আনাড়ি মহিলার উচ্ছৃঙ্খলতা (ধারাবাহিক উপন্যাস, সপ্তম পর্ব) :: দিলীপ রায় (+৯১ ৯৪৩৩৪৬২৮৫৪)।।

0
638

অবশেষে সাড়ে পাঁচটার সময় মালডাঙ্গা থেকে বর্দ্ধমানগামী বাস ছাড়লো বটে, কিন্তু ভয়ে প্যাসেঞ্জারদের বুক দুরদুর ! কখন ঝড় বৃষ্টি শুরু হয় কেউ হলফ করে বলতে পারছেন না । তার উপর যাত্রী বোঝাই বাস । অনেকক্ষণ বাস না থাকার জন্য মানুষ বাড়ি পৌঁছানোর তাগিদে উতলা । যার জন্য বাসে ঠাসাঠাসি ভিড় । বাসের ভিতরে যেমন গাদাগাদি মানুষ, তেমনি বাসের ছাদে অগুণতি মানুষ । তাঁরা গাদাগাদিভাবে ছাদে বসা । বাস চলছে ধীর গতিতে । তারপর বাস কিছুক্ষণ চলার পর মেঘের মৃদুগর্জন । আকাশভর্তি ঘন কালো মেঘের আনাগোনা । মেঘের গর্জনে কান পাতা দায় ! গুরুগুরু মেঘ দেখে বাসের প্যাসেঞ্জাদের মধ্যে আতঙ্কের গুঞ্জন ।
বাস ধীরগতিতে চলছে । যেটা আন্দাজ করা গিয়েছিলো সেটাই । হঠাৎ দমকা বাতাস । রাস্তার দুপাশে ধু ধু চাষের জমি । কোনো বাড়ি ঘর নেই । দূরে রাস্তার পাশে প্রকান্ড একটা বাবলা গাছ । তার পাশে পর পর দুটি তাল গাছ । তাল গাছে বড় বড় তালের কাঁদি । গাছে অনেক তাল ঝুলছে । মেঘলা হাওয়া ক্রমশ জোড়ালো হচ্ছে । বাসের ভিতর থেকে জোর আওয়াজ, বাস থামান ! ড্রাইভার সাহেব বাসের গতি বাড়িয়ে দিয়েছেন । দূরে একটি অশ্বত্থ গাছ । সম্ভবত ড্রাইভার সাহেব অশ্বত্থ গাছের নীচে দাঁড়াবার জন্য বাস জোরে ছোটাচ্ছেন । প্রচন্ড ঝড় । বাতাসের তীব্র ঝাপটা বাসের গায়ে । টিপটিপ বৃষ্টি পড়ার শব্দ । ড্রাইভার সাহেব জোরে চালাতে চেষ্টা করলেও ঝড়ের দাপটের সঙ্গে বাসের ড্রাইভার পেরে উঠছেন না । ড্রাইভার কোনোরকমে অশ্বত্থ গাছের নীচে বাসটা দাঁড় করালেন । ছাদে বসে থাকা প্যাসেঞ্জারেরা নীচে নেমে এলেন । কিন্তু বৃষ্টির হাত থেকে রেহাই পেতে নিরাপদ আশ্রয়ে দাঁড়াবার জায়গা নেই । অন্যদিকে বাসের ভিতর প্যাসেঞ্জারদের ঠাসাঠাসি । সেখানেও ঢোকার উপায় নেই । ঝড়ের প্রচন্ড তেজ । তেমনি শুরু হয়েছে ভারী বর্ষণ ।
সন্ধ্যার কালো অন্ধকার নেমে এসেছে । অশ্বত্থ গাছের তলায় আশ্রয় নিয়েও মাথার উপরের বৃষ্টির জল আটকানো যাচ্ছে না । বাসের ভিতরে একটা ত্রিপল পাওয়ায় কিছুটা রেহাই । যেমনি বাতাসের ঝাপটা, তেমনি একটানা বৃষ্টি । বাসের ভিতর যাত্রীদের কোলাহল তুঙ্গে । প্যাসেঞ্জারদের চোখে মুখে বাড়ি পৌঁছানোর দুশ্চিন্তার ছাপ স্পষ্ট ।
ইতাস নিজের চেয়েও বেশী উতলা ইমলিকে নিয়ে । দুশ্চিন্তায় ভারাক্রান্ত । বেচারা ইমলি, কিভাবে ঝড় বৃষ্টিতে ঘরে একা । এই কথাটা ভাবতেই তার প্রচন্ড কষ্ট । ইতাস ভালভাবেই জানে, বৃষ্টির চেয়ে ঝড়ে ইমলির বেশী ভীতি । এইজন্যেই তার দুশ্চিন্তা । বিয়ের পরে একদিন প্রবল ঝড়ের সময় ওদেশের বাড়িতে ইমলির ভীতি দেখে ইতাস রীতিমতো ঘাবড়ে গিয়েছিলো । সেই থেকে তার জানা, ঝড়ের তান্ডবকে ইমলি খুব ভয় পায় । এই মুহূর্তে ইতাসের মায়ের কথা ভীষণ মনে পড়ছে । সেই লাগামছাড়া প্রবল ঝড়ের সময় ইতাসের মা ইমলিকে নিয়ে শোওয়ার ঘরে খাটের পাশে চুপটি করে বসেছিলেন । ঝড় থামার পর ইমলির শান্তি । কিন্তু বৃষ্টিতে ইমলি আবার স্বচ্ছন্দ । বৃষ্টিতে ভিজতে তার খুব মজা । ব্যাঙ্কের বাবুরা চলে যাওয়ার পর ইমলির কী দুর্দশা হবে সেকথা ভেবেই ইতাস যারপরনাই বিচলিত । উৎকন্ঠায় জর্জরিত ।
প্রায় একটানা একঘন্টা ঝড় বৃষ্টি । তারপর পুনরায় বাস ছাড়লো । বাস ছাড়ার জন্য প্যাসেঞ্জারদের মধ্যে খুশীর বাতাবরণ । তাঁরা এতক্ষণে নিশ্চিন্ত, অন্তত নিজ নিজ বাড়ি পৌঁছাতে পারবেন ।
হায় রে ! সকলের মাথায় হাত ! বাসের পেছনের ডানদিকের টায়ার পামচার অর্থাৎ টায়ার থেকে হাওয়া উধাও । বাসে রাখা অতিরিক্ত টায়ার না লাগানো পর্যন্ত বাস নড়বে না । বাসের খালাসি, ড্রাইভার ও কন্ট্রাক্টর তিনজনেই টায়ার লাগাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন । মোবাইলের টর্চের আলোতে টায়ার লাগানোর কাজ চলছে । অত্যধিক ভিড়ের জন্য টায়ার পামচার, জনৈক বাস যাত্রীর অভিমত । যাই হোক বাস কর্মীদের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় আধা ঘন্টার মধ্যে টায়ার লাগানো শেষ ।
কুসুমগ্রামে বাস থেকে নামা মাত্র গদাই ইতাসকে ডাকলো, “দাদা আমি এদিকে । আমার সাথে দিদি রয়েছে” ।
“তোমরা এখানে” ? উদ্ভ্রান্তের মতো চিন্তাগ্রস্থ মনে প্রশ্ন করলো । আবার ইমলির দিকে তাকিয়ে ইতাস জিজ্ঞাসা করলো, “তুমি ঠিক আছো তো” ?
