আমার চোখে সাদামাটা কবি শঙ্খ ঘোষ – প্রয়াণ দিবসে শ্রদ্ধার্ঘ্য : দিলীপ রায় (+৯১ ৯৪৩৩৪৬২৮৫৪)।

0
591

বটবৃক্ষ বললে ভুল হবে, কবি শঙ্খ ছিলেন মহা বটবৃক্ষ । বাংলা সাহিত্যের নিরিখে মহা বটবৃক্ষ । সাদামাটা ধবধবে ধুতি-পাঞ্জাবি পরিহিত পিতৃসম কবি শঙ্খ ঘোষকে আমরা হারালাম । তিনি ছিলেন বাংলা সাহিত্যে অন্যতম নক্ষত্রতম । বাংলা ভাষার ধারক ও বাহক । মিতবাক, নম্র, উঁচু মাপের এক বাঙালি, বড় মাপের কবি, সাহিত্যিক, রবীন্দ্র ভাবুক, প্রাবন্ধিক ও বিশিষ্ট রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ । নিঃস্ব হল কবিতার জগত তথা সাহিত্যের জগত । রবীন্দ্রনাথের উপর তাঁর বিশ্লেষণমূলক সৃষ্টি “কালের মাত্রা ও রবীন্দ্র নাটক” (১৯৬৯) অনন্যতার জন্য আজও পাঠক মহলে অবিস্মরণীয় । তাছাড়া “এ আমির আবরণ”, “ওকাম্পোর রবীন্দ্রনাথ”, ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য গবেষণা গ্রন্থগুলি পাঠক সমাজে আজও উজ্জ্বীবিত । বিশ্লেষষণমূলক গ্রন্থ “নির্বাচিত প্রবন্ধ — রবীন্দ্রনাথ” (২০১৮) এবং “ হে মহাজীবন – রবীন্দ্রনাথ” (২০১৬) পাঠক মহলে ভীষণভাবে সমাদৃত । ছিলেন বাংলা সাহিত্যের স্তম্ভ ও রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ কবি শঙ্খ ঘোষ । তিনি শুধু কিংবদন্তি কবি নন, তিনি আসলে আমাদের হৃদয়ের কবি । তাঁর পঙ্‌ক্তিটি এখানে প্রনিধানযোগ্য “আজ আর কেউ নেই / মাঝে মাঝে কার কাছে যাব” ।


আমার লেখা দশটি উপন্যাস নিয়ে একটি গ্রন্থ, নাম “নারী জাগরণের দশটি উপন্যাস” । চাকরি জীবন থেকে অবসর গ্রহণের পর বইটি নিয়ে যখন তাঁর হাতে তুলে দিতে গেলাম, তিনি আন্তরিকতার সঙ্গে গ্রন্থটি নিয়ে মনোযোগ দিয়ে অনেক সময় ধরে পড়লেন এবং তারপর আমার পিঠ চাপড়ে বললেন, “তোমার হাত আগের চেয়ে এখন অনেক বেশী শক্ত । লিখে যাও, ফল মিলবেই” (সাক্ষাৎকারের ছবিটি সঙ্গে দিলাম) । সেই সময় অসুস্থতার কারণে তিনি খুব আস্তে আস্তে কথা বলতেন । আমার মতো ক্ষুদ্র কথা সাহিত্যিকের কাছে এটা একটা পরম প্রাপ্তি । আরও একটা ঘটনার কথা উল্লেখ না করে পারলাম না । ২০১৯’এর শেষের দিকে আমন্ত্রিত অতিথি হিসাবে ঢাকায় থাকাকালীন বাংলাদেশের কিংবদন্তী কবি এবং একুশের পদক জয়ী কবি অসীম সাহা (বাংলাদেশে এমনকি এদেশেও কবি অসীম সাহা নামে খ্যাত ও জনপ্রিয়) তাঁর নিজস্ব সাহিত্য পত্রিকা “চিরদিন “ কবি শঙ্খ ঘোষকে পৌঁছে দেওয়ার জন্য আমাকে একটা দায়িত্ব দিয়েছিলেন । আমি সেটা কবি শঙ্খ ঘোষের হাতে পৌঁছে দেওয়ার সময় তিনি আমার লেখার খোঁজ খবর নিচ্ছিলেন । এতটাই তিনি আমাকে ভালবাসতেন । এহেন উঁচু মাপের কবিকে হারিয়ে এই মুহূর্তে আমি অভিভাবকহীন হলাম ।


যতোদূর জানা যায় ১৯৪৯ সাল থেকে তাঁর কবিতা ও গদ্য রচনা লেখা শুরু এবং সেটা আমৃত্যুকাল । তবে লেখালেখির শুরুটার সাল নিয়ে মতভেদ রয়েছে । কিছু বিদগ্ধজনের মতে তাঁর সাহিত্যজীবন শুরু ১৯৫৩ সাল থেকে । যেটাই হোক, কবিতার জগতে শঙ্খ ঘোষের অবদান অপরিসীম । “দিনগুলি রাতগুলি” তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ (১৯৫৬) । তারপর ১১ বছর বিরতির পর “এখন সময় নয়” (১৯৬৭) । তারপর তাঁর অনবদ্য সৃষ্টির কিছু নাম উল্লেখ করছি … “মূর্খ বড় সামাজিক নয়” (১৯৭৪), “পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ” (১৯৮০), “প্রহর জোড়া ত্রিতাল” (১৯৮২), “মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে” (১৯৮৪), “লাইনেই ছিলাম বাবা” (১৯৯৩), “জলই পাষাণ হয়ে আছে” (২০০৪), “হাসি খুশি মুখে সর্বনাশ” (২০১১), “শুনি নীরব চিৎকার” (২০১৫) ইত্যাদি । গদ্যগুলির মধ্যে অন্যতম “নির্মাণ আর সৃষ্টি” (১৯৮২), “কবিতার মুহূর্ত” (১৯৮৭), “বইয়ের ঘর” (১৯৯৬), “এই শহর রাখাল” (২০০০), “বট পুকুরের ফেনা” (২০১১), বাড়াতে যাবার সিঁড়ি” (২০১৬), “লেখা যখন হয় না” (২০১৯), ইত্যাদি । তিনি অনুবাদেও ছিলেন সিদ্ধহস্ত । অনুবাদ করেছেন নিকোলাস গিয়েনের কবিতা ।
কবি শঙ্খ ঘোষের জন্ম ১৯৩২ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারি । অভিবক্ত বাংলার চাঁদপুরে । বড় হয়ে ওঠা পাবনায় । আসল নাম চিত্তপ্রিয় ঘোষ । ১৯৫১ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক । ১৯৫৪ সালে সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি । বৃত্তি হিসাবে গ্রহণ করেন অধ্যাপনাকেই । পড়িয়েছেন কলকাতার বঙ্গবাসী কলেজ, সিটি কলেজ এবং যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে । ১৯৬৭ সালে আমেরিকার আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক লেখক কর্মশালায় যোগ দেন । পরে পড়িয়েছেন দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে, সিমলার ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব অ্যাডভান্সড স্টাডিজ এবং বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে ।
কবি শঙ্খ ঘোষ বহু পুরস্কারে সম্মানিত । দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সাহিত্য সম্মান “সাহিত্য অকাদেমি” পুরস্কার পেয়েছেন দুইবার । ১৯৭৭ সালে “বাবরের প্রার্থনা” কাব্যগ্রন্থের জন্য প্রথমবার ও ১৯৮৯ সালে কন্নড় নাটকের বাংলায় অনুবাদ “রক্তকল্যাণ”-এর জন্য দ্বিতীয়বার সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার । বিশ্বভারতী ১৯৯৯ সালে তাঁকে “দেশিকোত্তম” উপাধিতে ভূষিত করেন । ২০১১ সালে সম্মানিত হন “পদ্মভূষণ”-এ । ২০১৬ সালে তিনি দেশের সর্বোচ্চ সাহিত্য সম্মান “জ্ঞানপীঠ পুরস্কার” অর্জন করেন । এছাড়া পেয়েছেন “রবীন্দ্র পুরস্কার”, সরস্বতী সম্মান”, “নরসিংহ দাস পুরস্কার”, “কবীর সম্মান” ইত্যাদি । এইসব পুরস্কার ও খ্যাতি কবি শঙ্খ ঘোষের লেখার পথচলায় তাঁকে ছুঁতে পারেনি । তিনি তাঁর নিজস্ব ঢঙে সৃষ্টির জগতে নিমজ্জিত থেকেছেন ।
কবির খ্যাতিও ওপার বাংলায় সমানভাবে সমাদৃত । বাংলা ভাষাসত্তার উপর তাঁর যে আবেগ, ভালবাসা পাঠককূলকে যথেষ্ট নাড়া দেয় । কবিতার পাশাপাশি তাঁর বিশ্লেষণমূলক সাহিত্য সৃষ্টি পাঠককূলকে খোরাক জোগায় । নাট্য ও শিল্পকলার সাথে কবি শঙ্খ ঘোষের সংখ্যতা ছিলো অবিসংবাদিত । তিনি নাটক ভালবাসতেন । তার বাংলা সংস্কৃতির প্রতি টান, আজও অমলিন । তাঁর বিরামহীন একের পর এক রচনা বাংলা সাহিত্যের ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করে গেছে । শুধুমাত্র বর্তমান প্রজন্ম নয় ভবিষ্যতের প্রজন্মেও তিনি থাকবেন মননে, চিন্তনে অবিস্মরণীয় হয়ে । তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করি । তাঁকে আমার শতকোটি প্রণাম ।
——————০——————–
এ১০এক্স/৩৪, কল্যাণী-৭৪১২৩৫ (ভারত)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here