আনাড়ি মহিলার উচ্ছৃঙ্খলতা (ধারাবাহিক উপন্যাস; তৃতীয় পর্ব) : দিলীপ রায় (+৯১ ৯৪৩৩৪৬২৮৫৪)।

0
758

ভোর হওয়ার আগেই ইতাস ও ইমলি বর্দ্ধমান ত্যাগ করলো । কেননা হেড মাস্টার মহাশয় কমোলাক্ষ বাবু বলেছিলেন, “ধ্যানেশ লোকটাকে তিনি ভালভাবেই চেনেন । তাদের আচরণ ভীষণ নিম্ন মানের । প্রচন্ড বাজে লোক । সে যদি জানতে পারে তোমরা বর্দ্ধমানেই বয়েছো, তবে পুনরায় দলবল নিয়ে হিংসার বশবর্তী হয়ে তোমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে । তারা সবরকম নিম্নমানের কাজে সিদ্ধহস্ত । সুতরাং যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব তোমাদের বর্দ্ধমান ত্যাগ করাটা তোমাদের কাছে মঙ্গল”। সেই কারণে কমোলাক্ষ বাবুর পরামর্শ মতো তারা বর্দ্ধমান ছাড়লো । এবার তারা কোথায় যাবে ? খোঁজ নিয়ে ইতাস জানতে পারলো, কেন্দ্রিয় সরকারের বিমাতৃসুলভ আচরণের কারণে শরণার্থীদের দেখা হয় জাতীয় অর্থনীতির উপর বাড়তি বোঝা হিসাবে । ওপার থেকে আসা শরণার্থীদের প্রথমে রাখা হয় দেশের বিভিন্ন ক্যাম্পে । তারপর তাঁদের প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও পাঠানো হয় আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে এমনকি দন্ডকারণ্যের জঙ্গলে । আর যারা ক্যাম্পে গেলেন না, ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় তাঁদের বসতি স্থাপনের হিড়িক । এদেশের নদীয়া ও ২৪ পরগনার বিশেষ করে অধুনা উত্তর ২৪ পরগনার সীমান্তবর্তী এলাকায় বসতি স্থাপনের ঢল বেশী । কিন্তু সেদিকে ইতাস ঝুঁকলো না ।
বর্দ্ধমান স্টেশন থেকে প্রথম ট্রেন ছাড়বে । গন্তব্যস্থল হাওড়া । তারা দুজনে ইঞ্জিনের পরের কামরায় গিয়ে উঠলো । ভোরবেলার “বর্দ্ধমান – হাওড়া” ফার্স্ট লোকাল । লোকজন কম । তারা কোথায় যাবে, তাদের কাছে কিছুই পরিস্কার নয় । এমন সময় লেমন টী’র কেটলি আর কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ নিয়ে একগাল দাড়ি সমেত কিম্ভূতকিমাকার চেহারার হকার কামরায় উঠে হাঁকলো, “লেমন টী চাই, লেমন টী । সঙ্গে বিস্কুট পাবেন”। ঐ হকার কয়েকবার ইমলির দিকে বিশ্রীভাবে নজর দিয়ে কামরা থেকে তড়িৎগতিতে নেমে গেল । হকারটির তাকানোর কায়দা এমনই, মনে হচ্ছে তার ঈপ্সিত মানুষের সন্ধান পেয়ে গেছে । চায়ের হকারের ঐরূপ কদর্যভাবে তাকানোর ইঙ্গিতটা “সুবিধার নয়” মনে করে ইতাস ও ইমলি অন্য একটি কামরায় গিয়ে উঠে বসলো । বসামাত্র ট্রেন ছেড়ে দিলো ।
মেমারী স্টেশন । ট্রেনটা দাঁড়াতেই সেই দাড়িওয়ালা হকার পুনরায় তাদের কামরায় । “লেমন টী চাই, লেমন টী” ? তারপর ইমলিকে দেখামাত্র তার চোখ দুটি খুশিতে ডগমগ” । ঝটিকা কামরা থেকে নেমে উধাও । ইতাসের ধারণা, হকারটি অন্য কাউকে ডাকতে গেল ! হকারের অসৎ উদ্দেশ্য আন্দাজ করে তারা দুজন ট্রেন ছাড়ার ঠিক আগের মুহূর্তে ট্রেন থেকে মেমারী স্টেশনে নেমে গেল । তাদের প্লাটফর্মে নামার সাথে সাথেই ট্রেনটির স্টেশন ত্যাগ । মেমারী নতুন জায়গা । এখন তারা কোথায় যাবে সেই সিদ্ধান্তে দোদুল্যমান । যদিও তাদের কাছে সমস্ত এলাকা নতুন । কিন্তু এটাও ইতাস বুঝতে পারছে, কোনো একটা জায়গা বেছে তাদের ঘর বানানো আশুকর্তব্য । নতুবা কতোদিন এভাবে যাযাবরের মতো ঘুরবে । ইমলি চাইছে, আগে মাথা গোঁজায় ঠাঁই । বা-পাশে তাকিয়ে তারা দেখলো, লোকাল বাস দাঁড়িয়ে । “মেমারী-মালডাঙ্গা” লোকাল বাস । বাসে গোটা কয়েক প্যাসেঞ্জার । তার মধ্যে হাতে গোনা কয়েকজন মহিলা ঝুড়িতে কাঁচা আনাচ নিয়ে চললো কাছাকাছি বাজারে বিক্রি করতে । বাসটির খালাসি চিৎকার করে হাঁকছে, “বাস এখনি ছাড়বে । কুসুমগ্রাম, মালডাঙ্গা যাচ্ছে । তাড়াতাড়ি বাসে উঠুন” । ইত্যবসরে ইমলি ও ইতাসকে দেখতে পেয়ে বাসের সেই খালাসি তাদের একরকম জোরজুলুম করে বাসে উঠিয়ে বাস ছেড়ে দিলো । “মেমারী-মালডাঙ্গা’ লোকাল বাসে উঠে তারা কুসুমগ্রামে নামলো । চারিদিকে অনুন্নত অজ পাড়া গ্রাম ঘেঁষা “কুসুমগ্রাম”, এলাকায় আধা শহর । আধা শহর বললে ভুল হবে, জমজমাট কুসুমগ্রাম বাজার । বাসের