আনাড়ি মহিলার উচ্ছৃঙ্খলতা (ধারাবাহিক উপন্যাস, দ্বিতীয় পর্ব) : দিলীপ রায় (+৯১ ৯৪৩৩৪৬২৮৫৪)।

0
605

ভারতের মাটিতে পা ফেলে একদিকে যেমন ইতাস ও ইমলির স্বস্তির নিঃশ্বাস, তেমনি অন্যদিকে বাঁচার নিরিখে তাদের চোখে সর্ষে ফুল ।
এই মুহূর্তে তাদের মনের ভিতরে দেশের মানুষের দ্বারা আক্রান্তের আতঙ্কের অবসান । বিভীষিকাময় জীবনের মুক্তি । দেশের আপনজন মানুষদের উৎপীড়ন থেকে রেহাই । ইতাস ও ইমলির জীবনে আতঙ্কের দুশ্চিন্তাগুলির অন্যতম যেমন, “ইতাস ও ইমলিকে দেশ থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার জন্য সুযোগ সন্ধানী মানুষের রক্তচক্ষু । কতিপয় হিন্দুবিদ্বেষী দেশবাসীর উগ্র আস্ফালন ! হিন্দুদের বিরূদ্ধে তাদের ন্যক্কারজনক আতঙ্কের বাতাবরণ । দুর্বৃত্তদের ন্যক্কারজনক হিন্দুবিদ্বেষী কার্যকলাপের জন্য ভয়ংকর দৃশ্যের অবতারণা । রাতের অন্ধকারে সুযোগ সন্ধানী কতিপয় রূঢ় মানুষের নিধন যজ্ঞ । কর্তব্যরত পুলিশ কর্তব্যের দোহাই দিয়ে শরণার্থীদের কাছ থেকে তাঁদের লুঠপাট অভিযান । ইচ্ছা করে মা-বোনদের শ্লীলতাহানি । স্বামীর কাছ থেকে তার স্ত্রীকে ছিনিয়ে নিয়ে বেপাত্তা” । তাদের দুজনের আরও অভিজ্ঞতা, “বয়স্ক মানুষেরা নিঃস্ব হয়ে দিশেহারা । ঘর নেই, বাড়ি নেই, সন্তানাদি নিখোঁজ, আত্মীয় পরিজন ছন্নছাড়া, স্বজন হারা বয়স্ক মানুষেরা আকাশের দিকে তাকিয়ে অনিশ্চয়তার অন্ধকারে নিমজ্জিত” । একরাশ বিভীষিকাপূর্ণ দুশ্চিন্তার যবনিকা ঘটিয়ে ভারতে প্রবেশ করে ইতাস ও ইমলি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে মানসিকভাবে অনেক চাঙ্গা ।
তারা পালিয়ে বেঁচেছে । কিন্তু ইতিপূর্বে ভারত সম্বন্ধে তারা কিছুই খোঁজ খবর নেয়নি বা খোঁজ খবর নেওয়ার অবকাশ পায়নি । কোথায় গেলে মাথা গোঁজার ঠাঁই । অন্যান্য শরণার্থীরা বাঁচার আশায় কোথায় আশ্রয় নিচ্ছে সে সম্বন্ধেও তাদের কাছে কোনো আগাম খবর নেই । নিঃসম্বল অবস্থায় দুটি প্রাণী । কী করবে ঠাহর করতে পারছে না । ভোরের সূর্যাকাশের নীচে তারা প্রাণভরে শ্বাস প্রশ্বাসটুকু নিচ্ছে মাত্র । কিন্তু তাদের অতঃপর কী করণীয় সে ব্যাপারে তারা ধন্দে !
এমন সময় “মাতলা” মাথায় কাস্তে হাতে খাদির জামা গায়ে একজন মধ্য বয়স্ক চাষি সম্ভবত চাষের জমিতে কাজ করতে যাচ্ছেন । তাঁকে দেখামাত্র ইমলি ছুটে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলো, “এইদিকে কোনো রেল স্টেশন আছে কী” ? চাষের জমিতে যাওয়া মানুষটি বুঝতে পারলেন, “এরা ওপার থেকে তাড়া খেয়ে এপারে এসেছে” । তাই তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনারা দলে কতোজন আছেন” ?
আমি ও আমার স্বামী ।
তাহলে শিগ্‌গির এখান থেকে পালান । নতুবা এপারের বর্ডারের পুলিশ এসে আপনাদের তুলে নিয়ে অযথা হয়রানি করবেন । সোজা গেলে গাংনাপুর রেল স্টেশন । সেখান থেকে ট্রেনে আপনাদের প্রয়োজনীয় জায়গায় যেতে পারবেন ।
“আমরা কোথায় যাবো, কিভাবে বাঁচবো, কি খাবো, সবটাই ঈশ্বর জানেন” । ইতাস তাঁকে অবহিত করলো ।
নিশ্চয় আপনাদের কোনো খাবার জোটেনি ?
না, আমরা তিনদিন না খাওয়া ।
চাষের জমিতে যাওয়ার মানুষটির হাতের পুটুলিটি দিয়ে বললেন, “এতে পান্তা ভাত রয়েছে । আমার একার খাওয়ার মতো । আপনারা ঐ ঝোপের আড়ালে বসে খেয়ে এখান থেকে পালিয়ে যান । নতুবা বর্ডার পুলিশের খপ্পরে পড়লে মহা বিপদে পড়ে যাবেন । অহেতুক জেল খাটবেন”।
ইতাস ও ইমলি পান্তা ভাতটুকু পরম তৃপ্তিতে খেয়ে ভীষণ তৃপ্ত । এহেন ভারতের মানুষের আন্তরিকতায় ইতাস ও ইমলির চোখে খুশীতে জল । তারপর অনেক কসরত করে তারা বিকেলে গাংনাপুর স্টেশনে এসে পৌঁছালো । রানাঘাট ও বনগাঁ রেল লাইনের মাঝখানে ছোট একটা স্টেশন, গাংনাপুর । প্লাটফর্মের বেঞ্চের উপর দুজনে বসে ভয়ার্ত চোখে এদিক-সেদিক তাকাতে থাকলো । নতুন জায়গা । পথ ঘাট নতুন । তাদের চোখে মুখে অচেনা অজানা আতঙ্কের ভয়ার্ত ছবি সুস্পষ্ট । ট্রেনের প্যাসেঞ্জারেরা কৌতুহলি দৃষ্টিতে ইতাস ও ইমলির দিকে তাকাচ্ছেন । প্যাসেঞ্জারদের অনুমান এরা ওপারের তাড়া খাওয়া মানুষ । কী দুর্ভোগ বেচারাদের ! অনেকে আবার তাদের পাশে কৌতুহলি দৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে আপশোশ করছেন, “এইসব তাড়া খাওয়া মানুষ এখানে বাঁচবে কিভাবে” ? আবার কিছু রেল যাত্রী তাদের জড়োসড়ো হয়ে বসে থাকতে দেখে, সন্দেহের চোখে উল্টাপাল্টা ভাবছেন । কতিপয় রেল যাত্রীসাধারণ বাঁকা চোখে ইমলির দিকে তাকাচ্ছেন । প্যাসেঞ্জারদের তাকানোর প্রেক্ষাপটে ইতাস হতাশ ! হতাশভাবে ইতাস ভাবছে, রাত্রির অন্ধকারে ইমলিকে নিয়ে কী বিপদ অপেক্ষা করে আছে কে জানে ? কিন্তু হতাশ হলে কী হবে, তাদের তো অন্যত্র মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই । ইতাস ইমলির দিকে তাকিয়ে দেখে, তার চোখে জল । ইতাসের চিন্তা ইমলিকে নিয়ে । সুন্দরী মহিলা । তার উপর সে কোনোদিন কোনোভাবে এত ধকল সহ্য করেনি । সারা জীবন আদরে আদরে মানুষ । বাবার নয়নের মণি ছিলো ইমলি । বড়দা ও ছোড়দার একমাত্র আদরের বোন । সেই ইমলি এখন মনোকষ্টে বিষম কাহিল । কোনো কারণে অসুস্থ হয়ে গেলে খুব বিপদ । এভাবে না খাওয়া অবস্থায় তার কোনোদিনও কাটেনি । বাড়ির বড় আদরের ইমলি এখন ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার প্রকট অন্ধকারে নিমজ্জিতা ।