“দিদি ঝড়ের আগে আমার দোকানে চলে এসেছে । দিদির নাকি ঝড়ে ভয় ! তাই ঝড়ের আগে আমার দোকানে পৌঁছে গেছে । আমার দোকানও ঝড়ের তান্ডবে লন্ডভন্ড” ! দোকানের দিকে আঙ্গুলের ইশারায় ইতাসকে গদাইয়ের দোকানের জীর্ণদশা দেখালো । দোকান ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণে গদাইকে ভীষণ হতোদ্যম দেখাচ্ছে ।
গদাইয়ের হতোদ্যম পরিস্থিতি দেখে ইতাস তাকে উৎসাহ দিয়ে বললো, “তুমি দুশ্চিন্তা করো না ভাইয়া । দোকানের ভাঙাচোরা অবলবস্থা শীঘ্রই ঠিক হয়ে যাবে । দরকার হলে আমিও তোমার সাথে তোমার দোকান স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে কোমর বেঁধে লেগে পড়বো । তুমি অযথা টেনশন করবে না” ।
“আমি একাই সামলে নেবো । একটা অতিরিক্ত খাটুনি এবং খরচার মধ্যে পড়লাম, এটাই আপশোশ” ! তারপর ইমলি ও ইতাসের দিকে তাকিয়ে গদাই বললো,”আপনারা বরং বাড়ি গিয়ে দেখুন ঘরের কী অবস্থা ? ঝড়ের যা তান্ডব দেখলাম তাতে আমার সন্দেহ, ঘরের ত্রিপল লন্ডভন্ড হয়ে গেলো কিনা” ? গদাই উল্টে ইতাস ও ইমলিকে বাড়ি যাওয়ার জন্য তাগাদা দিলো ।
তারপর ইতাস ও ইমলি ছুটলো তাদের ডেরায় । তখন রাত্রির ঘনকালো অন্ধকার । লোডশেডিং চলছে । কুসুমগ্রামে লোডশেডিং নিত্যকার ঘটনা । আবার ঝড় বৃষ্টির ক্ষেত্রে লোডশেডিং কতক্ষণ চলবে কেউ গ্যারান্টি দিয়ে সময় বলতে পারবে না । লোডশেডিংয়ের কথা মাথায় রেখে ইতাস একটা দেশলাই ও মোমবাতি কিনে ডেরায় ঢুকলো । ব্যাঙ্কের পিছনের বারান্দায় দিয়ে দেখে ঝড়ের জন্য সব তোলপাড় । পুরো বারান্দাটায় ওলট-পালট । বারান্দা ঘেরাওয়ের ত্রিপল ঝড়ের দাপটে উড়ে অন্যত্র পড়ে রয়েছে । রান্নার উনুন, হাঁড়ি-কড়াই বারান্দার বাইরে গড়াগড়ি । বারান্দায় বিছানো শতরঞ্চি বৃষ্টির জলে ভিজে একশা । বারান্দায় ত্রিপল টাঙানো ঘর, এখন আর ঘর নেই । ফাঁকা বারান্দা । জলে ভিজা । রান্না করে খাওয়া দাওয়ার চিন্তা মাথা থেকে উধাও । এখন চিন্তা, কিভাবে রাত্রি যাপন ? ঘরের এইরূপ একটা তালগোল পাকানো পরিস্থিতির মধ্যে পড়বে তাদের ধারণার বাইরে । তারা কিছুতেই ভাবতে পারছে না, ঝড়ে তাদের ডেরার ক্ষতি করবে ? কঠিন ভয়াবহ বাস্তব পরিস্থিতি ।
অগত্যা বারান্দায় বসে রাত কাটানো । ইতাস ও ইমলি দুজনের মধ্যে রাত পোহালেই কাজ কর্মের ফিরিস্তি নিয়ে আলাপ আলোচনা । সকাল বেলায় রৌদ্র উঠলে, ত্রিপল শুকিয়ে আবার যথাস্থানে লাগাতে হবে এবং সেটা করতে হবে ব্যাঙ্ক খোলার আগে । নতুবা গ্রাহকেরা ব্যাঙ্কে ভিড় করলে তখন গ্রাহকের সামনে দিয়ে ঘোরাঘুরি, ত্রিপল টানাটানি, বেমানান । আর তাছাড়া ইতাসকে হকারির কাজে বের হতে হবে । ঘরে রাখা প্রায় কেজি খানেক বাদাম ও কেজি খানেক চানাচুর জলে ভিজে নষ্ট । আগরওয়ালের কারখানা থেকে মাল না তুললে পরেরদিন হকারিতে ইতাসের বের হওয়া সম্ভব না । ত্রিপল বাঁধাবাধি, মাল আনা, এইসব করতে তার একবেলা কামাই । ইমলি মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লো । ঘরে বেশ কিছু মুড়ি রাখা ছিলো, সেগুলোও বৃষ্টিতে ভিজে নষ্ট । চারিদিকে অন্ধকার । রাস্তার পাশের সমস্ত দোকান বন্ধ । তাই রাতের খাবারের আশা, পুরোপুরি নিস্ফল আশা ।
বৃষ্টির জলে ভেজা বারান্দা পরিস্কার করে হাওয়ায় শুকিয়ে নিলো । তারপর তারা দুজনে ব্যাঙ্কের বারান্দায় পাশাপাশি বসেই রাত কাটিয়ে দিলো । ঘুম একদম হয়নি । একদিকে মশার কামড়, অন্যদিকে বৃষ্টি হওয়ার জন্য প্রচন্ড কনকনে ঠান্ডা হাওয়া । ইতাস একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইমলিকে বললো, “আমরা বাঁচার জন্য লড়াই করছি । ঘুরে দাঁড়াবার চেষ্টা করছি । ঠাঁই বানাবার আমাদের মরিয়া প্রয়াস । অথচ আমাদের চলার পথে পদে পদে বাধা । বারান্দার ঘর ঝড়ে ভেঙ্গে দিলো । এটা বানাতে পুনরায় অনেক মেহনত । হনুমানগুলি কলা খাওয়ায় তার খেসারত । ঘরে রাখা ভাজাগুলির দফারফা । প্রায় একটা দিন কাজ বন্ধ । বৃষ্টির জলে ভিজে শরীর আনচান । জ্বর এলে আর এক বিপদ” । তারপর ইমলির দিকে তাকিয়ে হতাশভাবে ইতাস বললো, “আমরা শেষ পর্যন্ত কী বেঁচে থাকতে পারবো” ?
ইমলি ইতাসকে সান্ত্বনা দিয়ে বোঝালো, “তুমি অযথা উতলা হবে না । সুদিন আমাদের ফিরবেই । শুধুমাত্র সময়ের অপেক্ষা” ।
“তুমি বলছো বটে, কিন্তু ভবিষ্যতে উন্নয়নের ব্যাপারে আমি সন্দিহান” ?