যোগাযোগ ব্যবস্থা ছাড়া আর কোনো যোগাযোগের ব্যবস্থা যেমন ট্রেন, ইত্যাদি নেই । সেখান থেকে একদিকে মালডাঙ্গা, দাঁইহাট, কাটোয়া যাওয়া যাবে এবং অন্যদিকে বর্দ্ধমান যাওয়ার রাস্তা । কুসুমগ্রাম বাজার এলাকাটা গাঁ-গঞ্জ ঘেরা । ধান চাষ প্রাধান্য । হিন্দু মুসলমান মিলেমিশে কুসুমগ্রাম । পুরানো আমলের গ্রাম । মানুষজন বংশ পরস্পরায় এই দেশের বাসিন্দা । কুসুমগ্রামের মানুষের ব্যবহার, ভীষণ আন্তরিক । গ্রামটি নানান দিক থেকে বর্ধিষ্ণু । খাদ্য খাওয়ায় এলাকার মানুষ স্বয়ম্ভর । হাই স্কুল রয়েছে । ওপার বাংলার মানুষের চিহ্ন নেই । বেশীর ভাগ মাটির বাড়ি । এমনকি মাটির দো-তলা বাড়ি । ইতাসের জীবনে মাটির দোতলা বাড়ি দেখার সৌভাগ্য এই প্রথম । শিক্ষার হার কম । তবে যাঁরা শিক্ষিত, তাঁরা বেশীর ভাগ বাইরে থেকে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত । কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় অনেক দূরে । মেমারীতে কলেজ এবং বর্দ্ধমানে বর্দ্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় । বাস স্ট্যান্ড কেন্দ্রিক কুসুমগ্রাম বাজার । বাস স্ট্যান্ডের আশপাশ দিয়ে প্রচুর দোকানপাট । সব ধরনের দোকান । রকমারী জিনিস পত্রের সমারোহ । তারা দুজনে বাস স্ট্যান্ডের পাশে গদাইয়ের চায়ের দোকানের সামনে রাখা বেঞ্চে বসলো । গদাই তখন কেটলিতে খরিদ্দারের জন্য চা বানাতে ব্যস্ত । আচমকা দুটো নতুন খরিদ্দার দেখে গদাই হকচকিয়ে গেল । মানুষ দুটিকে দেখলেই বোঝা যাচ্ছে, বড় ঘরের স্বামী স্ত্রী এবং তারা এই এলাকার নয় । বাইরে থেকে কুসুমগ্রামে আগমন । চা বানানো বন্ধ রেখে কেটলিটা উনুনে বসিয়ে গদাই তড়িৎ গতিতে ইতাসকে জিজ্ঞাসা করলো, “চা দেবো স্যার” ।
“হ্যাঁ দিন” । ইতাস গদাইকে বললো ।
আমাকে আপনি, আজ্ঞে, ইত্যাদি সম্ভাষণ করলে আমি রেগে যাই । আমাকে তুমি করে বললেই যথেষ্ট । আর শুনুন !
আবার কী হোলো ?
আমার নাম গদাই । কখনও চা খেতে আমার দোকানে এলে আমাকে গদাই নামে ডাকবেন । আমার নাম গদাই, গোটা কুসুমগ্রাম জানে ।
ঠিক আছে । এবার স্পেশাল করে এক কাপ চা বানান তো ভাই ।
এই যে শুনুন ! এখানে স্পেশাল চা তৈরি হয় না । আমার দোকানের চা, সবসময় স্পেশাল । চা খাওয়ার পর কোয়ালিটি হাড়ে হাড়ে টের পাবেন । গদাইয়ের চা একবার যে খেয়েছে, তাঁকে পুনরায় চা খেতে এমুখো হতেই হবে ।
ইতাস মনে মনে ভাবলো, আচ্ছা জ্বালায় পড়া গেল । তাই মৃদু স্বরে বললো, “গদাই, কথা না বলে তাড়াতাড়ি চা বানাও” ।
খুশিতে উনুনের পাশে গিয়ে ইমলিকে উদ্দেশ্য করে গদাই বললো,”দাদাবাবু আমাকে ঠিক চিনেছে । গদাই নামে এখন ডাকছে” ।
দোকানের আর একজন খরিদ্দার গদাইকে তাগাদা দিয়ে বললেন, “তুই কী শুধু বকবক করবি ! নাকি আমাদের চা দিবি” ?
জগা কাকা, আর এক মিনিট !
এরপর একটা থালায় পাঁচটা মাটির ভাঁড়ে চা নিয়ে গদাই হাজির । তার বগলে বিস্কুটের বয়ম ।
দোকানের আর তিনজন খরিদ্দারকে প্রথমে চা পরিবেশন করার পর ইতাস ও ইমলিকে চায়ের ভাঁড় এগিয়ে দিয়ে গদাই বললো, “চা খেয়ে আপনাকে বলতে হবে গদাইয়ের চা সত্যিই স্পেশাল কিনা” !
লোকাল বেকারির মোটা মোটা দুটো বিস্কুট ধরিয়ে দিয়ে গদাই আবার বললো, “আপনারা আস্তে আস্তে চা খান । আমি দোকান সামলাই” ।
ইতাস ও ইমলি বুঝতে পারলো গদাই ছেলেটা সত্যিই আন্তরিক । তার অন্তরটা নম্রতায় ভরা । মনে মনে তারা স্থির করলো, কুসুমগ্রামে আপাতত থাকার ব্যাপারে প্রয়োজনে গদাইয়ের সহযোগিতা চাইবে । গদাইয়ের ভাবগতি, আচার-আচরণ, খরিদ্দারদের সঙ্গে তার ব্যবহার অবলোকন করে তাদের দৃঢ় বিশ্বাস, তাকে ভরসা করা সমীচীন সিদ্ধান্ত । বর্দ্ধমান থেকে ভোরে উঠে মেমারী হয়ে কুসুমগ্রাম আসা । সেই কারণে চায়ের তেষ্টা বেশীমাত্রায় । সেই তেষ্টার নিরিখে গদাইয়ের চা খাওয়ার পর তাদের পরম তৃপ্তি । সত্যিই গদাই কথায় ও কাজে সমভাবে দায়িত্ববান । তারপর গদাই চায়ের ভাঁড় ফেলে দেওয়ার উদ্দেশ্যে ভাঁড় সংগ্রহের সময় কৌতুহলবশত ইতাসকে গদাই জিজ্ঞাসা করলো, “আপনারা কুসুমগ্রামে কোথায় যাবেন” ?
