দরজা খুলতে খুলতে পেরিয়ে আসি একটা আস্ত জীবন।
জন্মদরজা খুললেই কোলে তুলে নেয় মা, মাটির নিবিড় আকুলতায়
বাবা এসে ছায়া ধরে মুখে ছাতার নিশ্চিন্ত নির্ভরতায়…
তারপর থেকে শুধু দরজার পর দরজা, ছোট আর বড়, বড় আর ছোট
কোনটায় জল, কোনটায় আকাশ, কোনটায় অরণ্য
আবার কোনটায় সম্পর্কের রঙিন সুতোর অবাধ আনাগোণা, উৎসুক উঁকিঝুকি
দরজাটা ঠিকঠাক খুলতে জানলেই
জলের ভেতর জীবন, জীবনের ভেতর আনন্দ, আর আনন্দের ভেতর অনন্তকে
খুঁজে নেওয়া যায় অনায়াস দক্ষতায় কত সহজেই…
অথচ গর্ভজলের নরম ঢেউ থেকে চিতাকাঠের অন্তিম অঙ্গারবিন্দু পর্যন্ত
আয়ু অন্ধকার এতটাই গভীর আর ঘন যে, প্রতিটি দরজার গায়ে
ফনফনিয়ে বেড়ে ওঠে কাঁটালতার নিশ্চিন্ত, নিরুদ্বিগ্ন সংসার…
আমরা শুধু বদ্ধ দরজার উল্টো পিঠে বসে
কাজলের ঘরে কালি জমাতে থাকি, জমাতেই থাকি নির্বিশেষে…
(কবিতা— দরজা খুলতে খুলতে…, কবি — শুভ্রাশ্রী মাইতি।)
দিনপ্রতিদিন সংসারযাপনের অজস্র ক্লান্তি, অপমান, গ্লানি, ব্যথা-বেদনার নিঃসীম ঘন অন্ধকার আমাদের দু’চোখের পাতায় জমে উঠছে কাজললতার কালির মতো একটু একটু করে। নাছোড় কালির ছিটে ক্রমাগত এসে লাগছে আমাদের হাতে, পায়ে, মুখে, শরীরের নানা অঙ্গে। রূপকথার রঙে রঙ্গীন এ জীবন তখন ঘুমন্তপুরীর রাক্ষস পরিবেষ্টত কঠিন, কঠোর কারাগার। নটে গাছটি মুড়িয়ে গেছে সেই কবেই। সোনা-রূপার আশ্চর্য জিয়নকাঠি নিশ্চল হয়ে পড়ে আছে শিয়রে। কারাগারের অনন্ত অন্ধকারের জমাট প্রবাহে শ্বাসবায়ু আর আলোর প্রচন্ড আকুতি নিয়ে তিল তিল করে মৃত্যুর পথে এগিয়ে যাচ্ছে জীবন, এগিয়ে যাচ্ছি আমরা। এ মৃত্যু যতটা না শারীরিক, তার থেকে অনেক, অনেক বেশি মানসিক এবং যন্ত্রণাময়। এই যন্ত্রণাময়, অমোঘ মৃত্যুর হাত থেকে মৃত্যুঞ্জয়ী মন্ত্রে জীবনে ফিরে আসার আকুতিও তাই অনন্ত, অসীম ও অনুভূতিময়। এ হল সৃষ্টির সেই আদিতম অনুভূতি–যে অনুভূতির জ্বলন্ত, উত্তপ্ত লাভা স্রোতে জ্বলে পুড়ে খাঁটি সোনা হয়ে জন্ম নিয়েছে এই সসগরা, শস্যশ্যামলা পৃথিবী। আর সেই মৃত্যুঞ্জয়ী মন্ত্রের আলো-অনুভূতির আশ্চর্য কথকতাই সুদক্ষ শিল্পীর হাতের সূক্ষ্মতম কাজের মতো রচনা করে গেছেন কবি শুভঙ্কর দাস তাঁর সাম্প্রতিকতম কাব্যগ্রন্থ “মৃত্যুর দরজা ঠেলে”-এর পাতায় পাতায়।
প্রবেশক কবিতাটিতেই জীবনের প্রতি গভীর মায়ায় উদাত্ত কন্ঠে বলে উঠেছেন কবি—
“জীবন কোথায় যাচ্ছিস?
