আমি আর রবীন্দ্রনাথ : শিপ্রা দে।

ছোটো বেলায় তোমার সাথে একটু একটু করে পরিচয় এমন ভাবে হয়েছে তা আর কি বোলবো।
তখন তোমাকে চিনিও না,জানিও না অথচ তোমার লেখা পড়েই,গান শুনেই বড়ো হচ্ছি। তখন আমার ছয় কি সাত,খুব মনে আছে।
বসন্ত কাল চারিদিকে রঙের মেলা
আগুন ফুলে ছেয়ে গেছে বন
দোলের খুশিতে সবাই গেয়ে উঠলো

“ওরে গৃহবাসী খোল দ্বার খোল লাগলো যে দোল
স্থলে জলে বনতলে লাগলো যে দোল।”

আর আমি কিছু না বুঝেই বলে উঠলাম

করে হাসাহাসি চল ভাই চল বাজিয়ে মাদল
আজি এ রাতে চল একসাথে করি শোরগোল ।

আমার এক দাদা ধমক দিয়ে বললে কি যা তা বলছিস না পারিস না বল কিন্তু গুরুদেবের অপমান করিস না।আমি হা হয়ে ভাবলাম যাঃ বাব্বা,গুরুদেব আবার কে?
দাদাকে সেদিন জিজ্ঞেস করার সাহস হয়নি তবে পরে জেনেছি ঠাকুর তুমিই দাদার গুরুদেব,অবশ্য এখন আমারও।সেই থেকেই তোমার প্রতি মন আরো আকৃষ্ট হোলো,তোমাকে আরো জানার চেষ্টা বাড়ল।
একদম ছোটবেলা থেকে মায়ের কাছে যখন সবে মাত্র অ,আ,ক,খ, শিখে বানান শুরু করেছি জল,কল,পল,ফল ইত্যাদি ইত্যাদি। একদিন মা বললেন
এবার লেখ। “জল পড়ে পাতা নড়ে।”
তখন পাশের বাড়ির ছেলেপেলেরা আমগাছে ঢিল মেরে কাঁচা আম পাড়তে ব্যস্ত আর আমি জানলা দিয়ে তা দেখতে দেখতে বলে ফেলি।
‘ঢিল মারে ফল পড়ে’
মা বলেন কিরে তোকে কি বললাম আর তুই কি বলছিস? সম্বিত ফিরল মায়ের এক থাপ্পড়ে। অজান্তেই সেদিন এক অনন্য অনুভূতি হয়।
তাঁর কিছুদিন পরেই পঁচিশে বৈশাখ,তার তোড়জোড় চলছে পাড়ার ক্লাবে,স্টেজ সাজানো হচ্ছে তোমার জন্মদিন। আমিও নাচবো তোমার গানে “এসো হে বৈশাখ এসো এসো।” তার প্র্যাকটিস করছি রাতে জ্যোৎস্না আলোয় উঠোনে গুনগুন গান করে করে যাতে আবার কেউ দেখে না ফেলে আবার কি ভুল হবে!
আর বাকিরা চাটাই বিছিয়ে উঠোনে সবাই মিলে বসে আছে, আমাদের বাড়ির উল্টো দিকেই ছিল এক বাঁশের ঝাড় যদি বা সেসব এখন নেই।
জ্যোৎস্না রাত,চাঁদ উঠেছে বাঁশের মাথার ওপর
মা গুনগুন করে যেই গেয়ে উঠলেন।
“বাঁশ বাগানের মাথার ওপর চাঁদ উঠেছে ওই” আমি ছুটে গিয়ে সময়ের অপেক্ষা না করে অমনি বললাম।
“বাঁশ বাগানের মাথার ওপর চাঁদ উঠেছে ওই”
“মাগো আমি চাঁদ ধরবো এনে দে তুই মই”

অমনি মা রেগে গিয়ে বললেন কি বলিস? তুই আর রবীন্দ্রনাথের মান সন্মান রাখবি না দেখছি, বিশ্বাস করো ঠাকুর তখনও আমি জানতাম না এগুলো তোমার গান,তোমার অবদান।একটু একটু করে যতই জানছি তোমায়,শুনছি ,বুঝলাম জীবন তুমিময় সর্বত্রই তোমার অবাধ বিচরণ। তুমি ছাড়া কোনো কথা নেই,কোনো গান নেই,কোনো সুর নেই, কোনো খুশি নেই।আর তুমি ধীরে ধীরে নীরবে আমার ভেতরে সবটাই দখল করে নিলে।
তারপর যাই বলতাম অনেক ভেবে বলতাম কারণ তখন একটু একটু করে বুঝতে পেরেছি যে আমার দুঃসাহস করা আর চলবে না।
তবুও কি তোমায় সবটা জেনেছি ? না ঠাকুর সবটা জানার কথাও নয় আমার ক্ষুদ্র পরিসরে,কতটুকুই বা প্রয়াস করেছি তোমাকে জানার! সমুদ্রের বিশাল জলরাশির এক কণা ও বোধকরি তোমায় জানা হয়নি। তবু,
তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা,তুমি দখিন বাতাস
আমার ঊষর মরুতে তুমিই বয়ে আনো আশ।

তুমিই সকালের সূর্য,ভোরের পাখির কলতান
গ্রীষ্মের দাবদাহ,হেমন্তের শিশির বসন্তের গান।

গুরুদেব তুমি বেঁচে আছো বাঙালির চিন্তায় চেতনায় মননে, সৃজনে ।
সাহিত্যে অবাধ বিচরণে।

তুমি সুখে-সংগ্রামে,বেদনা উচ্ছ্বাসে রাগ-অনুরাগে
প্রেম-প্রকৃতিতে
তুমিই ভোরের রবির কিরণ,শেষ বিকেলের অস্তরাগ,
অনুভূতিতে।
তুমি দখিনা বাতাস চলমান সুর স্বপ্ন মাখা।
ভুবন জুড়ে সবার মনে তোমার ছবি আঁকা

তুমি চির নতুন চির ভাস্বর নব রূপে এসো বারবার
তুমি উদিত সূর্য,জাগ্রত সাহিত্য সভায়
সারা বিশ্বের রবীন্দ্রনাথ তোমাকে প্রণাম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *