আনাড়ি মহিলার উচ্ছৃঙ্খলতা (ধারাবাহিক উপন্যাস, ত্রয়োদশ পর্ব) : দিলীপ রায় (+৯১ ৯৪৩৩৪৬২৮৫৪)।

0
525

ইতাস আইসক্রিমের ব্যবসায় আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে পড়লো । কাঠি দেওয়া আইসক্রিম বিক্রি করার জন্য হকারের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে । গাঁয়ে গাঁয়ে ঘুরে ঘুরে আইসক্রিম বিক্রির জন্যে প্রত্যেক হকারের একটি আইসক্রিম বাক্স লাগে । কাঠি দেওয়া আইসক্রিম গুণে একটা নির্দ্দিষ্ট সংখ্যায় হাকারদের কাছে বিক্রি হয় । হকারেরা সংখ্যায় তিনশ, কিংবা চারশ আইসক্রিম বাক্সে ভরে । তারপর বিক্রির উদ্দেশ্যে রওনা দেয় । অনেক সময় প্রচণ্ড বৃষ্টি হলে কিছু আইসক্রিম অবিক্রিত থেকে যায় । হকারেরা সেগুলি বাক্সেই ফেরত নিয়ে আসে । সেই পয়সাটা হকারেরা ফেরত পায় । এই ব্যাপারে, ইতাসের খারাপ অভিজ্ঞতাও রয়েছে । যেমন বৃষ্টি নামলেই কিছু হকারেরা রাস্তা থেকে বাঁশের কাঠি কুড়িয়ে ইতাসের কাছে পয়সা ফেরতের দাবি করে । সেই ক্ষেত্রে জেনেবুঝেও হকারদের দাবিকে ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গির নিরিখে মেনে নিতে হয় । ইতাস হকারদের প্রচণ্ড বিশ্বাস করে । কেননা হকারেরাই তাঁর ব্যবসায়ের মূল ভরসা ।
ব্যাঙ্কের নিয়ম মোতাবেক ইমলি ফুল টাইম সুইপার পদে আসীন হল । কুসুমগ্রাম শাখায় পোস্টিং । পদোন্নতির সাথে সাথে তার কাজের দায়িত্ব বাড়লো কয়েকগুণ । ইমলি এখন ব্যাঙ্কের আর পাঁচটা কর্মীর মতোই সর্বক্ষণের স্থায়ী কর্মী । এতদিন পরে ইমলি বুঝতে পারছে, তার চলমান জীবন অনেকটা হাল্কা । কেননা আয়ের একটা ভদ্রস্থ স্থায়ী বন্দোবস্ত । যার জন্য ইমলি খুব খুশী । মেয়েকে মানুষ করার ক্ষেত্রে আর বাধা রইল না । এই মুহূর্তে ইতাসের ব্যবসা অনেকটা স্থিতিশীল । যদিও ইতাস পুনরায় নতুন একটি আইসক্রিম মেশিন বসাতে উদগ্রীব । নতুন মেশিন কেনার প্রেক্ষাপটে তার টাকা জমানোর মরিয়া প্রয়াস অবিরত ।
**********************************************
বেশ কয়েক বছর কেটে গেল ।
আসান এখন কুসুমগ্রাম গার্লস হাই স্কুলে পাঠরত । প্রতিদিন সকালে তাকে খাওয়ানো, স্কুল ড্রেস পরানো, স্কুলের টিফিন বানানোতে ইমলির কপালে ঘাম ছোটে । তারপর হুড়োহুড়ি করে ব্যাঙ্কে ছোটা । একটাই রিলিফ, ইতাস বাড়িতে থাকে । যদিও ভোর থেকে তারও হকারদের নিয়ে মহাযুদ্ধ ।
ইমলির মেয়ে ক্রমশ বড় হচ্ছে । মেয়ের দৈনন্দিন বায়নাক্কাও বাড়ছে । ইমলি মেয়েকে স্বাধীনভাবে বড় করতে চায় । ইমলির মতে, মেয়ে সমাজের সমস্ত কিছুর মধ্যে দিয়ে বড় হোক । রাস্তাঘাটে, স্কুলে, গাঁয়ে সকলের সঙ্গে মিলেমিশে বড় হোক । নিজেকে বুঝতে শিখুক । বাড়িতে গৃহশিক্ষক রাখা । পড়াশুনায় কোনোরকম শৈথিল্য ইমলির না-পসন্দ । মেয়েকে পড়াতে বসে ইমলি মোটামুটি ভারতের শিক্ষা ও শিক্ষণ পদ্ধতি সম্বন্ধে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল । তাই আসানকে পড়াতে ইমলির কোনোরকম সমস্যায় পড়তে হচ্ছে না । স্কুলে মাস্টারদের কাছে, বাড়িতে গৃহ শিক্ষকের কাছে ও মায়ের কাছে নিয়মিত পড়াশুনা করার জন্য আসান পড়াশুনায় অনেকটা উন্নত । ক্লাসের মাস্টারদের মতে, আসান ভাল মেয়ে ।
মেয়ে বড় হওয়ার সুবাদে ইমলি মেয়েকে ক্যারাটে স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছে । দিনকাল ও সমাজের সামগ্রিক পরিস্থিতির কথা ভেবে মেয়েকে আগাম তৈরী রাখছে যাতে ছোটখাটো উটকো সমস্যার সামাল সে নিজেই দিতে পারে । রাস্তাঘাটে আজকালকার ছেলেপেলে উঠতি বয়সের মেয়েদের দেখলে অপ্রিয় ঘটনা ঘটানোর জন্যে ওত পেতে থাকে । একা একা যাতায়াতের ক্ষেত্রে ঐসব উটকো ঝামেলার ফয়সালার জন্যেই তাকে ক্যারাটে শেখানো । ইমলি নিজের জীবনের ক্ষেত্রে এখনও অনেক অপ্রিয় সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে । মেয়ের ক্ষেত্রে সে কোনোরকম ঝুঁকি নিতে নারাজ । মেয়েকে সঠিকভাবে বড় করে গড়ে তোলা, তার লক্ষ্য । যাতে বিপদে ঘাবড়ে না গিয়ে বিপদের সঙ্গে মোকাবিলা করে জয়ী হতে পারে ।
ক্লাসে আসান প্রথম বা দ্বিতীয় স্থান দখল করতে না পারলেও তৃতীয় স্থান তার বাধা । অঙ্কে তার প্রচণ্ড দখল । বিজ্ঞানে জানার আগ্রহ ততোধিক । মাধ্যমিকে একানব্বই শতাংশ নম্বর পেয়ে পাশ করলো আসান । সে বিজ্ঞান নিয়ে পড়তে ইচ্ছুক । একই স্কুলে একাদশ শ্রেণীর বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হল আসান । ইতাসের ইচ্ছা তাদের মেয়ে ডাক্তার হোক । কিন্তু ডাক্তারী পড়াতে প্রচণ্ড খরচা । সেটা নিয়েই ইতাস বেশী চিন্তিত ।
ইতিমধ্যে ইতাস তার জমানো সমস্ত অর্থ দিয়ে আর কিছুটা ধার-দেনা করে নতুন মেশিনটি বসিয়েছে । ইমলি ব্যাঙ্ক থেকে লোন হিসাবে যে টাকাটা পেয়েছিলো, পুরো টাকা দিয়ে এক তলা কিছুটা বাড়িয়ে দোতলায় দুটো ঘর ও বাথ রুম ও কিচেন শেষ করেছে । এখন তাদের উপর তলায় বসবাস । নীচে পুরো বাড়িটাতেই আইসক্রিম মেশিনের কাজ কর্ম । ইতাস একা সব দিক সামাল দিতে হিমশিম খাওয়ার জন্য দিনে ও রাত্রিতে আইসক্রিম মেশিনের দেখাশোনা ও কাজকর্মের জন্য দুই জন লোক রেখেছে । আইসক্রিমের উৎপাদন ক্রমশ বাড়ছে । নানান ধরনের আইসক্রিম তৈরীর দিকে ঝুঁকছে ইতাস । তার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে ।
বর্তমানে ইতাস কুসুমগ্রাম বাজারের একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী । বাজার কমিটির একজন কর্মকর্তা । কিন্তু সমস্যা অন্যত্র । দোতলা বাড়ি বানানোর সাথে সাথে গাঁয়ের মানুষের চক্ষুশূল ইতাস । সকলের মুখে এক কথা, জল বেচা টাকা । ব্যবসায়ে খাটুনি নেই, পরিশ্রম নেই । শুধু কলের জল জমিয়ে পয়সা । রাস্তা ঘাটে মানুষের মধ্যে গুঞ্জন, বেচারা সেদিন ওপারের তাড়া খেয়ে এপারে এসে দুদিনের মধ্যেই ইটের দালান বাড়ি । কিছু অপ্রিয় মানুষ আরও একটুখানি এগিয়ে বলাবলি করেন, রাতের বেলায় বেচারা চুরি করে কিনা খোঁজ নিতে হবে ।
উলট পালট সমালোচনার দিকে ইতাসের মাথাব্যাথা নেই । সে নিজ কাজে ধ্যানমগ্ন । দুটো মেশিন বসানোর পর কারখানায় উৎপাদনের পরিমাণ অনেক বেড়ে গেছে । হকারের সংখ্যাও বেশী । বেশ কয়েকজন দূরের গাঁয়ের হকার আগের রাত্রিতে কারখানায় এসে শুয়ে থাকে । তারপর ভোরের আলো ফোটা মাত্র বাক্স মাথায় নিয়ে তাদের ছোটা । হকারেরা তাদের গ্রামের কাছে আইসক্রিম কারখানা পেয়ে যারপরনাই খুশী । এতকাল হয় মেমারী, নতুবা মন্তেশ্বর । আবার মন্তেশ্বরে না পেলে কাটোয়ার পানুহাট থেকে বাক্স ভরে আইসক্রিম আনতে হত । সেদিক দিয়ে বাড়ির কাছে কারখানা হওয়ায় তারা ভীষণ খুশী । ইতাস হকারদের ভাল মন্দের প্রতি সর্বদা সজাগ । আইসক্রিম কেনার খরিদ্দারেরা আইসক্রিম খেয়ে কি মন্তব্য করলো সেই খবরও ইতাস খুঁতিয়ে খুঁতিয়ে হকারদের কাছ থেকে সংগ্রহ করে এবং খরিদ্দারদের কোনও পরামর্শ থাকলে সেটাও জেনে নিয়ে নিজেকে শুধরাবার চেষ্টা করে । কারখানায় উদপাদিত আইসক্রিমের গুণগত মান নিয়ে ইতাস কোনোরকম সমঝোতায় যেতে নারাজ । উৎকৃষ্ট মানদণ্ড তার ব্যবসার মূল উদ্দেশ্য । তাতে লাভ কম হোক ক্ষতি নেই, কিন্তু কারখানার আইসক্রিমের গুণগত মান উন্নত হওয়া চাই । কত কচি শিশুরা তার কারখানার আইসক্রিম কিনে খাচ্ছে, সুতরাং তাদের কথা ভেবে আইসক্রিমের উপাদান সবসময় স্টান্ডার্ড রাখে ইতাস । যার জন্য “আসান আইস ফ্যাক্টরি”র সুনাম চতুর্দিকে ।
ইতাস আইসক্রিম ব্যবসাটা খুব ভাল রপ্ত করেছে । ব্যবসার বিভিন্ন দিক যেমন আইসক্রিমের কোয়ালিটি, কারখানার উৎপাদিত মালের প্রতি হকারদের দৃষ্টিভঙ্গি, খরিদ্দারদের রুচিবোধ, প্রয়োজনে মেশিন সারাইয়ের উপর তার দখল, ইত্যাদি ইতাসের নখদর্পণে । যার জন্য কারখানার সুনাম এখন কুসুমগ্রাম ছাড়িয়ে মন্তেশ্বর, মেমারী, দাঁইহাট, মালডাঙ্গা পর্যন্ত প্রসারিত । কারখানায় রাত দিন মাল তৈরী হচ্ছে । সিজনে ইতাসের খুব কম ঘুম হয় । ভাত খাওয়ার সময় পায় না । সিজন বলতে পৌষ সংক্রান্তি থেকে কার্তিক মাস পর্যন্ত । পৌষ সংক্রান্তির দিন বিভিন্ন জায়গায় মেলা বসে । বিশেষ করে উদ্ধারণপুর ঘাটের মেলা সর্বজনবিদিত । সেই সব মেলায় তার কারখানার আইসক্রিমের বাক্স যায় । তারপর শুরু হয় আইসক্রিম বিক্রির সিজন । তখন দম ফেলা দায় ! কাজ আর কাজ । হকারেরা ছাড়াও কাউন্টারে বিক্রি রমরমা । ইতাস কর্মব্যস্ততায় এদিক-ওদিক