বেঁচে থাকাটুকু ফেলে !
ফিরে আয়, তুই তো ফিরতে জানিস
মৃত্যুর দরজা ঠেলে ”
প্রবেশক কবিতাটিই সোনার সুতোর অচ্ছেদ্য বন্ধনে বেঁধে রেখেছে কাব্যগ্রন্হের হীরকদ্যুতিসম প্রতিটি কবিতাকে। না, কবি শুভঙ্কর তাঁর কাব্যগ্রন্হে একবারও মৃত্যুকে অস্বীকার করার কথা বলেননি, একবারও এমন কোন অলীক পৃথিবীর স্বপ্ন আমাদের দেখাননি যা শুধুমাত্র শ্বেতশুভ্র চন্দন চর্চিত সৌন্দর্যের আলোয় নির্মিত। বরং পাতায় পাতায় দক্ষ শিল্পীর মতো এঁকে গেছেন ধুলো-কাদা-অন্ধকার মাখা এমন একটা বাস্তব পৃথিবীর ছবি যেখানে—
“ শ্মশান রোজ নৃত্য পরিবেশন করে আগুনের,
আগুন ঘুমের আগে বা পরে গল্প শোনায় ক্ষুধার,
ক্ষুধা পেট, নাভি, যোনি-লিঙ্গকে পাঠ দেয় সংযমের
সংযম সন্ন্যাসীর সঙ্গে চলে গেছে গুহায়…”
অন্ধকারের রাক্ষসসম মুখব্যাদানেও কিন্তু ভয় পেয়ে কখনও সরে আসেননি কবি জীবনপথ থেকে। বরং আত্মানুসন্ধানের আশ্চর্য ভাবজ্যোতিতে জ্বালিয়ে নিয়েছেন চলার পথের আলোর বাতিটি ভালোবেসে। গলায় তুলে নিয়েছেন একতারার উদাস বাউল সুর—
“ তারপর মানুষ হয়ে জন্মানোর ইচ্ছেগুলো
কোনো এক আশ্চর্য পোয়াতি গুহায় রেখে
বেরিয়ে পড়ি পিতার সন্ধানে ! ”
অমল আলোকে পথ হেঁটে একটার পর একটা দরজা খুলতে খুলতে তিনি পৌঁছে গেছেন মৃত্যুদরজার কঠিন চৌকাঠে। বিশল্যকরণী অনুতাপ আর আত্মবীক্ষণের আগুন আলোয় পুড়ে পুড়ে সত্য আর সুন্দরের খাঁটি সোনার ঝলমলানি তখন তাঁর শরীর জুড়ে—
“এবার চৌকাঠ এগিয়ে আসুক আত্মজ্যোৎস্নার কাছে,
এমন জন্ম মায়ের গর্ভ আনমনা!
এইমাত্র যাত্রা শুরু হল, মুক্তির পায়ের কাছে আঁকা রক্তমাংসের আলপনা। ”
মৃত্যুকে তখন তিনি ভয় পান না কোনমতেই। বরং পরম নিশ্চিন্ততায় বলে ওঠেন নির্ভয়ে—
“ মৃত্যু তো গৃহপালিত।
কবর, কফিন আর আগুনের পাশে ঘাসবিচালি
চিবায়
তার দিকে চেয়ে পেট পোড়ানোর কোনো মানে নেই! ”
এবার শুধু মহামৃত্যুঞ্জয়ী মন্ত্র উচ্চারণের আশ্চর্য আকাঙ্ক্ষিত অপেক্ষা। কবি হাতে তুলে নেন তাঁর কবিতার বই, বুকের সমস্ত বেদনকে চোখের ঢেউজলে অনন্ত করে তোলেন সাদা পাতার ছত্রে ছত্রে—
“ সাদা কাগজে এত ফসল রেখে কবি
রোদ্দুরের গায়ে হাত বুলিয়ে দেন, অমলকে ডেকে নিয়ে সহযাত্রী করে
এগিয়ে দেয় জীবনের পালতোলা সমুদ্রে
এইবার মৃত্যুর কবিতাপাঠের পালা
কবি এগিয়ে আসে, নির্ভয়ে, নিমগ্ন তায়
কবি আসলে নিজেই জাতচাষা বা ঈশ্বর
তাই মৃত্যুকেও রক্তমাংসের কবিতা করে তোলে, চমৎকার ! ”
