কাদম্বরী দেবী।নামটি উচ্চারিত হলে অবশ্যম্ভাবী ভাবেই যে আরেকটি নাম চলে আসে তা নিশ্চিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। শুধুমাত্র এই দুটি ব্যক্তি ও তাদের পারস্পরিক সম্পর্ককে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হয়েছে অসংখ্য শব্দ।সন্দেহ নেই রবীন্দ্রনাথের প্রধান প্রেরণাদাত্রী ছিলেন কাদম্বরীদেবী।সেকথা কবি নিজেই স্বীকার করেছেন তাঁর বিভিন্ন লেখায়,কবিতায়,গানে- ‘তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা।’
আমাদের এই প্রবন্ধ অবশ্য সেই বহুচর্চিত সম্পর্ককে কেন্দ্র করে নয়।আজ একটি বিশেষ দিন।এইদিনেই কাদম্বরীদেবী পদার্পণ করেছিলেন ঠাকুরবাড়ীতে, তাছাড়া আজ কাদম্বরীদেবীর জন্মদিনও বটে।তাই এই বিশেষ দিনে আমরা কাদম্বরীদেবীকে দেখার চেষ্টা করব রবীন্দ্রালোকে নয় বরং একটু স্বতন্ত্রভাবে।বোঝবার চেষ্টা করব, তিনি কী শুধুই ‘কবির বৌঠান’ না নবজাগরণের যে আলোটুকু মেখে ঠাকুরবাড়ী সূচনা করেছিল এক নতুন দিগন্তের, তার যোগ্য পথিকৃৎরুপে নিজেকে প্রমান করতে পেরেছিলেন?
ঠাকুর বাড়ী ছিল পিরালী তায় ব্রাহ্ম,তাই একদিকে ব্রাহ্মণরা যেমন তাদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে চাইতেন না,তেমনি পিরালীরাও তাদের এড়িয়ে চলতেন।স্বভাবতই পুত্র ও কন্যাদের বিবাহের সময় যথেষ্ট সমস্যা দেখা দিত।ঠাকুরবাড়ীর বেশীরভাগ জামাই ছিলেন ঠাকুরবাড়ীতেই আশ্রিত বা সাধারণ বাংলায় আমরা যাকে ঘরজামাই বলে থাকি।পুত্রদের বিবাহের সময়েও দেখা গেছে গ্রাম থেকে মেয়ে নিয়ে আসার একটা চল ছিল।কুটুম্ববাড়ী প্রভাবে বিত্তে ঠাকুরবাড়ীর ধারে কাছে ঘেঁষতে পারত না।দেবেন্দ্রনাথের পরমগুনী ষষ্ঠপুত্র জ্যোতিন্দ্রনাথের জন্যে ঠাকুরবাড়ীর আশ্রিত শ্যামলালের তৃতীয় কন্যা মাতঙ্গিনীকে পাত্রী রুপে নির্বাচন করা হল।
দেশের প্রথম আই.সি.এস, মহর্ষির মেজোছেলে,সতেন্দ্রনাথের অবশ্য এতে প্রবল আপত্তি ছিল।ঠাকুরবাড়ীর একজন সামান্য সন্দেশ পরীক্ষক জগন্মোহনের নয় বছরের প্রৌত্রীকে তিনি তাঁর গুনী ভাইয়ের জীবনসঙ্গী হিসেবে মেনে নিতে চাননি।সে কথা সতেন্দ্রনাথ চিঠিতে জানিয়েছিলেন স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনী দেবীকে।আরো একটি আশঙ্কা তাঁর ছিল-” এরপরে কী জ্যোতি বিলেতে যাবে? যদি যায় তো ফিরে এসে কি এই ছোট্ট মেয়েটিকে জীবনসঙ্গিনীরূপে গ্রহণ করতে পারবে?শেষে নষ্ট হয়ে যাবে না তো দুটি জীবন! কিছুতেই কিছু হল না।”