ইমলি মুখটা কাঁচুমাচু করে কিছুক্ষণ গদাইয়ের দিকে উদাসভাবে তাকিয়ে রইলো । কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না । ইমলির নীরবতা লক্ষ্য করে ইতাস গদাইকে বিনীতভাবে বললো, “তুমি তোমার কাজ করো । আমরা তোমার দোকানে কিছুক্ষণ বসি । তারপর তোমার অবসর সময়ে সব বলছি” ।
গদাই বুঝতে পারলো, “ভদ্রলোক নিশ্চয় কোনো বিপাকে পড়েছেন” !
ইমলিকে চায়ের দোকানে বসিয়ে রেখে ইতাস গেল কুসুমগ্রাম বাজারটা ঘুরে দেখতে । এলাকাটা মুখ্যত কৃষিপ্রধান । চাষবাস মূল পেশা । বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের সংমিশ্রণ । বিভিন্ন পেশার মানুষের বসবাস । বর্ধিষ্ণু মানুষেরা যেমন রয়েছেন, তেমনি গরীব মানুষের বসবাস যথেষ্ট । সমস্ত ধরনের পেশার মানুষ এখানে রয়েছেন, যেমন কামার, কুমোর, ছুতোর, মুচি, মেথর, ধোপা, নাপিত, ব্রাহ্মণ, কায়েত, চাষা, কপালি, তিলি, রাজমিস্ত্রি (রাজমিস্ত্রি বেশীর ভাগ মুসলিম সম্প্রদায়ের), ব্যবসায়ী, চাকুরিজীবি, ইত্যাদি । হাই স্কুল ছাড়া পঞ্চায়েত অফিস, গ্রামীণ ব্যাঙ্ক, আরও অনেক অফিস কুসুমগ্রামে । সারা বছর কাজকর্ম করে মানুষ খেটে খায়, যার জন্য অসুখ-বিসুখ কম । পাশ করা ডাক্তার হাতে গোনা কয়েকজন । বেশীর ভাগ ডাক্তার বর্দ্ধমান, মেমারী, ইত্যাদি জায়গা থেকে সপ্তাহে এক-দুদিন আসেন । প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র রয়েছে । ইদানীং স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি সাজানো-গোছানোর পর চিকিৎসার সরঞ্জামে অনেক উন্নত । বেডের সংখ্যা বেড়েছে । ডাক্তার বাবুদের উন্নত চিকিৎসা পরিষেবার জন্য রোগীর সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে । তবুও গাঁয়ে গঞ্জে হাতুড়ে ডাক্তারের রমরমা । কুসুমগ্রাম জায়গাটা বসবাসের পক্ষে ইতাস ও ইমলির খুব মনে ধরলো । কিন্তু মনে ধরলে কী হবে — কোথায় থাকবে, কী খাবে, উপায়ের পথ কী, এই দুশ্চিন্তায় ইতাস মোহগ্রস্থ । হঠাৎ ইতাস লক্ষ্য করলো, গ্রামীণ ব্যাঙ্কের সামনে অনেক মানুষের ঢল । খোঁজ নিয়ে ইতাস জানতে পারলো, “সামনের বর্ষার চাষের জন্য চাষীদের মধ্যে কে-সি-সি ঋণ দেওয়ার তৎপরতা তুঙ্গে” । মালডাঙ্গা যাওয়ার পাকা রাস্তার পাশেই গ্রামীণ ব্যাঙ্ক । সম্ভবত নিজস্ব জমিতে ব্যাঙ্ক বিল্ডিং । গ্রামীণ ব্যাঙ্কের কুসুমগ্রাম শাখা । জায়গাটা প্রাচীর দিয়ে ঘেরা । ব্যাঙ্ক বিল্ডিংয়ের চারিদিকে বারান্দা । পেছনের বারান্দা ফাঁকা । লোকজনের চলাফেরা না থাকায় বারান্দাটা ধুলোয় ধুলোময় । ফাঁকা বারান্দাটা দেখে ইতাসের খুব আনন্দ হোলো । মনে মনে ভাবলো, রাতে থাকার জায়গা অন্য কোথাও সুরাহা না হলে গ্রামীণ ব্যাঙ্কের বারান্দায় তাদের রাত্রি যাপন নিশ্চিন্ত ।
গদাই ইমলির কাছে এসে তার পাশে বসলো । “দাদাকে দেখছি না, দাদা কোথায় গেল” ? গদাই প্রশ্ন করলো ।
রাখঢাক না করে ইমলি গদাইকে বলেই ফেললো, “তুমি আমার ভাইয়ের মতো । তোমাকে ঘটনাটা জানানো দরকার” ।
কথার মাঝখানে গদাই বললো, “একটু ডিস্টার্ব করছি । আমি আপনার ভাইয়ের মতো নয়, আজ থেকে আমাকে আপনার আপন ভাই ভাববেন । আপনি আমার অন্তরের দিদি” ।
গদাইয়ের কথা শুনে আবেগ প্রবণ হয়ে ইমলি কেঁদে ফেললো । গদাইয়ের মাথায় হাত দিয়ে বললো, “তুমি আমার জন্ম জন্মান্তরের ভাই” ।
ইতিমধ্যে ইতাস গদাইয়ের দোকানে ফিরে এসে হাজির ।
গদাই ইতাসকে দেখতে পেয়ে মনের আনন্দে বলে উঠলো, “ঐ তো দাদা এসে গেছেন” । আবার উনুনের দিকে যেতে যেতে গদাই বললো, “আপনারা আর একটু বসুন । আমার দোকান থেকে আর এক কাপ চা খেয়ে আপনারা অন্যত্র যাওয়ার জন্য উঠবেন” ।
স্মিত হেসে ইতাস গদাইকে সরাসরি প্রশ্ন করলো, “আচ্ছা গদাই, তোমার বাড়ি কোথায়” ?
আচমকা ইতাসের প্রশ্নে গদাই খানিকটা ঘাবড়ে গিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলো তাকে, “দাদা, হঠাৎ আমার বাড়ির প্রশ্ন কেন” ?
জানতে চাইছি । তোমার এত সুন্দর চায়ের দোকান । বাস স্ট্যান্ড লাগোয়া বড় রাস্তার উপরে । তাছাড়া তোমার দোকান ভীষণ চালু । প্রশংসা করার মতো তোমার জনপ্রিয়তা । বাজারে তোমার খুব নামডাক । তাই জিজ্ঞাসা করছিলাম, ”তুমি কাছাকাছি থাকো কিনা” ?
আপনার প্রশ্ন শুনে আমি হকচকিয়ে গিয়েছিলাম !
কেন ? হকচকিয়ে গেলে কেন ? তুমি তো ভীষণ চটপটে ছেলে । যাকে বলে কর্মঠ ছেলে । ঘাবড়ে যাওয়ার মতো তুমি অন্তত নও !