করলে কাউন্টার সেলের একটা পয়সাও ঘরে ঢোকেনা । ঐ পয়সাটা কর্মচারীর পকেটে যায় । শত বলেও কর্মচারীদের শোধরাতে পারেনি ইতাস । ইমলি বাড়ি থাকে না । মেয়েটা স্কুলে যায় । নজরদারির কেউ থাকে না । যার জন্য বিক্রি বাট্টার পয়সা কর্মচারীর পক্ষে নেওয়া সুবিধা । সিজনে দরকার হলে কারখানায় অস্থায়ীভাবে লোক রাখে ইতাস । দিনের বেলায় তখন দুই জন কর্মচারী এবং সঙ্গে ইতাস । প্রচণ্ড খাটে । ইতাসের খাটুনিতে ক্লান্তি নেই । বরং খাটতে সে খুব ভালবাসে ।
গতরে খেটে কারখানাটা দাঁড় করালো ইতাস । একতলাটা পোক্তভাবে গেঁথে পুরোটাতেই মেশিনের কাজকর্ম । দুটো মেশিন । বাড়িতে সব সময় মেশিন চলার ঘড়ঘড় আওয়াজ । মাঝে মাঝে সমস্যায় পড়তে হয় ইতাসকে । যদি বৈদ্যুতিক সংযোগ বন্ধ হয়, কিংবা ইলেক্ট্রিক লাইন না থাকে অর্থাৎ লোডশেডিং থাকে সেই সময় প্রচণ্ড ঝামেলা । মেশিন বন্ধ হলে কাজের গতিধারা কমে যায় । উৎপাদিত মালের পরিমাণ আশানুরূপ হয় না । প্রয়োজনীয় আইসক্রিম না পাওয়ায় হকারেরা তখন চিৎকার চেচামেচি করে । সব দিক সামাল দেওয়া ইতাসের কাছে সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় । আইসক্রিম তৈরীর গোটা প্রক্রিয়াটা ইলেক্ট্রিক কারেন্টের উপর নির্ভর । সেই কারণে লোডশেডিং হলে ইতাসের কপালে চিন্তার ভাঁজ ।
মাঝে মাঝে ব্লক অফিস থেকে বাবুরা চেকিংয়ে আসেন । কারখানা চলার কারণে পরিবেশ দূষন হচ্ছে কিনা সেটা সরেজমিনে তদারকি করতে । কিন্তু কিচ্ছু না পেয়ে চা-বিস্কুট খেয়ে তাঁরা অফিসে ফিরে যান । এই ধরনের রুটিন চেকিং নিয়মিত সংঘটিত হয় । অফিসের বাবুরা আসেন, চা খেয়ে ফিরে যান । ইতাস একরকম জোর করে বাবুদের ব্যাগে বাড়ির বাচ্চাদের জন্য আইসক্রিম ঢুকিয়ে দেয় । সুতরাং ইতাসের কারখানা নিয়ে কোথাও কোনো অভিযোগ নেই ।
মধ্যেখানে ইতাস ভেবেছিল, ব্যাঙ্ক থেকে ঋন নিয়ে আরও একটি আইসক্রিম মেশিন বসাবে । কিন্তু সেই ইচ্ছা থেকে সে নিজেই বিরত থেকেছে । অনেক ভেবে চিন্তে দেখলো, তার গিন্নি ঐ ব্যাঙ্কের স্থায়ী কর্মচারী । আশেপাশের লোকে বলাবলি করবে বৌয়ের প্রভাব খাটিয়ে লোন নিয়ে তার ব্যবসার রমরমা । সেই কথা শোনাটা ইতাসের পক্ষে অসম্মানজনক হয়ে দাঁড়াবে । তাই ব্যাঙ্ক থেকে ঋন নেয়নি ইতাস ।
উচ্চ মাধ্যমিকে নব্বই শতাংশ নম্বর পেয়ে আসান পাশ করলো । বাড়িতে খুব খুশীর ধুম । ইমলি মেয়ের পাশে আনন্দে উচ্ছ্‌সিত । ইতাস মেয়ের মাথায় হাত দিয়ে বললো, “তোমাকে জয়েন্ট পরীক্ষায় ভাল ফল করতে হবে মা । আমাদের ইচ্ছা, তুমি ডাক্তার হও । ডাক্তার হয়ে মানুষের পাশে দাঁড়াও । মানুষকে সেবা করার অর্থ ঈশ্বরকে সেবা করা । সুতরাং তুমি অনেক বড় হও ।“