ভোরের আলো দেখা দিতেই ইতাস কোমরে গামছা বেঁধে কাজে নেমে পড়লো । ত্রিপল গুছিয়ে প্রাচীরের উপরে শুকানোর জন্য টাঙিয়ে দিলো । ঝড়ের তান্ডবে দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া রান্নার উনুন ঠিক করলো । হাঁড়ি-কড়াই ও অন্যান্য বাসন কলের পারে ভাল করে মেজে, ধুয়ে সাজিয়ে রাখলো । ঘরে যেসব টুকিটাকি খাবার ছিলো সেগুলোর অবস্থা মর্মান্তিক । পুরোটাই নষ্ট । তাই মুড়ি, চানাচুর ভাজা, বাদাম ভাজা, ইত্যাদি কাগজের মধ্যে দলা পাকিয়ে বাইরে ডাস্টবিনে ফেলে দিলো । ঘন্টা খানেকের মধ্যে পুরো জায়গাটার পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করা এবং গুছানো শেষ । এবার ত্রিপল এনে পুনরায় বারান্দা ঘিরে ঘরের মতো তৈরী করলো । তারপর ইমলিকে বললো, “এবার চলো কোথাও চা খেয়ে আসি” ।
দুজনে চা খেতে সোজা গদাইয়ের দোকানে । সেখান থেকে চা খেয়ে ইতাস মেমারী চলে গেলো হকারির জন্য মাল আনতে । আর ইমলি ব্রাঞ্চে ছুটলো ব্যাঙ্কের ঘরদোর ঝাঁট দিতে । এক ঘন্টার মধ্যে ইমলিকে কাজ সারতে হবে । দশটায় অফিস । বাবুরা আসার আগে চেয়ার টেবিল সহ সমস্ত আসবাবপত্র পরিস্কার করতে হবে । সেখানে দায়সারা কাজ সারলে চলবে না । ইমলি কখনই চায় না, তার কাজের উপর কেউ বিরূপ মন্তব্য করুক । যার জন্য ব্রাঞ্চে প্রত্যেকটা স্টাফ ইমলির কাজের ব্যাপারে প্রশংসায় পঞ্চমুখ ।
দশটায় ব্যাঙ্কের বাবুরা অফিসে ঢুকলেই এক প্রস্ত তাদের জন্য চা । সেই চা খেয়ে তাঁদের দিনের কাজ শুরু । সেই কারণে সকালের চা, ইমলি খুব মনোযোগ দিয়ে তৈরি করে । যাতে চা খেয়ে বাবুরা হাসিমুখে কাজে মন দিতে পারেন ।
ব্যাঙ্কে ঢোকার একগোছা চাবি ইমলির কাছে থাকে । ম্যানেজার বাবুর নির্দেশ মতো ব্যাঙ্কের ঘর খোলার চাবিগুলি তাকে দেওয়া । যাতে ব্যাঙ্ক খোলার আগে ব্যাঙ্কের ভিতর-বাহির পরিস্কার করা সম্পূর্ণ হয়ে যায় । নতুবা বাড়ি থেকে বেরিয়ে দৌড় ঝাঁপ করে অফিসে পৌঁছে স্টাফদের তখন খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকাটাই ঝকমারি ! যেটা স্থায়ী ঝাড়ুদার সোরেনের ক্ষেত্রে মাঝে মাঝেই ঘটে । ম্যানেজার বাবুর বকা খেয়েও তার শুধরাবার লক্ষণ নেই । সেই কারণে অফিসের বাবুদের ইমলির উপর অতিরিক্ত ভরসা । ইমলি সেই ভরসার মান রাখতে যথেষ্ট তৎপর । আর তাছাড়া ব্যাঙ্কের বাবুরা ইমলিকে ভীষণ বিশ্বাস করেন । সেই কারণে তাকে চাবির গোছা দেওয়া । অথচ স্থায়ী স্যুঈপার সোরেনকে ম্যানেজার বাবুর বাড়ি গিয়ে চাবি এনে ব্যাঙ্কের ঘর খুলতে হয় । এখানেই ইমলি ভরসার মানুষ । তাই “ব্যাঙ্কের চাবি দেওয়া” ব্যাঙ্কের সাহেবদের তার উপর আস্থার নমুনা । সুতরাং ইমলি তার জান থাকতে “সেই আস্থা” কিছুতেই নষ্ট হতে দেবে না । ঝড় জলে ভিজবে তবুও চাবি থাকা সত্বেও ব্যাঙ্কের ঘর খুলে আশ্রয় নেবে না । এখানেই ইমলি স্বতন্ত্র । এটাই তার স্বচ্ছতার পরিচয় ।
যথাসময়ে ক্যাশিয়ার বাবু ব্যাঙ্কে ঢুকে গেলেন । পেছন পেছন ম্যানেজার বাবু ঢুকলেন । ব্রাঞ্চে ঢুকেই ম্যানেজার বাবু ইমলিকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন, “ঝড় জলে আপনারা ভাল ছিলেন তো” ?
ম্যানেজার বাবুর কথা শুনে ইমলির চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ার উপক্রম । নিজেকে কোনোরকমে সামলে নিয়ে ম্যানেজার বাবুর দিকে তাকিয়ে বললো, “হ্যাঁ স্যার । আমরা ভাল ছিলাম” ।
ইমলির কথা বলার জড়তা অবলোকন করে ম্যানেজার বাবুর সন্দেহ, কিছু একটা গোপন করছেন ইমলি ম্যাডাম । তাই নিজে চেম্বার থেকে বেরিয়ে পেছনের বারান্দায় গিয়ে দেখেন সব ওলট-পালট । ত্রিপল পুনরায় বেঁধেছে ঠিকই, কিন্তু তাতে অনেক খামতি । পুনরায় ঝড় উঠলে ঐ ত্রিপলের অস্থিত্ব কিছুই টিকবে না । তাই তিনি ইমলি ম্যাডামদের দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতি দেখে একটা লোক ডেকে এবং দুটো বাঁশ কিনে বারান্দার ঘরটা আরও পোক্ত করে পুনরায় বানিয়ে দিলেন । তিনি বুঝতে পারলেন, ইমলি ম্যাডাম আর পাঁচটা মহিলার মতো নয় । যার জন্য রাত্রিতে অতীব কষ্টে থাকা সত্বেও এক বারের জন্য সেইকথা মুখ ফুটে বললেন না, বরং হাসি মুখে ব্যাঙ্কের কাজকর্ম সারছেন ।
ক্যাশিয়ার বাবু পাউরুটি ও ছটা পাকা কলা কিনে চোখ গরম করে ইমলি ম্যাডামকে বললেন, “আগে এটা খেয়ে তারপর অন্যান্য কাজ করুন । আপনি অসুস্থ হয়ে পড়লে আমাদের কে দেখবে” ?
ক্যাশিয়ার বাবু ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর ইমলি তার চোখের জল ধরে রাখতে পারলো না । কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো । তারপর কিছুটা শান্ত হয়ে কলা ও পাউরুটি খেয়ে পরপর ঢকঢক করে দুই গ্লাস জল খেলো । তার প্রচন্ড ক্ষিদেও পেয়েছিলো, কিন্তু সেটা ব্যাঙ্কের বাবুদের চোখ এড়ালো না । এটাই ইমলির কাছে বড় সম্মান । সেই কারণে ব্যাঙ্কের বাবুদের উদারতা, মহানুভবতা অবলোকন করে ইমলির চোখে আনন্দাশ্রু ।
মেমারী থেকে মাল নিয়ে সোজা কুসুমগ্রাম । ঘরে মাল রাখতে এসে ইতাস অবাক ! ঘরের চেহারার আমূল পরিবর্তন । সকাল বেলায় সে কোনোরকমে গোঁজাতালি দিয়ে ত্রিপল টাঙিয়ে চলে গিয়েছিলো, যাকে বলে ঠ্যাকার কাজ কোনোরকমে সামাল দেওয়া । কিন্তু এখন বারান্দার চেহারা দেখে নিজে নিজেই অবাক । নিশ্চয়ই ব্যাঙ্কের বাবুদের কাজ । বাঁশ ফাটিয়ে বাঁশের ফলা দিয়ে শক্তভাবে ত্রিপল বারান্দার থামের সাথে এমনভাবে বেঁধে দিয়েছে যাতে বড় ঝড় এলেও ত্রিপল উড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার ভয় নেই । ইতাস তাদের ঘরের অবস্থা দেখে খুশীতে ভরপুর ।
ঘরে মাল গুছিয়ে রেখে ইমলিকে না জানিয়ে আবার বেরিয়ে পড়লো । চানাচুর, বাদাম, ভুজিয়া, ইত্যাদি ভাজাগুলির প্যাকেটিং না হওয়ার জন্য ভাজাভুজি বিক্রির জন্য বের হতে পারলো না । সেই কারণে কলিতা দাদার ফলের দোকান থেকে এক ঝুড়ি বারুইপুরের পেয়ারা মাথায় নিয়ে হকারিতে ছুটলো । দেশী পেয়ারার চেয়ে খরিদ্দারদের বারুইপুরের পেয়ারার কদর বেশী । তাই ইতাসের বারুইপুরের পেয়ারা বিক্রির দিকে ঝোঁক ।
মালডাঙ্গার লোকাল বাসে উঠে পড়লো ইতাস । মালডাঙ্গা বাজারে মাল বিক্রির ক্ষেত্রে ইতাসের কাছে পয়া । হেঁকে হেঁকে তার বিক্রিবাট্টা সর্বদাই সন্তোষজনক । যার জন্য মালডাঙ্গার বাজারের প্রতি তার দুর্বলতা । মন্তেশ্বরের বাজারের প্রতি অতোটা ঝোঁক নেই, যতোটা মালডাঙ্গার প্রতি । ইতাস মনে করে, কুসুমগ্রামের পরে তার কাছে বেচাকেনার পয়া বাজার ঐ মালডাঙ্গা । তারপর মালডাঙ্গায় নেমে বাস স্ট্যান্ডের আশেপাশে পেয়ারার ঝুড়ি নিয়ে হাঁকাহাঁকি । সূর্য অনেক আগেই পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়েছে । অস্ত যাওয়ার মুখে । হাঁকাহাঁকিতে পেয়ারা বিক্রি জমে উঠলো । রাস্তায় দাঁড়িয়ে একজন যুবক ছেলের সাথে বয়স্থা মেয়ে । হঠাৎ তারা ইতাসকে ডাকছে, “এই যে পেয়ারা দাদা । এদিকে এসো” ।
তাদের কাছে গিয়ে ইতাস বললো, “পেয়ারা কিনবেন দিদিমণি” ।
“হ্যাঁ । ভাল দুটো পেয়ারা বেছে কেটে বিট লবন মাখিয়ে দাও” । তারপর আবার ইতাসের দিকে তাকিয়ে বললো, “আপনার কাছে কী কাঁচা লঙ্কা আছে” ?