অবশ্য জ্যোতিন্দ্রনাথের সঙ্গে শ্যামলালের কন্যার বিবাহ তাতে বাধাপ্রাপ্ত হল না।১৮৬৮ সালে ৫ ই জুলাই এই বিবাহ সুসম্পন্ন হল।ঠাকুরবাড়ীর প্রথা অনুসারে নতুন বৌয়ের নতুন নাম হল কাদম্বরী। হারিয়ে গেল মাতঙ্গিনী।এক নবজন্ম হল কাদম্বরীর।ঠাকুরবাড়ীর বিশেষত্ব এইখানেই যে তাঁরা অত্যন্ত সঠিকভাবে অনুভব করেছিলেন যে একটি ডানাকে অকেজো করে রেখে কখনোই উড়ান সম্ভব নয়।তাই তাঁরা শুধুমাত্র নিজেরাই এগোননি নবজাগরণের পথে, এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন বাড়ীর মেয়েদেরকেও।কাদম্বরীদেবীর ক্ষেত্রেও তাঁর অন্যথা হল না।শুরু হল তাঁর শিক্ষা পর্ব।প্রশান্তকুমার পালের রচনাতে দেখতে পাই ঠাকুরবাড়ীর হিসাবের খাতায় কাদম্বরীর জন্য ধারাপাত ও বর্ণপরিচয়ের প্রথম ও দ্বিতীয়ভাগ কেনার উল্লেখ আছে।
সত্যেন্দ্রনাথ ও জ্ঞানদানন্দিনী ছিলেন এই ক্ষেত্রে পথপ্রদর্শক। তাঁদেরই পদাঙ্ক অনুসরণ করলেন জ্যোতিন্দ্রনাথ।কলকাতাবাসী বিস্ময়ে দেখল জ্যোতিন্দ্রনাথের পাশে পাশে ঘোড়ায় চড়ে যে গড়েরমাঠে হাওয়া খেতে যাচ্ছে সে একজন নারী।কাদম্বরীদেবী শুধু ঘোড়া চড়াতেই পারদর্শী ছিলেন না।অন্দরমহলের সাজসজ্জাতেও নিজের সুরুচির পরিচয় দিলেন।তিনতলার ছাদের উপর গড়ে তুললেন ‘নন্দনকানন। ‘ নানান ফুলের গাছে সেজে উঠলো ছাদখানি।চামেলি,গন্ধরাজ, দোলনচাঁপা,করবীর গন্ধে মাতাল হলো বাতাস।এসে জুটলো হরেকরকম পাখি।সেই নন্দনকাননে শুরু হলো সাহিত্য আসর।তাতে যোগ দিলেন বাইরের লোকেরাও।কবি অক্ষয় চৌধুরী, বিহারীলাল চক্রবর্তী প্রভৃতি।গানে,কবিতায়, গল্পে নিত্যনতুন পরিকল্পনায় আসর জমে উঠলো।এই সমস্ত কিছুর প্রানকেন্দ্রে ছিলেন স্বয়ং কাদম্বরীদেবী।নতুন কাপড় পরে,প্রসাধন সেরে, কবরীতে মালা জড়িয়ে যখন তিনি আসরে এসে বসতেন তখন জ্যোৎস্না আলোকিত সেই ছাদে তাঁকে দেবী সরস্বতী ভিন্ন আর কিছুই মনে হতো না।এইসবের বিস্তৃত বিবরণ আমরা পেয়েছি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বিখ্যাত ‘প্রথম আলো’তে।তাই সবিস্তারে আর গেলাম না।
আশ্চর্য এই যে, ঠাকুরবাড়ীর অন্য মেয়েরা যে সাহিত্যচর্চায় সক্রিয় অংশ নিয়েছিলেন তা আমরা ভালোভাবেই জানি।রবীন্দ্রনাথের দিদি স্বর্ণকুমারীদেবী নিজেকে পুরোপুরিভাবে নিয়োজিত করেছিলেন সাহিত্যচর্চায়। জ্ঞানদান্দিনীদেবীকেও আমরা দেখেছি ঠাকুর পরিবার থেকে প্রকাশিত ‘বালক’ পত্রিকায় সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে।ছোটদের জন্য বেশ কিছু নাটক তিনি রচনা করেছিলেন কিন্তু এই বিষয়ে কাদম্বরীদেবীর কোন প্রচেষ্টা আমাদের চোখে পড়ে না অথচ তিনি ছিলেন সাহিত্যের একজন প্রকৃত সমঝদার। হয়তো অনেকটা দীপের মতন। নিজে জ্বলে অন্যকে আলো দান করলেন।ঠাকুরবাড়ীর প্রানপুরুষটির মধ্যে জাগিয়ে তুললেন অনন্তের সম্ভাবনা।ভারতী পত্রিকা শুরুর উৎসস্থলই ছিল কাদম্বরীদেবীর এই নন্দনকাননের সাহিত্য আসর।নিজে না লিখেলেও লেখা বাছাইয়ের ক্ষেত্রে তাঁকেও উৎসাহভরে অংশ নিতে দেখি আমরা।বস্তুত, তাঁর জিম্মাতেই একটি সুটকেসে থাকত পত্রিকার জন্যে নির্বাচিত লেখা।