আমি ভাবলাম, আপনি জেলা প্রশাসনের বড় কর্তা ? যার জন্য আমার সম্বন্ধে খোঁজ খবর নিচ্ছেন । কেননা আমার দোকানের জায়গাটার কোনো অফিসিয়াল স্বীকৃতি নেই । কোনো রেকর্ড, দলিল, দস্তাবেজ, কিচ্ছু নেই । ভয়ে ভয়ে আমরা দোকান চালাই । যে কোনো মুহূর্তে উপরের সাহেবরা সদলবলে উপস্থিত হয়ে আমাদের মতো বে-আইনিভাবে দখলীকৃত জায়গার উপর থেকে দোকানদের উচ্ছেদ করে দিতে পারেন । সেইজন্য ভয়ে ভয়ে কাজ করি ।
তারপর আবার ইতাসের দিকে তাকিয়ে গদাই বললো, “আমার বাড়ি কিছুটা দূরে । অজ পাড়া গাঁ, কাঁসাইগ্রামে । সেখান থেকে প্রতিদিন সাইকেল চালিয়ে এসে দোকান চালু করি” ।
ইতাস মাথা নাড়লো । তার কাছে কাঁসাইগ্রাম, কুসুমগ্রাম সবই সমান । সে কিচ্ছু চেনে না । ইতাসের ইচ্ছা ছিলো গদাইয়ের বাড়ি কুসুমগ্রামে হলে তার কাছ থেকে তাদের নিজেদের বাস করার নিরিখে খোঁজ খবর নেবে । কিন্তু সেই গুড়ে বালি । গদাই থাকে কাঁসাইগ্রামে । সুতরাং এই গ্রামের হালহকিকৎ সে কিভাবে জানবে ?
গদাইয়ের হাতে চায়ের কেটলি দেখে ইমলি বেজারমুখে গদাইকে বললো, “আবার চা” !
ইতাস ও ইমলি চায়ের ভাঁড়ে চুমুক দিয়ে গদাইকে তাদের অসহায়তার কথা সবিস্তারে খুলে জানালো । ওপারের দেশ থেকে তাড়িয়ে দেওয়ায় তারা এখন নিঃস্ব, নিঃসম্বল । কিভাবে বাঁচবে সেই দুশ্চিন্তায় তারা দিশেহারা ? অনিশ্চয়তার দুর্যোগের কালো মেঘের মতো তারা ভাসমান । সমস্ত ঘটনা শুনে প্রাণচঞ্চল গদাই খানিকক্ষণ চুপচাপ । তারপর ইমলির দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বলতে যাবে এমন সময় গদাই লক্ষ্য করলো, তার দিদি ইমলি শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছছে । ইমলি এবার গদাইয়ের দিকে তাকিয়ে কাতরভাবে অনুরোধ করলো, “ভাই, বেঁচে থাকার জন্য আমরা তোমার সহযোগিতা চাই” ।
ভীষণ অস্বস্তিতে পড়ে গেল গদাই । কিভাবে তাদের সহযোগিতা করবে, সেই ব্যাপারে গদাই ধন্দে । সে নিজে একজন দরিদ্র পরিবারের সন্তান । তার বাড়িতে বাবা-মা রয়েছেন । তাঁরা খুব অসুস্থ । চার দিদিদের বিয়ে দিতে গিয়ে গদাইয়ের বাবা-মা এখন নিঃস্ব । দিদিদের বিয়ে দিতে মাঠের জমিগুলি খোয়াতে হয়েছে । যার জন্য এই মুহূর্তে তাদের কোনো চাষের জমি নেই । তাই গদাইকে অল্প বয়সে সংসারের হাল ধরতে হয়েছে । তার নিজস্ব কোনো পুঁজি নেই বা ব্যাঙ্কে জমানো টাকা নেই যেখান থেকে কিছু টাকা পয়সা দিয়ে আর্থিকভাবে তাদের সহযোগিতা করবে ! তাদের করুণ মুখ দুটি দেখে গদাই নিজে খুব উৎকন্ঠিত । দুশ্চিন্তায় বিভ্রান্ত ! গদাইয়ের মন খারাপ । কিভাবে অসময়ে দুটি মানুষের পাশে দাঁড়ানো যায় সেই চিন্তায় অস্থির ।
তারপর দুপুরের খাবার খেতে যাওয়ার নাম করে গদাইয়ের দোকান ত্যাগ করলো ইতাস ও ইমলি ।
সন্ধ্যা ৬টার সময় ব্যাঙ্কের দরজা বন্ধ করে শাখা প্রবন্ধক ও অন্যান্য ব্যাঙ্ক কর্মচারী বাড়ি চলে গেলেন । ব্যাঙ্কে কোনো নৈশ প্রহরী নেই । প্রাচীর দিয়ে ঘেরা প্রবেশ পথের গ্রীলে বড় একটা তালা ঝোলানো ।
সন্ধ্যা ৭টা । ব্যাঙ্কের প্রবেশের গেটে তালা । ইতাস ও ইমলি ব্যাঙ্কের সামনের রাস্তার উপর দাঁড়ালো । কিন্তু সমস্যা একটাই, কিভাবে তারা ব্যাঙ্কের বাউন্ডারির ভিতর ঢুকবে ? যদিও বাউন্ডারির পাঁচিল চার ফুটের মতো উঁচু । ইতাস পাঁচিল সহজেই টপকাতে পারবে । কিন্তু ইমলি পারবে কিনা, সেটা নিয়ে ধন্দে ইতাস । কিন্তু সময় নষ্ট করা চলবে না, যেভাবে হোক তাদের পাঁচিল টপকাতে হবে । তাই ইতস্তত করে সময় নষ্ট করতে চাইলো না ইতাস । সে পাঁচিল টপকে ভিতরে ঢুকলো । তারপর ভিতরে ঢুকে অতি সাবধানে ইমলির হাত ধরে তাকে ভিতরে ঢোকালো । বারান্দাটা ভীষণ নোংরা । ধুলোবালিতে ভরা । আশেপাশে পড়ে থাকা খবরের কাগজ কুড়িয়ে বারান্দা থেকে ধুলো ঝাড়লো । অদূরে গ্রাহকদের জন্য তৈরী সাইকেল গ্যারেজের পাশে জল খাওয়ার টিউবওয়েল । মূল দরজার সামনের বারান্দাটা অনেক বড় । সম্ভবত গ্রাহকদের কথা ভেবে তৈরী, যাতে গ্রাহকেরা সেখানে এসে ঠিকমতো দাঁড়াতে পারেন । বর্ষার বৃষ্টি থেকে নিরাপদে থেকে ব্যাঙ্ক পরিষেবা পেতে পারেন । তারা ব্যাঙ্কের পেছনের বারান্দার ধুলো ময়লা পরিস্কার করে একটু শান্ত হয়ে বসলো ।
ইমলির তখন শান্তি । এতক্ষণ ভয়ার্ত চোখে রাত্রি যাপনের অশনি সঙ্কেত দেখতে পাচ্ছিলো । এখন ব্যাঙ্কের বাউন্ডারির মধ্যে ঢুকে তার মনে হচ্ছে, অন্তত রাত্রিটা তারা নিশ্চিন্তে কাটাতে পারবে । এখানে থাকাটা অনেকটাই নিরাপদ । ঝুটঝামেলাহীন জায়গা । উটকো মানুষদের উৎপাত নেই । গোটা বাড়িটার ফাঁকা বারান্দায় তারা দুটি প্রাণী ।
ইতাস মুড়ির প্যাকেট খুললো । মুড়ি ও কাঁচা লঙ্কা । ভুখা পেটে মুড়িটা তাদের কাছে অমৃত সমতুল্য । ধীরে ধীরে মনের আনন্দে তারা মুড়ি খাচ্ছে । লঙ্কাটা ভীষণ ঝাঁজালো । ঝাল লঙ্কা দিয়ে মুড়ি খেয়ে ইতাস ঝালে হাঁসফাঁস । খুব ঝাল লেগে ইতাসের ছটফট । ইতাসের আগাগোড়া ঝাল খেতে অপছন্দ, অন্যদিকে ইমলি ঝাল খেতে ওস্তাদ । ইতাসের ঝাল লেগে মুখে জ্বালা করছে । অথচ ইমলির মনে পড়ছে, তাদের বাড়িতে দাদা-বৌদিরা একসঙ্গে থাকলে বিকেলে সর্ষের তেল দিয়ে ঝাঁঝালো করে মুড়ি মাখানো হোতো । মুড়িতে কাঁচা লঙ্কার কুচি ও পিঁয়াজ কুচি মুখ্য উপাদান । সেই ঝাঁঝালো মুড়ি খেয়ে ছোড়দা একমাত্র ঝালে চিৎকার করতো । মায়ের হাতে মুড়ি মাখানো খাওয়ার আনন্দ এখনও তার হৃদমাঝারে উজ্জীবিত । ইতাসের ঝাল লাগার জন্য সে টিউবওয়েলে গিয়ে ঢকঢক করে অনেকটা জল খাওয়ায় তার শান্তি । তারপর বাকী মুড়ি খেয়ে দুজনে শুয়ে পড়লো । ঘুমের তীব্রতার জন্য মশার উৎপাত তাদের ঘুমকে ব্যাঘাত ঘটাতে পারলো না ।
গভীর রাত । তারা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ।
হঠাৎ পুলিশ ! ইতাসের শরীরে পুলিশ লাঠি দিয়ে মৃদুমন্দ টোকা দিচ্ছেন । কিন্তু ইতাসের ঘুম ভাঙছে না । অন্যদিকে টর্চের আলো দেখে ইমলি টের পেয়ে গেছে, কারা যেন তাদের ডাকছে । তাই ইমলি ইতাসকে ডাকলো । হকচকিয়ে ঘুম থেকে লাফিয়ে উঠে দুচোখ বন্ধ অবস্থায় ইতাস বললো, “কী হয়েছে ইমলি” ?
পুলিশ বললেন, “আমি আপনাকে ডাকছি” ?
আপনি কেন ডাকছেন ?
আমি কুসুমগ্রাম ফাঁড়ির পুলিশ ইন-চার্জ । আপনাদের এখানে শুয়ে থাকার উদ্দেশ্য কী ? ব্যাঙ্ক ডাকাতি করা কী আপনাদের উদ্দেশ্য ? উঠুন, আমাদের সঙ্গে শিগ্‌গির চলুন ।
কোথায় যাব স্যার ?
কুসুমগ্রাম পুলিশ ফাঁড়িতে ।
আমাদের অপরাধ ?
ব্যাঙ্ক ডাকাতির কুমতলবের জন্য আমি আপনাদের ধরে নিয়ে যাচ্ছি ।
ইতাস পুলিশের পা জড়িয়ে ধরে বললো, “আমাদের কোনো অসৎ উদ্দেশ্য নেই । আমরা রাত কাটাবার জন্য এখানে আশ্রয় নিয়েছি । সঙ্গে আমার স্ত্রী । এত রাত্রিতে কোথাও থাকার জায়গা না পেয়ে এখানে আশ্রয় নেওয়া” ।
এতক্ষণ পাশে দাঁড়িয়ে ব্যাঙ্কের ম্যানেজার রিতম বাবু সব ঘটনা পর্যবেক্ষণ করছিলেন । মানুষ দুটির চোখ মুখ দেখে অন্তত ব্যাঙ্ক ডাকাত বলে রিতম বাবুর মনে হচ্ছে না । তাদের পরনে মলিন পোশাক পরিচ্ছদ, অথচ সঙ্গে তাদের একটামাত্র ব্যাগ । তাদের কাছে কোনোরকম সন্দেহজনক জিনিসপত্র নেই । দেখেই বোঝা যাচ্ছে অভাবী মানুষ । রিতম বাবুর অন্তরটা দুজনের জন্য বিগলিত হয়ে উঠলো । সেই কারণে রিতম বাবু পুলিশকে পরামর্শ দিলেন, “এদের আর ফাঁড়িতে ধরে নিয়ে যাওয়ার দরকার নেই । বরং আমাদের শাখা অফিসের বিল্ডিং থেকে তাড়িয়ে দিন” ।
পুলিশ ইন-চার্জ কিন্তু রিতম বাবুর পরামর্শ সহজে মানলেন না । তাই তিনি সরাসরি ব্যাঙ্ক ম্যানেজার বাবুকে জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনি কিভাবে আমাদের রিপোর্ট করলেন, ব্যাঙ্কে ডাকাত ঢুকেছে” ?
রিতম বাবুর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কুটলিকাক্ষ চাকলাদার মহাশয়কে দেখিয়ে বললেন, “প্রথমে কুটলিকাক্ষ বাবু আমাকে খবর দেন, ব্যাঙ্কে ডাকাত পড়েছে এবং তিনি স্বচক্ষে দেখেছেন” ।
এই যে কুটলিকাক্ষ বাবু, আপনি কিভাবে জানলেন এই দুটি মানুষ ডাকাত ?
কুটলিকাক্ষ বাবু আমতা আমতা করে পুলিশের দিকে তাকিয়ে বললেন, “স্যার আমি নিজে দেখেছি এই কিম্ভূতকিমাকার লোকটাকে ব্যাঙ্কের টিউবওয়েল থেকে জল খেতে । তখন আমি আশেপাশের কয়েকজন বাসিন্দাকে ডেকে জল খাওয়ার দৃশ্যটা দেখাই । তাঁরাই আমাকে পরামর্শ দিলেন, ম্যানেজার বাবুকে খবর দিতে । ম্যানেজার বাবু বৈকুন্ঠ সর্খেলের বাড়ি ভাড়া থাকেন, আমরা সকলে জানি । আমি সোজা ম্যানেজার বাবুর বাড়িতে পৌঁছে খবর দিয়ে আসি । স্যার, এর বেশী আমি কিছু জানি না” ।
তা তো বললে হবে না । আপনাকে সাক্ষী দিতে হবে । আপনার বয়ান এখানে খুব গুরুত্বপূর্ণ । চলুন, পুলিশ ফাঁড়িতে চলুন । তিনি রিতম বাবুকেও কিছুটা ধমকের সুরে বললেন, “আপনিও কুটলিকাক্ষ বাবুর সঙ্গে চলুন” ।
কুটলিকাক্ষ বাবু ভীষণ চালাক লোক । তিনি বুঝতে পারলেন পুলিশ ফাঁড়িতে গেলে ঝামেলার একশেষ ! তিনিও অযথা পুলিশের জালে জড়িয়ে পড়বেন । তাই সময় নষ্ট না করে, পুলিশকে কানে কানে কিছু একটা বললেন । তারপর তাঁরা দুজনে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ালেন । কুটলিকাক্ষ বাবু পুলিশকে সান্ত্বনা করার জন্য কিছু একটা জিনিস তাঁর হাতে গুঁজে দিলেন । সেটা দেওয়াতে পুলিশ অনেক শান্ত । কিন্তু অফিসিয়াল কারণে ব্যাঙ্কের ম্যানেজার বাবুকে কিছু বলতেও পারছেন না, অথচ রাত্রির দুপুরে পুলিশ নিয়ে অকারণে ব্যাঙ্কে আসার জন্য কথাও শোনাতে পারছেন না । অবশেষে তিনি খানিকক্ষণ চঞ্চলভাবে ব্যাঙ্কের বারান্দায় পায়চারি করে রাগ প্রশমিত করার চেষ্টা করলেন । অতঃপর অন্য পুলিশ কনস্টেব্‌ল সুতাসের পিঠে কয়েক ঘা লাঠি মেরে তাড়িয়ে দিলেন । তখন রাত চারটে । ম্যানেজার বাবু পুলিশ ইন-চার্জকে জোড়হাতে বললেন, “এবার আপনারা আমার বাড়ি চলুন, মিষ্টি খাবেন” ।
দাঁত বের করে ফাঁড়ির পুলিশ ইন-চার্জ রিতম বাবুকে বললেন, “অনেক ধন্যবাদ ম্যানেজার বাবু । প্রয়োজন হলে অবশ্যই ডাকবেন । আমরা দিন-রাত্রি যেকোনো সময় ডিউটি দিতে সর্বদা প্রস্তুত” ! তারপর দলে তিনজন পুলিশ ফাঁড়ির দিকে রওনা দিলেন । কুটলিকাক্ষ বাবু স্পষ্ট বুঝতে পারলেন পুলিশ বাবুরা তাঁদের ডিউটিতে এসে মনের দিক থেকে অখুশী । অখুশীর কারণ তাঁর জানা নেই । তারপর ম্যানেজার বাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন, “আপনি ঐসব ছিচ্‌কে চোরদের উপর হঠাৎ সুপ্রসন্ন হতে গেলেন কেন, আমার মাথায় ঢুকছে না ? পুলিশ ঐ দুটোকে ফাঁড়িতে নিয়ে গিয়ে দুই ঘা মারলেই গলগল করে তাদের ব্যাঙ্ক ডাকাতির পরিকল্পনার ছক ফাঁস করে দিতে বাধ্য হোতো । এইসব উদ্ভট লোকগুলি সরাসরি ব্যাঙ্ক ডাকাতির অপারেশনে না থাকলেও খবরাখবর আদানপ্রদানে সিদ্ধহস্ত” ।
আপনি অযথা রাগছেন কুটলিকাক্ষ বাবু ? নিরপরাধ স্বামী-স্ত্রী অহেতুক কিছুদিন জেলে পচে মরতো । দেখলেন তারা কেমন ম্রিয়মান । নিশ্চয় বিপদে পড়ে ব্যাঙ্কের বারান্দায় রাতে শুয়ে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো । তবে আপনি যতোই আমার বিরূপ হন, আমি কিন্তু বলবো ঐ দুজন অন্তত ডাকাত বা চোর নয় । বিপাকে পড়ে বারান্দায় তাদের আশ্রয় নেওয়া । এতে অন্যায় কিছু নয় । তারা তো কোনো গেরস্ত বাড়ির উঠানে বা বারান্দায় আশ্রয় নিতে যায়নি । সরকারি ব্যাঙ্কের বারান্দার স্মরণাপন্ন হয়েছিলো । সুতরাং প্লীজ কুটলিকাক্ষ বাবু, নিরপরাধ দুটি মানুষকে চোর বানানোর আর কসরত করবেন না । এবার চুপ করুন । ভোর হয়ে গেছে । বাস স্ট্যান্ডে চলুন । নিশ্চয় গদাইয়ের চায়ের দোকান খুলে গেছে । সেখান থেকে চা খেয়ে তারপর নিজের নিজের বাড়ি ।
রিতম বাবু গদাইয়ের চায়ের দোকানে দুজন মানুষকে বসে থাকতে দেখে রীতিমতো ভুত দেখার মতো চমকে গেলেন !
সরাসরি তাদের কাছে গিয়ে গ্রামীণ ব্যাঙ্কের ম্যানেজার বাবু জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনারা এখানে” ?
ইমলি উত্তরে বললো, “গদাই তার ভাই । ভোরবেলায় কোথাও না গিয়ে ভাইয়ের দোকানে চা খেতে এলাম” ।
রিতম বাবু এবার গদাইয়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “গদাই, তুমি কী এদের চেনো” ?