রাত্রির শেষ ট্রেন চলে যাওয়ার পর অবাঙালি স্টেশন মাস্টার ভাঙ্গা বাংলায় ইতাসকে এসে বললেন, “আপনারা বাড়ি ফিরে যান । প্লাটফর্মের জায়গাটা নিরাপদ নয় । উটকো লোকের আনাগোনা রাত বাড়লে বাড়ে । ফলে রাত্রির অন্ধকারে আপনাদের বিপদ হতে পারে । আমিও কোয়ার্টারে গিয়ে ঘুমাবো । রাত্রিতে আর ট্রেন নেই । ভোরবেলায় আমার অন্য সহকর্মী এসে দায়িত্ব বুঝে নেবেন । আর তাছাড়া সকালে আমি অফিসের কাজে অন্যত্র যাবো । তাই অনুরোধ করছি, আপনারা বাড়ি ফিরে যান । নিশ্চয় বাড়িতে গন্ডগোল করে স্টেশনের প্লাটফর্মে মন খারাপ করে দুজন স্বামী-স্ত্রী একত্রে বসে রয়েছেন । বাড়ির লোকজনও আপনাদের জন্য উদ্বিগ্ন ? প্লীজ বাড়ি ফিরে যান” ।
স্টেশন মাস্টারের দিকে খানিকক্ষণ ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো ইতাস ও ইমলি । তারপর দুজনের চোখে জল । দুজনে এক সঙ্গে ডুকরে ডুকরে কেঁদে উঠলো ।
স্টেশন মাস্টার বিরক্তি প্রকাশ করে ধমকের সুরে বললেন, “আপনাদের ভদ্র ভাষায় অনুরোধ করলাম সেটা শুনছেন না । এদিকে নিজের স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছেন, অথচ বাড়ি ফেরার নাম করছেন না । প্লীজ আমাকে আপনাদের বাড়ির ঠিকানা দিন, আমার মোটর বাইকে আপনাদের বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসছি” ।
এবার ইমলির ভয়ানক কান্না ! সব হারানোর কান্না । ইতাস স্টেশন মাস্টারের পা জড়িয়ে ধরে বললো, “স্যার, দেশ থেকে, ভিটেমাটি থেকে সেই দেশের দুর্বৃত্তরা আমাদের চিরদিনের জন্য তাড়িয়ে দিয়েছে । আমাদের ফিরে যাওয়ার উপায় নেই । আমাদের ফিরে যাওয়ার সমস্ত রাস্তা বন্ধ” ।
ছোটনাগপুর ডিভিশনের হাজারিবাগের বাসিন্দা স্টিফেন সাহেব । খ্রিস্টান মানুষ । তিনি সদ্য রেলে সহকারি স্টেশন মাস্টারের চাকরি পেয়ে গাংনাপুরে পোস্টিং । কয়েকদিন থেকে কলকাতা থেকে প্রকাশিত ইংরেজি দৈনিকে ওপার বাংলার হিন্দু মানুষদের দুর্দশার কথা তিনি জানতে পেরেছেন । জন্ম জন্মান্তরের নিজের দেশ এবং সেই দেশ থেকে হিন্দু মানুষদের গরু খেদানোর মতো তাড়িয়ে দিচ্ছে । জঘন্যতম নিধনকার্যে একশ্রেণীর উগ্র মানুষ মহানন্দে আত্মহারা । হিন্দুদের তাড়িয়ে তাদের সম্পত্তি দখল নিতে মরিয়া । তারই ফলশ্রুতির নিকৃষ্টতম উদাহরণ এই অল্প বয়সের স্বামী-স্ত্রী । অল্প বয়সের স্টেশন মাস্টার, স্টিফেন সাহেব ব্যাপারটা বোঝার পর কিছুক্ষণ চুপ রইলেন । বুঝতে পারলেন তারা সব হারিয়ে এখন নিঃস্ব । স্বাভাবিকভাবেই তাদের অমানবিক দুর্দশার কথা ভেবে তাঁর হৃদয় বেদনায় নাড়া দিয়ে উঠলো । তিনি রুমাল দিয়ে তাঁর চোখ দুটি মুঁছলেন ।
রাত্রি দুপুর । পাশেই তার রেল কোয়ার্টার । স্টিফেন সাহেব সেখানে একা থাকেন । তাই করজোড়ে ইতাসকে অনুরোধ করলেন, “আপনারা আজকের রাত্রিতে আমার কোয়ার্টারে কাটান । সকাল বেলায় নিজ গন্তব্যে চলে যাবেন, কেননা ভোর বেলায় তাঁকে ভুবনেশ্বর ছুটতে হবে । সেখানে সাত দিনের ট্রেনিং । সুতরাং আজকের রাতটা আমার কোয়ার্টারে কাটিয়ে দিন । নতুবা রাত্রিবেলায় প্লাটফর্মে থাকাটা বিপদের সম্ভাবনা” ।
তারপর রাত্রিতে স্টিফেন সাহেব ও ইতাস, দুজনে মিলে গ্যাসের উনুন জ্বালিয়ে খিচুরি রান্না করলো । ইমলি পেট পুরে খিচুড়ি খেয়ে ভীষণ তৃপ্ত । তাই স্টিফেন সাহেবকে আশ্রয় দেওয়া ও খাওয়ানোর জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলো । ভোর রাত্রির ট্রেনে স্টিফেন সাহেবের সাথে তারা রানাঘাট জংশনে নেমে প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকা লালগোলা যাওয়ার ট্রেনে উঠে বসলো । অন্যদিকে স্টিফেন সাহেব শিয়ালদহগামী ট্রেনে উঠবেন জানিয়ে দুই নম্বর প্লাটফর্মে গেলেন । তবে স্টিফেন সাহেব ইতাসের হাতে পাঁচ শত টাকা গুঁজে দিয়ে বললেন, “এটা কাছে রাখুন, অসময়ে কাজে লাগবে” । টাকাটা নিয়ে ইতাস ও ইমলি জোড়হাতে স্টিফেন সাহেবকে নমস্কার জানালো । তারপর স্টিফেন সাহেব খুব দ্রুত দুই নম্বর প্লাটফর্মের উদ্দেশ্যে চলে গেলেন । কেননা ট্রেনের খবর হয়ে গিয়েছিলো । এদিকে ইতাস ও ইমলির কাছে ভারতবর্ষ একটি নতুন দেশ । বড় দেশ । তাদের কাছে দেশের সমস্ত জায়গাই নতুন । দেশে থাকা অবস্থায় ইতাস মুর্শিদাবাদের নবাব সিরাজদৌল্লার কথা খুব শুনেছে, এমনকি ইতিহাস বইতেও পড়েছে । তাই সে ভাবলো মুর্শিদাবাদে গেলে নবাবের বাড়ির আশপাশ দিয়ে থাকার একটা বন্দোবস্ত ঠিক হয়ে যাবে । সেই ভরসায় লালগোলা ট্রেনে ওঠা ।