আছে দিদিমণি ।
তাহলে কাঁচা লঙ্কা কুচিকুচি করে কেটে পেয়ারার সাথে মাখিয়ে দাও । ঝাল ঝাল পেয়ারা খেতে ভীষণ সুস্বাদু ।
“ঠিক আছে দিদিমণি” । বলেই ঝুড়ি নামিয়ে দুটো পেয়ারা টুকরো টুকরো কেটে স্টীলের কৌটায় রাখলো । তারপর কাঁচা লঙ্কার কুচি, বিট লবন, টক-ঝাল-মিষ্টির মসলা, ইত্যাদি দিয়ে সুন্দর করে মাখিয়ে কাগজের প্লেটে সাজিয়ে মেয়েটার উদ্দেশ্যে ইতাস বললো, “দিদিমণি, আপনার পেয়ারা মাখানো শেষ । এবার মাখানো পেয়ারা ধরুন । খেয়ে বলবেন, কেমন হয়েছে” ?
“মেয়েটা দু-টুকরো পেয়ারা মুখে দিয়েই বললো, “ভাল মাখিয়েছেন দাদা” । তারপর যুবকটি তার মানি ব্যাগ থেকে টাকা বের করে ইতাসকে দিলো । তারা চলে যাওয়ার পর হঠাৎ অল্প বয়সী স্কুলের ড্রেস পরা কতকগুলি মেয়ে তাকে ঘিরে ধরলো । পেয়ারা মাখানো দেখে বাচ্চা মেয়েগুলি ইতাসের পেয়ারার ঝুড়ির সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়লো । সবাই একসঙ্গে চিৎকার করে বললো, “আমাকে আগে দিন প্লিজ” । বাচ্চা মেয়েদের চিৎকারের মাঝে দ্রুত গতিতে পেয়ারা মাখিয়ে যাচ্ছে এবং মাখানো পেয়েরার প্লেট মেয়েদের হাতে ধরিয়ে দিচ্ছে ইতাস । নিমেষের মধ্যে সবাইকে পেয়ারা মাখানো দেওয়া শেষ । সাথে সাথে তার ঝুড়ির পেয়ারাও শেষ ।
এবার ইতাস রাস্তার পাশে ঝুড়িটা রেখে টিউবওয়েলে গিয়ে পেয়ারা মাখানোর স্টীলের কৌটাটা ভাল করে ধুয়ে নিলো । তারপর তার হাত-পা ধুয়ে গামছা দিয়ে মুছে ইতাস ভাবলো, এবার দয়াময়ের দোকানে বসে এক কাপ চা খাওয়া যাক । সেইজন্য ঝুড়ির উপরে গামছা রেখে ঝুড়িটা বা-হাতে নিয়ে দয়াময়ের চায়ের দোকানের দিকে ধাবিতো হোলো । সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার বাসে তাকে কুসুমগ্রামে ফিরতে হবে । বাসের অনেক সময় বাকী । ততোক্ষণে আরাম করে তার চা খাওয়া হয়ে যাবে । এমন সময় পেছন থেকে এক মহিলা কন্ঠস্বর, “ইতাস সাহেব, একটু দাঁড়ান প্লিজ” ? মনে মনে ভাবছে ইতাস, সে এদেশে সাহেব হোলো কবে ? নিশ্চয় ভদ্রমহিলা অন্য কাউকে ডাকছেন । সেইজন্য পেছনে না তাকিয়ে ইতাস তার নিজস্ব ঢঙে হাঁটতে থাকলো ।
পেছন থেকে জোরে পা চালিয়ে ঐ মহিলা ইতাসের কাছে পৌঁছে ইতাসের ডান হাত টেনে ধরে বললো, “বলছি, দাঁড়ান ! অথচ আপনি আমার ডাকের তোয়াক্কা না করে বেমালুম হেঁটে যাচ্ছেন” ।
ভুল হয়ে গেছে ম্যাডাম ।
উঁহু, ম্যাডাম নয় । শুধু দীপালি । আগেই বলেছি আমার নাম ধরে ডাকবেন । ভুল যেহেতু হয়েছে, শাস্তি আপনাকে পেতেই হবে ।
ওরে বাবা ! শাস্তি কেন ? আমাকে বাড়ি যেতে হবে । বেশী দেরী হলে আমি সাড়ে ছটার বাস পাবো না । বাস না পেলে আর এক কেলেঙ্কারি, বাড়ি যেতে হবে দেরী ।
আজ অতো সহজে ছাড়ছি না । আপনার সাথে আমার অনেক কথা আছে । সেগুলো আপনাকে শুনতে হবে ।
আমার মতো অভাগা হকারের সাথে আপনার মতো সুন্দরী মহিলার আবার কী কথা থাকতে পারে, আমার মাথায় কিচ্ছু ঢুকছে না ?
মুখে আপনার মিষ্টি কথার ফুলঝুড়ি !
সেটা আবার কী ?
এই যে বললেন, “সুন্দরী মহিলা । আমি তো সুন্দরী মহিলা নই । সবাই আমাকে বলে পেত্নী” ।
“আমি আবার পেত্নীদের ভীষণ ডরাই” । ইতাস দীপালি ম্যাডামের সঙ্গে রসাত্মক কথায় মজে গেলো ।
“এবার আপনার ঘাড়ে পেত্মী ভর করবে । চলুন………?
কোথায় ?
আমার সঙ্গে ।
সেটা বলবেন তো, আমাকে কোথায় যেতে বলছেন ? অথচ আমাকে সাড়ে ছ’টার বাসে বাড়ি ফিরতে হবে । আমার বৌটা না খেয়ে বসে থাকবে । তাছাড়া রাতের বেলায় গিন্নি একা একা বড্ড ভয় পায় ।
“বুঝতে পারছি আপনি একজন বৌ-পাগল পুরুষ । ঠিক আছে, বৌয়ের কাছে যাবেন । এখন চলুন” ?
আরে বলবেন তো, “কোথায় যাবো” ?