দরজা খুলে যায় হাট হয়ে। সামনেই পূজাবেদী। প্রণামের চিহ্ন দিয়ে আলপনার মতো সাজানো গৃহদ্বার। রৌদ্রভরা রোদনের আশ্চর্য সমর্পণে চৌকাঠের মাটিকে অভিষেকের চন্দনটীকা করে সম্রাটের মতো প্রবেশ করেন কবি মৃত্যুর দরজা ঠেলে জন্মের আলোকিত আহ্বানে—
“ প্রতিটি জন্ম চির-ভিখিরির মতো সারিবদ্ধ পাথর
সেই পাথরে যদি চিহ্ন পড়ে প্রণামের
বুঝে নাও, সম্রাট এসে গেছে
যে সিংহাসন নয়, অগণিত হৃদয়ের ওপর বসে আছে। ”
অথচ কবি জানেন, এখানে
“সর্বোচ্চ হিংসার ওপর সাদা শালুতে স্হাপন করা আছে সরল মন্দির
সর্বনাশী প্রতিহিংসার ওপর
নীলঢালুতে প্রতিষ্ঠিত সহজ মসজিদ,”…
এই মেকী স্বার্থসর্বস্ব জীবনে “ কেউ না কেউ ঘুম থেকে তুলে দেবেই, সে যতই নরম ফুলের বিছানা হোক না কেন! ”
শুধু তাই-ই নয়, কবি বিশ্বাস করেন জীবন মানেই অসংখ্য দরজার সমাহার… যা আমাদের খুলতে খুলতে যেতে হয় মৃত্যুর শেষ দরজাটা পর্যন্ত…
“ দরজা কাঠ দিয়ে নয়, জমাট অন্ধকার দিয়ে তৈরি
যেই খুলল, নগ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সারিবদ্ধ পূর্বপুরুষ…
কেউ আধপোড়া, কেউ ছাইভস্ম, কেউ-বা মিশরীয় মমির বঙ্গীয় সংস্করণ ! ”
তাই এই আত্মানুসন্ধান সহজ নয় মোটেই—
“ নিজের ভেতর খুব কি সহজ নিজেকে খোঁজা ! ”
না, সহজ নয়। নয় বলেই, অনুসন্ধান চলতে থাকে, চলতেই থাকে জীবনভোর যদি…
“দগ্ধ সারমেয় সময়ের চিৎকারে
নিজের সঙ্গে নিজের একটিবার হয়ে যায় দেখা।”
কিন্তু শুধু চলতে চাওয়ার ইচ্ছেটাই তো সব নয়, চাই চলার সঠিক পথও। যে পথের শেষে সমস্ত লীলাখেলা, সমস্ত অলৌকিকত্বকে নস্যাৎ করে মনপড়া বিদ্যার গভীর সহজপ্রাণতায় চৈতন্যমুদ্রায় হেসে ওঠেন শ্রীরামকৃষ্ণ যাতে গৃহজীবনের সমস্ত গোপন যুদ্ধ, ধর্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষের গোলকধাঁধা, দুঃখসুতোয় সেলাই করা নকশীকাঁথা, ‘রোদপোড়াজল’-এর মতো ভালোবাসা, হেমলকের জামবাটি ছুঁয়ে ছুঁয়ে এক ‘নরম শস্যের হাত’ বুকের গভীরে এঁকে দেয় এক আশ্চর্য ধন্বন্তরি বাতাস আর ‘নবান্নের দেশ’।
এই সঠিক পথের দিশারী হলেন একজন কবি, যিনি তাঁর কবিতায় কবিতায় দিয়ে যান সেই পথের সন্ধান যা সাধারণ মানুষের দৃষ্টিগোচর হয় না সহজে। বিশিষ্ট কবি, প্রাবন্ধিক ও আলোচক সুজিত সরকারের মতে, একজন কবি হলেন ভবিষ্যৎ-দ্রষ্টা বা ‘Seer’। আলোচ্য কাব্যগ্রন্হটিতে কবি শুভঙ্কর যেন সেই seer-এর মতোই আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন এক একটা পথের আশ্চর্য সব রূপরেখা—
“ জন্মের মতো আশ্চর্য ক্রিয়াপদ আর হয় না !
