অন্তরালে (ধারাবাহিক গোয়েন্দা গল্প, চতুর্থ ও পঞ্চম পর্ব) : রুমা ব্যানার্জী।

0
487

চতুর্থ পর্ব।

শীতের ছুটি হোক বা গরমের সুরুচির পিসিঠাম্মার বাড়ী আসা চাইই চাই আর চাইবে নাই বা কেন?পিসিরঠাম্মার বাড়ী মানেই তখন অঢেল আনন্দ আহ্লাদ। সামনেই নদী।গ্রীষ্মের সময় তাতে হাঁটু জলও থাকে না।অনায়াসে পায়ে হেঁটে পারাপার করা যায় সে নদী।বালির উপর দিয়ে ছুটে ছোঁয়া যায় দিগন্তকে।সুরুচিদের শহুরে জীবনে সে যেন এক খোলা জানালা। সঙ্গে পিসিঠাম্মার হাতের এটা ওটা রান্না তো আছেই।ওদের যৌথ পরিবারে একদল ছেলেমেয়ে,সবাই মিলে হৈচৈ করে থাকার মজা সুরুচি প্রথম এখানে এসেই পেয়েছিল।
পিসিঠাম্মার নাতনি বিন্দুদির বন্ধু ছিল টুনাদি।ওরা একই কলেজে পড়তো।পিসিঠাম্মাদের বাড়ী থেকে কয়েকটা বাড়ী পড়েই থাকতো। ওদের সব আড্ডায় টুনাদির থাকা চাই, নাহলে আসর যেন জমেই না।ওরাও কতবার গেছে টুনাদিদের বাড়ী।ওদের গাছে খুব ভালো পেয়ারা হতো,তাই নিয়ে ওদের মধ্যে কাড়াকাড়ি পড়ে যেত।
দীপুদা ছিল পিসিঠাম্মার সেজো ছেলের ছোটছেলে।দীপুদা তখন কোলকাতায় থেকে কী একটা চাকরি করে।সবাই জানতো দীপুদার সঙ্গেই টুনাদির বিয়ে হবে।দীপুদা আর টুনাদিকে কতবার ও চোখে চোখে ইশারা করতে দেখেছে।কিন্তু…সেদিনটা আজকেও খুব মনে আছে সুরুচির।শীতের দুপুরে সবাইমিলে লুকোচুরি খেলছিল ওরা।সুরুচি সেদিন বারবার আগে ধরা পড়ে সবাইকে খুঁজছিল।খুঁজতে খুঁজতেই ও চলে গিয়েছিল পিসিদের গোয়ালঘরের পিছনে।সেখানেই ও প্রথম টুনাদিকে দেখেছিল অপুদার সঙ্গে।অপুদার দুটো ঠোঁট মিশে গিয়েছিল টুনাদির ঠোঁটের সঙ্গে।দুজনে দুজনকে দুটো শঙ্খ লাগা সাপের মতন করে জড়িয়ে ধরেছিল।এক মুহুর্তের জন্য থমকে গিয়েছিল সুরুচি। নারী-পুরুষের আদিম রহস্য যে ওর কাছে খুব স্পষ্ট ছিল তখন তা নয় তবে আবছা একটা ধারনা তো ছিলই।ও চুপচাপ পালিয়ে এসেছিল সেখান থেকে।মনে মনে ভেবেছিল টুনাদির সঙ্গে তো দীপুদার বিয়ের ঠিক,তহলে অপুদা কেন…অপুদা ছিল দীপুদার কাকা মানে ন’কাকার ছেলে।না সুরুচি কাউকে কিছু বলেনি।ভয় পেয়ে গিয়েছিল। শুধু সেদিনের পর টুনাদির সঙ্গে কথা বলতে গেলেই ওর কেমন একটা তাল কেটে যেত।
সেবার পিসির বাড়ী থেকে ও একটু তাড়াতাড়ি চলে এসেছিল।ওর মামার বিয়ে ছিল।তারপরের গ্রীষ্মের ছুটিতে ওরা পুরী বেড়াতে গিয়েছিল কারন শ্রাবণ মাসে তো পিসির বাড়ী যেতেই হতো, দীপুদার বিয়ে ঠিক হয়েছিল যে।তবে পাত্রী বদলে গিয়েছিল।টুনাদি নাকি এখন বিয়ে করবে না বলেছে।ও শহরে এসেছে।এখানেই থাকবে।আরো কী কী সব শুনেছিল যেন।ও তো কেউ কিছু বলেনি।বড়দের থেকে লুকিয়ে চুড়িয়ে যেটুকু শোনা যায়। সুরুচি মনে মনে ভেবেছিল টুনাদি তবে নিশ্চিত অপুদাকেই বিয়ে করবে।ওর মনের মেঘটা একটু একটু করে কাটতে শুরু করেছিল।আর ঠিক তখনই এসেছিল অপুদার মৃত্যুর খবরটা।অপুদা আত্মহত্যা করেছিল,গলায় দড়ি দিয়ে।সুরুচি চমকে গিয়েছিল।তারপর থেকেই পিসিঠাম্মাদের বাড়ীটা কেমন ছন্নছাড়া হয়ে গেলো।সুরুচিরও পড়াশোনার চাপ বাড়লো, ওদের বাড়ী যাওয়াটাই কমে গেলো।এখন তো আর পিসিঠাম্মাও বেঁচে নেই।টুনাদির আর কোন খবর পাইনি ও।ওরা নাকি সব বেচেবুচে গ্রাম ছেড়ে চলে গিয়েছিল।
সেই টুনাদিকে আজ এতবছর পর এই অবস্থায় দেখবে সুরুচি ভাবতেই পারেনি।আচ্ছা,টুনাদি কী একই আছে, না বদলে গেছে,টুনাদি জানতো অপুদার মৃত্যুর কথা।টুনাদির বরও কি টুনাদির জন্যই?ভাবতে ভাবতে সুরুচি দেখতে পেলো, বাগানের দিক থেকে একজন মহিলা ওকে হাত নেড়ে ডাকছে।শাড়ী দেখে মনে হচ্ছে এখানেরই কর্মী,সবার একই পোশাক। ও কেন ডাকছে? ও কী কিছু দেখেছে? কিছু জানে, যা সুরুচিকে বলতে চায়? সুরুচি দ্রুত পায়ে এগিয়ে যায় ঐ মহিলার দিকে।