এখন আপনি দোকানে বসে আমার সঙ্গে জল খাবার খাবেন ।
আমার পকেট শূন্য ।
শূন্য বললে হবে ? এতগুলি পেয়ারা বিক্রি করলেন, সেই পয়সা কোথায় গেলো মশায় ? ভয় নেই, আমি আপনার পকেট ফাঁকা করে কিছু খাবো না । আমি আপনাকে খাওয়াবো ।
আপনি কেন খাওয়াবেন ?
অতো কথার উত্তর দিতে আমি পারবো না মশায় । চুপচাপ চলুন । নতুবা আমি চিল্লিয়ে লোক জড়ো করবো । লোক জড়ো করে বলবো, আপনি আমার সঙ্গে ……ইয়ে করছেন ?
ইয়ে মানে বুঝলাম না ।
“কিচ্ছু বুঝতে হবে না । চলুন” । দীপালি ম্যাডাম ইতাসের হাত ধরে টান দিলো ।
আপনাকে নিয়ে মহা মুশকিলে পড়লাম ।
এবার দীপালি ম্যাডাম ঠিক ইতাসের কানের কাছে ফিসফিস করে বললো, “আপনাকে আমার মনে ধরেছে । বুঝলেন মশায়” ।
সেটা তো বুঝলাম । কিন্তু আপনি তো আমার বিপদ ডেকে আনছেন । আপনার মানুষটা এসে আমার পিঠের চামড়া তুলে নিলে আমাকে কে বাঁচাবে ?
সেই ভয় নেই ।
সেটা কী রকম ?
আমার মানুষটা এমন একটা দেশে চলে গেছে যেখান থেকে ফেরা অসম্ভব !
ম্যাডামের উত্তর শুনে ইতাসের মনটা তাৎক্ষণিক বেদনায় ভরে উঠলো ।
তারপর তারা দুজনে খাবারের দোকানে ঢুকলো । মালডাঙ্গা বাজারের মধ্যে এটাই ভাল খাবারের দোকান । সন্ধ্যাবেলায় সিঙারা মিষ্টির অর্ডার দিলো দীপালি ম্যাডাম । অনেক দিন পরে ইতাসের মিষ্টি খাওয়ার সৌভাগ্য জুটলো । তারপর আনন্দোচ্ছ্বাসের চোখে ইতাস দীপালি ম্যাডামকে বললো, “প্রায় একটা যুগ পরে মিষ্টি খাওয়ার সৌভাগ্য ঘটলো” ।
আমি একটা কথা বলবো ইতাস বাবু ?
“নিশ্চিন্তে বলুন । তবে খাওয়ার পেমেন্ট আমি মেটাতে পারবো না । পেমেন্ট ছাড়া অন্য সব কথা বলুন” । ঢাকঢাক-গুড়গুড় না করে পকেট খালি ব্যাপারটা আবার বুঝিয়ে দিলো ।
দীপালি ম্যাডাম মুচকী হাসলো । তারপর ইতাসের দিকে তাকিয়ে বললো, “আমার কিন্তু দৃঢ় বিশ্বাস আপনি হকার নয় । হকারি করতে বাধ্য হয়েছেন । আপনার চেহারা, ভাবভঙ্গি, আচার – আচরণ, অন্য কথা বলে । আপনি নিঃসন্দেহে বড় ঘরের সন্তান” !
আমার ইতিহাস শুনলে আপনি হার্ট ফেল করবেন ।
“হার্টফেল করলে আপনি আমাকে শ্মশানে নিয়ে যাবেন । তবুও আপনার জীবনের কথা আমাকে শুনতে হবে । আপনার আজকের পরিস্থিতির জন্য কে বা কারা দায়ী” ? ইতাসের জীবনের ঘটনা শোনার উপর দীপালি জোর দিলো ।
খেতে খেতে নানান প্রসঙ্গে দু-চার কথা । হাসি ঠাট্টা গল্প গুজব । দীপালি বাস স্ট্যান্ড পর্যন্ত একসঙ্গে এসে ইতাসকে বাসে তুলে দিয়ে বাড়ি ফিরলো ।
দীপালি ম্যাডামের হাতের ছোঁয়ায় ইতাসের পরিশ্রান্ত, ক্লান্ত শরীরে এক ঝলক ঠান্ডা বাতাসের অনুভূতি । অন্তরের গহনগাঙে খুশীর বাতাবরণ ।
তারপর বাড়ি পৌঁছে দেখে ইমলি বসে বাদাম, চানাচুর, ভুজিয়া, ডালমোটর, নিমকি, ইত্যাদি ভাজাগুলির প্যাকেটিংয়ে ব্যস্ত ।
ইমলি ইতাসের দিকে তাকিয়ে দেখে, ইতাস অন্যান্য দিনের চেয়ে আজ বেশী তরতাজা । শারীরিকভাবে চাঙা । তার চোখে মুখে খুশীর ছাপ । শরীরে হাড়ভাঙ্গা খাটুনির ক্লান্তি উধাও । ইতাসের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা ইমলি ভালভাবে জানে । সুতরাং তার চোখ এড়ানো কঠিন ! তাই নিজেকে চেপে রাখতে না পেরে ইমলি মুচকী হেসে জিজ্ঞাসা করেই ফেললো, “আজ এত খুশী কেন ? লাভের অঙ্ক বেশী, না অন্যকিছু” ?
“অন্যকিছু” মানে বুঝলাম না ।
কোনো মধুর সম্পর্কে জড়ালে কিনা ?
“কি যে বলো ইমলি । এবার দয়া করে খেতে দাও । বড্ড খিদে পেয়েছে” ।
ইমলি ও ইতাস রাতের খাবার খেয়ে শুয়ে পড়লো ।
পরদিন ভোরবেলা মুখরোচক ভাজাগুলি ব্যাগে গুছিয়ে রেখে নিজেই চা বানাতে লেগে গেলো ইতাস । দুজনে বসে চা ও মুড়ি খেয়ে যে যার কাজে লেগে পড়লো । ইমলি ছুটলো ব্যাঙ্কের বাবুদের ক্যান্টিনের রান্নার বাজার করতে । আর ইতাস ছুটলো কুসুমগ্রাম বাস স্ট্যান্ডে । ইমলির একটা দিকে বাঁচোয়া, যেহেতু ইতাস দুপুরে বাড়ি ফেরে না তাই দুপুরের রান্নার চাপ নেই । দুপুরের খাবার ইতাস হোটেলে খায় । তারপর বাস স্ট্যান্ডে ঢোকার আগে গদাইয়ের দেখা । গদাই জোর করে ইতাসকে তার দোকানে বসিয়ে চা খাওয়ালো । গদাই ভীষণভাবে ইমলির ভক্ত । ইমলিকে দিদি বলতে অজ্ঞান । গদাই ইতাসকে জানালো, সে দিদির জন্য গাঁয়ের গাছ থেকে বেশ কয়েকটা হিমসাগর গাছ-পাকা আম এনেছে । সেগুলি একটু পরে দিদিকে দিতে যাবে । গদাইয়ের কথা শুনে ইতাস শুধুমাত্র হাসলো । তারপর টুকিটাকি কথা শেষে নিজ কাজে মনোযোগ দিলো ।
ভাজাভুজির প্যাকেট নিয়ে ইতাসের এবাস-ওবাসে হাঁকাহাঁকি করলেও তার মন পড়ে রয়েছে মালডাঙ্গার দিকে । দীপালির হাসি মুখটা তার অন্তরে মণিকোঠায় উদ্ভাসিত । দীপালির সঙ্গে দেখা না হওয়া পর্যন্ত তার মন বড্ড চঞ্চল । দীপালির প্রতি একটা প্রচ্ছন্ন টানের মাধুর্য সমুজ্জ্বল । মিষ্টি মধুর ভাললাগার টান ! যেটা সে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে ।
তারপর একটু বেলায় ইতাস মালডাঙ্গার বাসে উঠে পড়লো । ইতাসের বিক্রিবাট্টা আজকাল অনেকটাই ঊর্ধ্বগামী । ফলে তার চিত্তে তুষ্টি নীরবে প্রবহমান । বাসের মধ্যে বসে ইতাস হকারি ছেড়ে অন্য ব্যবসার কথাও ভাবছে । তার ধারণা, হকারিতে বেঁচে থাকা যাবে কিন্তু জায়গা জমি কিনে ঘর বাঁধার স্বপ্ন ফলপ্রসু করা খুবই কঠিন । অথচ তাদের মাথা গোঁজার ঠাঁই না হওয়া পর্যন্ত শান্তি নেই ।
“দাদা, দুই প্যাকেট ডালবাদাম দেবেন” । বাসে একজন বাচ্চা প্যাসেঞ্জার ইতাসের কাছে চাওয়াতে সে সম্বিত ফিরে পেলো । ডালবাদাম দিয়ে পয়সা নেওয়ার সাথে সাথেই বাসটি মালডাঙ্গা ঢুকে পড়লো ।
ঘোরাঘুরি করে ভাজাভুজি বিক্রি চলছে, কিন্তু চোখ ও কান খাড়া দীপালির জন্যে । অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে দীপালির এক গাল হাসি নিয়ে আবির্ভাব । শাড়ির আঁচলের ভিতরে টিফিন কৌটো । ইতাসকে ডেকে নিয়ে দাইহাঁট যাওয়ার রাস্তার পাশের বটগাছ তলায় দাঁড়ালো । তারপর শাড়ির ভিতর থেকে টিফিন কৌটা বের করে ইতাসকে বললো, “ঝটপট খাবারটা খেয়ে নিন” ।
একটু দ্বিধান্বিতার সুরে ইতাস বললো, “আবার এগুলো কেন” ?