ট্রেনে সহযাত্রীদের সাথে আলাপচারিতায় ইতাস জানতে পারলো পলাশীতে অনেক শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছেন । সেখানে গেলে তাদের একটা হিল্লে হওয়ার সম্ভাবনা । যেই ভাবনা সেই কাজ । অবশেষে তারা পলাশী স্টেশনে নেমে পড়লো । পলাশী স্টেশনে নেমে জানতে পারলো পলাশীপাড়ায় শরণার্থীদের জন্য নোঙরখানা খুলেছে । সেখানে ঢালাও খিচুরির বন্দোবস্ত । পলাশী স্টেশন থেকে বড়-চাঁদঘর হয়ে পলাশীপাড়া যেতে অতিরিক্ত বাস ভাড়া । তবুও তারা দুজনে গিয়ে দেখলো, সেখানে ভিড়ে ঠাসা শরণার্থী । তাছাড়া শরণার্থীদের উপর সহানুভূতির চেয়ে স্থানীয় মানুষদের জুলুমবাজী বেশী । যারা ঐদেশ থেকে যা কিছু এনেছে যেমন সোনা-দানা, গয়নাগাটি, ইত্যাদি, সেগুলো তাদের কাছে বিক্রি করতে হবে । নতুবা থাকার ব্যাপারে ছাড়পত্র পাওয়া মুস্কিল । যারা বিক্রি করছেন, তাদের সেইসব সোনার ওজনে গড়মিল । অন্যায়ভাবে একরকম জোরপূর্বক শরণার্থীদের মূল্যবান জিনিসপত্র কেড়ে নেওয়া হচ্ছে । এইসব ন্যাক্কারজনক কাজকর্ম দেখে ইতাস হতাশ । ওদেশে দাঙ্গা সৃষ্টি করে হিন্দুদের তাড়িয়ে দেওয়ার সময় যেমন লুটতরাজ চলছিলো, এখানেও আশ্রয় দেওয়ার নাম করে চুপিসারে শরণার্থীদের মালপত্রের লুটপাট চলছে । ইতাস ও ইমলির ব্যাপারটা মোটেই ভাল ঠেকলো না । তারা নোঙরখানা থেকে খিচুরি খেয়ে অন্যত্র অজানা উদ্দেশ্যে রওনা দিলো ।
পথে সন্মার্গের সাথে দেখা । বাসে ইতাস ও সন্মার্গ পাশাপাশি সিটে বসা । ইমলি বসা বাসের লেডিস সিটে । সন্মার্গ বেশ চটপটে ছেলে । সদ্য স্নাতক । এখানকার অর্থাৎ এই দেশের বাসিন্দা । যাচ্ছে মীরা পলাশী বাজার । বাসে বসেই ইতাসের সঙ্গে আলাপ জমলো । সন্মার্গের বক্তব্য, এভাবে কতকাল ঘুরবেন । যেকোনো রিফুইজি কলোনিতে ঢুকে সেখানে গ্রামের শেষ মাথায় তাল পাতার ছাউনি দিয়ে একটা ঘর বানান । তারপর কাজ খুঁজুন । পরের বাড়ি মুনিষ খাটলে দিনান্তে যে পয়সা জুটবে তাতেই আপনাদের দুজনের পেট ভালভাবেই চলে যাবে । কিন্তু এভাবে ঘুরে বেড়ালে নিজেকে দাঁড় করাতে আপনাকে অনেকদিন পিছিয়ে পড়তে হবে । তারপর সন্মার্গ ইতাসদের বর্দ্ধমান শহরের যাওয়ার পরামর্শ দিলো । বর্দ্ধমান শহরের আশেপাশে বড় বড় নদী-নালা রয়েছে । শোনা গেছে, নদীর ধার ঘেঁষে অনেক বসতবাটী গড়ে উঠ্‌ছে । সেখানে গেলে ঘর বাড়ি বানিয়ে জীবন কাটাতে আপনাদের সহজ হবে । নতুবা অনিশ্চয়তার দাবানলে জ্বলে পুড়ে মরতে হবে । সেটা হবে অকল্পনীয় ও অসহনীয় ।
এতকাল ইতাসের মাথার উপরে বাবা-মা ছিলো । বাল্যজীবন কাটার পর কৈশর জীবনে পড়াশুনা নিয়ে ব্যস্ততা । তারপর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে চাকরি । চাকরি পাওয়ার পর বিয়ে । ইমলির ক্ষেত্রেও তাই । নিজেকে জানবার, বুঝবার আগেই দেশ থেকে বিতাড়িত । তাই এখন সিদ্ধান্ত নিতে দোদুল্যমান । ইতাস বুঝেই উঠতে পারছে না, তার এখন কী করণীয় ? যার জন্য ইমলির হাত ধরে অসহায়ের মতো তার কান্না ! এই মুহূর্তে তার বোধশক্তির খুব অভাব !
বর্দ্ধমান স্টেশনে তার যখন অবতরণ করলো তখন সন্ধ্যার ঘুটঘুটে অন্ধকার । স্টেশনের ১নম্বর প্লাটফর্মে সাধারণ যাত্রীদের জন্য বিশ্রামকক্ষ । কিন্তু সেই বিশ্রামকক্ষের দরজা বন্ধ । সেখানে তালা ঝুলছে । অগত্যা প্লাটফর্মে যাত্রীদের জন্য বসার জায়গায় গিয়ে তারা দুজনে বসলো । যেভাবে হোক রাত কাটাতে হবে । বিশাল বড় বর্দ্ধমান স্টেশন চত্বর । অনেকগুলি প্লাটফর্ম । তাই ইতাস বুঝতে পারলো, স্টেশনের প্লাটফর্মে থাকাটা অনেক নিরাপদ । কেননা অনেক রেল পুলিশ বাহিনী টহলরত । তাছাড়া প্লাটফর্মে রেল যাত্রীদের প্রাচুর্য তুলনামূলকভাবে বেশী । কালো কোটধারী টিকিট পরীক্ষকদের টিকিট চেকিং নজরকাড়া । ট্রেন এসে থামলেই ট্রেনের টিকিট পরীক্ষকদের প্লাটফর্মে ভিড় । কয়েকজন বিনা টিকিটের যাত্রীর কাছ থেকে ঐ টিটিই’রা জরিমানা পর্যন্ত করলেন । ঐসব দেখে ইতাসের মনে ভয় ধরে গেল । রাত্রিবেলায় বিনা টিকিটের জন্য যদি তাদের প্লাটফর্ম থেকে তাড়িয়ে দেয় । তাহলে নিঃস্ব অবস্থায় রাতের অন্ধকারে তারা কোথায় যাবে ? কিভাবে রাত্রি কাটাবে ? দুশ্চিন্তার একশেষ । ইতাসের চোখে মুখে উৎকন্ঠার তীব্র ছাপ । তবুও মনটাকে শক্ত করলো ইতাস । এই মুহূর্তে স্টেশন চত্বরে থাকাটাই যুক্তিযুক্ত । তারপর প্লাটফর্মের ঘড়িতে তাকিয়ে দেখলো, রাত্রি তখন ১১টা । প্লাটফর্মের চারিদিক প্রায় সুনসান । সন্ধ্যারাত্রিতে যে হারে মানুষ প্লাটফর্মে ঘোরাফেরা করছিলো, সেটা রাত্রি হওয়ার সাথে সাথে কমে প্রায় শুণ্যে এসে দাঁড়ালো । প্লাটফর্মে কতিপয় রেল সুরক্ষা বল’এর (আর-পি-এফ) জোওয়ানেরা এবং কয়েকজন টিকিট পরীক্ষকের ঘোরাফেরা ।
ইমলির প্রচন্ড জল তেষ্টা । তাই ইমলি দুই নম্বর প্লাটফর্মের উপরের কল থেকে জল খেতে ছুটলো । সারাদিন কিছু খাওয়া হয়নি । জল খেয়ে ক্ষুধার নিবৃতির চেষ্টা । ইমলি বেঞ্চ থেকে উঠে যাওয়ার দরুন ফাঁকা বেঞ্চে ইতাস শুয়ে পড়লো । শরীরের উপর দিয়ে সারাদিনে অসহনীয় কতো ধকল ! শোয়ামাত্র ঘুমে ইতাসের চোখ বুজে আসলো । এমন সময় জম্মু-তাউয়াই মেল (জম্মু থেকে শিয়ালদহ) ট্রেন বর্দ্ধমান স্টেশনের এক নম্বর প্লাটফর্মে ঢুকলো । এক নম্বর প্লাটফর্ম তখন ফাঁকা থাকায় মেল ট্রেনটির প্রবেশ । ট্রেন থেকে এক ঝাঁক কালো কোটধারী টিকিট পরীক্ষক বর্দ্ধমান স্টেশনে নামলেন । সেইসঙ্গে রেলওয়ে প্রটেকশন ফোর্সের অনেক জওয়ান । গোটা ১নং প্লাটফর্মে পুলিশে পুলিশে ছয়লাপ । তেমনি টিটিইদের টহল । ইতাস জানতে পারলো, বর্দ্ধমান স্টেশনে ম্যাজিস্ট্রেট চেকিং । হঠাৎ ……?
