্রাম্মণ সমাজের ভুল ভেঙ্গেছে । তাঁরা গোটা বায়েন পাড়ার মানুষদের আলাদাভাবে ডেকে সম্মান জানিয়ে বলে দিয়েছেন, “এখন থেকে তোমরা আমাদের আপনজন” । খেমটির প্রতিভার জন্য গোটা ব্রাম্মণ সমাজ গর্বিত । তাঁরা নির্দ্বিধায় বলেছেন, ঘোড়াডাঙা গ্রামের ইতিহাসে এত বড় সম্মান কেউ অর্জন করতে পারেনি । সেখানে নীচু সম্প্রদায়ের মেয়ে হয়ে দেশের সর্বোচ্চ সম্মান খেমটি স্বয়ং রাষ্ট্রপতির হাত থেকে পেয়ে গাঁয়ের মানুষের মুখ উজ্জল করেছে । সুতরাং সর্বত্র একটা শান্তির বাতাবরণ । পুরোটাই খেমটির জন্যে । ঘোড়াডাঙা গ্রামে জাতপাতের অবসান । গ্রামবাসীদের মধ্যে মধুর সম্পর্কের দৃঢ় বন্ধন ।
সেই মুহূর্তে শিবদাস মোড়ল জেল থেকে ছাড়া পেয়ে সোজা খেমটির সঙ্গে দেখা করতে বায়েন পাড়ায় । খেমটির পা জড়িয়ে ধরে দুচোখের জল ফেলে কী কান্না ! কান্না ভেজা গলায় বললেন, “মা, আমাকে ক্ষমা করো” ।
তৎক্ষণাত মোড়ল মশায়ের হাত নিজের মাথায় তুলে নিয়ে খেমটি বললো, “আপনি একি করছেন ! আমার পাপ হবে । আপনি আমার বাবার মতো । আপনাকে আমার প্রণাম” ।
তারপর কুহক ও খেমটির বিয়ে মহাধুমধামে সুসম্পন্ন হোলো ।
কুহক ও খেমটির মা খুশীতে তাঁদের চোখে আনন্দাশ্রু । কুহকের মা বললেন, “এই দিনটির অপেক্ষায় আমাদের এতদিনের সাধনা” । সঙ্গে সঙ্গে খেমটির মা কুহকের মাকে জড়িয়ে ধরে আলিঙ্গনাবদ্ধ হলেন । তারপর উভয় পরিবারের মধ্যে মধুর মিলন ।
শুরু হোলো কুহক ও খেমটির শান্তির দাম্পত্যজীবন ……।
( শেষ )
—————০—————–
এ১০এক্স/৩৪, কল্যাণী – ৭৪১২৩৫ (ভারত)