চোখ দুটি বড় করে দীপালি বললো, “আগে কৌটার মুখটা খুলুন । তারপর চুপচাপ খেয়ে নিন” ।
“লুচি, আলুর দম ও সুজির হালোয়া” । খাবার দেখে ইতাস আহ্লাদিত । তাই হাসিমুখে দীপালিকে ইতাস বললো, “আপনি কী করে বুঝলেন আমার এই খাবারগুলি প্রিয়” ?
“আমি আন্দাজ করতে পেরেছিলাম । তাই খাবারগুলি বানিয়েছি । আলালের ঘরের দুলালদের সাধারণত এই ধরনের খাবার পছন্দ । সেই ভাবনা থেকেই আমার খাবার বানানো । আমি জানি, আপনি জাত হকার নন । অবাঞ্ছিত অবস্থার জাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে আজ আপনি হকার । গাধার মতো হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খাটছেন । অথচ আপনি যে ভাল বংশের মানুষ সেটা অনেক আগেই আন্দাজ করতে পেরেছি । আপনি খান, আমি জল নিয়ে আসছি” ।
তারপর দীপালি শুরু করলো তার জীবনের ইতিহাস ।
তার বাড়ি বর্দ্ধমান জেলার কৈচর গ্রামে । বলগোনার কাছাকাছি কৈচর, একটি বর্ধিষ্ণু গ্রাম । পাশ দিয়ে কাটোয়া- বর্দ্ধমান বাস রুট । সেখানে মামার বাড়িতে মানুষ । বাবা-মা তাকে মামা বাড়িতে রেখে দিয়ে পুনরায় ওপার বাংলায় চলে গেছেন । ওপার বাংলায় ফরিদপুর সদরে তিনতলা বাড়ি । বাবা প্রাথমিক স্কুলের প্রধান শিক্ষক । বাবা-মা ঐদেশে ফিরে যাওয়ার পর আজ পর্যন্ত তাঁদের কোনো খোঁজ-খবর পাওয়া যায়নি । শোনা গেছে, সেদেশে রায়টের সময় তাঁরা দুজন “না-ফেরার দেশে” হারিয়ে গেছেন । আমি ছিলাম বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান । তাঁরা বলে গেলেন, ঐদেশে ফিরে জমি জায়গার একটা সুরাহা করে খুব শীঘ্র ফিরবেন । কিন্তু সেই চলে গেলেন, আজ পর্যন্ত তাঁদের হদিস পাওয়া গেলো না । তারপর আমি বড় হলাম । কুড়ি বছরের মাথায় আমার বিয়ে । এই মালডাঙ্গা গ্রামের সনতের সাথে । আমার মৃদু আপত্তি ছিলো । সনতের মিলিটারি চাকরি । কিন্তু মামা বোঝালেন, “সনত সৎ ছেলে । দেখতে শুনতে খাসা । মিলিটারিতে চাকরি । বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান । অনেক জমি জায়গা । নিজস্ব বাড়ি ঘর । সুতরাং সনত তোর উপযুক্ত পাত্র” । সনতের পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনা করে মামা সনতকে পছন্দ করেছিলেন । দীপালিকে আরও বুঝিয়েছিলেন, “মিলিটারীতে যারা চাকরি করে তারাও তাদের পরিবার নিয়ে পোস্টিংয়ের কাছাকাছি থাকতে পারে । সুতরাং সনত ইচ্ছা করলে তোকে নিয়েও চাকরিস্থলে থাকতে পারবে । তাছাড়া মিলিটারি চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর প্রাক্তন সামরিক কর্মী হিসাবে সনত ভাল সরকারি চাকরিও পাবে” ।
বিয়ের সময় সনতের পোস্টিং ছিলো কোহিমাতে । বাড়িতে এসে সনত কোহিমার অনেক গল্প করতো । সেখানে খ্রিস্টান বেশী । তাঁদের জীবন যাত্রা কেমন সেটাও বলতো । নাগাল্যান্ডের মানুষ নাকি ব্যাঙের মাংস ভক্ত । আরও কতো ধরনের তাঁদের দৈনন্দিন জীবনের গল্প । পাহাড়ি জায়গা কোহিমা । যার জন্য কোহিমায় ঘর ভাড়া নিয়ে থাকা খরচাবহুল । তবুও ছোট একটা বাসা ভাড়া নিয়েছিলো সনত । কিন্তু দুই বছরের মাথায় হঠাৎ তাকে লাদাখে সিয়াচেনের বর্ডারে পোস্টিংয়ে পাঠালো । সেই সময় চীনা ফৌজিদের সাথে ভারতীয় ফৌজিদের আদায়-কাঁচ কলায় সম্পর্ক । যার জন্য বাছাই বাছাই কিছু জওয়ানকে সিয়াচেন বর্ডারে পোস্টিং । সেই সময় আমি অন্তঃসত্বা । লাদাখে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি নেই । তাছাড়া সিয়াচেন বর্ডারে পৌঁছানো সাংঘাতিক ঝকমারি । পাহাড়ি জায়গা । লে থেকে সর্বোচ্চ মোটরের রাস্তা “খড়দুংলা” পার হয়ে নুভ্রা ভ্যালি হয়ে সেখানে পৌঁছানো । সেখানে পরিবার নিয়ে থাকার পরিস্থিতি নেই । বছরের অর্দ্ধেক সময় বরফে ঢাকা । বরফে ফৌজিদের কাজ করাও ভীষণ কষ্টসাধ্য । অনেক সময় ডিউটিরত অবস্থায় ফৌজিদের এক হাঁটু পর্যন্ত বরফ জমে ।
আমরা খবরের কাগজে দেখলাম, সিয়াচেন বর্ডারে চীনা ফৌজি ও ভারতীয় ফৌজিদের মধ্যে এলোপাথারি গুলি বর্ষণ । তারপর একদিন ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে দেখি কফিন বন্দি অবস্থায় সনতের মৃতদেহ । তারপর আমার জীবনের সখ্‌-আহ্লাদ, বেঁচে থাকার স্পৃহা, সব শেষ ! মালডাঙ্গা গ্রামে মান্ধাতা আমলের সামজিক রীতি-নীতির জাঁতাকলে আমি চিরে-চ্যাপ্টা । বিধবা থাকার জন্য নিরামিষ খেতে হবে, সাদা শাড়ি পরতে হবে, পিঁয়াজ-রসুন খাওয়া চলবে না । আরও অনেক রকম সামাজিক নিয়ম কানুনের বাহানা । আমি আবার ঐসব আজগুবি বস্তাপচা সামাজিক নিয়ম নীতি একদম মানি না । যার জন্য সমাজ আমাদের “এক ঘরে” করে রেখেছে । সমাজ আমাদের “এক ঘরে” করলেও তাতে আমার কিচ্ছু যায়-আসে না । আমি আমার মতো । তাই আমার স্বাধীনভাবে বিচরণ । মেয়ে তুলিকা । তুলিকা দার্জিলিংয়ের রেসিডেন্সিয়াল স্কুলে পাঠরত । সপ্তম শ্রেণীর ছাত্রী । তারপর আমি চাইছি, তুলিকাকে সেন্ট জ্যাভিয়ার্স কলেজে ভর্তি করাবো । আমার ঈপ্সিত বাসনা, তুলিকা নিজের পায়ে দাঁড়াক । একনাগাড়ে এতগুলি কথা বলে দীপালি থামলো । তার চোখ দুটি ছল ছল ।
“আপনার শ্বশুর-শাশুড়ি” ? তাঁদের কী খবর ? ইতাস জিজ্ঞাসা করলো । এতক্ষণ সে নীরব শ্রোতা ছিলো । প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে তার মৌনতা ভঙ্গ করলো ।
তাঁদের শারীরিক অবস্থা খুব খারাপ । বলতে পারেন শ্বশুর – শাশুড়ির জন্য আমি এখন ঘরবন্দী । মালডাঙ্গায় পচে মরছি । একদিন আপনাকে বাড়ি নিয়ে যাবো, তাহলে বুঝতে পারবেন আমি কী অবস্থার মধ্যে জীবন কাটাচ্ছি !