হঠাৎ ইতাসকে ধাক্কা দিয়ে দলে পাঁচজন টিকিট পরীক্ষক তার কাছে টিকিট চাইলেন । পাঁচজন টিকিট পরীক্ষকের পেছনে রেল সুরক্ষা বলের টীম । হঠাৎ অতোজন টিকিট পরীক্ষক ও পুলিশ দেখে ইতাস হকচকিয়ে গেলো । ঘাবড়ে গিয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় । ইতাসের গড়িমসি অবলোকন করে হেড টিকিট পরীক্ষক সরাসরি বললেন, “আপনার টিকিট প্লীজ” ?
হতচকিতভাবে ইতাস বললো, “স্যার, আমি ট্রেনে আসিনি” ।
তাহলে প্লাটফর্ম টিকিট প্লীজ ?
উদাস হয়ে তাকিয়ে রইলো । হকচকিয়ে গিয়ে ইতাস কথা বলার সুযোগ খুঁজে পাচ্ছে না । নির্বাক দৃষ্টিতে ইতাস দুশ্চিন্তায় নিমজ্জমান ।
দ্বিতীয় টিকিট পরীক্ষক জিজ্ঞাসা করলেন, “টিকিটহীনভাবে এত রাত্রিতে প্লাটফর্মে আপনি কী করছেন” ?
ইতাসের উত্তরের অপেক্ষা না করে পুলিশের বড় কর্তা টিকিট পরীক্ষককে বললেন, “এসব উটকো মানুষ অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে বড় রকম অঘটন ঘটানোর অছিলায় প্লাটফর্মে রাত কাটায় । কয়েক ঘা দিলেই এদের চাঁই ধরা পড়তে বাধ্য স্যার । আপনি অনুমতি দিলে আমি বান্দাকে জেরা করে প্লাটফর্মে থাকার আসল রহস্য শীঘ্রই উদ্ঘাটন করতে পারবো” ।
পরিস্থিতি বেগতিক ভেবে ইতাস হেড টিটিই’কে বললো, “স্যার, আমার কোনো অসৎ উদ্দেশ্য নেই । পকেটে টাকা না থাকার জন্য প্লাটফর্মে রাত কাটাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছি স্যার । ভোর হলেই প্লাটফর্ম ছেড়ে গাঁয়ে চলে যাবো” ।
সঙ্গে সঙ্গে হেড টিটিই বললেন, “বিনা টিকিটে আপনি প্লাটফর্মে থাকার জন্য “অবৈধ যাত্রী” হিসাবে পরিগণিত । রেল কর্তৃপক্ষের নির্ধারিত জরিমানা না দিতে পারলে আমি দুঃখিত, আপনাকে আমরা রেল পুলিশের হাতে তুলে দিতে বাধ্য । সেক্ষেত্রে আপনার জেল হওয়ার সম্ভাবনা । ডিউটি পালনে আমরা কর্তব্যনিষ্ঠ । তাই আপনাকে ছেড়ে দিলে আমরা কর্তব্য অবহেলার দায়ে দোষী হিসাবে সাব্যস্ত হবো । সেক্ষেত্রে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনে আমাদেরকে চাকরি থেকে বরখাস্ত পর্যন্ত করতে পারেন” ।
ইতাস হেড টিটিই’র পা ধরে কেঁদে কেঁদে বললো, “স্যার আমার সঙ্গে আমার স্ত্রী রয়েছে । শাস্তি দিলে আমাদের দুইজনকে একসঙ্গে দেন । নতুবা তাকে কোথায় রেখে আমি জেলে যাবো স্যার” ?
টিকিট পরীক্ষকের টীম ইতাসকে পুলিশের হাতে তুলে দিলেন । পুলিশ বর্দ্ধমান থেকে তিনজন বিনা টিকিটের যাত্রীদের নিয়ে শিয়ালদহগামী জম্মু-তাউয়াই মেলে ওঠা মাত্রই প্লাটফর্ম থেকে ট্রেন ছেড়ে দিলো । ইতাস ট্রেনের জানালা দিয়ে তাকিয়ে কোথাও ইমলিকে দেখতে পেলো না । তারপর তার কী কান্না ! সব হারিয়ে তারা দেশ ছাড়া । ইতাসের একমাত্র সঙ্গী তার স্ত্রী, ইমলি । বিদেশের মাটিতে এসে তাকেও হারাতে হোলো । এই ভাবে প্রাণপ্রিয় অর্ধাঙ্গিনীকে হারাতে হবে ইতাসের কল্পনার বাইরে । মনোকষ্টে ইতাস পর্যুদস্ত ।
ট্রেন প্লাটফর্ম ছেড়ে চলে যাওয়ার পর বর্দ্ধমান স্টেশন একেবারে ফাঁকা । লোকজনহীন সুনসান প্লাটফর্ম । ইমলি জল খেয়ে শরীরে কিছুটা তাকত পাওয়ার পর হেলতে দুলতে ইতাসকে লক্ষ্য করে ১নং প্লাটফর্মে ফিরছে । হঠাৎ প্লাটফর্মের বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখে, পাউরুটি ও ঘুগনি বিক্রেতা তল্পিতল্পা গুটিয়ে ঘরে ফেরার জন্য তৈরী । গাংনাপুর স্টেশন মাস্টার স্টিফেন সাহেব যে পাঁচ শত টাকা দিয়েছিলো, সেই টাকাটা ইমলির কাছে । সেখান থেকে দশ টাকা বের করে ঘুগনি বিক্রেতাকে অনুরোধ করে ঘুগনি ও পাউরুটি আগুনে সেঁকে ইতাসের উদ্দেশ্যে হাঁটতে লাগলো । পাউরুটির সাথে ঘুগনি ইতাসের খুব পছন্দ । তার মতে, অল্প পয়সায় পুষ্টিকর খাদ্য । পয়সা কম লাগে অথচ ক্ষুধা নিবারণে উৎকৃষ্ট খাবার । খাবার নিয়ে সে ইতাসকে চমকে দিতে চায় । কেননা খাবার সংগ্রহ করার দায়িত্ব তার । অথচ শেষে কিনা ইমলিকে খাবার জোগাড়ে নামতে হোলো । রাত্রিবেলায় বর্দ্ধমান স্টেশন চত্বরে একাকী সুন্দরী মহিলা সুনসান রাস্তা দিয়ে প্লাটফর্মে ইতাসের দিকে যাচ্ছে । যে কয়েকজন মানুষের স্টেশন চত্বরে আনাগোনা সকলের দৃষ্টি এখন ইমলির উপর । এত রাত্রিতে ভদ্র ঘরের বৌ কেন স্টেশন চত্বরে ? উপস্থিত মানুষের মনে কৌতুহলি প্রশ্ন ?