তারপর কিছুদিন পরেই জয়েন্টের রেজাল্ট । আসান ডাক্তারীতে চান্স পেলো । তবে কলকাতার মেডিকেল কলেজগুলিতে নাম না উঠে তার নাম উঠলো বর্ধমান মেডিকেল কলেজে । যদিও আসানের ইচ্ছা ছিল, সে কলকাতার কোনও একটি মেডিকেল কলেজে পড়বে । কিন্তু র‍্যাংক অনুযায়ী তার ভাগ্যে জুটলো বর্ধমান মেডিকেল কলেজ । ইমলি মেয়েকে বোঝালো, বর্ধমান মেডিকেল কলেজ দেশের মধ্যে বৃহত্তম কলেজ । সেখান থেকে পাশ করলে তুমি বড় মাপের ডাক্তার হবে এবং জীবনে প্রতিষ্ঠিত হবে ।
আসান ভর্তি হল বর্ধমান মেডিকেল কলেজে ।
হস্টেলেই থাকে । সপ্তাহান্তে বাড়ি আসে । শনিবার রাতে বাড়ি ঢুকে আবার রবিবার বিকেলেই বর্ধমান ফিরে যায় । সোমবার সকাল থেকেই ক্লাস । পড়াশুনায় ফাঁকি দেওয়া আসানের ধাঁচে নেই । পড়াশুনার ব্যাপারে খুব সিরিয়াস । ডাক্তারী পড়াশুনার ভীষণ চাপ । যার জন্য তার নাচ অনুশীলন বন্ধ । পড়ার চাপ থাকলে কোনও রবিবারে বাড়ি আসতে পারেনা, সেই ক্ষেত্রে ইমলি নিজে বর্ধমানে মেয়ের সাথে দেখা করে আসে । ইতাস ব্যবসা নিয়ে কর্মব্যস্ত । তার সময় খুব কম । কারখানা তাকে ঠিকমতো চালাতেই হবে । মেয়ের ডাক্তারী পড়ায় অনেক খরচ । সেই খরচ সামাল দিতে মেশিন বন্ধ রাখার ঝুঁকি নিতে নারাজ ।
বড় হচ্ছে আসান । চেহারা তার আগাগোড়া ভাল । মুখশ্রী মায়ের মতো । বাড়ন্ত বয়স । রাস্তা দিয়ে হাঁটলে মানুষের নজর আসানের দিকে । ইমলির দুশ্চিন্তা মেয়েকে নিয়ে । হস্টেলে থাকে । একা একা বাইরে থাকা তার জীবনে প্রথম । এদেশে তাদের কোনও আত্মীয় নেই । সেই আত্মীয় বাড়ি গিয়ে দুদিন বেড়িয়ে আসবে সেই সুযোগ ছিল না । তাই আসানের ঘোরাঘুরি কুসুমগ্রামের মধ্যেই । এতদিন নাচ ও পড়াশুনা নিয়েই ব্যতিব্যস্ত ছিল । এরপর হস্টেলে থেকে পড়াশুনা । মেয়েটা কারও কুনজরে পড়ে গেলে বিষম বিপদ । এই সব কারণে ইমলির দুশ্চিন্তা । তার একটাই মেয়ে । তাকে নিয়ে তাদের খুব আশা । মেয়েটা বড় হয়ে সমাজের জন্য কিছু করুক । নিজের পায়ে দাঁড়াক । তার পায়ের তলার মাটি শক্ত হোক । আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান হোক । মেয়েকে নিয়ে এটাই তাদের মনোবাঞ্ছা ।
মেয়েকে নিয়ে নানান দুশ্চিন্তায় ইমলির রাত্রিতে ঘুম ভেঙ্গে যায় । তখন বিছানা থেকে উঠে নীচে আইসক্রিম মেশিনের কাজকর্ম দেখাশোনা করে । ভোর থেকে হকারেরা আইসক্রিম তাদের বাক্সে ভরতে শুরু করে । তখন ইমলি দাঁড়িয়ে থেকে হকারদের বাক্স ভরতে সাহায্য করে । গিন্নির সহযোগিতার জন্য ইতাস তখন ঢিলা মেজাজে পয়সা গুণতে মগ্ন থাকে । হকারেরা আইসক্রিম বিক্রি করার পর তাদের পেমেন্ট খুচরো পয়সায় মেটায় । কাগজের নোট খুব কম । গ্রামে গঞ্জের মানুষেরা খুচরো পয়সা দিয়ে আইসক্রিম কেনে । ফলে হকারদের কাছে খুচরো পয়সা অনেক জমে । ইতাসের আবার খুচরো পয়সাটাকে