আজ উঠি দীপালি ম্যাডাম ।
উঁহু ! শুধুমাত্র দীপালি ।
ম্যাডাম উঠতে একটু সময় নিচ্ছে, ঠিক আছে দীপালি । আজ থেকে আমরা একে অপরের ভাল বন্ধু । আপনিও আমাকে নাম ধরে ডাকবেন । শুধুমাত্র ইতাস ।
আপনার মতো মানুষকে আমারও নাম ধরে ডাকতে কিছুদিন সময় লাগবে । এইটুকু সময় আপনাকে দিতেই হবে । আগামীকাল বিকালে অবশ্যই তিনটের সময় দেখা হচ্ছে । সেইখানে আপনার জীবনের কথাগুলি শুনবো । বলে না “চোরে চোরে মাসতুতো ভাই” । আমাদের জীবনের কষ্টকর অধ্যায়ের জন্য দুইজনের জীবন প্রবাহ প্রায় এক । যার জন্য মনের মিল অফুরন্ত । আর একটা কথা …?
আজ আর কথা নয় । আমার এখনও কিছুই বিক্রি হয়নি । মাল বিক্রির জন্য আমাকে হন্যে হয়ে ঘুরতে হবে । আগামীকাল কথা হবে ।
“এত রাগ করছেন কেন” ? বলেই দীপালি একশ টাকার পাঁচখানা নোট ডান হাতের মধ্যে লুকিয়ে ইতাসের পকেটে আচমকা ঢুকিয়ে দিলো ।
টাকার নোট দেখে ইতাসের রাগান্বিত মুখ । কিন্তু নিজেকে সামলে নিয়ে ঠান্ডা মাথায় ইতাস দীপালিকে বললো, “আপনি আমার ভাল বন্ধু । আমরা উভয়ে ভাল বন্ধু হয়ে বাঁচতে চাই । সুতরাং টাকা পয়সা দেবেন না । টাকাটা ফেরত নিয়ে নিন প্লিজ । আমার শরীর যথেষ্ট সচল । উপার্জন ক্ষমতা আমার যথেষ্ট । আমার বেঁচে থাকার ব্যাপারে একদম চিন্তা করবেন না । আপনাকে দেখার পর আমি……।“
“আমি কী ? থামলেন কেন” ? উদগ্রীব হয়ে দীপালি শুনতে চাইলো । তারপর আবার বললো, “আপনার মুখ থেকে ঐ কথাটা শোনার জন্য ব্যকুল হয়ে ছুটে আসি । আমার অন্তরে শুধু হাহাকার ! মরা গাঙ !” অন্তরের গভীর অন্তর্বেদনা ব্যক্ত করে চোখের জল শাড়ির আঁচলে মুছতে মুছতে ছুটে পালালো দীপালি ।
একদৃষ্টে দীপালির যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো ইতাস । তার বারবার মনে হচ্ছে, “দীপালি যাদু জানে । তার যাদুর কাছে সে হেরে ভুত । দীপালির সঙ্গে মেলামেশার নেশায় ইতাস বিভোর । কিছুতেই তাকে ছেড়ে থাকতে মন চাইছে না । তবুও নিজেকে ধাতস্থ করে মনকে শক্ত করলো । ইমলির কথা দশবার ভাবলো । তারপর দীপালির মিষ্টি মুখখানা অন্তর থেকে সরাতে সফল হোলো । তাই ইতাস মনটাকে শক্ত করে সিদ্ধান্ত নিলো, “দীপালির দৌড় বন্ধু পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাক” ।
ইতাস পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে স্বাভাবিক ও স্বচ্ছন্দ্বে ফিরে মনে মনে স্থির করলো, “দীপালির সঙ্গে আর বেশী দেখা করা যাবে না । দেখা করলেই বরং দীপালির প্রতি তার ভাললাগার ব্যকুলতা বাড়ে । দীপালি তার ভাল বন্ধু, সুতরাং ভাল বন্ধু হিসাবেই থাক । ইমলিকে ফাঁকি দিয়ে দীপালির প্রেমে হাবুডুবু খাওয়া তার পক্ষে অসম্ভব” !
