অন্তরালে (ধারাবাহিক গোয়েন্দা গল্প; প্রথম ও দ্বিতীয় পর্ব) :: রুমা ব্যানার্জি।

0
513

প্রথমপর্ব..

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শেষবারের মতন নিজেকে দেখে নিচ্ছিল অহনা।না কোন সন্দেহ নেই দুধসাদা রঙের এই মসলিনটা যেন ওকে মনে রেখেই বানানো হয়েছে,সঙ্গে হালকা সোনার গয়না,কানে হীরের দ্যুতি, সবকিছু কী অসম্ভব পরিমিত সাজ কিন্তু অসাধারণ সুন্দর। আসলে সাজতে জানতে হয়।অমিতের বন্ধুর বৌদের দেখে হাসি পায় অহনার,যেন এক একজন শাড়ি আর গহনার চলমান বিজ্ঞাপন। সেখানে অহনা একদম আলাদা।

নিজের টিপটাকে কপালের ঠিক মাঝখানে বসাতে বসাতে আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজেই হেসে ফেলল অহনা।শুধুই কি সাজতে জানলে হয়? তার সঙ্গে সাজাতে জানাটাও কি জরুরী নয়? এই যেমন ওর নিজের জীবনটাকে ও যে এতো সুন্দরভাবে সাজিয়ে নিয়েছে তবেই না আজকের সন্ধ্যায় পৌঁছাতে পেরেছে।আর কদিন পরেই পৌঁছে যাবে আরো একটা ধাপ উঁচুতে। সেখান থেকে হয়তো ডানা মিলবে আকাশে।

ঘর থেকে বেরিয়ে আসে ও।বারান্দায় দাঁড়ায়। এখানে আকাশ পরিষ্কার।দূরের বাগানে আজকের সান্ধ্য উৎসবের আয়োজন চলছে।ওদিক থেকে ভেসে আসছে সুখাদ্যের ঘ্রাণ। আকাশের দিকে তাকায় অহনা,এরকম আকাশ ওর ঘরের জানলা থেকে দেখা যেত।তারায় তারায় ভরা।জানলার পাশে ছোট্ট চৌকিখাট, তার ওপরে পাতা দুখানা পাতলা কাঁথা আর একটা চাদর।সেইখান থেকেই উঠে আজ কোথায় পৌঁছে গেছে ও।কারন চিরদিন ওর লক্ষ্য ঠিক ছিল,সেদিনকেও ও আর পাঁচজনের থেকে আলাদাই ছিল।একটা নিজস্ব সত্তা তৈরী করে নিয়েছিল।

পিছন ফিরে একবার দেখে অহনা।অমিত ভিতরেই আছে।এতক্ষণ গ্লাস নিয়ে বসেছিল বারান্দায়। বলে বলে এই গেছে তৈরী হতে।ও দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে বাগানের দিকে পা বাড়ালো। আজকের এই উৎসবে ও আর অমিতই কর্তা,সুতরাং ওদের আজ দেরী করা মানায় না।তাড়াতাড়ি পা চালাতে গিয়ে শাড়ির খুঁটে কিভাবে যেন পা জড়িয়ে টান পড়ে পায়ে,হুমড়ি খেয়ে পড়ে যায় অহনা।

দ্বিতীয়পর্ব..