হ্যাঁ স্যার ।
তোমার বাড়ির কুটুম । অথচ তারা আজ রাত্রিতে কোথায় ছিলো, জানো কী ?
এইমাত্র দিদির কাছে শুনলাম । তবে দাদা-দিদিদের ব্যাপারে আপনার সাথে আমার কিছু কথা আছে । দুপুর বেলা আমি ব্যাঙ্কে গিয়ে আপনার সঙ্গে দেখা করে কথাগুলি বলবো ।
চা বানিয়ে গদাই সবাইকে মাটির ভাঁড়ে চা পরিবেশন করলো ।
চা খাওয়ার পর ব্যাঙ্কের ম্যানেজার বাবু, বাবু রিতম বাবু ও অন্যান্যরা যার যার বাড়ি চলে গেলেন ।
কুসুমগ্রামে থাকতে গেলে একজন বরিষ্ঠ মানুষের ছত্র-ছায়ায় থাকাটা খুব জরুরি । ইতাস ও ইমলি ওপার বাংলার তাড়া খাওয়া মানুষ, জানাজানি হলেই তাদের প্রতি কুসুমগ্রামের মানুষের স্বাভাবিক নজরের পরিবর্তন ঘটতে বাধ্য । গদাইয়ের আন্তরিক ব্যবহারের জন্য গদাই তাদের একান্ত আপনজন । গদাই একমাত্র পারবে তাদের স্থায়ীকরণের সুরাহার পথ বাতলে দিতে । সাদামাটা ছেলে এবং ভীষণ মানব দরদী ।
ইতাস গদাইকে বললো, “আমাকে একটা কাজ দাও গদাই । এভাবে বসে থাকলে আখেরে আমাদের বেঁচে থাকাটা কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে” !
গদাইয়ের চায়ের দোকানের কাছাকাছি বাজার এলাকায় ঘোরাঘুরি করার জন্য ইমলি উঠে গেল । এই সুযোগে ইতাস গদাইকে অনুনয় বিনয় করে বললো, “ফলের দোকান থেকে কিছু পেয়ারা কিনে অথবা ধারে জোগাড় করে দিলে আমি সেগুলো বিক্রি করে পয়সা ফেরত দিয়ে দিতাম” ।
ইতাসের পেয়ারা বিক্রি করার প্রস্তাবে গদাই খুব খুশী । এক গাল হাসি দিয়ে সে স্পষ্টতই ইতাসকে বললো, “সৎ ভাবে বেঁচে থাকার জন্য যেকোনো কাজ খুব গর্বের” । আবার ইতাসের দিকে তাকিয়ে গদাই বললো, “দাদা, আপনার প্রস্তাবে আমি খুব খুশী । আমি পেয়ারা সংগ্রহ করে আনছি । আপনি আজ থেকেই কাজে লেগে পড়ুন । দেখবেন কাজ করার আনন্দই আলাদা” ।
গদাই একটা ঝুড়িতে পঞ্চাশটি বারুইপুরের পেয়ারা এনে ইতাসের মাথায় তুলে দিলো । শুরু হোলো পয়সার খালি হাতে ইতাসের জীবনের প্রথম ব্যবসা । পরিশ্রম না করলে উপার্জন অসম্ভব । তাই বেঁচে থাকার জন্য উপার্জন অনিবার্য । মাঠের কাজে যেহারে পরিশ্রম, সেই পরিশ্রমের ধকল ইতাসের শরীরে কুলাবে না । খোঁজ নিয়ে ইতাস জেনেছে, মাঠে জন-মজুরের কদর রয়েছে । বিশেষ করে চাষের মরশুমে মাঠে জন-মজুরের ভীষণ আকাল । তাছাড়া ধান রোয়ার সময়, ধান কাটার সময়, ধান ঝাড়ার সময় অনেক সংখ্যায় জন-মজুরের প্রয়োজন । ফলে বলা চলে, চাষবাসে সারা বছর জন-মজুরের কাজ থাকে । কিন্তু ইতাসের সেদিকে মন টানলো না । তাই ব্যবসা করে খাওয়ার দিকে ঝুঁকলো ।
“পেয়ারা চাই, পেয়ারা” । মেমারী-মালডাঙ্গার বাস ঢুকতেই ইতাস বাসের জানালার দিকে তাকিয়ে হাঁকছে, “পেয়ারা চাই, বারুইপুরের পেয়ারা” । বাস থেকে এক ভদ্রমহিলা নামতেই তাঁর কাছে গিয়ে ইতাস বললো, “দিদি পেয়ারা । ভাল পেয়ারা । বারুইপুরের পেয়ারা” ।
পেয়ারার রঙ ও চেহারা দেখে সেই ভদ্র মহিলা খুব বিগলিত । বারংবার তিনি পেয়ারাগুলির দিকে তাকালেন । তারপর ইতাসকে লক্ষ্য করে বললেন, “এই যে পেয়ারা, দশটা পেয়ারা ভাল করে প্যাক করে দাও” ।
দশটা পেয়ারা কাগজের ঠোঙায় ঢুকিয়ে ভদ্রমহিলার হাতে দিয়ে ইতাস পয়সার জন্য তাঁর দিকে তাকিয়ে রইলো । ভদ্রমহিলা তাঁর পার্স থেকে টাকা বের করে ইতাসকে দিয়ে বললেন, “তোমাকে আগে কোনোদিন বাস স্ট্যান্ডে দেখিনি । নতুন ব্যবসায় নেমেছো বুঝি” ?