সাহিত্যচর্চার সঙ্গে যুক্ত না হলেও তিনি ছিলেন সুগায়িকা ও অভিনেত্রীও। বিবাহের পরেই জ্যোতিন্দ্রনাথ তিনতলার ঘরে নিয়ে এসে দিয়েছিলেন পিয়ানো।জ্যোতিদাদা,রবি ও বৌঠান মিলে চলত সঙ্গীতের সাধনা।ঠাকুরবাড়ীতে প্রায়ই বিভিন্ন নাটক অভিনীত হতে দেখা গেছে,সেখানে পরিবারের সদস্যরাও অংশ গ্রহন করতেন।এরকমই একটি নাটক ‘এমন কর্ম আর করব না’ তে হেমাঙ্গিনীর চরিত্রে অভিনয় করেন কাদম্বরীদেবী।কবি সজনীকান্ত দাশের অনুমান সেই ‘হেমাঙ্গিনী ‘ নামের আড়াল নিয়েই কবি কাদম্বরীদেবীকে ‘ শ্রীমতী হে’ নামে তাঁর ‘ভগ্নহৃদয় ‘ কাব্যগ্রন্থ উৎসর্গ করেন।অবশ্য এই নামকরণ নিয়ে আরও অনেক ব্যাখ্যা আছে।’হেমাঙ্গিনী ‘ নাটকে কাদম্বরীর অভিনয় নিয়ে অবশ্য পরবর্তীতে ইন্দিরাদেবী সংশয় প্রকাশ করেছেন।তবে ‘বসন্ত- উৎসব ‘ ও ‘মানময়ী’ তে কাদম্বরীদেবীর অভিনয় নিয়ে কোন সংশয় নেই।
কাদম্বরীর হৃদয়ে ছিল অবিরাম স্নেহের ফল্গুধারা।বিবাহের অনতিপূর্বেই মাতৃহারা দেবরটিকে কাছে টেনে নিয়ে প্রথম সেই ফল্গুধারার সন্ধান দিয়েছিলেন।হয়ে উঠেছিলেন একাধারে তাঁর খেলার সাথী অন্যধারে তাঁর আশ্রয়। গৃহকর্মেও তাঁর ছিল তাঁর অনিবার্য উপস্থিতি।শোনা যায়,কাদম্বরী ছিলেন যথেষ্ট রন্ধনপটিয়সী।মল্লিকা সেনগুপ্ত বিরচিত ‘কবির বৌঠান ‘ গ্রন্থে আমরা দেখি রবির উপনয়নের সময় তার জন্য হবিষ্যান্ন রাঁধার ভার নিচ্ছেন কাদম্বরীদেবী।মল্লিকাদেবী লিখছেন ‘সারাদিন উপোস করে সন্ধ্যায় গায়ত্রীমন্ত্র জপের পর যখন নতুন বৌঠানের রেঁধে দেওয়া হবিষ্যান্ন মুখে দিলেন,রবির মনে হল যেন অমৃত খাচ্ছেন।’ নিজে নিঃসন্তান হলেও বাড়ীর কোন খুদে সদস্য অসুস্থ হলে তার সেবার ভার নিতেন কাদম্বরী। স্বর্নকুমারীদেবী নিজের কনিষ্ঠা কন্যা ঊর্মিলার ভার দিয়েছিলেন কাদম্বরীকে।নিজ সন্তানের মতন যত্নে তাঁকে লালন করেছিলেন কাদম্বরী। দুর্ভাগ্যবশত একটি দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় ছোট্ট ঊর্মিলার।ভেঙে পড়েন কাদম্বরী।