হাতে লন্ঠন নিয়ে স্টেশনের একজন অবাঙালি পোর্টার ইমলিকে দেখে বললেন, “এই যে মেয়েছেলে, তুমি প্লাটফর্মের বেঞ্চে বসেছিলে না” ?
“হ্যাঁ । আমি ও আমার স্বামী । কিন্তু আপনি হঠাৎ ঔৎসুক্য দৃষ্টিতে আমাকে এই কথা জিজ্ঞাসা করছেন কেন” ? উদগ্রীবভাবে ইমলি খানিকটা মেজাজের সুরে পোর্টারের কাছে জানতে চাইলো ।
“তোমার স্বামীকে রেল সুরক্ষা বল যাকে বলে আর-পি-এফ বাহিনী তুলে নিয়ে গেছে । তোমার স্বামীর জেল হওয়ার সম্ভাবনা” ! উত্তরে পোর্টারটি জানালো ।
“জেল” ! কথাটা পুনরুক্তি করা মাত্রই ইমলির হাত থেকে সেঁকা পাউরুটি ও ঘুগনি মাটিতে পড়ে গেলো । তারপর ইমলির চটজলদি জিজ্ঞাসা, “তার স্বামীর অপরাধ” ?
“বৈধ টিকিট” না থাকায় “অবৈধ ট্রেন যাত্রী” হিসাবে তাকে ম্যাজিস্ট্রেট চেকিং পুলিশের হাতে তোমার স্বামীকে তুলে দিয়েছে । জরিমানা দিতে না পারার জন্য তোমার স্বামীর জেল অনিবার্য ।
সেখান থেকেই ইমলির চিৎকার, “ইতাস” ! কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো ইমলি । অচেনা অজানা জায়গায় রাত্রির অন্ধকারে ভয়ে ইমলির মুখ শুকিয়ে কাঠ ! কিভাবে ইতাসকে ছাড়া তার দিন কাটাবে, সেই দুশ্চিন্তায় ইমলির চোখে মুখে ভয়ংকর আতঙ্কের ছাপ । ওপারের আপন দেশ থেকে লাথি ঝাঁটা খেয়ে এপারের দেশ অনেক বাঁচার আশা নিয়ে পা রাখা । এখানেও পদে পদে বিপদ । সহায় সম্বলহীনভাবে এমনিতেই তারা উদ্ভ্রান্তের মতো যাযাবরের ন্যায় । স্থায়ী বসবাসের বন্দোবস্ত করার জন্য যাযাবরের ন্যায় এদিক-সেদিক তাদের ঘোরাঘুরি । অথচ স্থায়ী বসবাসের কোনো সুরাহা নেই । কিন্তু বিপদ তাদের পিছু ছাড়ছে না ! সে জানে, তাদের দুজন জুটির মধ্যে ভীষণ মজবুত সম্পর্ক । তাই ইতাসকে ছাড়া ইমলি কিভাবে বাঁচবে সেই দুশ্চিন্তায় অস্থির । তার উপর সে মহিলা । ওদেশের আইন শিক্ষায় একজন শিক্ষিত । অথচ এদেশে আসার পর সেই শিক্ষার জলাঞ্জলি । বরং বলা চলে সে এখন একজন আনাড়ি মহিলা । প্রতি পদে পদে অশান্তির বিড়ম্বনা । এদেশের মাটিতে ইমলি পা রেখেছে বটে, কিন্তু তার পায়ের তলার মাটি ভীষণ আলগা । পা ফসকালে সলিল সমাধির একটা আতঙ্ক তার অন্তরে সর্বক্ষণ বিরাজিত । ইতাসকে হারিয়ে ইমলি এখন দিশেহারা ।
পোর্টারের নাম ধ্যানেশ । ধ্যানেশ বাঁকা চোখে কয়েকবার ইমলির দিকে তাকালো । তার অভব্য তাকানোটা, ইমলির দৃষ্টি এড়ালো না । ধ্যানেশ আমতা আমতা করে আধো হিন্দি আধো বাংলায় ইমলিকে বললো, “আপনি এখন কী করবেন ? কোথায় রাত কাটাবেন” ?
“জানি না । কোথায় কিভাবে রাত কাটাবো, আমি কিচ্ছু জানি না ।“ ধ্যানেশের কথার উত্তরে ইমলি হতাশভাবে বললো ।
ধ্যানেশ প্রস্তাব দিলো, “আপনার আপত্তি না থাকলে আমার কোয়ার্টারে থাকতে পারেন । আমার বিবি-বাচ্চা দেশে গেছে । ফিরতে অনেক দেরী । যে কদিন মন চাইবে আপনি আমার কোয়ার্টারে নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন” ।
ধ্যানেশের দিকে ভাল করে তাকিয়ে ইমলি বুঝতে পারলো, চল্লিশের আশপাশ তার বয়স । তাগড়াই চেহারা । কিন্তু চাহনীটা বড্ড নোংরা । রাতের অন্ধকারেও তার দৃষ্টিটা ইমলির চোখের দিকে নয়, বরং তার শরীরের অন্যত্র । প্লাটফর্মে তাকিয়ে ইমলি দেখলো প্লাটফর্ম জনশুণ্য । স্টেশনের অফিস ঘরগুলিতে শুধুমাত্র আলো । অন্যত্র সুনসান । প্লাটফর্মের ঘড়িতে তখন রাত্রি একটা ।
অন্য উপায় না পেয়ে নিজেকে নিরাপদে রাখার চিন্তাভাবনার কারণে ধ্যানেশের প্রস্তাবে রাজী হোলো ইমলি । তিনকোনিয়া বাস স্ট্যান্ডের পাশেই কোয়ার্টার । ঘন বসতি । সরকারি কোয়ার্টারগুলি ঘেঁষাঘেষিভাবে তৈরী । যার জন্য পাশাপাশি বাড়িতে কী হচ্ছে অনায়াসেই সেটা দেখা যায় । এমনকি টের পাওয়া যায় । ইমলিকে একটা ঘর ছেড়ে দিয়ে ধ্যানেশ বললো, “আপনি ঘরে গিয়ে বিশ্রাম নিন । আমি বরং আপনার জন্য খাবার বানাচ্ছি । আপনি ফ্রেস হয়ে সত্বর খাবার টেবিলে আসুন” ।
খেয়ে শুতে যেতেও রাত তিনটের কাছাকাছি । বিছানায় শুয়ে শুয়ে ইতাসকে নিয়ে ইমলির দুর্ভাবনা । লোকটা কয়েকদিনের টানাপোড়েনে বিপর্যস্ত । ভীষণ মনোকষ্টের মধ্যে দিয়ে তার দিন কাটছিলো । হায় রে ভগবান ! শেষে কিনা তার নিরপরাধ স্বামীকে সোজা জেলে । তার সঙ্গে দেখা করার এতটুকু সুযোগ দিলো না । সহায় সম্বলহীন নিঃস্ব একটা মানুষ, টিকিট কাটবে কোথা থেকে ? ওপার থেকে তারা নিঃস্ব অবস্থায় একরকম ঈশ্বরের কৃপায় জানে বেঁচে কোনোক্রমে এদেশের মাটিতে আশ্রয়ের আশায় বুক বেঁধে আছে । সেই দেশের রেল পুলিশ নিরপরাধ ইতাসকে ধরে নিয়ে গেল । ভাবতে পারছে না ইমলি । বেশী ভাবলেই, তার চোখে মুখে ভবিষ্যতের কালো অন্ধকার ফুটে ওঠে । হঠাৎ ………… !