অনেক অনেক দূরের মহাশূন্য, হাতের কাছে তাই মাতৃগর্ভ
এক পৃথিবীর ভেতর সহস্রলক্ষ পৃথিবী ঘুরছে
জলে, অন্ধকারে এবং স্নায়ুস্নিগ্ধ শিকড়ে ! ”
( কবিতা— জন্মের মতো আশ্চর্য ক্রিয়াপদ)
বা,
“পিতামাতার চক্রাকার দাগে
একটি পাথর মূর্তি, একটি জায়গার মাটি তীর্থ, একটি কথা মন্ত্র আর
নিজেই মায়া, হেসে ঈশ্বর হয়ে ওঠে
শুধু আর একটা জন্মের আশ্চর্য অনুরাগে। ”
( কবিতা–শস্যক্ষেত্রে নেমে আসে শরীর)
বা,
“ আগম চাই না মা, আশ্রয় চাই।
সুখ চাই না মা, সহজপ্রাণতা চাই।
সম্পদ চাই না মা, সাহস চাই
চরণে স্পর্শফুল রাখার।”
( কবিতা– দুঃখের দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে)
বা,
“ সিংহাসনে বসলেই হাতলে ধ্বনিত হবে
উঠে যেতে হবে একদিন…
তার চেয়ে মাটিতে বসা ভালো
মিশে যাওয়ার আগে পর্যন্ত গাছ হওয়ার
একটা সুবর্ণ সুযোগ থাকে…”
(কবিতা— কাঠের হোক বা সোনার)
কারণ কবি জানেন, কারো কাছে হাত পাতার ভেতর লুকিয়ে নেই কোন সমাধান কারণ “সমগ্র ব্রহ্মান্ড একটি ভিক্ষার মুদ্রায় জেগে আছে অনন্তকাল” যেখানে “ লীলাখেলার ভেতর ধর্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষ/ পড়ে আছে মরিচা পড়া তলোয়ারের মতো…”, যেখানে মৃত্যুর আগে বার বার মৃত্যু এসে কড়া নেড়ে যায় দরজায়। তাহলে কার কাছে আছে সমাধান? তখনই আমাদের হাত ধরতে হয় কবির…কান্নায় আর কাতরতায়, বিশ্বাসে আর বন্ধুত্বের, সমর্পণ আর সত্যে। কারণ কবিই জানেন কিভাবে রক্তমাংসের শরীরকে প্রতিমা করে গড়ে তোলা যায় ঈশ্বরীয় অবয়ব।
গ্রীক দার্শনিক অ্যারিস্টটল বলেছেন, “ The business of a poet is to tell, not what has happened, but what could happen, and what is possible, either from its probability or from its necessary connection with what has gone before.”
দক্ষ দূরদর্শী মতো একজন সৎ কবিই পারেন আমাদের সেই নতুন দৃষ্টি, নতুন পথের সন্ধান দিতে। কারণ তাঁর কবিতার পংক্তিতে পংক্তিতে বেজে ওঠে অভিজ্ঞতার সারাৎসার, অনুভূতির বিকিরণ আর আলোর বিচ্ছুরণ। আর বিশিষ্ট কবি পবিত্র মুখোপাধ্যায়ের মতে তা একমাত্র সম্ভব “ নিরন্তর শব্দ-মন্হন, শব্দের বহুকৌণিক দ্যুতি উন্মোচন ও শব্দের দ্বারা চৈতন্যের জ্যা আরোপনের মাধ্যমে।”
এই কাজটি কবি শুভঙ্কর খুব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেছেন তাঁর কাব্যগ্রন্হের অধিকাংশ কবিতার মধ্যে। তাই শব্দ নয়, শব্দকে পেরিয়ে এক অনন্য শব্দাতীত অনুভূতিতে আচ্ছন্ন হয়ে যায় পাঠকের মন যখন অন্তরআলোতে বলে ওঠেন কবি–
“ কবি জন্মভিখিরি, অনুভবের ঘরে ঘরে সকাতর ভিক্ষে
করে আনে একমুঠো খুদকুঁড়ো “…
“…যদি বানাতে পারে অফুরন্ত এক শস্যগোলা
ঘরের ভেতর ঘরে
আমার সব খিদে মিটে যেত
জন্ম-জন্মান্তরে…”
শব্দের সীমানা অতিক্রম করে এরকম অসাধারণ ব্যঞ্জনার ব্যবহারে আলো হয়ে আছে এই কাব্যগ্রন্হের বেশ কিছু কবিতা…পড়লে যেন আলো এসে স্পর্শ করে হৃদয়। অনুভূতির কাছে মাথা নত করে বসতে হয় কিছু সময়।
কবি শুভঙ্করের কবিতার আর একটি উল্লেখযোগ্য দিক হল, তাঁর চিত্রকল্প নামক তুলিটি ব্যবহারের অসামান্য দক্ষতার কথা… যার হালকা টানে মগ্ন চিত্রকরের মতো সাদা পাতার উন্মুক্ত ক্যানভাসে তিনি একের পর এক এঁকে চলেন জীবন্ত, প্রাণবন্ত সব ছবি। আর আমরা, পাঠকেরা মুগ্ধ বিস্ময়ে ছবিগুলি দেখতে দেখতে প্রবেশ করি কবির মনোজগতে। উদাহরণ হিসেবে দু-একটি তুলে ধরার লোভ সম্বরণ করা গেল না কিছুতেই—
“ শ্মশানে সন্ধ্যা নামে বিড়ালের পায়ের
থাবার মতো
নরম অথচ নখর!”
বা,
“ মেঘেদের এখন কাঁখে করে
জল আনার সময়
শিশুঘাসেরা খেলা ফেলে তাই দেখছে
এক আকাশ, দিগন্তে লুটিয়ে গেছে সোনার আঁচল…”
চরণগুলি পড়ার সময় পাঠক শুধু ছবিটাকেই
পাচ্ছেন না, তার সাথেই পেয়ে যাচ্ছেন কবির ভাব জগতে প্রবেশের এক আশ্চর্য ছাড়পত্র। এই জন্যই “ ইমেজিস্ট পোয়েট্রি” সংকলন সম্পাদক পিটার জোনস চিত্রকল্প প্রসঙ্গে বলেছেন, “ It is not merely description, but evocation…There is however a strong sense of the abstract caught within the concrete.”
আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যেখানে আলোকপাত না করলেই নয়, তা হল চরণসিদ্ধ পংক্তির অনন্য ব্যবহার। শব্দ, প্রতীক, চিত্রকল্প যত অসাধারণই হোক না কেন, দর্শন না থাকলে সে কবিতার স্থায়িত্ব থাকে না। মহৎ কবিতায় দর্শন থাকবেই, তা প্রচ্ছন্নভাবে হলেও। যিনি মহৎ কবি, তিনি দার্শনিকও বটে। ভিক্টর হুগো বলেছিলেন, সেই কবিতাই প্রকৃত কবিতা, যার মধ্যে আছে Immensite বা বৃহতের ভাব। ‘মৃত্যুর দরজা ঠেলে’ কাব্যগ্রন্হটির বেশ কিছু কবিতায় এরকম হীরকদ্যুতিসম চরণসিদ্ধ পংক্তির সন্ধান মেলে, যা কালের অনন্ত প্রবাহে কাব্যগ্রন্হটির অসাধারণ সন্তরণ সম্বন্ধে আশাবাদী করে তোলে আমাদের। এরকম কয়েকটি চরণসিদ্ধ পংক্তি হল—-
১) আয়ু আসলে কিছুই নয়, শুধু মুহূর্ত আবিষ্কার !
২) আমাদের অমরত্ব নেই, আয়োডিন আছে !