কাগজের টাকায় রূপান্তরিত করতে ভীষণ বেগ পেতে হয় । খুঁজে খুঁজে খেয়া নৌকার মাঝিদের স্মরণাপন্ন হয় । কেননা মাঝিদের খেয়া ঘাটে অনেক খুচরো পয়সার দরকার । নদী / গঙ্গা পার হওয়ার পর প্যাসেঞ্জারদের কাছ থেকে পয়সা নেওয়ার সময় মাঝিদের খুচরো পয়সার দরকার হয়ে পড়ে । তাই ইতাসের কাছ থেকে খুচরো পয়সা সংগ্রহ করেন । তারপর বাজারের আনাচ তরকারি বিক্রেতারা খুচরো পয়সা খোঁজ করেন । বাসের কন্ট্রাক্টরেরা খুচরো পয়সা ইতাসের কাছ থেকে বেশী পরিমাণে সংগ্রহ করেন । এই ভাবে বিভিন্ন পেশার মানুষকে খুচরো পয়সার যোগান দিয়ে ইতাস তার পয়সাটাকে কাগজের টাকায় রূপান্তরিত করে । ইমলি ভোরবেলায় কারখানায় থাকলে বরং ইতাসের অনেকটা সুবিধা । তারপর সকালে হকারদের ভিড় সামলিয়ে দুই জনে মিলে চা খাওয়ার পর্ব । এতদিন মেয়েটাও তাদের সাথে বসে চা খেতে বসতো । এমনকি আসান নিজেও মাঝে মধ্যে চা বানিয়ে তার বাবাকে বলতো, “দেখ তো বাবা, চায়ের স্বাদের পরিবর্তন বুঝতে পারো কিনা ?”
মেয়েটা নাচ ভালবাসে । নাচ অনুশীলন করার জন্য তার শারীরিক গঠন মজবুত । মেমারী, মন্তেশ্বর, এমনকি অগ্রদ্বীপ-নবদ্বীপেও নাচের অনুষ্ঠান মঞ্চস্থ করেছে, যার জন্য এখনও নাচের প্রোগ্রামে তার ডাক আসে । ইমলিকে সবিনয়ে অনুষ্ঠানের কর্মকর্তাদের ফিরিয়ে দিতে হয় । এখন নাচের চেয়ে তার ক্যারিয়ারের মূল্য অপরিসীম । এই জন্য ইমলি মেয়েকে নাচের ব্যাপারে একবারের জন্যে তাগাদা দেয় না ।
মেয়েকে নিয়ে ইমলির আরও একটা দুশ্চিন্তা ! সেটা গাঁয়ের নবকৃষ্ণ দত্তের কুলাঙ্গার ছেলেটাকে নিয়ে । বাপের আস্কারা পেয়ে ছেলেটা গোল্লায় গেছে । আসানের হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষার পর নবকৃষ্ণ দত্তের ছেলেটা মেয়েটাকে ভীষণ উত্ত্যক্ত করেছিল । রাস্তায় আসানকে একা পেয়ে একরকম জোর করে মোটর বাইকে তুলে শিবের গাজন মেলায় ঢুকেছিল । ভাগ্যিস সেখানে আইসক্রিমের হকার বনমালীদা ছিল । বনমালীদা শক্ত সমর্থ মানুষ । তার আবার ভয়ডর কম । নবকৃষ্ণ দত্তের ছেলের মোটর বাইকের পেছেন আসানকে দেখতে পেয়ে তার সন্দেহ হয় । বনমালীদা জানে, আসান কি ধরনের মেয়ে এবং এটাও জানে নবকৃষ্ণের গোল্লায় যাওয়া ছেলে, মদনের চরিত্র কেমন ? বনমালীদা সাতপাঁচ না ভেবে নবকৃষ্ণের কুলাঙ্গার ছেলের কাছ থেকে ইমলির মেয়েটাকে উদ্ধার করে । তারপর সোজা অটো রিজার্ভ করে বাড়ি । রাগে গজরাতে গজরাতে বনমালীকে সেদিন নবকৃষ্ণের ছেলে, মদন শাসিয়ে বলেছিল, “আজ মেলার মধ্যে লোক জড়ো করে মেয়েটাকে বাঁচাতে পারলি । এরপর আমি আসানকে তুলে আষাঢ় মাসে পাটের জমিতে যদি না ঢোকাতে পারি তবে আমার নাম মদন নয় ! হিম্মত থাকলে সেদিন আমাকে আটকাস্‌ ! আটকাবার জন্য তোকে আমি চ্যালেঞ্জ দিলাম ?”