পঞ্চম পর্ব

“দিদি আমার সঙ্গে একটু চলুন,আপনার থাকবার ঘরটা পরিষ্কার করে দিয়েছি।”
এতক্ষণে সুরুচির খেয়াল হলো, ও নিজেই বিনয়বাবুকে বলেছিল ওর থাকবার জন্য এখানে একটা ঘরের ব্যবস্থা করে দিতে।ওর ছোট্ট ব্যাগটা রিসেপশনে রাখা আছে,ও একটু হেসে মেয়েটির পিছনে পিছনে হাঁটতে শুরু করলো।
“তুমি এখানেই কাজ করো?” সুরুচি প্রশ্ন করলো।একজন গোয়েন্দার কাছে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হলো সময়,যা একটু নষ্ট করলে চলে না।
“হ্যাঁ দিদিমনি।আমি কাজ করি,আমার ঘরের মানুষটাও করে।”
“কতদিন কাজ করছো এখানে? ”
“তা সেই প্রথম দিন থেকেই আছি গো আমরা।”
“কাল সন্ধ্যায় কোথায় ছিলে, দুর্ঘটনার সময়?”
“আমি তখন হেঁশেলে ছিলুম।”
“তুমি কি এখানে রান্না করো? ”
“না গো, আমি ঘরদোর ঝাড়পোঁছ করি,সাজিয়ে গুছিয়ে রাখি।তবে কাল সেইসব সেরে আবার হেঁশেলে ঢুকতে হয়েছিল,একজন লোক কাল হেঁশেলে কম ছিল।”
কথা বলতে বলতে কখন যেন ওরা দুজনেই কটেজের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।
না, এই ঘরটি অহনা মিত্রদের ঘরের মতনই, ছিমছাম, সুন্দর, সাজানো গোছানো। রিসর্টের মেয়েটি ওর হাতে চাবি তুলে দিয়ে বলে,”আমি সামনেই আছি দিদিমনি,কিছু দরকার হলে আমায় একটু ডাকবেন।ঐ যে টেবিলের উপর ঘন্টি আছে,বাজালেই ছুটে আসবো।”
মেয়েটির হাসি মাখা মুখের দিকে তাকিয়ে সুরুচি একটু অন্যমনস্ক ভাবে ঘাড় নাড়ার, তারপর বলে,
“আচ্ছা,কাল যেজন মারা গেলেন,ওনার দেখাশোনার দায়িত্বে কে ছিল বলতে পারবে? ”
সুরুচি খেয়াল করলো, হঠাৎ করেই মেয়েটির মুখটা কেমন অন্ধকার হয়ে গেলো।তারপর একটু মাথা নীচু করে বলল,”আমিই ছিলুম।”
না, বিনয়বাবু বুদ্ধিমান লোক বলতে হবে।ঠিক লোককেই পাঠিয়েছে ওর কাছে,অবশ্য বুদ্ধি না থাকলে কি আর এমনি এমনি এতো বড় ব্যবসা সামলাচ্ছেন।মুখে এক টুকরো হাসি ফুটিয়ে ও বলল,এই দেখো,”তোমার নামটাই আমার এতক্ষণ জানা হয়নি।”
“টগর গো।”
না,আবার হাসি ফুটেছে মুখে,অন্ধকার কেটে গেছে।সুরুচি মনে মনে ভাবলো। টগরকে ওর এখন অনেক কাজে লাগবে, ওর কাছ থেকে অনেক কিছু জানার আছে,আছে অনেক কিছু শোনার….

ক্রমশ….