হাতের পত্রিকাটা উল্টেপাল্টে দেখছিল সুরুচি।শুধুমাত্র রহস্য গল্প নিয়ে একটা গোটা পত্রিকা। রহস্যের প্রতি মানুষের আকর্ষণ চিরন্তন। এই সংক্রান্ত গল্প, উপন্যাস, টিভি সিরিয়াল, সিনেমা সব কিছুই সুপার ডুপার হিট। ফ্লপ শুধু বাস্তবের গোয়েন্দারা।গল্প উপন্যাসের মতন এখানে কোন বড়ো গাড়ি চেপে মক্কেল এসে দরজায় কড়া নাড়ে না।বিনা বাক্য ব্যয়ে কেউ কোন চেক লিখে দেয় না।তাই গোয়েন্দাকেও ঘুরতে হয় নিজের রুটিরুজির তাগিদে।সুরুচিও তার ব্যতিক্রম নয়।তবে ওর সৌভাগ্য এক্ষেত্রে যে,নেশা আর পেশা ওর ক্ষেত্রে মিলে গেছে।ওর তদন্তগুলোর নিয়মিত আপডেট দিয়ে থাকে,সেই দেখেই ওর সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন ‘দরজার আড়ালে ‘ পত্রিকার সম্পাদক। ‘দরজার আড়ালের ‘ সার্কুলেশন মন্দ নয়,সুরুচি তা জানে,ওনারা প্রস্তাব দিয়েছিলেন সুরুচি যাতে ওর তদন্তের বর্ননাগুলো ফেসবুকে আগে না লিখে ওনাদের পত্রিকায় দেয়।সুরুচির তাতে আপত্তি নেই কিন্তু আসল কথা হচ্ছে ওর হাতে এখন কোন কেসই নেই।মিথ্যে বানিয়ে বানিয়ে গল্প লিখতে ওর মন চায় না।”দিদিভাই কখন থেকে তোমার ফোন বাজছে,শুনতে পাওনা?””এমা,সত্যিই শুনিনি রে।”কুসুমের হাত থেকে ফোনটা নিতে নিতে সুরুচি বলল।কুসুম ওদের বাড়ি নতুন এসেছে।আসলে মায়ের বয়স হচ্ছে,সবসময়ের জন্য একজন সাহায্যকারীর দরকার ছিল।তাই মাসি কুসুমকে এনে দিয়েছে।ফোনটা নিয়ে সুরুচি দেখল একটা অজানা নম্বরের মিসকল।কে জানে কে কোন দরকারে করেছিল?ভাবতে ভাবতে নম্বরটা ডায়াল করলো ও।অপরপ্রান্তে রিং হতে না হতেই একটি জলদ গম্ভীর কন্ঠস্বর বলল,”নমস্কার ম্যাডাম, আমি এইমাত্র আপনাকেই আবার কল করতে যাচ্ছিলাম।”সুরুচির কেমন মনে হলো, ও ওর নতুন কেসটা পেয়ে গেছে,তাই সোফায় ভাল করে নড়েচড়ে বসে বলল,”হুম,বলুন।”