৩) ঈশ্বর আর জাতচাষার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই।
৪) প্রতিটি শব্দের মতো প্রতিটি গাছের জন্মদাতা আসলে কবি…ইত্যাদি…।
কাব্যগ্রন্হটির আর একটি বিশেষত্ব হল, প্রতিটি কবিতার নামকরণেই কবিতার প্রথম লাইনের বুদ্ধিদীপ্ত ব্যবহার। নতুন শব্দপ্রয়োগ, অসাধারণ শব্দ বন্ধের ব্যবহার, চোখ জুড়ানো চিত্রকল্প, গভীর ভাব-দর্শন, গদ্য-ছন্দ-অলংকার, যতির সুপ্রয়োগ ছাড়াও যে অমূল্য জিনিসটি মাখন মায়ার মতো ঘিরে আছে কবিতাগুলিকে তা হল কবির তীক্ষ্ণ বাস্তববাদ ও অসাধারণ মানবপ্রেম। যে মানবপ্রেমের হাত ধরে তাঁর কবিতায় রাম ও রহিম এক হয়ে যায় সাদা ভাতের মায়ের বীজধান আঁচলে, ঈদের একফালি চাঁদ সুগোল রূপোর থালা হয়ে ওঠে কোজাগরীতে, উপেন রাজপথের পীচ খুঁড়ে লাগিয়ে চলে স্নেহ আমের আশ্চর্য বাগান, গফুর দুধ দুয়ে আনে অনাথ হিন্দু সন্তানদের খাওয়াবে বলে, হেমলকের জামবাটি হাতে সার সার দাঁড়িয়ে পড়ে সত্যের আলোয় উজ্জ্বল হয়ে ওঠা মুখগুলো, মইদুল গড়গড় করে মুখস্হ বলে যায় হিন্দু রাজার পার্ট ভালোবেসে আর শরৎচন্দ্রের পাশে বসে ভালোবাসার কাদামাটি মেখে ঈশ্বর গড়া শিখে নেন প্রেমচাঁদ। কবি শেষপর্যন্ত স্হির বিশ্বাস রাখেন প্রেমে, সম্পর্কে… কারণ তিনি জানেন, তাঁর ভয় পাওয়ার কিছু নেই—–পর্দা উঠলেই…
“ ভেতরে গর্ভবতী মাতা
যাকে কোন ঈশ্বর নির্মাণ করেনি!
কোনো শয়তান ভয় দেখাতে পারে না!
শিকারের পাথুরে অস্ত্র ফেলে পিতা
গুহার বাইরে পায়চারি করছে
যাকে কোন হিংস্র পশু ভয় দেখাতে পারে না!
যাকে কোন অপ্সরাও প্রলুব্ধ করতে পারে না! ”
পরিশেষে, যে কথাটি বলা যায়, মৃত্যুচেতনা নিয়ে বাংলা সাহিত্যে বা কাব্যে নানাভাবে আলোচনা কিছু কম হয়নি। মহাকবি কালিদাস থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ এবং আরও বহু কবির কলমে মনুষ্যজীবনের সবচেয়ে দুরূহ, সবচেয়ে অভূতপূর্ব এই কাজটি উঠে এসেছে নানা রূপকে, নানা চিত্রকল্পে। কবি শুভঙ্করের আলোচ্য কাব্যগ্রন্হটি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মৃত্যুকে সামনে রেখে পরম মমতায় জীবনকে অনুসন্ধান করে গেছে মেঘ-রোদ-জলে, আলোতে-আঁধারে, সুখে-দুঃখে, সমর্পণে-সংঘাতে। কারণ কবি বিশ্বাস করেন, ফুলের গন্ধ হৃদয় ছুঁলে, মেঘে মেঘে জল ঝরে টুপটাপ, সকল নদী ও নৌকা এক হয়ে যায় পারাপারে—
“ রক্তের ভেতর বাঁশি, বাঁশির ভেতর অরণ্য, অরণ্যের ভেতর পাতা
পাতার ভেতর গৃহ থাকে একা !
জন্মেছ রক্তমাংসে আবার,
তাই তো এতো আলো আত্মজীবনী হয়ে লেখা।”
দি সী বুক এজেন্সী কর্তৃক প্রকাশিত বইটি দেবাশিস সাহার সুন্দর প্রচ্ছদ, ছোট্ট সূচনা কবিতা, ছাপান্নটি মূল কবিতা এবং প্রচ্ছদপটের শেষ দুটি কবিতা পর্যন্ত হৃদয়ের অকৃত্রিম আবেগে হয়ে উঠেছে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ মৃত্যুঞ্জয়ী পদাবলী, কবিতার… যেখানে সত্যিই নাভিমূল থেকে উচ্চারিত হয়ে ওঠে অমোঘ কবিকন্ঠ—
“বেঁচে থাকি বা না থাকি
কিসের এত আক্ষেপ, কিসের এত শোক !
একটা গোটা দিন, সত্যিকারের কবিতার হোক।”
কবি শুভঙ্করের একটা গোটা দিন শুধু নয়, একটা গোটা জীবন কবিতার হয়ে উঠুক…এই কামনাই থাকল।
____________________________________________
মৃত্যুর দরজা ঠেলে। শুভঙ্কর দাস। দি সী বুক এজেন্সী। মূল্য–৮০ টাকা।