ঠাকুরবাড়ীর মহিলা মহলে কাদম্বরীদেবী বিশেষ সমাদৃত ছিলেন না।কারণ তিনি ছিলেন ঠাকুরবাড়ীর সেরেস্তার সামান্য কর্মচারীর মেয়ে।অনেকেই তাঁর সেই পরিচয় ভুলতে পারেননি। এছাড়াও কাদম্বরীর প্রতি জ্ঞানদানন্দিনীর ছিল প্রবল বিরাগ।নিজের প্রায় সমবয়সী জ্যোতির সঙ্গে জ্ঞানদানন্দিনীর সম্পর্ক ছিল বন্ধুত্বপূর্ণ। তিনি চেয়েছিলেন জ্যোতির সঙ্গে নিজের পছন্দ করা শিক্ষিতা মেয়ের বিয়ে দিতে।সত্যেন্দ্রনাথও কাদম্বরীকে কোনদিনই ‘জ্যোতির’ যোগ্য মনে করেননি।একথা পূর্বেই উল্লেখ করেছি।যদিও কাদম্বরীদেবী নিজের শিক্ষা, সুরুচির মাধ্যমে তাঁদের ভ্রান্ত প্রমান করেছিলেন অচিরেই কিন্তু ঠাকুরবাড়ীর অন্দরমহলের নিজস্ব রাজনীতি তাঁকে অনেকটাই একঘরে করে দিয়েছিল।রবির সঙ্গে সুসম্পর্ককেও অনেকেই বিশেষ করে জ্ঞানদানন্দিনী ভালো চোখে দেখেননি।বস্তুত মহিলামহলের রাজনীতির কারনেই তিনি পূর্বে একবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন যদিও সেবারে বিফল হন।
ঠিক কী কারনে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিলেন এ হেন রূপবতী গুনবতী নারী?সেই নিয়ে আছে অজস্র ব্যাখ্যা।হয়তো কোন একটি কারনকেই কারো আত্মহত্যার জন্য দায়ী করা চলে না।জ্যোতিন্দ্রনাথের উদাসীনতা, রবির ব্যস্ততা সর্বোপরি বিবাহ কাদম্বরীকে অনেকটাই একলা করে দিয়েছিল।তাতে ঘৃতাহুতি দেয় এক বিখ্যাত নটীর সঙ্গে জ্যোতিন্দ্রনাথের সম্পর্কের গুঞ্জন। অবশেষে যেদিন প্রথম জ্যোতিন্দ্রনাথের জাহাজ জলে ভাসছে,সমস্ত ঠাকুরবাড়ী মুখর আনন্দে, গর্বে- একাকিনী কাদম্বরী পূর্বে সংগ্রহ করে রাখা আফিম খেয়ে বেছে নেন আত্মহত্যার পথ ।তখন তার বয়স মাত্র চব্বিশ বছর।প্রখ্যাত ঠাকুরবাড়ী তার প্রভাব প্রতিপত্তিকে ব্যবহার করে সেই ঘটনাকে চাপা দিতে অবশ্য চেষ্টার কোন ত্রুটি রাখেনি।পুড়িয়ে ফেলা হয় কাদম্বরীর লেখা শেষ চিঠি।পরেরদিনের কোন সংবাদপত্রে কোন সংবাদ প্রকাশিত হয় না এই বিষয়ে। সবকিছুই হয় প্রবল গোপনীয়তা বজায় রেখে।
হারিয়েই যাওয়া উচিত ছিল কাদম্বরীর কিন্তু হারানোর জন্য তো তাঁর জন্ম হয়নি।তিনি যে কবির প্রেরণা, তাঁর মানসী।শরৎকুমারীর ভাষায়, তিনি ছিলেন ‘ফুলের তোড়ার বাঁধন’।’ বাঁধন যেদিন ছিঁড়ে গেল সেদিন বোঝা গেল কাদম্বরীর মূল্য।এক অতি সাধারণ পরিবারের প্রায় অশিক্ষিত মাতঙ্গিনী থেকে কাদম্বরী রূপে তাঁর যে যাত্রাপথ সেপথে তিনি ফুটিয়েছেন নানান ফুলের একটি ডালি – ‘রবীন্দ্রনাথ ‘।অজ্ঞানতার অন্ধকারে নারী জাগরনের যে প্রদীপখানি ঠাকুরবাড়ী জ্বালিয়েছিল, কাদম্বরী ছিলেন সেখানে যথার্থই আলোকবর্তিকা। আধুনিক নারীর পথিকৃৎ- যিনি একাধারে অসামান্যা প্রেরণাদাত্রী ও স্বতন্ত্রতার প্রতীক।।
তথ্যসূত্রঃ
১.প্রথম আলো- সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।
২.ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল- চিত্রা দেব।
৩.কবির বৌঠান- মল্লিকা সেনগুপ্ত।
৪.কাদম্বরী দেবী- সুব্রত রুদ্র।