দীপালি থেকে তাকে দূরে থাকতে গেলে এবার তাকে আয়ের অন্য এবং স্থায়ী পথ বাছতে হবে । দোকান খুলে কুসুমগ্রাম বাজারে একটা স্থায়ী ব্যবসা চালু করা প্রয়োজন । যদিও সেটাই ইতাসের প্রবল ইচ্ছা ।
তারপর কুসুমগ্রাম বাস স্ট্যান্ড । গদাইয়ের দোকানে বসে আবার চা খাওয়া ।
মনটা খারাপ । বিক্রিবাট্টা কিচ্ছু হয়নি । হতাশ হয়ে বাড়ি ঢুকলো ইতাস ।
মালডাঙ্গা বাজার থেকে কিছু শুটকি মাছ কিনলো ইতাস । জীবন বিজ্ঞান পরার সময় মাস্টার মশায়ের কাছে শোনা, শুটকি মাছ পোয়াতি মহিলাদের ক্ষেত্রে শুভ । সেই কথা ভেবে পুঁটি ও ট্যাংরা মাছের শুটকি কেনা । সেগুলি ইমলির হাতে দিয়ে বললো পিঁয়াজ, রসুন, আদা ও কাঁচা লঙ্কার ঝাল দিয়ে কষিয়ে শুটকি মাছ রাঁধতে । কিন্তু শুটকি মাছ দেখে ইমলির আবার নাক সিটকানো । ইমলির শুটকি মাছ একদম না-পসন্দ । শুটকি মাছের গন্ধ তার কাছে অসহ্য ! ইমলির গররাজীর মুখভঙ্গিমা অবলোকন করে ইতাস নিজেই বটিতে পিঁয়াজ কুচি কুচি করে কেটে শুটকি মাছ রান্নায় মনোযোগ দিলো । আদা, রসুন শিল-নোড়ায় বেটে মাছের সাথে মাখালো । বাজারে কিছু ধনে পাতা পাওয়ায় বাঁচোয়া । অনেক কসরত করে শুটকি মাছের মাখা মাখা কষানো ঝাল রান্না করলো । সেটা জিভে চেটে ইমলি অভিভূত । শুটকি মাছের গন্ধ নেই বললেই চলে । খেতে ভীষণ সুস্বাদু । রান্না হওয়ার সাথে সাথে পাত পেতে খেতে বসলো দুজনে । দুজনে মনের আনন্দে চেঁছেপুঁছে খেয়ে পাত পরিস্কার । উভয়ে খুব খুশী ।
সকালে পাকা কলা নিয়ে বের হোলো ইতাস । সেদিন রবিবার । কুসুমগ্রামে বাজারে খুব ভিড় । সকাল দশটার মধ্যে তার একঝুড়ি পাকা কলা শেষ । বিক্রির পরে পুনরায় বাড়ি ঢুকলো । হাতের ব্যাগে বাজার থেকে কেনা দেশী পোনা মাছ । খেতে সুস্বাদু, অথচ দামেও কম । যদিও মাছটাতে কাঁটা অতিরিক্ত । কাঁটা বেশী হলে ইমলির মাছ খেতে কষ্ট । সেদিন ব্যাঙ্ক বন্ধ । সুতরাং বাইরের টিউবওয়েলে স্নান । রবিবারদিন ছাড়া অন্যান্য দিন ভোরবেলায় স্নান সেরে ইতাস কাজে বের হয় ।
হঠাৎ ইতাসকে দেখে ইমলি অবাক ! তাই মুচকী হেসে অন্যভাবে বললো, “সাহেবের কী আজ কাজে মন নেই” ?
কাজ সেরেই এসেছি ম্যাডাম । মাছের ঝোল ভাত খেয়ে আবার বেরোবো । এবার সোজা মালডাঙ্গায় ।
আচ্ছা বলো তো, কুসুমগ্রাম বাজার ছেড়ে ঘনঘন মালডাঙ্গা বাজারে ছোটো কেন ? শুধুই বাজার ভাল, না অন্য কিছুর টান ?
অন্য কিছু মানে ?
কোনো মধুর টান আছে কিনা ? ইদানীং দেখছি, মালডাঙ্গা থেকে ফিরলে তোমাকে খুব খুশী খুশী লাগে । এতেই আমার সন্দেহ, তুমি মালডাঙ্গায় কোনো মধুর সন্ধান পেলে কিনা ?
কি যে বলো ইমলি, আমার সাদাসিধে জীবনে কোনো সুন্দরী মহিলা ফিরেও তাকাবে না !
সুন্দরী না হোক, অসুন্দরী মহিলার আবির্ভাব ঘটতে কতোক্ষণ ?
“আজেবাজে বকবকানি বন্ধ রেখে রান্নায় মন দাও । আমাকে আবার বের হতে হবে” । ইতাসের গলায় কড়া সুর ।
তারপর ইমলি রান্নায় মন দিলো ।
খেয়েদেয়ে ইতাস একটা ভাত ঘুম দিতে গিয়ে বেলা তিনটে । তড়িঘড়ি বেরিয়ে বাস ধরে সোজা মালডাঙ্গা । তার বেলা তিনটের মধ্যে মালডাঙ্গা পৌঁছানোর কথা । সেই কারণে দীপালি ঠিক তিনটে থেকে বাস স্ট্যান্ডে তার অপেক্ষায় । বাস থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গে হাইজ্যাক করে ইতাসকে টেনে নিয়ে সোজা দীপালিদের বাড়ি । দো-তলা বাড়ি । নীচের তলায় লেডিস টেলারিং । দো-তলায় তারা থাকে । ইতাসকে নিয়ে উপরে উঠে গেলো দীপালি । ড্রয়িং রুমে বসালো ইতাসকে । সাজানো গোছানো ঘর বাড়ি । এক বাটি পায়েস খেতে দিলো ইতাসকে । তারপর দীপালি বললো, “পায়েস খাওয়া হলে আমার শ্বশুর শাশুড়ির সাথে আলাপ করিয়ে দিচ্ছি । তারপর আপনার জীবনের ইতিহাস শুনবো” ।
ব্যস ! এইটুকুর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকুন । তাহলে আমি সাড়ে ছ-টার বাসটা ধরতে পারবো ।
আপনাকে বাস ধরানোর দায়িত্ব আমার । কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ খান ।
শ্বশুর মশায় হার্টের পেসেন্ট । শাশুড়ি নিমোনিয়া, থাইরয়েড, হাই সুগারের পেসেন্ট । শ্বশুর মশায় শয্যাশায়ী । তাঁদের সাথে হেসে হেসে কথা বললো ইতাস । তাঁরা ইতাসকে দেখে কেঁদে দিলেন । তাঁরা কেঁদে কেঁদে বললেন, “তুমি আগের জন্মে আমাদের ছেলে ছিলে, যার জন্য তুমি আমাদের মতো হতভাগা মানুষকে দেখতে এসেছো বাবা” । ইতাস তাঁদের সামনে অনেকক্ষণ বসে রইলো । দীপালির শ্বশুর শাশুড়িকে দেখে ইতাসের ভীষণ কষ্ট হচ্ছিলো ।
ড্রয়িং রুমে কিছুক্ষণ নির্বাক রইলো ইতাস । মানুষ এত কষ্টের মধ্যে থাকতে পারে তার ধারণার বাইরে ।
তারপর ইতাস তার জীবনের ইতিহাস ব্যক্ত করলো দীপালিকে ।
দীপালি ইতাসের কষ্টকর জীবনের কাহিনী শুনে বিমর্ষ । করুণ চোখে দীপালি ইতাসকে বললো, “একটা কথা বলবো ইতাসদা” ?
হ্যাঁ বলুন ।
আপনারা আমাদের বাড়ি এসে বসবাস শুরু করুন । নীচের টেলারিং আমি চালাই । লোক রাখা আছে । তারাই দোকান দেখ-ভাল করে । মাঠের জমি ভাগে দেওয়া । চাষে যা ধান পাওয়া যায়, বছরের খাওয়ার চেয়ে বেশী । সুতরাং আপনারা আমাদের বাড়িতে থাকলে আমরা ধন্য হতাম ।
তা হয় না দীপালি । আপনার সাথে আমার বন্ধুত্ব সারা জীবন অটুট থাকুক । এভাবে আমাকে অনুরোধ করবেন না প্লিজ । কঠোর পরিশেমের মাধ্যমে আমরা ঠিক দাঁড়িয়ে উঠবো । আপনার সাথে মিশে আমি বুঝতে পেরেছি, আমি একজন আপন মানুষকে খুঁজে পেয়েছি ।
শুধু আপন মানুষ, না অন্য কিছু ?
শুধুমাত্র হাসি দিলো ইতাস ।
পরক্ষণেই দীপালি ইতাসের হাত ধরে তার বুকের কাছে টেনে নিয়ে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো, ঠিক তখন ইতাস দীপালিকে বললো, “এভাবে আমাকে দুর্বল করে দেবেন না প্লিজ । আমি ইমলির সাথে ঘর করি । আপনি নিশ্চয় চান না, ইমলির সাথে আমার ঘর ভাঙ্গুক” !
তারপর…………?
 ( চলবে )