হঠাৎ রাত্রি তিনটের সময় তার শোওয়ার ঘরের দরজায় টোকার আওয়াজ ! হকচকিয়ে গেল ইমলি । সে ভাবলো, এত রাত্রিতে তার শোওয়ার ঘরের দরজায় কে টোকা দিচ্ছে ? তাই বিছানায় বসেই ইমলি আওয়াজ দিলো, “কে, কী দরকার” ?
“আমি ধ্যানেশ, একটু দরজা খুলুন” ।
“ধ্যানেশ দাদা, এত রাত্রিতে আপনি হঠাৎ” ! ইমলি জিজ্ঞাসা করলো ।
হ্যাঁ । আপনার সঙ্গে দরকার আছে । দরজা খুলুন । ঘরে ঢুকে বলছি ।
দরজাটা পুরো না খুলে দরজার পাল্লা একটুখানি খুলে মুখটা বের করে ইমলি জিজ্ঞাসা করলো, “ধ্যানেশদা, কিছু বলবেন” ?
“আমি আপনার ঘরে শুতে এসেছি” । কথাগুলি বলেই শরীরের ভারসাম্য রাখতে না পেরে প্রায় মেঝেতে পড়ে যাচ্ছিলো । এমন সময় ইমলি তাকে ধরে ফেললো । কিন্তু ইমলি টের পাচ্ছে, তার মুখে বিশ্রি দুর্গন্ধ । তাছাড়া ধ্যানেশ তার নিজস্ব স্বাভাবিকতায় নেই । দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না । তার পা দুটি টালমাটাল ! কথাবার্তায় অশুভ ইঙ্গিত ! কোনো কিছু বোঝার আগেই ইমলি ধ্যানেশের মুখের সামনে ঘরের দরজা বন্ধ করে দিলো । বাইরে থেকে ধ্যানেশ চিৎকার করে অশালীন ভাষায় বলেই যাচ্ছে, “দরজাটা খোল্‌ হারামজাদি । তোকে থাকতে দিয়েছি এমনি এমনি ! বিনিময়ে কিছু চাই” । ইমলি ভাবলো এখানে থাকা তার পক্ষে আর এক মুহূর্তও নিরাপদ নয় । যেভাবে হোক পালাতে হবে । নতুবা মাতালের ঘরে থেকে অশান্তির বিপদ অনিবার্য । ধ্যানেশের উদারতা দেখে ইমলি ভেবেছিলো, “ইন্ডিয়ার মানুষ কতো মানবিক ! গভীর রাত্রিতে অসহায় মহিলাকে স্বেচ্ছায় যেচে রাত্রিতে থাকার ব্যবস্থা করে দিচ্ছে” । এখন বুঝতে পারছে তার ভাবনাটার খামতি ছিলো । উপকারের নামে ধ্যানেশের আসল দৃষ্টি তার যৌবনশ্রী শরীরটার উপর । আর ইমলির ভাববার অবকাশ নেই । তাই পাশের বাড়ির দিকের জানালা খুলে ইমলির চিৎকার, “বাঁচাও ! বাঁচাও ! হেল্প ! হেল্প মী । আমাকে বাঁচান” ।
পাশের কোয়ার্টারের গতরী মাসি বেরিয়ে এসে ধ্যানেশের উদ্দেশ্যে বললেন, “হতচ্ছাড়াটা নিশ্চয় কোনো মেয়েছেলেকে তুলে এনে নিজের শোওয়ার ঘরে ঢুকিয়েছে । বে-আক্কেলের নচ্ছারটার জন্য মান সম্মান ধুলোয় মিশে একশা । আজ আমি একটা হেস্তনেস্ত করে তবেই ধ্যানেশটাকে ছাড়বো । রোজ রোজ মেয়েছেলে ঘরে এনে ফূর্তি করা ঘুচিয়ে দেবো” । বলেই তিনি সোজা অন্যান্য কোয়ার্টারের মানুষদের ঘুম থেকে তুলে দল বেধে ধ্যানেশের কোয়ার্টারে ঢুকে প্রথমে ইমলিকে উদ্ধার করলো । তারপর রেল কলোনীর সাফাইকারী দলের মস্তান হটাকৃষ্ট কয়েক ঘা ধোলাই দিলো ধ্যানেশকে । ধ্যানেশ কান ধরে সবার কাছে ক্ষমা চাইলো । গতরী মাসি ইমলির কাছে এসে বললো, “বেটা এবার তুমি নিশ্চিন্তে বাড়ি যাও । তোমার আর ভয় নেই । কিন্তু তুমি এত সুন্দরী মহিলা, অথচ আনাড়ি মহিলাদের মতো রাতের বেলায় বাইরে এত ঘোরাঘুরি কেন” ? ইমলির উত্তর না শুনেই গতরী মাসি আবার বললেন, “ভুখা পেটের জন্য কচি বয়সে এই লাইনে নামা । বুঝেছি বাছা ! সাবধানে থাকবে । দিনকাল ভাল নয়” । বলেই গতরী মাসি ভুলভাল বকতে বকতে স্থান ত্যাগ করলেন । তখন ভোর পাঁচটা । ইমলি বেরিয়ে সোজা বড় রাস্তার উপরে এসে দাঁড়ালো । রাস্তা দিয়ে পরপর দুটি বাস একটা কাটোয়া এবং অন্যটা আসানসোল যাচ্ছে । পূর্ব আকাশে রক্তিম আভা । শীঘ্রই সূর্য দেবতার আবির্ভাব ঘটবে তারই পূর্বাভাস । পাকা রাস্তার উপরে এসে ইমলি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো । সে এখনও ধন্দে, ভারতের মানুষ অতি সহজে ভদ্র সমাজের শিক্ষিত মহিলাকে অসভ্য বানাতে যথেষ্ট পরিপক্ক । তার উৎকৃষ্ট নিদর্শন গতরী মাসি । তিনি বুঝতেই চাইলেন না, কোন্‌ বিপাকে পড়ে ইমলি আজ ঘর ছাড়া, দেশ ছাড়া, রাত্রির অন্ধকারে পথহারা ও স্বামীহারা ? মনের ভিতর তীব্র কষ্টানুভূতি । মনের ভিতর চাপা দুঃখের কারণে তার অস্থিরতা । মানুষের কার্যকলাপ দেখে তার মনের মধ্যে অনেক প্রশ্ন । হাজার অযাচিত প্রশ্নের উত্তর তার অজানা ।
কর্জন গেটের কাছে পোস্ট অফিসের পাশের চায়ের দোকানে বসে এক কাপ চা ও দুটো বিস্কুট নিয়ে বেঞ্চের উপরে বসলো । মাটির ভাঁড়ে চা । চায়ের ভাঁড়ে চুমুক দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার পাশে রাখা খবরের কাগজের উপর ইমলির হঠাৎ চোখ পড়লো । “ম্যাজেস্ট্রেট চেকিংয়ের জালে বর্দ্ধমান থেকে তিনজন বিনা টিকিটের যাত্রী ধৃত” । তিনজনের ছবির মধ্যে ইতাসের ছবিও সেখানে জ্বলজ্বল করছে । কোথাকার জেলে তাদের রাখা হয়েছে তার কোনো খবর সেখানে লেখা নেই । চা খাওয়ার পর ইমলি ঐ খবরের কাগজটা কিনে নিজের কাছে রাখলো । সে নিজে আইনের স্নাতক । আইন সম্বন্ধে কমবেশী ওয়াকিবহাল । তারপর ইমলি প্রমাদ গুণলো, কোর্ট খুললেই কোনো উকিলবাবুর পা জড়িয়ে ধরে ইতাসকে “বেলে” ছাড়াতে চেষ্টা করবে ।
ইমলি নিজেকে স্থির রাখতে পারলো না । কোর্টে গেল । বার অ্যাসোসিয়েশনে বসা বয়স্ক উকিলের সন্নিকট গিয়ে ইমলি ইতাসকে জেলে তুলে নিয়ে যাওয়ার সমস্ত ঘটনা জানালো । সেই সময় চায়ের দোকানের পটলা ছোকরা এক কেটলি লিকার চা নিয়ে সরাসরি বার অ্যাসোসিয়েশনে হাজির । উকিল বাবুকে উদ্দেশ্য করে বললো, “বাবু চা” ?