বনমালী মদনের হুমকির তোয়াক্কা করেনি । বরং বলেছিল, “যা পারিস করে নিস । আমি তোকে সাবধান করে দিচ্ছি, এরপরে কোনোদিন আসানের দিকে হাত বাড়াবি না । আমি যদি জানতে পারি তুই হাত বাড়িয়েছিস, তোর ঐ হাত আমি আস্ত রাখব না ।“
ইমলির ভয়, শনিবার রাতের অন্ধকারে বর্ধমান থেকে বাড়ি ফেরে আসান । সেই সময় একা পেয়ে মদন আসানকে ক্ষতি না করে । আজকাল মেয়েদের মুখ লক্ষ করে অ্যাসিড ছুড়ে মারা আকছার ঘটনা । মেয়ের সুরক্ষার কথা ভেবে ভীষণ চিন্তিত হয়ে পড়ে ইমলি ।
সেদিন শনিবার । সারাদিন বৃষ্টি । অঝোরে বৃষ্টি । কালো মেঘে আকাশ মেঘাচ্ছন্ন । সন্ধ্যার অন্ধকারে বাস থেকে আসান কুসুমগ্রামে নেমেছে । ধারে কাছে রিক্সা নেই । ছাতায় বৃষ্টি মানছে না । বাস স্ট্যান্ডের শেডে ঠায় দাঁড়িয়ে । আসান চিন্তা করছে কীভাবে বাড়ি ফিরবে । হেঁটে গেলে নির্ঘাত বৃষ্টিতে ভিজে যাবে । বৃষ্টির ফোঁটা যেমনি বড়, তেমনি বৃষ্টি থামবার লক্ষণ নেই । উদ্বিগ্ন আসান বাড়িতে হেঁটে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে কিংকর্তব্যবিমূঢ় । অথচ বাড়িতে জানালে, বাবা-মা চিন্তায় ছটফট করবে । তাই আসান ছাতা মাথায় দিয়ে হাঁটতে শুরু করলো । কয়েক কদম হাঁটার পর বৃষ্টির জলে ভিজে একশা ।
রাস্তা ধরে আসানের হেঁটে বাড়ি ফেরার খবর যেভাবে হোক মদনের কানে পৌঁছায় । এক মুহূর্ত দেরী না করে মদন গাড়ি নিয়ে আসানকে রাস্তার উপরে ধরে ফেলে । জোর করে গাড়িতে তোলে । রাস্তা সুনসান । আসানের চিৎকার কারও কানে পৌঁছালো কিনা সন্দেহ ! রুমালে রাসায়নিক পাউডার মিশিয়ে আসানকে গাড়ির ভিতর অবশ করে রাখলো । তারপর পাটুলির জলাশয়ের পাশে গাব গাছটার নীচে তার গাড়ি দাঁড় করালো । তখনও আসান চোখ বুজে অবশ হয়ে গাড়ির পেছনের সিটে সটান শুয়ে । তার শরীরের জামা কাপড় ভেজা । ভেজা অবস্থায় আসানকে প্রাণ ভরে দেখছিল মদন । তারপর আসানের অবশ শরীরে হাত বুলাতে গিয়ে চমকে উঠলো মদন । আসানের জ্ঞান ফিরেছে । আসান উঠেই প্রথমে মদনকে দুই পায়ের মাঝখানে লাথি ! আচমকা লাথি খেয়ে মদন চিৎপটাং । সেই সুযোগে গাড়ি থেকে নেমে আসান ছুটে বড় রাস্তায় ।
মদন সম্বিৎ ফিরে পেয়ে আসানকে লক্ষ করে ছুট্‌ ।
অন্ধকার রাত্রিতে বৃষ্টির মধ্যে একটা গাড়ির হেড লাইট দেখতে পেলো আসান । গাড়িটাকে দাঁড় করানোর জন্য হাতের ইশারা করতেই গাড়িটা ঠিক আসানের পাশে দাঁড়িয়ে পড়লো । পেছনে মদন এসে উপস্থিত । আসান চিৎকার করে উঠলো, “প্লিজ হেল্প, হেল্প মি ?”