“জী, আমি প্রথম হকারি ব্যবসায় নেমেছি” । ভদ্রমহিলার কথার উত্তর দিয়ে অন্যত্র পেয়ারা বিক্রি করতে ইতাস ছুটলো । বেলা একটার মধ্যে সমস্ত পেয়ারা শেষ । বিক্রির পরে হিসাব করে ইতাস দেখলো, “পেয়ারার মূল টাকা শোধ করে তার হাতে লাভ ৬০ টাকা । জীবনে প্রথম ব্যবসায় নেমে প্রথম দিন ইতাস ৬০টাকা লাভের মুখ দেখায় আনন্দে উদ্বেলিত । ইমলি ইতাসের শারিরীক পরিশ্রমে যতোটা না বিচলিত তার চেয়ে অনেক বেশী আনন্দিত ব্যবসার সাফল্য দেখে ।
গদাই ইমলির দিকে তাকিয়ে বললো, “দিদি, ম্যানেজার বাবুর সঙ্গে দেখা করতে যেতে হবে । আর সময় নষ্ট করা যাবে না । এখনই চলুন” ।
“আসবো স্যার” ? ম্যানেজারের চেম্বারে ঢোকার আগে অনুমতি চাইলো গদাই ।
রিতম বাবু গদাইকে দেখে খুশী মনে ডেকে বললেন, “আরে ! গদাই যে । ভিতরে এসে বসো” ।
“আমার সঙ্গে আরও দুইজন অতিথি এসেছেন । তাদেরকে নিয়ে আমি কী ভিতরে আসতে পারি” ? কাঁচুমাচু হয়ে গদাই পুনরায় গ্রামীণ ব্যাঙ্কের ম্যানেজার বাবুকে জিজ্ঞাসা করলো ।
অবশ্যই । সকলকে নিয়েই ভিতরে এসো ।
গদাই ইতাস ও ইমলিকে নিয়ে রিতম বাবুর চেম্বারে ঢুকলো ।
ইমলি কথা শুরু করলো, “স্যার, আপনাকে আমাদের অনুরোধ । আমাদের কথা একটু মনোযোগ দিয়ে শুনুন । আমরা খুব বিপদে পড়ে আপনার স্মরণাপন্ন হয়েছি এবং আপনার সহযোগিতা প্রার্থনা করছি” ।
রিতম বাবু চেয়ারটা নাড়াচাড়া দিয়ে সঠিকভাবে বসে ইমলিদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “হ্যাঁ আপনারা নিসঙ্কোচে বলুন” ।
ইমলি তাদের সমস্ত ঘটনা খুলে বললো । কুসুমগ্রামে তাদের কোনো আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব কেউ নেই । একমাত্র গদাই তাদের সম্মান দিয়ে তাকে “দিদি” বলে ডেকেছে । গদাই তার কাছে আপন ভাইয়ের চেয়ে বড় । কুসুমগ্রামে একমাত্র গদাই তাদের বাঁচার অনুপ্রেরণা জোগাচ্ছে । আজকে আপনার সম্মুখে দুটো কথা বলছি সেটাও গদাইয়ের সৌজন্যে । এবার আমাদের বিনীত প্রার্থনা আপনার কাছে, “আমাদের কিছুদিন আপনার ব্যাঙ্কের বিল্ডিংয়ের পেছনের বারান্দায় থাকতে দিন” । আরও একটা অতিরিক্ত বিপদের মধ্যে পড়তে চলেছি । আপনাদের এখানে থাকার সুযোগ পেলে সেই বিপদ থেকেও মুক্তি সম্ভব !
“অতিরিক্ত বিপদ, বুঝলাম না” । ম্যানেজার বাবু ইতাস ও ইমলিদের দিকে তাকিয়ে তাদের উত্তর শোনার জন্য উদগ্রীব হয়ে রইলেন ।
“আমার স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা ! যদিও এখন প্রাথমিক পর্যায়ে” । ইতাস এই খবরটা ম্যানেজার বাবুকে শোনালো ।
“আপনারা আমাকে ভীষণ সমস্যার মধ্যে ফেলে দিলেন । আপনাদের বর্তমান পরিস্থিতি নিঃসন্দেহে দুঃখজনক ! আর তাছাড়া মানবিক দৃষ্টিকোন থেকে দেখলে আপনাদের সমস্যার সুরাহা সত্বর প্রয়োজন । আপনি সন্ধ্যাবেলায় আবার ব্যাঙ্কে আসুন । আমি আমাদের সহকর্মীদের সাথে কথা বলি । ব্যাপারটা ব্রাঞ্চ লেভেলেই সমাধান দরকার । সুতরাং সেই ক্ষেত্রে সহকর্মীদের মতামত ও সহযোগিতা প্রয়োজন” । রিতম বাবু এইভাবে তাঁর অভিব্যক্তি প্রকাশ করলেন ।
হঠাৎ কৌতুহলবশত ইতাস রিতম বাবুকে জিজ্ঞাসা করলো, “স্যার আপনার বাড়ি কী কুসুমগ্রামে” ?
আমার বাড়ি কুসুমগ্রামে নয় । এবার গদাইয়ের দিকে তাকিয়ে তিনি গদাইকে বললেন, “আমার বাড়ির সম্বন্ধে তুমি তাদের অবহিত করোনি” ?
স্যার, বলার সুযোগ হয়ে ওঠেনি ।
আমার বাসস্থানের খবর দিতে গেলে পুরো ঘটনাটা শুনতে হবে । আমরা সাঁওতাল সম্প্রদায়ের মানুষ । বাবা-মা ঝাড়খন্ডের ছোটনাগপুরের বাসিন্দা । তাঁরা একটা সময় প্রচন্ড আর্থিক দুর্দশার মধ্যে পড়েছিলেন । শুধুমাত্র আমার বাবা-মা নয় ছোটনাগপুরের অধিকাংশ বাসিন্দার এক হাল । খাবার জুটতো না । অর্ধাহারে, অনাহারে দিনাতিপাত । দরিদ্রতার করাল গ্রাসে পড়ে তাঁরা দল বেঁধে ছোটনাগপুর ত্যাগ করেন । তাঁরা আসামের চা বাগানে কাজ নিয়ে চা বাগানের মধ্যের কুঠিতে থাকতেন । তারপর বাবা-মা উত্তর দিনাজপুরের ইসলামপুর শহরের কাছাকাছি একটা অজ পাড়া গাঁয়ে ঘর বানান । কিন্তু সেখানেও বেশীদিন আমরা থাকতে পারিনি । চলে আসি ব্যান্ডেল । ব্যান্ডেলেই আমি মানুষ । চাকরি পাওয়ার পর বিয়ে । তারপর বাবা-মায়ের পরপর বিদায় । এখন আমি ফ্যামিলির সঙ্গে পোস্টিংস্থলেই বাসা নিয়ে থাকি । তবে……!
তবে কী ম্যানেজার বাবু ?
“তবে আপনাদের মতো আমাদেরও কুসুমগ্রামের জল, আবহাওয়া, মানুষজনের ব্যবহার ভাল লেগেছে । সেই কারণে বড় রাস্তার পাশে পাঁচ কাঠা বাস্তু জমি কিনেছি । ভাবছি অচিরেই সেখানে বাড়ি বানাবো” । কথাগুলো বলে রিতম বাবুর হাসি ।
আপনার সঙ্গে কথা বলে খুব শান্তি পেলাম ম্যানেজার বাবু । এবার আমরা উঠি । ঠিক সন্ধ্যা ৬টার সময় পুনরায় আপনার সঙ্গে দেখা করছি । নমস্কার ।
 ( চলবে )