অনেকদিন বাদে এইদিকে এলো সুরুচি।আগে অবশ্য অনেকবার এসেছে, ছোটবেলায়।এখানে বাবার পিসির বাড়ি। পিসিঠাকুমা মারা যাবার পর অবশ্য আর আসা হয়নি।দুপাশে দেখতে দেখতে যাচ্ছিল,না সেইভাবে কিছুই বদলায়নি জায়গাটার।তবে ইদানিং এইদিকে কয়েকটা রিসর্ট হয়েছে।খোলামেলা গ্রাম্য পরিবেশে কিছু প্রচুর পয়সাওয়ালা লোকজন আসে হুল্লোড় করতে।সেইরকমই একটা রিসর্টে যাচ্ছে এখন ও।একটা খুনের তদন্তে।আজ সকালে বারান্দায় বসে ও যখন হাতে কেস নেই বলে মনে মনে ভাবছিল, ঠিক তখনই ওর কাছে ফোনটা এসেছিল।ফোনটা করেছিল এখন ও যে রিসর্টে যাচ্ছে তারই মালিক।ওনার রিসর্টে গতকাল রাত্রে একটা মৃত্যু হয়েছে, অবশ্য সেটি খুন না আত্মহত্যা সেই সম্পর্কে উনি নিশ্চিত কিছু বলতে পারলেন না।সুরুচি জানে এটাই স্বাভাবিক। আসলে সবাই যদি সব বুঝে যায় তাহলে তো আর সুরুচির দরকারই ছিল না।ভাবতে ভাবতেই রিসর্টের বিশাল গেটের সামনে এসে দাঁড়ায় গাড়িটা।হাওড়া থেকে পাক্কা তিনঘন্টা সময় নিলো।গাড়ি থেকে নেমে চারিদিকে চোখ বুলিয়ে নিলো ও।সামনেই নদী আছে,অসংখ্য গাছগাছালিতে ঘেরা চারিদিক।কিন্তু এখন এসব না দেখলেও হবে,আগে ওকে ভেতরের অবস্থা জানতে হবে।ও তাড়াতাড়ি ভেতরে যাবার জন্যে পা চালালো। ওকে রিসর্টে ঢুকতে দেখে যেই ভদ্রলোক এগিয়ে এলেন তিনিই সম্ভবত ওকে ফোন করেছিলেন।ভদ্রলোকের বয়স চুয়ান্ন থেকে ছাপান্নর মধ্যে।ব্যাকব্রাশ করা চুল।প্রায় ছ’ফুট লম্বা। গায়ের রঙ হালকা শ্যামবর্ণ। চোখেমুখে ব্যক্তিত্বের ছাপ সুস্পষ্ট। “নমস্কার, আমিই আপনাকে ফোন করেছিলাম।”হাত তুলে প্রতি নমস্কার জানাতে জানাতে সুরুচি জিজ্ঞেস করলো”বডি কি এখনো আছে? “”হুম আছে,আসুন,আমার সঙ্গে।”এগিয়ে যেতে গিয়ে থমকে গেলেন বিনয়বাবু,ওর দিকে ফিরে বললেন, “দেখুন আমি কিন্তু পুলিশ বা অন্য কাউকে আপনার আসল পরিচয় জানাইনি, আপনি আমাদের একজন অংশীদারের আত্মীয়া,এই পরিচয় দেবো।”সুরুচি ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালো।না,ভদ্রলোকের বুদ্ধির তারিফ করতে হচ্ছে, মনে মনে ভাবলো।আসলে প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটরদের পুলিশ মোটেই ভালো চোখে না।একটু এগিয়ে যেতেই জায়গায় জায়গায় ছোটখাট জটলা চোখে পড়লো। দেখে মনে হচ্ছে সবাই রিসর্টেরই অতিথি। সুরুচির ঘটনাস্থলের দিকে হাঁটতে হাঁটতে মনে করতে লাগলো সকালবেলা ফোনে বিনয়বাবুর ফোনে জানানো ঘটনাটা।গতকাল সকালেই একটা বড় পার্টি এসে উঠেছিল ওনার রিসর্টে।পুরো রিসর্টটাই ওনারা ভাড়া নিয়েছিলেন।সন্ধেতে একটা ছোট পার্টির আয়োজন করা হয়েছিল।সেই পার্টি আরম্ভ হবার আগেই মৃত্যু হয় পার্টিহোস্টের।হুলুস্থুল বেঁধে যায় রিসর্টে,নিমেষে পরিবেশ বদলে যায়।পুলিশ আসে।যাতে রিসর্টের কোন বদনাম না হয় তাই সুরুচির শরনাপন্ন হন রিসর্টের মালিক ভদ্রলোক।পাশাপাশা অনেকগুলো কুটিরের মতন ঘর,তারই একটাতে ওকে নিয়ে ঢুকলেন বিনয়বাবু।ঘরে ঢুকেই সুরুচির চোখ গেলো বিছানায়,ওখানেই শোয়ানো আছে বডি।সাদা চাদরে ঢাকা।”ওনার নামটা কি ?”সুরুচি মৃদুস্বরে জিজ্ঞাসা করলো।”অমিত,অমিত মিত্র।” ঠিক সেই সময়েই ডেডবডির পাশে বসে থাকা মহিলার দিকে তাকিয়েই থমকে গেলো সুরুচি।আস্তে করে বিনয়বাবুকে জিজ্ঞাসা করল “আর উনি?”
বিনয়বাবু ফিসফিসিয়ে বললেন,”অমিতবাবুর স্ত্রী,অহনা মিত্র।”
ক্রমশ…