আবার বললো, “আমাকে বাঁচান স্যার ।“
থানার বড় বাবু বুঝতে পারলেন, মেয়েটা বিপদে পড়েছে । তিনি গাড়ি থেকে নামলেন । তারপর মদনকে জিজ্ঞাসা করলেন, “মেয়েটা তোমার কে হয় ?”
আমার বান্ধবী স্যার ।
অন্ধকার রাত্রিতে এখানে কেন ?
বর্ধমান থেকে ফিরছিল । কিন্তু কিছুতেই আমার সঙ্গে বাড়ি ফিরতে চাইছে না ।
আসান সঙ্গে সঙ্গে বললো, “ছেলেটা মিথ্যা কথা বলছে স্যার । মুখে ঔষধ মাখানো রুমাল গুঁজে দিয়ে ধর্ষনের উদ্দেশ্যে আমাকে জলাশয়ের পারের গাব গাছের তলায় গাড়ি দাঁড় করিয়েছে । আমি অনেক কষ্টে পালিয়ে আপনাদের স্মরণাপন্ন হয়েছি । আপনারা না থাকলে এতক্ষণ আমার জীবন সংশয় দেখা দিত ।“
বড়বাবু ব্যাপারটা অনুধাবন করে আর সময় নষ্ট করলেন না । সঙ্গের দুজন কন্সটেবলের হাতে মদনকে তুলে দিয়ে মদনের গাড়িতে থানায় ফিরে যেতে বললেন । মদনকে যেন লক আপে রাখা হয় । তিনি ফিরে ব্যবস্থা নেবেন । ইত্যবসরে বড়বাবু আসানকে সঙ্গে নিয়ে ছুটলেন কুসুমগ্রামে । আসানকে বাড়িতে পৌঁছে দিতে ।
বাস স্ট্যান্ডের সন্নিকট ফলের দোকানদার আসানকে মদনের গাড়িতে তুলতে দেখে তাঁর সন্দেহ হয় । সন্দেহ হওয়ায় ইতাসদের বাড়িতে খবরটা পৌঁছে দেন । তখন থেকেই বাড়িতে হুলস্থুল । ইতাস ছুটেছে একদিকে, আর ইমলি ছুটেছে ব্যাঙ্কের ম্যনেজার বাবুর বাড়িতে । তখন বৃষ্টির তেজ কম । যদিও আকাশ মেঘাচ্ছন্ন । বৃষ্টি ক্রমশ কমছে । ইমলিকে নিয়ে ম্যানেজারবাবু সোজা কুসুমগ্রাম পুলিশ ফাঁড়িতে । আসান মিসিং, ডায়েরি করালেন ম্যানেজারবাবু । ম্যানেজারবাবু ইমলিকে নিয়ে তারপর নবকৃষ্ণের বাড়ি । কিন্তু সেখানে মদনকে পাওয়া গেল না । তারপর তারা ছুটলেন মন্তেশ্বর থানায় । সেখানে ম্যানেজারবাবু জানতে পারলেন, অন্য থানার বড়বাবুর হেফাজতে আসান । বড়বাবু আসানকে সঙ্গে নিয়ে কুসুমগ্রামে ফিরছেন । এই খবরটা শোনার পর, শীঘ্রই ম্যানেজারবাবু ও ইমলি কুসুমগ্রামে ফিরলেন । বাড়ি পৌঁছে দেখেন আসানকে নিয়ে থানার বড়বাবু বাড়ির দোরগড়ায় দাঁড়িয়ে । মাকে দেখতে পেয়ে আসান ছুটে মাকে জড়িয়ে ধরলো । দুজনের চোখে জল । তারপর মা ও মেয়ে কিছুক্ষণ নীরব । সেই নীরব মুহূর্তের সাক্ষী হয়ে রইলেন থানার বড়বাবু ও ব্যাঙ্কের ম্যানেজারবাবু ।
 ( চলবে )

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here