“এক কাপ চা দিলে হবে না” । ইমলির দিকে তাকিয়ে উকিল বাবু পটলাকে বললেন, “আমার গেস্টকেও এক কাপ চা দাও” । তারপর ইমলির দিকে তাকিয়ে উকিল বাবু বললেন, “আরে আপনি দাঁড়িয়ে আছেন কেন ? সামনের চেয়ারটা টেনে বসুন” । অগত্যা ইমলি চেয়ারটার উপর বসলো । চা খাওয়া হয়ে গেলে উকিল বাবু হাসতে হাসতে বললেন, “এসব কেসে আমি লড়ি না । আমার অধীনস্থ এক অভিজ্ঞ উকিল রয়েছে । সে কেসটাতে লড়ুক”। বলেই তিনি সম্রাট বাবুকে ডাকলেন ।
সম্রাট বাবুকে ডাকা মাত্র তিনি বয়স্ক উকিলের কাছে এসে উপস্থিত । সারাদিন তার কোনো ক্লায়েন্ট জুটছিলো না । ইতাসের কেসটা হাতে পেয়ে তিনি স্পষ্টত খুব উৎফুল্ল । সম্রাট বাবু ইমলিকে অনুরোধ করলেন, “পাশের ঘরটাতে আমরা বসি । সেখানে আমরা আলোচনা করি । তাহলে সমস্ত ঘটনা জানা যাবে” ।
পাশের ঘরে বসামাত্র সম্রাট বাবু চায়ের কেটলি হাতে পটলকে দেখতে পেয়ে চিৎকার করে হাঁকলেন, “এই পটলা, শিগ্‌গির এক কাপ চা দে । গেষ্ট রয়েছে” । পটলাকে দেখে ইমলি জোড়হাতে বললো, “চা খাবো না” ।
“চা খাব না বললে কী করে হবে ? একটু চা খেতেই হবে” । চা খাওয়ার মিনতি জানালেন সম্রাট বাবু ।
এবার ইমলির দিকে তাকিয়ে সম্রাট বাবু বললেন, “আমার ফিস্‌ একটু বেশী । এই কেসটা আবার বেশ ক্রিটিক্যাল । ওপার থেকে পালানো কেস । কোর্ট জানতে পারলে নির্ঘাত আপনাদের দেশে ফিরিয়ে দেবেন । তাতে ঝঞ্ঝাটের কেলেঙ্কারি ! তাই কেসটাতে সর্বসাকুল্যে এক হাজার দুশো টাকা লাগবে । আজ আপনাকে পাঁচ শত টাকা অগ্রিম দিতে হবে । তারপর আমরা কাজটা শুরু করবো । আমি আবার টাকা পয়সার ব্যাপারটা অগ্রিম সেরে ফেলতে ভালবাসি । আপনার কেস হিস্ট্রিটা আমি জেনে নিয়েছি । এক্ষেত্রে সহজে কারও জেল হয় না । যদি ইতাস বাবুর জেল হয়, তবে প্রথমে বেল পাওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ “।
কিন্তু স্যার ?
আবার কিন্তু কেন ?
টাকা দেওয়াটাই সমস্যা স্যার । আমরা নিঃস্ব অবস্থায় ওদেশ থেকে এসেছি । একটা কানা-কড়িও নেই । তাই অনুরোধ করছিলাম, টাকা ছাড়া কেসটাতে লড়ে আমার স্বামীকে ছাড়াতে পারলে আমি আপনার কাছে খুব কৃতজ্ঞ থাকতাম ।
সম্রাট বাবু মুখটা গম্ভীর করে ঝটিকায় চেয়ার ছেড়ে অন্যত্র উঠে গেলেন । ইমলি বুঝতে পারলো এখানে টাকা ছাড়া কোনো কাজ হবে না । তবুও অনেক আশা নিয়ে বয়স্ক উকিলের কাছে আবার ছুটে গেল ইমলি । বার অ্যাসোসিয়েশনে গিয়ে দেখে তিনি সীটে নেই । ইমলির ধারণা, সম্ভবত কেস সওয়াল করতে তিনি বিচারকের এজলাসে আছেন । কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর বয়স্ক উকিলের দেখা না পেয়ে ইমলি হতাশ্‌ । বেলা গড়িয়ে যাচ্ছে । হঠাৎ রাত্রিতে নিজের থাকার কথা ভেবে ইমলি আতকে উঠলো । রাত্রিতে কোথায় কাটাবে ? রেল স্টেশন চত্বর, তার কাছে মোটেই নিরাপদ নয় । ভয়ে ভীতিতে ইমলি জড়োসড়ো ।
ইমলি ভাবলো স্টেশনে গিয়ে টিকিট পরীক্ষকদের কাছে পরামর্শ চাইলে তাঁরা হয় তো সঠিক রাস্তা বাতলে দিতে পারবেন । তাই আবার বর্দ্ধমান স্টেশনে গিয়ে একজন কর্তব্যরত বয়স্ক টিটিই’কে ডাকলো ইমলি । তারপর গত রাত্রে ইতাসকে “বিনা টিকিটের যাত্রী” হিসাবে দোষী বানিয়ে চেকিংয়ের টীম তাকে তুলে নিয়ে সম্ভবত হাজতে ঢুকিয়ে দিয়েছে । পুরো ঘটনা জানিয়ে ঐ টিটিইকে অনুরোধ করলো তাকে ছাড়িয়ে আনতে গেলে কী করণীয় ?
দেখা গেল ঐ টিটিই সমস্ত ঘটনা জানেন । এমনকি তিনি স্টেশনে ঐ সময়ে কর্তব্যরত অবস্থায় প্লাটফর্মে ছিলেন । কেননা স্পেশাল ম্যাজিস্ট্রেট চেকিংয়ের খবর আগে থেকেই উপর-মহল থেকে স্টেশনের কর্তৃপক্ষকে জানানো ছিলো । তিনি আরও বললেন, প্লাটফর্মের সমস্ত যাত্রীদের ঐ ম্যাজিস্ট্রেট চেকিংয়ের ব্যাপারে আগেভাগেই সজাগ করে দেওয়া হয়েছিলো । এই জাতীয় স্পেশাল চেকিং বছরে এক-আধ-বার হয় । খুব কড়া চেকিং । সেখানে আমাদের কোনো ভূমিকা থাকে না । তাঁর মতে, জরিমানা না দিতে পারলে ইতাসকে কোর্টে পাঠানোর কথা । যতোটুকু তিনি জানেন, ইতাসকে নৈহাটির আর-পি-এফ থানায় জমা রাখা হয়েছে । বাড়ির লোকের খোঁজ না পেলে তারপর তাদের পরবর্তী পদক্ষেপ । পরের দুদিন অর্থাৎ শনিবার ও রবিবার কোর্ট বন্ধ । সুতরাং ইতাসকে আরও দুদিন নৈহাটির থানার লক আপে কাটাতে হবে ।
ইমলি তখন প্রশ্ন করলো, ইতাসকে কিভাবে উদ্ধার করা যায় ?
ইতাসকে উদ্ধার করতে হলে এদেশের কোনো বিচক্ষণ মানুষের ছত্রছায়ায় গিয়ে তাঁর সহযোগিতা নিতে হবে । কোনো উকিল-আদালত করা চলবে না । উকিলের কাছে গেলে বিনা কারণে একগাদা টাকা নিয়ে ছেড়ে দেবে । সুতরাং আমার অনুরোধ, এই দেশের কোনো বিশিষ্ট মানুষকে নৈহাটি থানায় নিয়ে গিয়ে প্রমাণ করতে হবে আপনারা এদেশের স্থায়ী বাসিন্দা । নতুবা কোনো কারণে কর্তৃপক্ষ যদি জানতে পারেন যে, আপনারা ওপারের বাসিন্দা এবং পালিয়ে এসেছেন । তাহলে কিন্তু রেহাই নেই । যেভাবে হোক আপনাদের দেশে ফিরিয়ে দেওয়ার বন্দোবস্ত তাঁরা নিজেদের দায়িত্বে পালন করবেন । আপনাকে দেশে ফেরানোর দায়িত্ব তখন এদেশের সরকারের । সেই ক্ষেত্রে আপনাদের বিপদের সম্ভাবনা বেশী ।
বর্দ্ধমান স্টেশনের টিকিট পরীক্ষক যথার্থ পরামর্শ দিয়েছেন । তাঁরা এই লাইনে যথেষ্ট অভিজ্ঞ ও দক্ষ । তাই ইমলি ঠিক করলো, বিশিষ্ট কাউকে সঙ্গে নিয়ে নৈহাটির আর-পি-এফ’এর থানায় যাবে । এখন প্রশ্ন, ঐরকম হিতাকাক্ষী মানুষ সে কোথায় পাবে ? তার কাছে দেশটা পুরোটাই নতুন । হঠাৎ তার মনে একটা কথা ভেসে উঠলো, ইমলির নিজের বাবা ছিলেন হাই স্কুলের শিক্ষক । বাবাকে দেখে ইমলির অভিজ্ঞতা, হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষকেরা সমাজে সাধারণত ভদ্র ও মানবিক হন । তাকে একজন হাই স্কুলের হেড মাস্টার মশায়কে ধরতে হবে । সূর্য তখন পশ্চিমাকাশে । বেলা তখন চারটে । ইমলি ছুটলো পোস্ট অফিসের পাশের চায়ের দোকানে । চায়ের দোকানদারকে ইমলি জিজ্ঞাসা করলো, কাছাকাছি হাই স্কুল কতোদূরে । তিনি উত্তরে বললেন, পাশেই মিউনিসিপ্যালিটির হাই স্কুল । আর একটু এগিয়ে ব্রিজটা পার হয়ে গেলে নীলগঞ্জের হাই স্কুল । চায়ের দোকানদারের কাছে হাই স্কুলের খবর পেয়ে ইমলি ছুটলো নীলগঞ্জে । হাই স্কুল থেকে ঠিক তখন প্রধান শিক্ষক কমোলাক্ষো তপাদার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিচ্ছেন । তাঁর সঙ্গে হাই স্কুলের করণিক সুফল রয়েছেন । ইমলি সোজা কমোলাক্ষো স্যারের পা জড়িয়ে ধরে বললো, “স্যার আমাকে বাঁচান” !
ইমলি আচমকা পা জড়িয়ে ধরায় কমোলাক্ষো বাবু হকচকিয়ে গেলেন । অচেনা, অজানা মহিলা এভাবে কেন তাঁর পা জড়িয়ে ধরছে, ব্যাপারটা তাঁর কাছে কৌতুহল ঠেকলো । তাই ইমলিকে দুহাত দিয়ে তুলে জিজ্ঞাসা করলেন, “কে তুমি মা ? এই ভাবেই বা কাঁদছো কেন ? তোমাকে ইতিপূর্বে আমি কখনও দেখেছি কিনা মনে করতে পারছি না” ।
কান্না থামিয়ে ইমলি স্যারকে তার স্বামীর বিপদের কথা খুলে বললো । তারপর ইমলি তার বাবার কথা বলতে গিয়ে কেঁদে কেঁদে জানালো, “আমার বাবাও আপনার মতো হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক । বাবাকে দেখেই আমি শিখেছি, প্রধান শিক্ষক মহাশয়েরা সর্বক্ষণ সমাজের হিতার্থে কাজ করেন । আপনিও ঠিক আমার বাবার মতো । তাই আপনার স্মরণাপন্ন হওয়া” । ওপার বাংলা থেকে তাদের তাড়িয়ে দেওয়া থেকে এপারের দেশে এখনও মাথা গোঁজার ঠাঁই হয়নি সমস্ত ঘটনা খুলে স্যারকে অবহিত করলো । এমনকি আরও বললো, তার স্বামীকে রেল সুরক্ষা বলের নৈহাটি থানার লক্‌ আপে রাখা আছে । ইতিমধ্যে আমরা ছাড়িয়ে না আনলে তাকে সোমবারদিন কোর্টে চালান করে দেবে । সেক্ষেত্রে সমূহ বিপদ ! কেননা কোর্ট থেকে ছাড়ানোর হ্যাপা বেশী । সুতরাং স্যার, আমার সাথে নৈহাটি গিয়ে তাকে ছাড়িয়ে আনার জন্য আপনাকে অনুরোধ করছি ।
এবার কমোলাক্ষো বাবুর ব্যাপারটা বোধগোম্য হোলো । মেয়েটার ভীষণ কান্নাকাটি অবলোকন করে কমোলাক্ষো বাবু সিদ্ধান্ত নিলেন, বাড়ি না ফিরে বরং রাত্রিবেলায় নৈহাটি জংশনে গিয়ে ইতাসকে ছাড়িয়ে আনা । মাস্টার মশায় আরও ভাবলেন, ইতাসকে ফিরিয়ে না আনলে ইমলির রাত কাটানো খুব কষ্ট । ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখেন সন্ধ্যা প্রায় ছ’টা । তাই বাড়ি না ফিরে ৬-৪০ মিনিটের বর্দ্ধমান – শিয়ালদহ লোকাল ধরে করণিক সুফলকে সঙ্গে নিয়ে ইমলির সঙ্গে নৈহাটি গিয়ে পৌঁছালো । থানার বড়বাবু কমোলাক্ষো বাবুকে দেখামাত্র চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে স্যারের পা ছুঁয়ে প্রণাম করলেন । স্যারের ছাত্র থাকায় ইতাসকে ছাড়াতে আরও সহজ হোলো । কমোলাক্ষো মাস্টারও জানেন, “ছাড়াতে গেলে বেশ কিছু পয়সার রফা ঘটে” । কিন্তু থানার বড়বাবু ছাত্র থাকায় শুধুমাত্র রেল নির্ধারিত জরিমানা ছাড়া একটা পয়সাও লাগলো না । কমোলাক্ষ বাবু ছাত্রের আন্তরিক ব্যবহারে যারপরনাই উদ্বেলিত । তাঁর সন্তুষ্ঠির আরও কারণ, তিনি ছাত্রদের মধ্যে অন্তত মানবিক বোধটা জাগ্রত করতে পেরেছেন । মানবিকতার উজ্জ্বল নিদর্শন, তাঁর ছাত্র আর-পি-এফ’এর নৈহাটি থানার বড় বাবু ।
কমোলাক্ষ বাবুর পরামর্শমতো ইতাস ও ইমলি বর্দ্ধমানের তাঁর হাই স্কুলের বারান্দায় রাত কাটাবার সিদ্ধান্ত নিলো ।  ( চলবে )
——————০————————
এ১০এক্স/৩৪, কল্যাণী-৭৪১২৩৫ (ভারত)